Posts

গল্প

তৃণার অপেক্ষা (ছোট গল্প )

July 31, 2025

মোঃ বজলুর রশীদ

Original Author মোঃ বজলুর রশীদ

95
View


নবাবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠটা বড়। শুধু বড় বললে ভুল হবে বিশাল বড়। বিকেলে পশ্চিম দিক থেকে আসা রোদ যখন লালচে হয়, তখন মাঠের ঘাসগুলোও সোনালি আকার ধারণ করে দেখতে অসম্ভব ভালো লাগে ।

চতুর্দিক তারকাটা দিয়ে ঘেরা থাকায় মনে হয় সীমান্তবর্তী কোন এলাকা। তবে সীমান্ত এলাকা বললে ভুল হবে না । কারণ বিদ্যালয় থেকে সীমান্তবর্তী এলাকা খুব বেশি দূরে নয় একদম কাছেই । আমরা রোজ বিকেলে এই মাঠেই খেলতাম – ফুটবল, ক্রিকেট, কখনও স্রেফ দৌড়ঝাঁপ। কেউ কেউ আবার শরীরচর্চা করতেও আসতো।

আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি, তৃণা সেভেনে। এইটে পড়া একটা ছেলের মনে এমন ভালো লাগা কাজ করবে, এটা তো স্বাভাবিক।
প্রকৃতিই হয়তো এভাবেই সব সাজিয়ে দিয়েছে। কে জানে, হয়তো এই ভালো লাগাটাই একদিন সত্যিকারের প্রেমে রূপ নেবে।পৃথিবীতে অনেক কিছুই পরিকল্পনা করে হয় না, তেমনি প্রেমও কখনো পরিকল্পনা করে হয় না। এই প্রেম জিনিসটা হঠাৎ হয়ে যায়। তৃণাদের বাড়িটা ঠিক মাঠের পাশেই। নিজেদের বাড়ি ছিল না, ভাড়া থাকতো। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তৃণা মাঝে মাঝে আমাদের খেলা দেখতো।

আমি মাঠে নামতাম খেলার জন্য ঠিকই, কিন্তু আমার চোখটা সারাক্ষণ তাদের জানালার দিকেই পড়ে থাকত। তৃণা কখন আসবে, কখন জানালার পাশে দাঁড়াবে, কখন আমাদের খেলা দেখবে, কখন তাকাবে এসবের জন্যই যেন মাঠে নামা। খেলার ছলে শুধু তৃণাকে একবার দেখা।

তৃণাকে প্রথম দেখেছিলাম স্কুলের লাইব্রেরিতে। ও খুব মন দিয়ে একটা বই পড়ছিল। 
আমি পাশ দিয়ে চলে গেলাম, একবারও ফিরে তাকাল না। ব্যাপারটা কেমন যেন একটা অস্বস্তি দিল। এত বড় দুনিয়ায় আমি আছি কি নেই, সেটা ওর জানার দরকার নেই? মনে হলো, আমি বুঝি একটা তুচ্ছ জিনিস।

অল্প কিছুদিনের মধ্যে বুঝলাম, তৃনা নামের মেয়েটি আমার মনের গভীরে জায়গা করে নিতে শুরু করেছে।ওকে কিছু একটা বলতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সাহস হতো না।সেই সাহসটা এলো অনেকদিন পর, হঠাৎ করেই।

​আমরা যেহেতু একই স্কুলে পড়তাম, তাইএকদিন স্কুলের ওয়েটিং রুমে ওকে একা দেখতে পেলাম।
তৃণা একাই বসে ছিল। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওকে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ তৃণা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।
তৃণা শান্ত চোখে বলল, বলো।

আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না। কথাটা এত দ্রুত বলেছিলাম যে, ভয়ে আমার মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল ওয়েটিং রুমে পানি থাকায় আমাকে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিতে হলো। এরকম পানির তৃষ্ণা এর আগে আমার কখনো পায়নি ।

তৃণা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর খুব আস্তে করে বলল, এটা অসম্ভব!

