Posts

গল্প

স্মৃতির সিঁড়িতে বৃষ্টি

August 11, 2025

Tanvir khan

57
View

পর্ব ১: স্মৃতির সিঁড়িতে বৃষ্টি

‎২০১৬ সালের গ্রীষ্মকাল। ঢাকা শহরের ব্যস্ত বাড্ডা এলাকায় অবস্থিত আলহাজ্ব রহীমুল্লাহ মোল্লা আলিম মাদরাসা তখনো তেমন কেউ চিনত না। কিন্তু এই মাদরাসার তৃতীয় তলার একটি ক্লাসরুমে শুরু হয়েছিল এমন এক গল্প, যার শেষ লিখেছিল সময় নিজেই।

‎তানভীর—নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থেকে সদ্য ভর্তি হওয়া এক ছেলে। ক্লাস সেভেনের নতুন ছাত্র। লাজুক, কিন্তু চোখে ছিল এক অন্যরকম গভীরতা। সেদিন দুপুরে, নামাজের পরের বিরতিতে, দ্বিতীয় তলার সিঁড়িতে আচমকাই ধাক্কা লাগে একজনের সাথে। কাঁধে হাত, চোখে চোখ।
‎—"দেখে চলতে পারো না?"
‎—"তুমি-ই তো আমার সামনে এসে পড়লে!"
‎—"হুঁ! তুমি নাকি নতুন? গ্রামের ছেলেরা এমনিই বোকা হয়।"

‎তানভীরের ভেতরে কিছু একটা কেঁপে উঠলো। সে জানত না, এই মেয়েটাই তার ভবিষ্যতের সবচেয়ে আপন নাম হয়ে উঠবে—বৃষ্টি। বৃষ্টি ছিল ঢাকাইয়া মেয়ে, চঞ্চল আর ঝাঁঝালো স্বভাবের। ওদের সম্পর্কটা শুরু হলো ঝগড়াঝাঁটির মধ্য দিয়েই। ক্লাসে দেখা হলে চোখাচোখি, বইয়ের পেছনে খোঁচা দেওয়া, আর মাঝে মাঝে কাউকে না জানিয়ে একে অপরের দিকে চেয়ে থাকা।

‎একদিন তানভীর বলেই ফেলল,
‎—"তুমি সবসময় ঝগড়া করো কেন?"
‎—"তোমাকে সহ্য হয় না, তাই!"
‎তবুয় দুজনেই জানত, এই “সহ্য হয় না” বলার মধ্যে লুকিয়ে আছে অন্যকিছু।

‎তারা ধীরে ধীরে বুঝতে পারল—ঝগড়ার মাঝে এক অভ্যাস জন্মেছে। একে অপরকে খোঁজার, বোঝার, অনুভব করার অভ্যাস।

‎কিন্তু একদিন... বৃষ্টি বলেছিল এমন একটা কথা, যা তানভীরের ভেতরটা ছিন্নভিন্ন করে দিল। সে কিছু না বলেই মাদরাসা থেকে চলে গেল। আর কারো সাথেই যোগাযোগ রাখেনি। হারিয়ে গেলো সে এক অভিমানে, এক কষ্টে।

পর্ব ২: আবেগের অজানা চিঠি

‎তানভীর চলে গিয়েছিল মাদরাসা থেকে, একদিন হুট করেই। কোনো বিদায় নেই, কারো কাছে কিছু না বলে। সবাই ভাবল, হয়তো ওর পরিবার নারায়ণগঞ্জে নিয়ে গেছে চিরতরে। কিন্তু সত্যিটা কেউ জানত না।
‎সে কষ্ট পেয়েছিল—একটা এমন কথায়, যেটা ছিল বৃষ্টির ঠোঁট থেকে বের হওয়া, কিন্তু মনে হয় হৃদয়ের গভীর গহ্বরেও পৌঁছে গিয়েছিল।

‎সেদিন বিকেলে ক্লাস শেষে, ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল তানভীর। হঠাৎ বৃষ্টি এসে বলে,
‎—“তোমার মতো ছেলেরা শুধু স্বপ্ন দেখে। বাস্তবের কোনো মূল্য বোঝে না।”
‎—“মানে?”
‎—“মানে, তুমি আমাকে পছন্দ করো জেনেও ভাবছো আমি কিছু বুঝি না? আমি তো কখনোই তোমার মতো একটা সাধারণ ছেলের সাথে কিছু কল্পনা করি না।”

