নতুন স্বপ্নের খোঁজে চণ্ডীপুরের বিপ্লব
মেদিনীপুরের কোলে লুকিয়ে থাকা এক শান্ত গ্রাম, চণ্ডীপুর। এখানকার জীবন নদীর মতো সহজ, ধীর গতিতে বয়ে চলে। সেই গ্রামেরই এক উজ্জ্বল তরুণ, বিপ্লব। সদ্য কলেজের পাঠ চুকিয়ে সে এখন এক নতুন স্বপ্নের ক্যানভাস খুঁজছে। চণ্ডীপুরের পরিচিত সবুজ আর মাটির গন্ধ ছেড়ে সে পাড়ি দিতে চায় শহরের ঝলমলে আলোয়। কলকাতায় গিয়ে একটা চাকরি, নতুন জীবন আর শহুরে জীবনের স্বাদ নেওয়ার প্রবল ইচ্ছে তার চোখেমুখে। বাবা-মায়ের মন একটু শঙ্কিত হলেও, ছেলের অদম্য জেদের কাছে হার মেনেছিলেন। তাঁদের আদরের বিপ্লব পা রাখল এক অজানা ভবিষ্যতের পথে।
কলকাতার অলিতে এক পুরোনো ঠিকানা
কলকাতায় এসে প্রথম ক'টা দিন বিপ্লব তার আত্মীয়দের বাসাতেই কাটালো। কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন তাকে তাড়া করছিল। তাই ক'দিন বাদেই তার বন্ধুদের সাথে মিলে সে একটা পুরোনো বাড়ি ভাড়া নিল—দক্ষিণ কলকাতার এক নিরালা গলিতে, যার নাম ভবানী দত্ত লেন। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি, যেন শহরের কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন এক আলাদা জগৎ। বাড়িটা ব্রিটিশ আমলের, তার দেওয়ালে ইতিহাসের ছোঁয়া। চারপাশে পুরোনো, প্রায় পরিত্যক্ত দালানকোঠা, যেন বহু দিনের অব্যবহৃত গল্প নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রথম রাত থেকেই বিপ্লব কিছু একটা অস্বাভাবিক অনুভব করতে শুরু করে। জানালার পাশে দাঁড়ালেই কেমন যেন একটা চাপা কান্না ভেসে আসে কানে, কখনো মনে হয় কেউ যেন ফিসফিস করে বলছে, "আমার শরীরটা ফেরাও..." প্রথম প্রথম সে ভেবেছিল, হয়তো শহরের নতুন পরিবেশে তার মন ভুল দেখছে। কিন্তু সেই অনুভূতি ক্রমেই জোরালো হতে থাকে।
অশরীরীর হিমশীতল ছায়া
তৃতীয় রাতেই সেই অলৌকিক অভিজ্ঞতা বিপ্লবের রক্ত হিম করে দিল। সে তখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। হঠাৎই তার চোখে পড়ল এক সাদা শাড়ি পরা নারীমূর্তি। তার মুখ নেই, শুধু গলা পর্যন্ত একটা কালো ছায়া। সেই ছায়াটা যেন শূন্যে ভাসছে। বিপ্লব ভয়ে জমে পাথর হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই সেই অশরীরী ছায়া তীব্র গতিতে তার দিকে ধেয়ে এলো। মনে হলো যেন তার হৃৎপিণ্ডটা বুকের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসবে। এক তীব্র আর্তনাদ করে উঠল বিপ্লব, তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেল। বন্ধুরা ছুটে এসে তাকে সান্ত্বনা দিল, "দুঃস্বপ্ন দেখেছিস রে! আর কিছু না।" কিন্তু বিপ্লব জানতো, ওটা দুঃস্বপ্ন ছিল না। ওটা ছিল নির্মম বাস্তবতা।
এরপর থেকে বিপ্লবের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল। সেই ছায়া, সেই ফিসফিস আওয়াজ যেন তার পিছু ছাড়ছিল না। দিনের বেলায় সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও, রাতের আঁধার নামলেই তার মনে আতঙ্ক বাসা বাঁধতো।
ইতিহাসের ধূলি সরিয়ে অভিশপ্ত সত্য
এই বাড়ির রহস্য উদঘাটন করার জন্য বিপ্লব অস্থির হয়ে উঠল। সে আশপাশের লোকজনের কাছে খোঁজ নিতে শুরু করল এই ভবানী দত্ত লেনের ইতিহাস। অবশেষে, স্থানীয় এক বৃদ্ধের কাছে সে জানতে পারল এই অভিশপ্ত বাড়ির ভয়ংকর অতীত। বৃদ্ধ কম্পিত কণ্ঠে বলতে লাগলেন, "এই বাড়িতে ১৯৪৮ সালে এক ইংরেজ সেনা তার ভারতীয় স্ত্রীকে পুড়িয়ে মেরেছিল। স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিল, তাই ক্রোধে অন্ধ হয়ে সেই পাষণ্ড স্বামী এমন নৃশংস কাজ করেছিল। তারপর থেকেই সেই নারীর আত্মা এই বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। সে নিজের পোড়া শরীরের দগ্ধ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। সে শরীর খুঁজছে... কাউকে নিজের মধ্যে নিয়ে আবার জন্ম নিতে চায়, আবার নতুন করে বাঁচতে চায়, প্রতিশোধ নিতে চায়!" বিপ্লবের সারা শরীরে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। তার মনে পড়ে গেল সেই ফিসফিস আওয়াজ: "আমার শরীরটা ফেরাও..."।
