মোকা মামার বিয়ে। বরযাত্রী প্রস্তুত। রেডি হয়ে আছি আমিও। বিয়ে মানে আনন্দ উল্লাস, বিয়ে বাড়ি মানে ইচ্ছেমত খাওয়ার সুখ। কিন্তু, বড়দের ফিসফাস থেকে জানলাম, অন্য ছোটদের সাথে আমিও বাদ। এর কারণ গরুর গাড়িতে জায়গার অভাব। শুনে সে কি কান্নাকাটি। মনে আছে, মাটিতে গড়াগড়ি দেয়ার পর মুরুব্বিরা সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয়। উঠে বসি গরুর গাড়িতে। নানা বাড়ি উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার ভিতরে। গ্রামের নাম দুর্গাপুর বালাপাড়া। যে সময়ের এই গল্প, তখন গোটা উপজেলায় পাকা রাস্তার সংখ্যা গুণতে আঙ্গুলের কড়ারও দরকার হয় না। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল নদী খালে ভরা। ঐ অঞ্চলে যোগাযোগের প্রধান উপায় ছিল নৌকা। কিন্তু, দেশের উত্তর অঞ্চলে সেই সুযোগ ছিল না। স্থলপথই আমাদের ভরসা।
গ্রামের রাস্তা মানেই মাটির বাঁধের তৈরি কাচা সড়ক। এই সড়ক ধরে এক জায়গা থেকে অন্যত্র যাওয়ার সম্বল নিজের দুই পা,সাইকেল অথবা ছইওয়ালা গরুর গাড়ি। গ্রামে মোটরসাইকেল তখনও প্রায় ডুমুরের ফুল, কালে ভদ্রে দেখা যায়। আর বর্ষাকালে? শুধু মাথার উপরে নয়, রাস্তায়ও নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। পিচ্ছিল রাস্তায় পা টিপে টিপে হাটা, একটু অসতর্ক হলেই পিছলে গিয়ে চিৎপটাং। কত নতুন জামাই, নতুন বউ কাঁদা মেখে শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ করেছে, তার ইয়াত্তা নেই। এর চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নদী পার হওয়া। একবার ভাবুন, বর্ষায় খরস্রোতা নদী, জলে টইটুম্বর। কিন্তু ওপারে যেতেই হবে। তবে মানুষ যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির সাথে মানিয়ে চলে আসছে। একটা উপায় ঠিক বের করে নেয়। পানিতে নেমে পর্যায়ক্রমে লুঙ্গী মাথার উপরে তুলে। এক হাতে সেই লুঙ্গি ও অন্যান্য কাপড় নিয়ে সাঁতার কেটে নদী পার হয়ে যায়। এরকম বিরল ও বিচিত্র দৃশ্য দেখার সুযোগও হয়েছে আমাদের। এখনকার এই দিনে নিজের কাছেই রূপকথার মত মনে হয়, সেই সব দিনকে। নদীতে বাঁশের সাঁকো থাকা মানে হাতে আকাশের চাঁদ। সাঁকো থাকা মানে ইজ্জত ফালুদা হওয়া থেকে রক্ষা। তবে সাঁকো পার হতেও বিশেষ কৌশল লাগে। আমি কখনও খুব একটা কৌশলী ছিলাম না। কিন্তু সেই বয়সে সাইকেল কাঁধে নিয়ে বাঁশের সাঁকো পার হয়েছি। এই সময়ে সে কথা ভাবলে অবিশ্বাস্য মনে হয়।
২।
দাদির ভীষণ অসুখ। গ্রাম থেকে গরুর গাড়িতে দাদিকে নেয়া হয়েছে পার্বতীপুর রেলওয়ে স্টেশনে। দিনাজপুরে নেয়া হবে। ভালো চিকিৎসা হবে দাদির। প্লাটফর্মে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা চলছে। এই সময়ে দাদির হুশ ফিরে। কোনমতেই ট্রেনে উঠবেন না। ট্রেনে উঠা মাকরুহ, এমনকি পাপও (বিদআত) হতে পারে। এই ছিল দাদির বিশ্বাস। বড়দের কাছে শুনেছি, সেদিন দাদি নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। ট্রেনে উঠেন নি, দিনাজপুরে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি। শুধু আমার দাদির নয়, সেই সময়ের অনেক মানুষের এরকমই বিশ্বাস ছিল।