‎এই কথাটা শোনার পর তানভীর আর কোনো উত্তর দেয়নি। শুধু তাকিয়ে ছিল বৃষ্টির চোখে—নীরব, বিস্মিত, হতবাক। তার দৃষ্টিতে কোনো অভিশাপ ছিল না, ছিল শুধু একরাশ ভাঙনের শব্দ।

‎সেদিন রাতেই সে সিদ্ধান্ত নেয়, আর থাকবে না এখানে।
‎নিজের এলাকায়, মাদরাসা থেকে ফিরে গিয়েছে নীরবে, নিঃশব্দে নিজের মতো করে কষ্ট পুষে রেখে।

‎তবে বৃষ্টির গল্প এখানেই থেমে যায়নি।

‎তানভীর চলে যাওয়ার পর হঠাৎ করেই বৃষ্টি যেন বদলে গেল। আগের সেই হাসিখুশি, ঝগড়াটে মেয়েটা আর নেই। চুপচাপ, মনমরা হয়ে থাকত। ক্লাসে একদিন হালকা সর্দি ছিল বৃষ্টির, বইয়ের ভেতরে একটা পুরোনো চিঠি বের হয়ে এলো।
‎মেয়েরা হাসতে হাসতে পড়ে ফেলল—

‎> "তুমি যদি কোনোদিন হারিয়ে যাও, আমি জানব—তোমার অভিমান আমার কথার জন্য। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি কেবল ভয় পেয়েছিলাম… তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছি বুঝে। আমি যদি সত্যি ভালোবাসি, সেটা কখনো জোরে বলতে পারব না। শুধু চোখে লিখে যাবো—তুমি আমার মেঘ হয়ে থেকো আজীবন…"



‎সবাই চুপ।
‎তখনো কারো জানা ছিল না, বৃষ্টি এই চিঠি লিখে গিয়েছিল পরের দিন তানভীরের বইয়ের ভেতরে রেখে দেয়ার জন্য। কিন্তু তানভীর তো সেইদিনই চলে যায়...

‎পর্ব ৩: ভালোবাসার শূন্য দশক, অচেনা গন্তব্য

‎সময়ের স্রোতে ২০১৬ অনেক দূরে সরে গেছে।
‎তানভীর সেই অভিমানী ছেলেটা থেকে এখন বদলে গেছে—দৃঢ়, পরিণত, আত্মবিশ্বাসী। নয় বছরের মধ্যে জীবনের সব কষ্ট, অভাব, আর স্মৃতিকে পেছনে ফেলে সে নিজেকে গড়ে তুলেছে।
‎আজ সে একজন সফল ফ্রিল্যান্সার—গ্রাফিক ডিজাইন আর ওয়েব ডেভেলপমেন্টে তার দক্ষতার জন্য বিদেশি ক্লায়েন্টদের কাছে পরিচিত নাম। তবুও তার ভেতরে এক শূন্যতা রয়ে গেছে… যার নাম বৃষ্টি।

‎২০২৫ সালের এক শুক্রবার সকালে তানভীর ঠিক করল, নিজের জন্য একটি হাই-এন্ড কম্পিউটার কিনবে। অনলাইনে খোঁজ করে জানল, ঢাকার নিউ এলিফেন রোডের সুবাস্ত আইসিটি ভবনেই পাবে সেরা কনফিগারেশনের পিসি।
‎দুপুরে ব্যাগ কাঁধে, শার্ট-প্যান্টে গম্ভীর ভঙ্গিতে সে পৌঁছাল ভবনের নিচে।

‎ভবনের ভেতরে ঢুকতেই ভিড়ের ভেতর এক ধরনের নস্টালজিয়ার গন্ধ পেল—যেন এই শহরের কোনো না কোনো জায়গায় বৃষ্টি লুকিয়ে আছে, শুধু দেখা হওয়ার অপেক্ষায়।

‎লিফটে ওঠার আগে ফোনে বিক্রেতাকে কল দিচ্ছিল তানভীর। হঠাৎ পাশ দিয়ে হালকা বাতাস এসে গালে ছুঁয়ে গেল। চোখ তুলে তাকাতেই…

‎একটা মেয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া, হাতে ল্যাপটপ ব্যাগ, চুলে হালকা বাতাসের খেলা, চোখে পরিচিত সেই দীপ্তি।
‎তানভীরের বুক ধক করে উঠল—বৃষ্টি!

