"-ঐ যে পুল দেখছিস, ওটার নাম গেনার পুল। গেনাতুল্লাহ প্রামাণিক মানুষের সুবিধার জন্য ওটা করে দিয়েছিলেন। তিনি হলেন আমার বড় আব্বার (দাদার বাবা) বড় আব্বা।" পুলটা পার হওয়ার সময় একদিন কথাটা আব্বা বলেছিলেন। এরপর কতবার সেই রাস্তা ধরে আসা যাওয়া করেছি। গেনার পুল পার হলেই বাপের সেই কথা মনে পড়ত। জীর্ণ-শীর্ণ হওয়ায় একদিন গেনার পুল ভেঙ্গে নতুন ব্রিজও তৈরি হয়। এখন সেই নতুন ব্রিজ হয়ে বড় রাস্তা বদরগন্জ হয়ে চলে গেছে রংপুর অব্দি।
গেনাতুল্লাহ প্রামাণিকের পরপর কয়েকটি সন্তান মারা যায়। এরপর এক ফকিরের পরামর্শে ছেলের নাম ফকির মামুন রেখে বংশেরবাতি রক্ষা পায়। ফকির মামুনের পুত্র বদরেতুল্লাহ প্রামাণিকের ছেলে সরেতুল্লাহ প্রামাণিক হলেন আমার দাদার দাদা। আর আমার দাদা আজগর আলী প্রামাণিকের বাবা ছিলেন হসরেতুল্লাহ প্রামাণিক। বাপের কাছে এই গল্প শোনা।
আব্বা সেই সাথে আরও একটি গল্প প্রায়ই বলতেন। কয়েক পুরুষ পরে গেনাতুল্লাহর সম্পত্তির অল্প কিছুই ভাগে পেয়েছিলেন আমার দাদা। ছোটবেলা থেকে আব্বার শখ ছিলো কমপ্লিট সেট পরার। দাদা প্রতিবছর আবাদ শুরু হলে বলতো, "মন দিয়ে কাজ কর্ম কর। এবার ধান কাটা হলে তোক কমপ্লিট কিনে দিম।" কিন্তু সেই কমপ্লিট কেনা আর হতো না। তবে তিনি অবুঝও ছিলেন না। ছাত্র হিসেবে ভালো থাকার পরও সংসারের প্রয়োজনে বই খাতা শিকেয় তুলে রেখে সংসারের কাজে থিতু হন। কিন্তু কমপ্লিটের আফসোসটা বোধহয় সারা জীবন ছিলো। মানুষের জীবনটাই এরকম, কিছু অতৃপ্তি সারা জীবন থেকে যায়। বিধাতা মানুষ সৃষ্টি করে সম্ভবত জীবন ভর একটা অতৃপ্তি রেখে দেন। আর সেই অতৃপ্তি মানুষকে ভিতর থেকে বেঁচে থাকার জ্বালানির জোগান দিয়ে যায়।
এই হলো প্রামাণিক পাড়ার গল্প।
দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার ৪ নম্বর পলাশবাড়ি ইউনিয়নের চকবোয়য়ালিয়া প্রামানিক পাড়া। আমার নাড়িপোতা গ্রাম, আমার শৈশবের বেড়ে ওঠার স্থল। দেশের সাধারণ আর ১০ টা গ্রামের চেয়ে ব্যতিক্রম নয় আমাদের গ্রামটাও। কবে এই গ্রামের পত্তন হয়েছে সেটা কেউ বলতে পারে না। শহরে যাওয়ার রাস্তা থেকে একটা সরু রাস্তা নেমে গেছে। সেই রাস্তার দুই পাশে একের পর এক বাড়ি ঘর। ছোটবেলায় দেখেছি ২/১ টা বাড়ি বাদে সকলের ছিলো মাটিরঘর, উপরে খড়ের কিংবা টিনের চাল। যে ২/১ টা বাড়ি ছিলো দালানের, সেগুলো সগৌরবে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষনা করতো। কারও কারও সেই দালানের ইটে ছিলো মানুষ ঠকানোর ছাপ। অনেক পরে এসে সেটা জানতে পেরেছিলাম।
