Posts

নন ফিকশন

মাছ ধরার গল্প

August 17, 2025

সাজিদ রহমান

142
View

কী সব কাণ্ডই না ঘটেছিলো। মাছ ধরে বের হওয়ার সময় নিরাপত্তা বাহিনী আটকে দেয় আমাদের। রীতিমত হাজতখানায় তালা দিয়ে রাখে। তখন স্কুলে পড়ি। বাড়ির পাশে রেলওয়ের ডিজেল ওয়ার্কশপ। ভিতরে অনেক বড় জলাশয়। পাশে কয়েকটা ছোট খাল। অনেক ছোটবেলা থেকেই মাছ ধরার নেশা ছিল। পাড়ার ছেলেরা মিলে মাছ ধরতে বের হতাম। ছিপ, জাল দিয়ে নয়, আমরা পানি সেচে মাছ ধরতাম। 

একদিনের কথা। আমরা ৮/১০ জন বের হলাম। টার্গেট ওয়ার্কশপের একটা ছোট খাল সেচে মাছ ধরবো। সেই মাছ দিয়ে হবে পিকনিক। কিন্তু ঐদিন ভাগ্য আমাদের সহায়ক ছিলোনা। আমাদের দুইটা ভুল হয়। প্রথমত ভেবেছিলাম পানি খুব বেশি হবে না। কিন্তু সেচতে গিয়ে দেখি, পানি শেষ হয় না। সেটাও ব্যাপার ছিল না, যদি মাছ বেশি পাওয়া যেত। মাছের বেলা লবডংকা। সবাই হতাশ। সবাই মন খারাপ করে ফিরছি। এ সময় রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী আমাদের আটকে দেয়। অনুমতি ছাড়া সেখানে ঢোকা নিষেধ। গেটে বড় করে লেখা। এমনিতে আমার বন্ধুদের বেশির ভাগই ছিল রেলের কর্মচারির ছেলে। সেই ভরসায় আগেও অনুমতি ছাড়া ভিতরে গেছি, আসছি। কিন্তু সেদিন ছিল গৃহস্থের সেই দশম দিন। কয়েক জন ছিল বেশি ছোট, ওরা বেশ কান্নাকাটি করে। এরপর গার্ডিয়ান এলে আমাদের ছেড়ে দেয়। 

২। 

কিছু ঘটনা খুব মনে থাকে। ১৯৮৮ সালের বন্যা। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা আঘাত করেছে। সারাদেশে ভয়াবহ সংকট চলছে। এরশাদ সাহেব হেলিকপ্টারে চড়ে সারা দেশে দৌড়াচ্ছেন। কোমর পানিতে নেমে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে। তখন জানতাম, যারা দেশের প্রধান হন, তাদের নাম হয় এরশাদ। যা হোক, এরই মধ্যে মাছ ধরারও ধুম লেগেছে। কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। প্রায় প্রতি ঘর থেকে মাছ ধরতে বের হয়েছে। আব্বাও জাল নিয়ে বের হন,সাথে মাছ রাখার পাত্র নিয়ে আমি। স্টেশনের আগে রেলক্রসিং কালভার্ট দিয়ে হু হু করে পানি আসছে। যেকোন সময় ভেঙ্গে চুরে যেতে পারে। বিভিন্ন পুকুর খালের পানি সেখান দিয়ে চলে যাচ্ছে। সেই কালভার্টের মুখে জাল ফেললেই বড় বড় মাছ। জালে খলবলিয়ে উঠছে। আব্বা একের পর এক পাকে মাছ উঠাচ্ছেন, আমি ব্যাগে ঢুকাচ্ছি। একটা সময় ব্যাগ বহন করাই কঠিন হয়ে পড়ে। চোখের সামনে এখনও জ্বলজ্বল করছে সেই দিন। 

৩। 

আরও আগে আমরা গ্রামে থাকতাম। বর্ষা কাল। বৃষ্টি শুরু হলে থামার লক্ষণ ছিল না। চারিদিকে পানি থই থই করে। জমি লাঙ্গল দেয়া শেষ। মই দেয়া শুরু হলে গ্রামের ছেলে মেয়েরা মইয়ের পিছন পিছন দৌড়। মই দিলেই কই মাগুর শিং পুয়া টাকি মাছ ভেসে উঠে। যে ধরতে পারবে মাছ তার। মাছ ধরতে গিয়ে কত হুটোপুটি। পড়ে গিয়ে কাঁদায় মাখামাখি। বাড়ি থেকে মানুষ হিসেবে বের হয়ে ভূত হয়ে ঘরে ফেরা। ভূতের হাতে মাছের পোটলা। এখন সেই গ্রামে বর্ষাকালেও জমিতে পানি নেই। ভুগর্ভে পানি নেই। নিজেদের প্রয়োজনে প্রকৃতির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছি আমরা। 