‎নয় বছর পর, একই শহরে, হঠাৎ এই দেখা…
‎কিন্তু সে কি তাকে চিনবে?

‎তানভীর থমকে দাঁড়াল।
‎বৃষ্টি কিছু বুঝে না বুঝেই পাশ কাটিয়ে লিফটে ঢুকে গেল। দরজা বন্ধ হওয়ার ঠিক আগে, তাদের চোখে চোখ পড়ল…
‎আর সেই চোখের গভীরে তানভীর যেন ফিরে গেল ২০১৬ সালের দ্বিতীয় তলার সেই সিঁড়িতে।

‎‎পর্ব ৪: হঠাৎ দেখা, সুবাস্ত আইসিটি ভবন

‎লিফটের দরজা আবার খুলল।
‎বৃষ্টি নামতে যাচ্ছিল, তানভীরও পিছন থেকে পা বাড়াল। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের জন্য দুজনের চোখ একে অপরের দিকে আটকে রইল।

‎তানভীর প্রথমেই ভাঙল নীরবতা—
‎—"তুমি... বৃষ্টি, তাই তো?"

‎বৃষ্টি থমকে দাঁড়াল। বিস্মিত চোখে তাকাল, যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না।
‎—"তানভীর? তুমি এখানে?"

‎তানভীর হালকা হাসল।
‎—"হ্যাঁ, কম্পিউটার কিনতে এসেছি। ভাবিনি, এখানে তোমাকে দেখব।"

‎বৃষ্টি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‎—"তুমি তো... পুরো বদলে গেছো। আগে যে চুপচাপ ছেলেটা ছিলে, এখন দেখছি আত্মবিশ্বাসে ভরা। কী করো এখন?"

‎তানভীর চোখে হালকা গর্বের ঝিলিক এনে বলল,
‎—"ফ্রিল্যান্সিং করি। সময় আর জীবন বদলে গেছে, কিন্তু কিছু স্মৃতি এখনো আগের জায়গায় আটকে আছে।"

‎বৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্য চোখ নামিয়ে নিল।
‎—"তুমি সেইদিন চলে গেলে, একবারও জানালে না কেন?"

‎তানভীর গম্ভীর গলায় উত্তর দিল,
‎—"কারণ, আমি ভেবেছিলাম... তুমি তো বলেছিলে আমার মতো ছেলেরা শুধু স্বপ্ন দেখে। তখন বুঝিনি, সেই কথার পেছনে অন্য কিছু লুকিয়ে ছিল।"

‎বৃষ্টির ঠোঁট কাঁপল।
‎—"হ্যাঁ, ছিল… কিন্তু তুমি বলার সুযোগ দেওনি।"

‎তাদের মধ্যে আবারও নীরবতা নেমে এলো। চারপাশে মানুষের ভিড়, কম্পিউটারের দোকানের ডাকাডাকি, কিন্তু তাদের কাছে যেন সেই মুহূর্তে সবকিছু থেমে গেছে।

‎ঠিক তখনই, বৃষ্টি নিজের ল্যাপটপ ব্যাগ থেকে একটা পুরোনো নীল খাম বের করে তানভীরের হাতে দিল।
‎—"এটা রাখো। এটা সেই চিঠি... যেটা তুমি কখনো পাওনি।"

‎তানভীর খামটা হাতে নিয়ে অবাক চোখে তাকাল।
‎খামের ওপরে শুধু একটা লাইন লেখা—
“তুমি আমার মেঘ হয়ে থেকো আজীবন…”

‎পর্ব ৫: শেষ প্রহরে ফিরে দেখা

‎তানভীর নীরবে খামটা খুলল। ভেতরে একটি সাদা পাতায় বৃষ্টির হাতের লেখা—হালকা বাঁকা অক্ষর, কিন্তু প্রতিটি লাইনে যেন জমে থাকা আবেগের ভার।
‎> "তুমি যদি কোনোদিন হারিয়ে যাও, আমি জানব—তোমার অভিমান আমার কথার জন্য। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি কেবল ভয় পেয়েছিলাম… তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছি বুঝে। আমি যদি সত্যি ভালোবাসি, সেটা কখনো জোরে বলতে পারব না। শুধু চোখে লিখে যাবো—তুমি আমার মেঘ হয়ে থেকো আজীবন…"। 
‎বিশ্বাস কর তানভীর, আমি তোমাকে প্রথম দিন থেকেই অনুভব করেছি। শুধু ভয় পেয়েছিলাম… হয়তো তুমি আমার জীবনে স্থায়ী হবে না। সেই ভয়েই সেদিন কঠিন কথা বলেছিলাম।"