আমরা যারা তখন খুব ছোট তাদের কোন কিছুতেই কিছু এসে যেত না। বরং দলবেঁধে নারিকেল পাতা দিয়ে আমরা ঘড়ি ও চশমা বানিয়ে পরতাম। সেই ঘড়ি ও চশমা পরে একেক জন শহুরে সাহেবের অভিনয় করতাম। অন্যদের গ্রাম্য লোকের অভিনয়ে থাকতে হত। সবাই শহুরে বাবুর পার্ট করতে চাইতাম। কারন অভিনয়ের বড় অংশজুড়ে থাকত শহুরে ভদ্রলোক দ্বারা গ্রামের মানুষের নির্যাতন ও অবজ্ঞার চিত্রায়ন। শহরে যাওয়ার সুযোগ আমাদের হতোনা। আবার বড়রাও আমাদের মত পুচকেদের খুব বেশি পাত্তা দিতো না। তারপরও কিভাবে যেন গ্রাম ও শহরের বৈষম্য আমাদের খেলায় চলে আসত। এখনও আম্রিকা বাংলাদেশকে পাত্তা দেয়না, ঢাকা শহর পাত্তা দেয়না মফস্বল শহরকে। এমনকি গ্রাম থেকে মফস্বলে আসলে কেউ কেউ বলে, "দেখ দেখ, গ্রাম থেকে কোন মফিজ আসছে। চলনে বলনে, পোশাকে আশাকে একদম গাঁইয়া-ধুর"। সেই অবজ্ঞার খেলাটা সম্ভবত দুনিয়া জুড়ে এখনও চলছে।
একদিন দেখি, মটর সাইকেলে পুলিশ এসেছে। মটর সাইকেলের ঢরর ঢরর শব্দে ও পুলিশের ভয়ে দুরে পালিয়ে যাই। আমরা জানতাম, পুলিশ এসে মানুষকে ধরে নিয়ে যায়। থানায় নিয়ে পিডায়ে রক্তাক্ত করে ফেলে। এমনকি মেরেও ফেলে। পুলিশ সেদিন একজন আসামি ধরতে এসেছিল। সেটা জেনে আমরা ভয়ে আরও দুরে পালিয়ে যাই। মনে হত, পুলিশ বুঝি আমাদেরও ধরে নিয়ে যাবে। আমাদের শৈশবটা ছিলো এরকম নানা রকম ভয়ে, কৌতুহলের রোমান্চকর অভিজ্ঞতায় ভরপুর। সেই ভয়টা অনেক অনেক দিন ধরে মনের ভিতরে বসবাস করত। এমনকি কিছুদিন আগে একজন ওসি থানায় দাওয়াত দিলে বলে ফেলি, "থানা-পুলিশ দেখলে ভয় লাগে"। উনি আমার কথা শুনে হাসলেও আমার মানস পটে ছিলো শৈশবের সেই ঢরর ঢরর শব্দ করে আসামি ধরে নেয়ার ছবি।
গ্রামের সেই জীবনে আনন্দের এতটুকু কমতি ছিলোনা। সকাল নাই, দুপুর নাই খেজুর কিংবা নারকেল পাতার গাড়ি নিয়ে আমরা ব্যস্ত সময় কাটাতাম। নারিকেল পাতার শক্ত ও গোড়ার দিকটায় একজন বসে পড়ত। ১ জন চিকন দিকটা ধরে টানত, আরেক জনকে পিছন থেকে ঠেলতে হত। পালাক্রমে সবাই সেই পাতার গাড়িতে চড়তাম। যে যখন গাড়িতে বসত সে নিজেকে রাজা মনে করতো। শহর থেকে এক আত্মীয়ের সাথে আমাদের বয়সি একটা পুচকি এসেছিলো। সে নারিকেল পাতার গাড়ি দেখে তাদের এলাকার বিয়ারিং গাড়ির বর্ণনা দেয়। ভ্যান বা রিকশার চাকায় বিয়ারিং পুরাতন হলে বদলাতে হয়। মেকারের কাছ থেকে পুরাতন বিয়ারিং কিনতে পাওয়া যায়। ৩ টা বিয়ারিং গাছের ডালে ঢুকিয়ে তার উপর কয়েকটা কাঠের তক্তা বিছিয়ে বিয়ারিং গাড়ি তৈরি হয়ে যায়। নারকেল পাতার গাড়িতে বসলে প্যান্ট নষ্ট হয়, ধুলোবালিতে গা-পা একাকার হয়ে পড়ে। বাড়িতে গেলে মায়ের হাতের ২/৪ টা দুমদাম পিঠেও পড়ত। বিয়ারিং গাড়িতে সে সমস্যা নাই। চাকা আবিষ্কারে যেমন দুনিয়া বদলে যায়, বিয়ারিং গাড়ি আমাদের আনন্দের দুনিয়াও অনেক খানি বদলে দিয়েছিলো।
