তোমার নামটা দোয়ায় রাখি

(একটি পবিত্র ভালোবাসার শেষ প্রহর পর্যন্ত যাত্রা)
অধ্যায় ১: দুপ্তারা কুমারপাড়ার মনোরম সকাল
আমার নাম তানভীর।
আমি ছোট্ট গ্রাম দুপ্তারা কুমারপাড়া থেকে।
গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে আমাদের বাড়ি, যেখানে দুই পাশে একে অপরের সাথে স্নিগ্ধতা দিয়ে জড়িয়ে আছে দুটি পুকুর।
একটি পুকুর আমাদের বাড়ির পূর্ব দিকে, আর অন্যটি দক্ষিণে।
পুকুরের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে থাকা আমগাছ আর কলাগাছের ছায়া পড়ে যেমন মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করে, ঠিক তেমনি পুকুরের দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে ছড়িয়ে আছে বিস্তীর্ণ কৃষিজমি।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সেই প্রকৃতির নীরব symphony আমার মন ছুঁয়ে যায়।
আমাদের বাড়ির পাশে একটি ছোট্ট মরজিদ আছে।
প্রতিওয়াক্তে মাইকের সুমধুর আজানের আওয়াজ এসে পড়ে হৃদয়ে, যার মধ্যে লুকিয়ে থাকে শান্তির আবেদন।
মসজিদের নামাজের ডাক যেন জীবনের পবিত্রতা ও স্নিগ্ধতা বাড়িয়ে দেয়।
আমার বাবা একজন মাদরাসার শিক্ষক।
বেতন সামান্য হলেও, তাঁর নিষ্ঠা আর ভালোবাসা শিক্ষার প্রতি অপরিসীম।
বাবার কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে শিখেছি—জীবন মানে লড়াই আর ধৈর্যের পরিচয়।
আমি মাদরাসা থেকে আলিম পাস করে নরসিংদী সরকারি কলেজে অনার্সে ভর্তি হই।
বাড়িতে বসে কম্পিউটারের মাধ্যমে স্টক মার্কেটে কাজ করে সামান্য উপার্জন করি, যা দিয়ে পড়াশোনা চালাই।
এই নতুন জগতের মুখোমুখি হয়ে আমার স্বপ্নগুলো ছোট হলেও বড় হওয়ার অপেক্ষায় থাকে।
জীবনের নতুন অধ্যায়ের শুরু হয় এ থেকে।
অধ্যায় ২: কলেজ জীবনের আলোছায়া
আমাদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে, নরসিংদী পাশের এক জেলা। সেই জেলা সহরে অবস্থিত নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়তে বাসে যাতায়াত করতাম।
প্রতিদিন ভোরের প্রথম আলোয় বের হয়ে রাস্তার ধারে ঝরে পড়া পাতা, বাতাসে ভাসমান ধুলো আর মানুষের মুখরিত শব্দের মাঝ দিয়ে বাসে উঠতাম।
এই দৈনন্দিন যাত্রা আমার ছোট্ট স্বপ্নগুলোকে আরও মজবুত করত, প্রতিদিন নতুন কিছু শেখার আগ্রহে বুক ফুলে উঠত।
কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকলেই চোখে পড়ে বিশাল এক পুকুর, যেন এক শান্ত জলরাশি সময়ের কোলে বিশ্রাম নিচ্ছে।
পুকুরের দক্ষিণ পাশে উঁচু তিন তলা একটি ডিপার্টমেন্ট ভবন, যেখানে আমাদের ইসলামী ইতিহাস অনার্সের ক্লাসগুলো চলত।
দূর থেকে পুকুরের জল সূর্যের রোদের সঙ্গে খেলা করে ঝলমল করে ওঠে।
মনরমস সেই দৃশ্য জানালা দিয়ে দেখি বার বার, আর হাজারো স্বপ্ন আঁকা হয় আমার হৃদয়ে।
কলেজের লাইব্রেরি ছিল আমার প্রিয় আশ্রয়।
সেখানে বসে বইয়ের পাতা উল্টানো, নোট লেখা আর জানালার বাইরে তাকিয়ে দিগন্তের অসীমতায় হারিয়ে যাওয়া—সেই সময়গুলো ছিল আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত।
এক দুপুরের নীরবতায়, লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে পড়াশোনা করছিলাম।
তখনই প্রথম চোখে পড়ল সাদা ওড়নার এক মেয়ে—সুরাইয়া।
তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত মিশ্রণ—বিষণ্নতা আর অন্তরাত্মার গভীর শান্তি, যা আমাকে অনায়াসে আকৃষ্ট করল।
আমাদের চোখ মিলল মাত্র এক মুহূর্তের জন্য।
সেই মুহূর্তেই হৃদয়ের গভীরে নতুন এক গল্পের সূচনা হলো, যা আজও আমার স্মৃতিতে ঝকঝক করে জ্বলজ্বল করে।
অধ্যায় ৩: বন্ধুত্বের প্রথম স্পন্দন
সেদিনের সাদা ওড়নার মেয়ে, সুরাইয়া, আসলে ছিল এমন এক মানুষ যার হাসির আড়ালে লুকানো ছিল এক গভীর দুঃখ।
আমাদের প্রথম কথোপকথন শুরু হয় কলেজের এক গ্রুপ প্রজেক্টের সময়।
সুরাইয়া ভদ্র, শান্ত ও কিছুটা রিজার্ভড, আর আমি তানভীর, গ্রাম থেকে উঠে এসেছি নতুন স্বপ্ন বুকে নিয়ে।
প্রজেক্ট চলাকালীন সময় বেশ কয়েকবার ওর পাশে বসার সুযোগ হতো।
সুরাইয়ার চোখে একটা কথা ছিল, যা ও কখনো বলে উঠতে পারত না।
একদিন সে হঠাৎ বলল—
“তুমি অনেক চুপচাপ, কোনো স্বপ্ন নেই?”
