রাতে ঠিক ঘুমাতে পারিনি। আমার চোখে ভাসছে অসহায় হয়ে দ্বিকবিদিক ছুটে বেড়ানো শিশুর ছবি। ভাসছে হার না মানা মায়ের ছবি। জীবনের শেষটুকু দিয়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া কাপ্তান তৌকিরের ছবি।
আহা, মাহরিন— মা আমার। একজন শিক্ষক দুনিয়ার সমস্ত মাতৃত্বের টানে ফুলের মতো ছেলেগুলোকে বাঁচানোর জন্য ঝাপিয়ে পড়লেন আগুনে, যেন জান্নাতি বাগানে। মাহরিন কী ভাবছে— যদি আরো কিছু ফুল কুড়িয়ে নেয়া যায়, শান্তি দিও খোদা তাতেই আমায়।
দুঃসহ স্মৃতির রাত পেরিয়ে এমন একটা সকাল হাজির হলো সামনে। ঘুম ভাঙলেই শুনতে হবে আরো আরো লাশের সারি পড়ে আছে বার্ন ইউনিটে, মর্গে।
একটা সকাল যেন বদলে দিলো জাতির স্বপ্ন। কয়েক মুহূর্তের কান্না, আহাজারিতে ডুবিয়ে দিলো প্রজন্মের সমস্ত আশা। মা জানে না তার ছেলে-সন্তান কোথায়, কোথায় ঘুমিয়ে আছে নিথর ও নীরবে। আহা, চোখ ফেরাতে পারছি না।
মাইলস্টোনের স্বপ্নবাজ তরুণ—শিশুরা হয়তো আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে বুক ভরেছিল, কিন্তু সেই আকাশ আর দেখা হলো না, থেমে গেলো স্বপ্ন পূরণের যাত্রা।
কেউ কেউ হয়তো ফিরেছে— তবে নিস্তব্ধ, নিথর হয়ে। এমন বিভীষিকাময় অবেলার ডাক কলেজ, পরিবার, বন্ধু ও আনন্দের জীবনকে বদলে দিয়েছে চোখের পলকে। নিস্তব্ধ হয়ে গেলো পুরো দেশ।
আহা, পাখির মতো ডানা মেলতে চাওয়া তরুণদের এই পরিণতি কে মেনে নেবে? কে সান্ত্বনা দেবে সেই মাকে- বাবাকে। নিথর মুখের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছেন?
এখনো আমার কানে বাজতেছে— জুলাইয়ে "মুগ্ধের পানি লাগবে পানি" কিংবা মাইলস্টোনে অবুঝ শিশুর কথা "আম্মু পানি দাও জ্বালা করে"। টের পাওয়া যায়— এই শ্রাবণে, কী বেদনায় জুলাই নেমেছিল জীবনে, ভুলতে না পারার স্মৃতি যেন আজ হাজির হলো আমাদের মাইলস্টোনে!
কতো ফুল ঝরে গেলো চোখের সামনে। এসব লেখায়, ভাষায় বলার কোনো উপায় নেই। এই লেখার কোনো শেষ নেই, যেমন শেষ নেই আমাদের ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ের আর্তনাদ। এ যেন আজ ভাঙা হৃদয়ে দেখি— বেদনার বাংলাদেশ।
আল মাহমুদ কি এজন্যই লিখেছেছিলেন— তোমরা কি না ফেরার পথে মাইলপোস্ট?
অবুঝ শিশু-কিশোরদের কান্না, রক্তে লাল হয়ে যাওয়া ক্লাসরুম, পুড়ে যাওয়া খাতা, পেন্সিল, ব্যাগ, অসহায় মায়েদের আর্তনাদ, এসব সহ্য করা যায় না। আমার চোখ ভিজে আসছে বারবার। পুড়ে গেলো শহরের ফুল, ঝরে গেলো অযুত স্বপ্ন ঘেরা জীবনের আলো।
আমার ভাই, বোনগুলো— জান্নাতি ফুলগুলোর জন্য বুকভরা দোয়া। বেদনাবিধুর হৃদয়ে এইটুকু দোয়া ছাড়া আর কী আছে আমার। আহতদের দ্রুত সুস্থ করে দাও প্রভু। যতগুলো পরিবার আজ নিঃস্ব হলো এই শোককে সাহস দিয়ে ভরপুর করে দাও, সহ্য করার ধৈর্য দাও।