সেই গ্রাম কি এখনও আছে? গ্রামে গেলে পুরাতন ছবির সাথে নতুন ছবির তুলনা করি। জানি পরিবর্তন মাত্রই সমাজের অংশ, তবু স্মৃতির চোখ দিয়ে পুরাতন গ্রামটা দেখার লোভ সামলানো যায়না। কারন বর্তমানের গ্রামে নয় বরং পুরাতন জীর্ণ গ্রামে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাই। এখন গ্রাম পর্যন্ত পাকা রাস্তা হয়েছে। এসেছে বিদ্যুত, তার সাথে ডিশ। আরও কত কিছু। অথচ একটা সময়ে সাইকেল, গরুর গাড়ি ও ২ পা ছিলো সবচেয়ে সাধারণ বাহন। শীতকালে ধান কাটা হলে পদব্রজে চলতে চলতে ধানক্ষেত দিয়ে সোজা রাস্তার নিশান তৈরি হয়ে যেত। পরের ফসল লাগানোর আগ পর্যন্ত সে পথে সবাই চলতো। আমন ধান চাষের সময়ে একটা মজার ঘটনা ঘটতো। চাষের পর ধানের চারা লাগানোর আগে মই দেয়ার নিয়ম। মই দেয়া শুরু হলে সবাই মইয়ের পিছনে পিছনে দৌড়াতাম। কারন ক্ষেতে লুকিয়ে থাকা সব মাছ সে সময় ভেসে উঠত। আর আমরা খপাখপ ধরে খলুইয়ে ভরতাম। তবে তারচেয়ে বেশি ম্যাজিক দেখাত আমার মেজ ভাই (শহিদুল ভাই)। সে পুকুরে হোক, নদীতে হোক ডুব দিয়ে মাছ ধরতো। একবার তাঁর সাথে গিয়ে থাল দিয়ে জমি সেচে এত মাছ ধরেছিলাম সেটা আজও ভুলি নাই। মাগুর, শিং, টেংরা, কই, টাকি, পুটি কত রকমের মাছ ছিলো সেই জমিতে।
আমাদের গ্রাম ঘেষে গেছে ছোট একটা নদী।সোনারবান নামে পরিচিত। সময়ের অভিশাপে সেটা আজ মৃতপ্রায়। কিন্তু আমাদের শৈশবে সোনারবানে ছিলো যৌবনের ধার। গাছে চড়ে নদীর জলে লাফ দিয়ে তলদেশে গিয়ে কাদা নিয়ে আসার কম্পিটিশন চলতো। কার কত দম, সেটার পরীক্ষা চলত। এরপর চলতো পানিতে ডুবে ডুবে লুকোচুরি খেলা। যাকে খুঁজতে হবে সে তার একটা আঙ্গুল উচিয়ে বলতো,
-এটা কি?
-আঙ্গুল।
-কাটলে কি বের হবে?
-রক্ত
-মোক এবার ধরতো!!
এই বলে ডুব দিত সে। এরপর ডুবে ডুবে চলতো তাকে খুঁজে বের করার কাজ। বর্ষা শুরু হলে পানির তোড়ে দুই তীর ভেঙ্গে যেত। একবার হলো কি, কলার ভেলায় নদীর ওপারে গিয়ে কোনভাবে ফেরা যাচ্ছিলো না। পরে কয়েক কিলোমিটার হেটে পুল দিয়ে বাড়িতে আসি।
বড়দের মাঝে অনেক সময় ঝগড়া লেগে যেত। জমির ভাগ কিংবা জমির আইল সরানো নিয়ে কখনও কখনও তুলকালাম কান্ড লেগে যেত। তখন যে পক্ষের লোক বেশি তাদের কাছে হার মানতে হত। এর প্রভাব এসে পড়ত আমাদের মাঝেও। ঝগড়ার পর কারও বাপ কিংবা মা কড়া শাসনে বলে দিত, "খবরদার, ঐ নাউয়ার বেটার সাথে মিশবুনা। মিশলে তোর টেংরি ভাংগি দেইম।" এক বেলা সেই সামরিক আইন চালু থাকলেও পরের বেলায় সবকিছু দুধভাত হয়ে যেত। ছোট মনে এই প্রশ্নটাও আসতো, আমরা ঝগড়া করলে একটু পর যেই সেই। কিন্তু বড়রা কেমন জানি। নিজেরাও কথা কয়না আমাদেরও কথা বলতে দেয়না।
শৈশবেই জীবনের চলমান নদী ভিন্ন দিকে ধাবিত হয়। নানা বাড়িতে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে হঠাৎ করে দুনিয়া থেকে মা হারিয়ে যায়। মায়ের দাফন শেষ করে ঐদিনই প্রিয় প্রামাণিক পাড়া ও নিজের শৈশবকে পিছনে ফেলে পথ ধরি শহরে যাওয়ার।
আমার খুব মনে আছে, শহরে যাওয়ার সময় অন্য অনেক জিনিসের সংগে ছিলো একটা কালো খাসি।