‎"তুমি স্বপ্ন দেখা মানুষ নও, তুমি সেই স্বপ্ন… যেটাকে আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে চাই।"

‎পড়তে পড়তে তানভীরের চোখ ভিজে গেল। নয় বছরের অভিমান, কষ্ট আর দূরত্ব যেন মুহূর্তেই গলে গেল।

‎বৃষ্টি নিচু গলায় বলল,
‎—"আমি জানি, অনেক দেরি হয়ে গেছে। হয়তো তুমি এগিয়ে গেছো… তবুও ভাবলাম, চিঠিটা তোমার কাছে থাকা উচিত।"
‎তানভীর গভীরভাবে তার দিকে তাকাল।
‎—"বৃষ্টি, আমি অনেক দূর এগিয়েছি জীবনে, কিন্তু তোমার থেকে কখনো এগিয়ে যেতে পারিনি। তোমাকে ভুলে থাকার ভান করেছি, কিন্তু প্রতিদিনই তোমাকে মনে করেছি।"
‎বৃষ্টি চোখে জল নিয়ে হাসল।
‎—"তাহলে এখন?"
‎তানভীর হাত বাড়িয়ে তার হাতের উপর রাখল।
‎—"এখন আর হারিয়ে যেতে দেব না। এবার আমরা ভয়কে দূরে রেখে বাকি পথটা একসাথে হাঁটব।"

‎বৃষ্টি কিছু বলল না, শুধু মাথা নিচু করে হাতটা শক্ত করে ধরল।
‎ক্যাফেটেরিয়ার জানালা দিয়ে ঢাকার ব্যস্ত রাস্তা দেখা যাচ্ছিল—গাড়ির শব্দ, মানুষের ভিড়, কিন্তু তাদের কাছে সেই মুহূর্তে সবকিছু থেমে গিয়েছিল।

‎এইবার কোনো অভিমান, কোনো দূরত্ব, কোনো চিঠি মাঝখানে থাকল না।
‎শুধু দুটি হাত, একটি প্রতিশ্রুতি—
‎"তুমি আমার বৃষ্টি হয়ে থেকো আজীবন…"

‎সমাপ্তি
‎"স্মৃতির সিঁড়িতে বৃষ্টি"—এটি ছিল এক পবিত্র ভালোবাসা, স্বপ্ন ও অপেক্ষার গল্প। তানভীরের জীবনে বৃষ্টি এসেছিল হঠাৎ করেই, আর বিদায় নিয়েছিল নীরবে, রেখে গিয়েছিল অসংখ্য অমলিন স্মৃতি। ২০২৫ সালের সেই নিউ এলিফ্যান্ট রোডের সুবাস্ত আইসিটি ভবনে দেখা হওয়ার পর তাদের গল্প যেন নতুন মোড় নেয়, কিন্তু জীবন সবসময় আমাদের ইচ্ছেমতো চলে না।
‎তাদের গল্প শেষ হলেও স্মৃতির সিঁড়িতে বৃষ্টির পদচিহ্ন চিরকাল রয়ে যাবে তানভীরের হৃদয়ে।

‎📌 নোট: এটি একটি কাল্পনিক কাহিনি। কোনো ব্যক্তি, স্থান বা ঘটনার সাথে মিল পাওয়া গেলে তা সম্পূর্ণ কাকতালীয়।

‎✍ লেখক: তানভীর খান
‎📚 নরসিংদী সরকারি কলেজ, অনার্স ফার্স্ট ইয়ার
‎🏡 গ্রাম: দুপ্তারা কুমারপাড়া
‎উপজেলা: আড়াইহাজার, জেলা: নারায়ণগঞ্জ

Comments

    Please login to post comment. Login

  • Kazi Eshita 3 months ago

    নিউ এলিফেন রোড নয় নিউ এলিফাণ্ট রোড । ভালো লাগলো