আমি হেসে বললাম—
“আছে... কিন্তু আমার স্বপ্ন গরিব, মুখ খুলে না।”
সেই কথা থেকে আমাদের বন্ধুত্বের সূচনা।
ও মাঝে মাঝে আমার পাশে বসত—লাইব্রেরিতে, ক্যান্টিনে, এমনকি একদিন আমার বাড়িতেও এসেছিল আমার ডিজাইন দেখার জন্য।
ও বলত,
“তোমার হাতের কাজ সুন্দর, মনও নিশ্চয় সুন্দর হবে।”
আমার হৃদয় ও কথাগুলোতে প্রতিফলিত হতো, কিন্তু আমি কখনো বলতে পারিনি—
“আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
কারণ জানতাম, আমার মতো একজনের ভালোবাসা হয়তো ওর জীবনের সুখের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।
অধ্যায় ৪: বলা হলো না সেই কথা
কিছুদিন পর জানতে পারলাম, সুরাইয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
আমার বুকটা যেন ফেটে গেল, মনের গভীরে এক অচেনা শূন্যতা এসে বাসা বেঁধে গেল।
তবুও একদিন সাহস করে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম—
“ছেলে পছন্দ হলো?”
সুরাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল—
“তুমি থাকলে আর কাউকে ভালো লাগে না...”
আমার হৃদয় তখন শব্দহীন হয়ে গেল।
আমি বুঝতে পারলাম, সমাজের নিয়ম, পরিবারের বাঁধন আমাদের ভালোবাসার পথ আটকে দিয়েছে।
আমাদের পবিত্র ভালোবাসা হয়তো কেউ বুঝবে না।
সেদিন রাতে আমি একাকী নিঃশব্দে কেঁদেছিলাম—একটা ভালোবাসা, যা প্রকাশ করার সাহস পাইনি, তার ব্যথা বুকের আকাশে গর্জন করছিল।
অধ্যায় ৫: বিদায়ের শেষ মুহূর্ত
বিয়ের মাত্র এক সপ্তাহ আগে সুরাইয়া আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।
তার চোখ লাল, কণ্ঠ কাঁপছে, যেন সারা জীবনের বেদনা ও ভালোবাসার সঞ্চয় একবারে বেরিয়ে পড়ল।
“তুমি কি একবারও বলবে না, আমাকে তুমি ভালবাসো?”
সে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞাসা করল।
আমি ওর চোখের গভীরে ডুবে ধীরে বললাম—
“তুমি সুখী থেকো, এই কামনায় দোয়া করতে শিখেছি।”
সেদিনের পর আর কোনো খবর পাইনি ওর।
কিন্তু সেই রাতে একটা চিঠি এল—
“তুমি আমার জীবনের একমাত্র সত্যি, যাকে পাব না—এই সত্যটাও মেনে নিতে শিখছি।”
এক সপ্তাহ পর এক ভয়ঙ্কর ফোন কল এল—
সুরাইয়া আর নেই।
বিয়ের কেনাকাটা শেষে বাসায় ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে ওদের গাড়ি।
সব শেষ।
আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।
যেখানে ভালোবাসাও প্রকাশ করা হয়নি, সেখানে বিদায়ও হয়ে গেল চিরতরে।
অধ্যায় ৬: স্মৃতির আঙিনায় বেঁচে থাকা
আজও আমি কাজ করি, দিনের সূর্য ওঠার আগেই ছুটে যাই গ্রামের রাস্তায়।
কোনো শব্দ করি না, নিজেকে ব্যস্ত রাখি।
মানুষ বলে, “তুমি তো ভালো ছেলে, বিয়ে করো না কেন?”
আমি শুধু মাথা নেড়ে বলি—
“আমার বিয়ে হয়েছে… সেই মেয়ের সাথে স্বপ্নে, যার জন্য আমি প্রতিদিন বাঁচি।”
আমার হৃদয় এখন স্মৃতির সঙ্গে বাস করে—স্মৃতির গভীর চিরসবুজ বাগানে।
প্রতিদিন নামাজ শেষে আমি দোয়া করি—
“আল্লাহ, ওকে শান্তিতে রাখ।”
জীবন এগিয়ে চলে,
কিন্তু ভালোবাসার নাম আমার মনে গেঁথে আছে,
এক নাম যা আমি আজও দোয়ার তালিকায় রেখে এসেছি—সুরাইয়া।
পরিচয়:
এই উপন্যাসের চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক।
তবে কিছু অংশ আমার কল্পনার অনুভূতির কাছাকাছি।
গল্পটি আমার মনের আবেগ আর কল্পনার মেলবন্ধনে রচিত।