ঢাকা শহরের ভোরটা এক অদ্ভুত। রাস্তায় তখনো পূর্ণ ট্রাফিক জ্যাম জমেনি, দোকানগুলো আধা-খোলা, চা-স্টল থেকে ভেসে আসছে গরম ধোঁয়া আর আদার ঘ্রাণ।
সেই ভোরেই রিকশায় চেপে যাচ্ছিল নীলিমা। হাতে একটা পুরোনো খাম—ধুলো জমা, একটু কুঁচকানো, আর তার ওপরে লেখা—"রিয়াদ, যদি কখনো দেখা হয়"।
নীলিমার মুখে উদ্বেগের ছাপ। পাঁচ বছর ধরে এই খামটা সে নিজের কাছে রেখেছে। কখনো খোলেনি। খুলতে চেয়েও পারেনি। খামের মালিক রিয়াদ—তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু, যার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে। তারপর রিয়াদ হঠাৎ হারিয়ে যায়, কোনো চিঠি, ফোন বা খবর ছাড়াই।
পাঁচ বছর আগে…
ঢাকার এক বর্ষার বিকেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল ইটের করিডোর ভিজে চকচক করছে। নীলিমা আর রিয়াদ ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছিল।
রিয়াদ হঠাৎ বলল—
"নীলিমা, যদি আমি একদিন হঠাৎ হারিয়ে যাই, তুমি কি আমাকে খুঁজবে?"
নীলিমা হেসে বলেছিল—"তুমি সিনেমার ডায়লগ মারছ নাকি?"
রিয়াদ কিছু বলল না, শুধু খামটা এগিয়ে দিল।
"যেদিন বুঝবে, আমার খোঁজ পাওয়া দরকার—সেদিন এটা খুলো।"
নীলিমা হেসে খামটা ব্যাগে রাখল। জানত না যে সেটাই হবে তাদের শেষ কথা।
আজ নীলিমা সেই খাম নিয়ে যাচ্ছে কমলাপুর স্টেশনে। রিয়াদের এক পুরোনো বন্ধু, সোহান, গত সপ্তাহে হঠাৎ ফোন দিয়ে জানিয়েছে—
"রিয়াদকে চট্টগ্রামে দেখেছি। ও খুব অসুস্থ।"
এই খবর পাওয়ার পর থেকেই নীলিমা যেন ঘুমাতে পারছে না। ভোরের ট্রেনে চড়ে সে রওনা হবে চট্টগ্রাম।
ট্রেনের সীটে বসে নীলিমা খামের দিকে তাকিয়ে থাকে। খোলার লোভ হচ্ছে, কিন্তু মনে হচ্ছে—না, এই চিঠি রিয়াদের সামনেই খোলা উচিত।
ট্রেনে নীলিমার পাশে বসা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক কথা বলতে শুরু করলেন।
"মেয়ে, তোমার মুখে কেমন যেন চিন্তার ছাপ দেখছি। কারো কাছে যাচ্ছ?"
নীলিমা হেসে বলল—"হ্যাঁ, অনেকদিনের হারানো এক বন্ধুর কাছে।"
বৃদ্ধ বললেন—"বন্ধুদের কাছে যাওয়া সবসময়ই ভালো, কিন্তু মনে রেখো, মানুষ বদলায়। পাঁচ বছর আগের মানুষ হয়তো আজকে আর আগের মতো নেই।"
এই কথাটা নীলিমার মনে কাঁটার মতো বিঁধল।
দুপুরের দিকে ট্রেন পৌঁছাল চট্টগ্রাম স্টেশনে। সোহান সেখানে অপেক্ষা করছিল।
"চল, আমি নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এক কথা বলি—রিয়াদ এখন আগের মতো নেই। খুব শান্ত, কম কথা বলে। আর… ডাক্তার বলেছে, সময় খুব বেশি নেই।"
নীলিমার বুকের ভেতর কেমন যেন ধাক্কা লাগল। এতদিনের অপেক্ষা, এতদিনের রহস্য—এখন কি ভেঙে পড়বে?
সন্ধ্যার দিকে তারা পৌঁছাল সমুদ্রের ধারে ছোট্ট এক কুঁড়েঘরে। ভেতরে বিছানায় শুয়ে আছে রিয়াদ—শরীর শুকিয়ে গেছে, চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে অদ্ভুত শান্তি।
রিয়াদ নীলিমাকে দেখে মৃদু হাসল—
"তুমি এসেছ… আমি জানতাম তুমি আসবে।"
নীলিমা চোখের জল আটকাল—"রিয়াদ, তুমি কোথায় ছিলে এতদিন?"
রিয়াদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল—"চিঠিটা খুলো।"
নীলিমা খাম খুলল। ভেতরে এক পৃষ্ঠা, কালি একটু ফিকে হয়ে গেছে। লেখা—
"নীলিমা,
যদি কখনো এই চিঠি তোমার হাতে খোলো, জানবে আমি আর আগের মতো নেই। আমি জানতাম, আমার রোগ আমাকে ধীরে ধীরে শেষ করবে। তোমাকে বলতে চাইনি—তুমি যেন তোমার জীবন নিয়ে এগিয়ে যাও।
যদি একদিন মনে হয় আমাকে খুঁজে পাওয়া দরকার, তবে এসো… হয়তো তখনো আমার কিছু কথা বাকি থাকবে।"
নীলিমার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।
"তুমি কেন বলোনি?"
রিয়াদ হাসল—"তোমাকে কাঁদাতে চাইনি।"
সেই রাতে সমুদ্রের ধারে বসে তারা দু’জন সূর্যাস্ত দেখল। ঢেউয়ের শব্দে কথা হারিয়ে যাচ্ছিল। রিয়াদ বলল—
"জানো, সূর্যাস্তও আসলে এক ধরনের প্রতিশ্রুতি। আজ বিদায় নিলেও, কাল আবার ফিরবে।"
নীলিমা শুধু হাত ধরে রইল।
কয়েক সপ্তাহ পর রিয়াদ চলে গেল—শান্তভাবে, সমুদ্রের শব্দের মতোই নীরবে।
পাঁচ বছর পরে নীলিমা আবার চট্টগ্রামে এল। সেই কুঁড়েঘর নেই, কিন্তু সমুদ্র আছে।
হাতে এক নতুন খাম—এবার নীলিমা লিখেছে রিয়াদের জন্য, যদিও সে জানে, রিয়াদ আর পড়তে পারবে না। খামটা সমুদ্রের জলে ছেড়ে দিয়ে সে মনে মনে বলল—
"বিদায় নয়, রিয়াদ। এটা শুধু আবার দেখা হওয়ার আগের বিরতি।"
ঢেউ এসে খামটাকে দূরে নিয়ে গেল, যেমন একদিন সময় নিয়ে গিয়েছিল রিয়াদকে। কিন্তু এইবার নীলিমা জানে—কিছু মানুষ হারিয়ে গেলেও হৃদয়ের সমুদ্র থেকে কখনো হারায় না।