আমি জানতাম, কেন অসম্ভব। কারণ আমাদের ধর্ম আলাদা। পরিবার এই সম্পর্ক কখনোই মেনে নেবে না। সমাজের নিয়ম বলে কথা। আমাদের সমাজে ভিন্ন ধর্মের ছেলেমেয়ের বিয়ের সংখ্যা হাতে গোনা, আর লোকে ভালো চোখে দেখে না। তাই আমাদের এক হওয়ার সুযোগ ছিল না। তারপরও, সেদিন থেকে আমরা সমাজের নিয়মকে একরকম উপেক্ষা করেই একে অপরকে ভালোবাসতে শুরু করলাম।

এই ভালোবাসাটা ছিল ভীষণ গোপন, সমাজের চোখকে ফাঁকি দিয়ে। ক্লাসের ফাঁকে দেখা, স্কুলের করিডোরে দ্রুত হাঁটার সময় এক ঝলক তাকিয়ে নেওয়া, কিংবা ওর ক্লাসরুমের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখা , এভাবেই চলছিল আমাদের প্রেম। আর প্রতিদিন বিকেলে নবাবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে খেলতে যেতাম শুধু তৃণাকে একবার দেখব বলে।

স্কুল জীবন শেষ হলো একদিন। আমরা দুজনেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, তবে আমাদের
সাবজেক্ট ছিল আলাদা। প্রথমে মনে হয়েছিল, আমরা হয়তো  ধর্ম, পরিবার, সমাজ, সব কিছু উপেক্ষা করে হয়তো একসঙ্গে থাকতে পারবো।
কিন্তু পরে মনে হল অতি আবেগ দিয়ে জীবন চলে না।


তারপর হঠাৎ করেই একদিন আমার জীবনে অন্য এক মেয়ের আগমন হলো। সে ছিল আমার সহপাঠী। আমাদের মাঝে কোনো ধর্মীয় বাধা ছিল না। আমরা একই ধর্মের অনুসারী ছিলাম। সহজ, সরল প্রেম। আমি ধীরে ধীরে তৃণার কথা ভুলতে শুরু করলাম।

তৃণা হয়তো বুঝতে পেরেছিল। 
আমরা একই ক্যাম্পাসে থাকার কারণে মাঝে মাঝে তার সঙ্গে দেখা হতো। 
হঠাৎ একদিন ও আমাকে বলল, তুমি আমাকে দেখলে এড়িয়ে যাও কেন?
​আমি চুপ করে রইলাম। আসলে সত্যি সত্যিই আমি ওকে এড়িয়ে চলতাম।
​কিছুদিন পর আমি নতুন প্রেম করতে করতে ছাত্রজীবন শেষ করে বিয়ে করলাম। তৃণা সব জানতো, কিন্তু কিছুই বলল না। শুধু নীরবে কেঁদেছিল, সেটা আমি পরে জানতে পারি।
তৃণা অনেকদিন অপেক্ষা করল আমার জন্য। তারপর বাড়ীর চাপে সেও বিয়ে করল একদিন, আমাদেরই এলাকার এক পরিচিত ছেলেকে।

​অনেক বছর পর, একদিন বিকেলে হঠাৎ তৃণার সঙ্গে দেখা হলো। ওর কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা, আমার হাতেও আমার সন্তানের হাত। আমরা কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বলার মতো কিছু ছিল না। তবুও, না বলা কথাগুলো যেন চোখের ইশারায় বলা হয়ে গেল।


​তৃণা একটা অভিমানী হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, কেমন আছো?
ভালো। তুমি?
আমি শুধু মাথা ঝাঁকালাম।

​তারপর দুজনেই যার যার বাড়ির পথে হাঁটা দিলাম। পেছন ফিরে তাকাইনি। কারণ আমি জানতাম, তাকালে তৃণার চোখে একটাই প্রশ্ন দেখতে পাবো:

​ধর্ম, সমাজের নিয়ম, সবকিছু উপেক্ষা করে আমরা কি একসঙ্গে থাকতে পারতাম না ?

​সেই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না, তৃণাও জানে না। জীবন শুধু সামনে এগিয়ে যায়, পেছনে ফিরে তাকায় না। প্রকৃতি এমনই... রহস্যময়।

Comments

    Please login to post comment. Login

  • Kazi Eshita 4 months ago

    সব ভালোবাসা যে মিলনেই পূর্ণতা পাবে তা কিন্তু. নয়। ভালো লেগেছে গল্পটা