হলে সিনেমা দেখা নিয়ে মজার কথা শুনেছিলাম আনোয়ার চাচার কাছে। চাচা ততদিনে রেলওয়েতে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দিয়ে হঠাৎ বেকার। সময় পেলে আমাদের সাথে গল্প করেন। সেই গল্পটা শুনবো একটু পর। তখন সিনেমার নাম শুনলেই অন্য রকম লাগে। সিনেমার বিশাল পর্দায় দানব সমান যে মানুষ দেখা যায়, তাঁরা তাঁরা হয়ত অন্য কোন জগতের মানুষ। রূপকথার দেশেরই হবে। সিনেমা ও তাতে অভিনীত পাত্রপাত্রী সম্পর্কে এই ছিল ধারণা।
রঙ্গিন রূপবান। হলে গিয়েদেখা প্রথম সিনেমা, যেটার কথা মনে আছে। ১৩ দিনের রূপবানের সাথে ১৩ বছরের মালেকা বানুর বিয়ে। সে এক রূপকথার গল্প। মালেকা বানুর দেশেতে মনু মিয়া আইলো রে... এরকম একটা হিট গান ছিল। বড়দের সাথে বেশ কিছু সিনেমা দেখে ছিলাম। বাড়িতে দুর থেকে আত্মীয় স্বজন এলে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার চল ছিল। এরপরে মনে ছুটির ঘণ্টার কথা। স্কুলের টয়লেটে আটকা পড়ে মারা গেলো একটি ফুটফুটে ছেলে। আহারে, মানুষের কি কান্নাকাটি।
সিনেমা দেখার নেশা কতটা ছিল, একটা ঘটনা বললে কিছুটা বোঝা যাবে। জানু ভাই পৌরসভায় চাকরি করতেন। একদিন কিছু কাজ করে দিতে বললেন। এর বিনিময়ে সিনেমা দেখাবেন। সেই মত কাজ করলাম। নিয়ে গেলেন উত্তরা টকিজে। হলে ঢুকিয়ে দিলেন। ১০ মিনিটও হয় নি। সিনেমা শেষ। সবার সাথে আমাকেও বের হতে হলো। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। বহুদিন ভেবেছি, বিষয়টা ভুলে যাবো। কিন্তু ভুলতে পারিনি। সেদিন বুঝেছিলাম, ছোটদের সাথে প্রতারণা করতে নেই। ঐ বয়সের কষ্ট, প্রতারণা কখনও ভোলা যায় না।
২।
এরপর বুদ্ধি গজালো। খেয়ে না খেয়ে ৫ টাকা জমিয়ে কোথাও লুকিয়ে রাখতাম। এরপর রুবেলের সিনেমা এলেই দেখতে যেতাম। একশন ধাঁচের রুবেল-ড্যানি সিডাকের জুটি ছিল ভীষণ জনপ্রিয় ছিল আমাদের কাছে। এরপর ইলিয়াস কাঞ্চন, মান্না পেরিয়ে এই দেশের সিনেমা প্রেমীরা দেখা পেয়েছিলো সালমান শাহ এর। সালমান শাহর মৃত্যুর পর আমরা কয়েকজন এলাকার মোড়ের নাম রেখেছিলাম সালমান শাহ মোড়। একবার বড় ভাইয়ার সাথে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছিলাম। সেটাও একটা ব্যতিক্রম ঘটনা ছিল।
আমাদের নিয়ম ছিল, সামনে পরীক্ষা?