অভিশপ্ত রাত: আত্মার গ্রাস
একদিন রাতে বিপ্লবের বন্ধুরা বাইরে গিয়েছিল, সে একাই ছিল বাড়িতে। ঘড়িতে তখন রাত দুটো। হঠাৎই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ! "ঠক... ঠক... ঠক..."। শব্দটা যেন খুব কাছ থেকে আসছে। বিপ্লবের শরীর ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে ভয়ে জবুথবু হয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল, ভাবল হয়তো কোনো ভুল হচ্ছে। কিন্তু পরের মিনিটেই দরজার নিচ দিয়ে একধরনের কালচে ধোঁয়া ভেতরে ঢুকতে শুরু করল। সেই ধোঁয়া যেন জীবন্ত, তার নিজস্ব গতি আছে। মুহূর্তের মধ্যে সেই ধোঁয়া বিপ্লবের শরীরকে জাপটে ধরল, যেন এক অদৃশ্য সত্তা তাকে গিলে খাচ্ছিল।
বিপ্লব প্রাণপণে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তার শরীর যেন অবশ হয়ে আসছিল। সে হঠাৎই অনুভব করল—তার নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই চলে যাচ্ছে। চোখে সামনে স্পষ্ট দেখতে পেল সেই মুখহীন সাদা শাড়ি পরা নারীমূর্তিকে। তার কালো ছায়া যেন আরও ঘনীভূত হয়েছে। এবার সেই নারীমূর্তি অস্ফুটে বলল, "তুই তো আমার নতুন শরীর... এবার তুই পোড়বি, আমি বাঁচব..."
দগ্ধ পলায়ন: জীবনের জন্য দৌড়
মৃত্যুর শীতল স্পর্শ অনুভব করে বিপ্লবের মধ্যে এক অলৌকিক শক্তি জেগে উঠল। সে তার সমস্ত শক্তি এক করে সেই অদৃশ্য বাঁধন থেকে নিজেকে ছিঁড়ে বের করে আনল। উন্মত্তের মতো সে দৌঁড়ে বারান্দার দিকে গেল এবং নিচে ঝাঁপ দিল। দোতলা থেকে নিচে পড়ার শব্দ হল ধুপ করে। মাটিতে পড়ার পর তার পা মচকে গেল, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কেটে রক্ত বেরোতে লাগল। কিন্তু সেদিকে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ ছিল না। বিপ্লব কোনোমতে হামাগুড়ি দিয়ে পাশের রাস্তায় ছুটে পড়ল।
তখনই হঠাৎ একটি ট্রাকের তীব্র আলো তার গায়ে এসে পড়ল। ট্রাকচালক আর আশপাশের লোকজন ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করল। বিপ্লব তখন প্রায় জ্ঞান হারানোর উপক্রম। সে শুধু বলতে পারছিল, "ওখানে আত্মা... ও আমাকে পুড়িয়ে দেবে..." সেদিনের পর বিপ্লব আর কোনোদিনও সেই অভিশপ্ত বাড়িতে ফিরে যায়নি। ভয়ে তার মন পলে পলে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
চণ্ডীপুরের নিরাপদ আশ্রয় এবং দগ্ধ স্মৃতি
দগ্ধ, ভীত, বিভ্রান্ত বিপ্লব কোনোমতে ফিরে এল তার নিজের গ্রাম চণ্ডীপুরে। গ্রামের পরিচিত পরিবেশ, মা-বাবার স্নেহময় মুখ দেখে তার মনে কিছুটা শান্তি এলেও, সেই ভয়ঙ্কর রাতের স্মৃতি তাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফিরছিল। এখনো তার পিঠে সেই আগুনে পোড়া দাগ স্পষ্ট। যেন সেই দগ্ধ আত্মার ছোঁয়া আজও তার শরীরে লেগে আছে। রাতে যখন সে ঘুমোতে যায়, তখনো কানে ভেসে আসে সেই হিমশীতল কণ্ঠস্বর—
"আমি আবার আসব..."
📜 শেষ কথা:
এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শহরের আলো যতই চকচকে আর আধুনিকতার প্রতীক হোক না কেন, তার কিছু অলিগলি এমন আছে যেখানে ইতিহাসের গভীর ক্ষত নিয়ে কিছু ছায়া এখনো ঘুরে বেড়ায়, শরীর খুঁজে বেড়ায়। তারা হয়তো কেবলই এক নতুন জীবনের আশ্রয় চায়, কিংবা কোনো না বলা প্রতিশোধের আগুন নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গোনে। এমন কিছু স্থান আছে যেখানে প্রকৃতির নিয়ম ভেঙে যায়, এবং অতীতের প্রেতাত্মারা বর্তমানের ওপর তাদের কালো ছায়া ফেলে। আপনি কি কখনো এমন কোনো রহস্যময় স্থানের মুখোমুখি হয়েছেন?
51
View