কিন্তু আমার মায়ের বেলায় সেরকম কিছু হয়নি। মায়ের চোখে সমস্যা দেখা দেয়। চোখ দেখাতে হলে যেতে হবে দিনাজপুর চক্ষু হাসপাতালে। আমি অনেক ছোট। আবছা আবছা মনে পড়ে। প্রথম বারের মত ট্রেনে উঠেছি। ঝক ঝকা ঝক শব্দ করে, সোঁ সোঁ করে বাতাস কেটে, ট্রেন চলতে শুরু করে। কখনও আবার মনে হয়, ট্রেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, আশেপাশের সবকিছু বরং পিছনের দিকে সরে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে মন্মথপুর, চিরিরবন্দর ও কাউগাঁ স্টেশন পার হয়ে ট্রেন পৌঁছে যায় দিনাজপুরে। মায়ের চিকিৎসা শেষে অন্য একটা ট্রেনে করে ফিরি। সে কি উচ্ছ্বাস ভিতরে ভিতরে, নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুলে যাবো অবস্থা। ট্রেনে দিনাজপুর যাওয়ার গল্প শুনতে চাইতো সমবয়সীরা। ওদের বেশির ভাগই তখনও ট্রেনে চড়ার সুযোগ পায়নি। আমি ট্রেনে চড়ার গল্প বলি, হয়ত কিছুটা বাড়িয়ে। ওরা হা করে শোনে, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটায়।
৩।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ রেল স্থাপনের শুরুর দিকে-সেই ১৮৭৮ সালে পার্বতীপুর রেল নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হয়। সেই রেলজংশনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে নতুন ধরনের শহর। আগে যে রাস্তা যেতে ৫ দিন লাগতো, ট্রেনে চড়ে ৫ ঘণ্টায় সেখানে পৌঁছানো যায়। যেন ট্রেন নয়,কী দারুণ ম্যাজিক। প্রায় ১৫০ বছর পূর্বে এদেশে শহর ছিলো না বললেই চলে-যা ছিলো তা মূলত নদী বন্দর কেন্দ্রিক হাট বাজার। পায়ে হেটে, গরুর গাড়ি ছাড়া, মানুষের যাতায়াত ব্যবসা বাণিজ্যের পুরাটাই ছিলো নদী নির্ভর। এর বিপরীতে সমান্তরাল দুইটা পাতের উপর চড়ে, দানবের মত আসা দ্রুত গতির ট্রেন, সত্যিকার অর্থে অজপাড়ার আনপড় সহজ সরল মানুষের কাছে ছিলো বিস্ময়কর। অসম্ভব মুগ্ধজাগানিয়া।
পূর্ববাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং উত্তরবঙ্গ তথা আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন ও পণ্য পরিবহনের জন্য ব্রিটিশরা রেল স্থাপন করে। পার্বতীপুর ছিল সেই সময়কার আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের অংশ। এটি ছিল আসাম থেকে কলকাতা পর্যন্ত পণ্য ও চা পরিবহনের মূল রুট। তখন থেকে পার্বতীপুর বাংলাদেশ রেলওয়ের উত্তরাঞ্চলের একটি কৌশলগত কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর আসামের সাথে পশ্চিমবঙ্গের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভারতকে নতুন করে রেল পথ বসাতে হয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়েও পার্বতীপুর রেলওয়ে জংশন একটি কৌশলগত সামরিক অবস্থানে পরিণত হয়। যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা এ জংশনের উপর গেরিলা হামলা চালায় ও রেললাইন বিচ্ছিন্ন করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এরও বহু যুগ আগে পার্বতীপুর ছিল গৌড় ও কামরূপ রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চল। কালের পরিক্রমায় পাল ও সেন আমলে একটি গুরুত্বপুর্ন গ্রাম্য জনপদে পরিণত হয়,যেখানে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের বেশ চর্চা হত। মুঘল আমলে এটি একটি পরগনায় রূপান্তরিত হয়।
১৯৬০ এর দশকের একটি ঘটনা স্থানীয় প্রবীণদের মুখে বেশ প্রচলিত ছিল। এক পুরানো ইঞ্জিন লাগিয়ে মালবাহী ট্রেন সৈয়দপুরের দিকে রওয়ানা হয়। ইঞ্জিন চালক ও গার্ড দুজনেই ছিলেন অমনোযোগী। লোকেরা দেখতে পেলো- ইঞ্জিন চলে যাচ্ছে একা একা, আর গার্ড দাঁড়িয়ে থাকলো তার লাল পতাকা নিয়ে। এই ঘটনার পর বগি-ইঞ্জিন কাপ্লিং পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়।