একটা সিনেমা দেখে নিই।
পরীক্ষা শেষ হলে তো দেখতেই হবে।
সিনেমা দেখার সবচেয়ে লজ্জার বিষয় ছিল, বের হয়ে আসার সময় ধরা খাওয়ার লজ্জা। তারও আগে হলে গেলে কাটপিস কুড়িয়ে আনতাম। সেসব আলোর বিপরীতে ধরলে সিনেমার অংশ বিশেষ দেখা যেত। সেসব খুব যত্নে রেখে দিতাম।
স্কুল পাশ দিয়ে রাজধানীতে এসে পড়লাম। থাকি উত্তরা। একদিন শুনি, কাছাকাছি সিনেমার শুটিং হচ্ছে, ফাল দিয়ে গেলাম। উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর। সোহেল রানার বাড়ি ‘খেয়া’র সামনের ফাঁকা প্লটে সেট করা হয়েছে। ফাঁক ফোকর দিয়ে ভিতরে চলে গেলাম। নায়িকা শাবানার কোলে একটা নবজাতক। সোহেল রানা বিয়ে করে বীজ রোপণ করে দুরে চলে গেছিলেন। আর এদিকে সেই বীজ থেকে শাবানার কোলে বাচ্চা। সোহেল রানা ফিরে এসেছে। সেই মুহুর্তের মান অভিমান চলছে। আমি ভীষণ আগ্রহ নিয়ে সেই শুটিং দেখছি। সিনেমার নাম ‘গৃহযুদ্ধ’। এর মধ্যে কেউ একজন আমাকে আবিষ্কার করে ফেলে।
এই ছেলে কে? বের হও, বের হও।
সুড়সুড় করে বের হয়ে আসি।
ঐ দিন নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হয়। ছোটবেলায় দেখা হাইপ ঝুরঝুর করে ঝরে যায়। একই মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়েছি সোহেল রানা, রুবেল, রাজিব। একদিন সোহেল রানা আমার পাশেই জুম্মার নামাজ আদায় করলেন। সেই থেকে স্বপ্নের রুপালি মানুষেরা অতি সাধারণ হয়ে ধরা দিলো। এরপর খুব একটা বাংলা সিনেমা দেখা হয়নি।
ভার্সিটিতে উঠে আবার শুরু হলো। এবার নেশা পেয়ে বসলো হিন্দি ও হলিউডের। সাথে কলকাতার উত্তম-সুচিত্রা জুটির। পলাশীর মেহেদি, আজিমপুর, বকশী বাজার নিরিবিলি। সিডির দোকান থেকে সিডি নিয়ে এসে দেখতাম। এরপর হল, হলে ল্যান শেয়ার। প্রচুর সিনেমা দেখেছি।
একে একে সারাদেশের সিনেমা হল ভেঙ্গে ফেলা হল। তৈরি হল মার্কেট। এরপর আসলো সিনেপ্লেক্স। বসুন্ধরা সিটি থেকে যাত্রা শুরু। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে।

(ছবি কৃতজ্ঞতাঃ হলের দর্শক।
গত ৫ জুলাই ২০২৫ তারিখ, সীমান্ত সম্ভারের সিনেপ্লেক্সে বাপ বেটা জুরাসিক ওয়ার্ল্ড রিবার্থ দেখে বের হওয়ার পর।)
৩।
সারা জীবন বাপ মাকে ভয় পেয়ে এসেছি। লুকিয়ে সিনেমা দেখেছি, গল্পের বই পড়েছি। সেই আমরাই নিজের সন্তানকে গল্পের বই কিনে এনে দেই।
বাবা একটু পড়।
মা পড়ে দেখো, বইটা চমৎকার।
হলে নিয়ে সিনেমা দেখাচ্ছি। ছোটবেলা কেটেছে ভয়ে ভয়ে, পিতা মাতার ভয়ে। এখনও ম্যানেজ করে বাচ্চাদের মানুষ করছি। আমরা এক আজব প্রজন্ম।
৪।
আনোয়ার চাচা সিনেমা দেখতে গেছেন। পাশের সিটে বসে অপরিচিত একজন। কিছুক্ষণ পর গন্ধ টের পেলেন। এদিক ওদিক খেয়াল করলেন। প্রচণ্ড গন্ধ। পাশের লোককে সন্দেহ হয় চাচার। সিনেমা দেখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
না, আর সন্দেহ রইলোনা। সেই লোক এবার প্রচণ্ড শব্দের সাথে বায়ুত্যাগ করছেন।
চাচা আর সহ্য করতে পারছিলেন না।
-দেখেন ভাই, ভালো হচ্ছে না।
- দুঃখিত ভাই, আমার অবস্থা খুব খারাপ। এর চেয়ে ভালো আর পারছিনা।
সেই লোকের জবাব।
এরপর আর কি? চোখ মুখ বন্ধ করে বাকি সিনেমা দেখেন আনোয়ার চাচা।