৪।
বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালি বের হয় ১৯২৯ সালে। পথের পাঁচালিতে অপু ও দুর্গার বাবা হরিহর রায় ওদেরকে রেল লাইন দেখাতে নিয়ে যায়। অপু দুর্গার রেল লাইন দেখতে যাওয়ার যে শিহরিত অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে তা অনন্য। এই ঘটনা থেকে আমরা সেই সময়ের সমাজের অবস্থা কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। এরও ৫১ বছর পূর্বে পার্বতীপুরে ৪ লাইনের জংশন স্থাপিত হয়। এখানে সংযুক্ত হয় ব্রডগেজ ও মিটার গেজ লাইন। সকাল দুপুর রাতে চারদিক থেকে আসে ট্রেন। ট্রেন চলে যায়। অজপাড়া হয়েও এই রেলওয়ে জংশন পার্বতীপুরকে দিয়েছে অন্য মাত্রা। আজকের এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বসে সেই যুগের মানুষের আবেগ উপলব্ধি করা খুব কঠিন। দ্রুত দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া সম্ভব হল, দূরের বহুদূরের মানুষেরা ট্রেনে করে এখানে আসতে লাগলো। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ছোট গল্প 'বাক্স বদল' পার্বতীপুর জংশনেরই ঘটনা, পরে এই গল্প থেকে সিনেমা তৈরি হয়েছে (১৯৭০ সালে নির্মিত, সৌমিত্র ও অপর্ণা সেন অভিনীত)। এ বাদেও তৈরি হয়েছে বেশ কিছু সিরিয়াল ও নাটক। পার্বতীপুর জংশন এখনও ব্রিটিশ রেলের আদি রুপকে ধারণ করে আছে। একারনে হয়ত কাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু সিনেমার শুটিং হয় এই জংশনে।
শুধু তাই নয়, কবি কাজী নজরুল ইসলামের "কুহেলিকা" উপন্যাসের সাথেও জড়িয়ে আছে পার্বতীপুর জংশনের নাম। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী প্রমথ সংঘঠনের কাজে ছদ্মবেশে চলাফেরা করার সময় কিছুক্ষণের জন্য এই জংশনে এসেছিলেন। পুলিশের চোখেধুলো দিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালের আগে বাংলা বিহার উড়িষ্যা বাদেও আসামে যাতায়াতের জন্য গুরুত্বপূর্ন পয়েন্ট ছিলো পার্বতীপুর জংশন। এখনও এই উপজেলা শহর থেকে খুলনা, রাজশাহী, রংপুর ও ঢাকা ছাড়াও প্রায় ২০টি জেলায় সরাসরি যাতায়াত করা যায়। এই জংশনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ডিজেল শপ, ওয়ার্কশপ ও দেশের একমাত্র কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার চেয়ে কিছুটা বড় আয়তনের (গাজার ৩২০ বর্গকিলোমিটারের বিপরীতে পার্বতীপুর ৩৯৫ বর্গকিলোমিটার)। এই জংশন-এক অর্থে পার্বতীপুর উপজেলা শহরের দুঃখেরও কারন হয়েছে। অতি পুরাতন এই শহরটি এখনও মাথা তুলে দাড়াতে পারেনি। শহরের অধিকাংশ জমির মালিক হয় রেল, না হয় অন্য কোন বিশেষ সংস্থা।
৫।
গ্রাম ছেড়ে পার্বতীপুর শহরে চলে আসি সেই ছোটবেলায়। রেলজংশন বিধৌত পার্বতীপুরের সোঁদা গন্ধ মেখে বড় হওয়া এই আমাদের গাঁয়ে এখনও আছে তাঁরই ঘ্রাণ। মান্নাদের মত আমাদের কোন কফি হাউজ নেই। পার্বতীপুর রেলওয়ে জংশনই আমাদের কফি হাউজ। যেখানে জমা আছে আমাদের হাজারও স্মৃতি। আমাদের কাছে পার্বতীপুর জংশনই লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজ, প্যারিসের আইফেল টাওয়ার। আমাদের পরিচয়ের আইকনিক স্থাপনা। আর তাই ভালোবাসার সূরে আমরা গেয়ে উঠি, ‘এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে গেলে/দমকা হাওয়া মাতাল হয়ে/পায়ে স্নেহের বেড়ি পরায়/ঝিকর ঝিক সূর তুলে ফের/ঘ-বগিটি আস্তে ধীরে/ঘোমটা সরায়, সামনে দাঁড়ায়’।
সাজিদ রহমানঃ গল্পকার, লেখক ও প্রকৌশলী