৪। 

পার্বতীপুর বদরগঞ্জ সড়ক ধরে পাশে নিচু জমি। বছরের অন্যান্য সময় অল্প পানি থাকে। কিন্তু বর্ষা এলেই পানিতে টইটুম্বর হয়ে থাকে। বর্ষাকালের শেষের দিক। আমি ও শহীদুল ভাই মাছ ধরতে গেছি। শহীদুল ভাই পুকুরে ডুব দিয়ে মাছ ধরত। মাছের আবাস কোথায় হতে পারে, এ বিষয়ে ভাই খুব দক্ষ। ভাইয়ের পিছনে পিছনে ঘুরছি। শহীদুল ভাই হেটে হেটে দেখছে। এখনকার যুগের ভাষায় বলা যায়, ফিজিবিলিটি স্টাডি করছে। 

একটা নিচু জমি দেখিয়ে বলে, আয় এটা সেচি। বলে থাল বের করে সেঁচা শুরু করে। আমি বেশ ছোট। যতটুকু পারি অবদান রাখার চেষ্টা করি। অনেক পানি। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। শহীদুল ভাই চারদিকের আইল চেক করে নিলো। কোন পাশ দিয়ে পানি ঢুকতেছে কিনা। ঐ দিনের মত মাছ ধরা মুলতবি রেখে আমরা বাসায় চলে যাই। শহীদুল ভাইয়ের কথা মত খুব ভোরে সেখানে যাই। বাকি পানি সেচতে হবে। তখনও পানি সেঁচা শেষ হয়নি। আমার চোখ আনন্দে চকচক করতে লাগলো। টাকি মাগুর শিং কই পুয়া পুঁটি মাছ খলবল খলবল করতে শুরু করেছে। পানি কমছে, মাছের চাঞ্চল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। তখনও সুর্য উঠেনি। কিন্তু দেখতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। 

অল্প জায়গায় এত মাছ কোনদিন দেখিনি। শুধু মাছ আর মাছ। দুই ভাই মিলে ধরতে থাকি। ধরতে ধরতে ক্লান্ত হওয়ার যোগাড়। মাছ ধরা প্রায় শেষ। দুই একজন মানুষ আসা শুরু করেছে। আমরা দেরি করি না। প্রায় ১২/১৪ কেজি মাছ নিয়ে বাড়িতে ফিরি। মাছ ধরে এরকম আনন্দ আর কখনও পাই নি। 

৫। 

চাচা পুলিশে চাকরি করেন। পোস্টিং রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলায়, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে। ছুটিতে এসেছিলেন, ফেরার সময় আমিও  সাথে গেলাম। ১৯৯২ সালের ঘটনা। ট্রেনে করে চট্টগ্রাম পৌছালাম। কাপ্তাই থেকে ট্রলারে প্রায় ৩ ঘণ্টার জার্নি। লেকের দুদিকের সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে উঠি। আমরা যারা উত্তরের মানুষ, মূলত ডাঙ্গায় বাস করি, জলের কুমির, উঁচু পাহাড়, কোনটাই দেখার অভিজ্ঞতা নেই। সেকারণে ভালো লাগার শেষ ছিলোনা। কাপ্তাই লেকের জলে শ্যালো মেশিনের ভটভট শব্দের সাথে পানি সরে গিয়ে গিয়ে বিলাইছড়ি পৌছাই।  

বিলাইছড়ি মূলত পাহাড়ি টিলা। সেই টিলার ফাকে ফাকে বাসা। একটু বড় সমতল জায়গা জুড়ে ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার। দূরে অনেক বড় উঁচু পাহাড়। নিচে নামলে কাপ্তাই লেক। চাচাত ভাই জুয়েল, আমার চেয়ে বয়সে ছোট, কিন্তু দস্যিপনায় সিদ্ধহস্ত (এখনকার যুগ অনুযায়ী মাষ্টার মাইন্ড শব্দ বেশ খাপ খায়) । সেখানে প্রায় মাস খানেক ছিলাম। পূরাটা সময় এদিক ওদিক ছুটাছুটি করে বেড়িয়েছি। 

একদিন আমাকে বললো, চলেন আজকে মাছ ধরবো। শোনামাত্রই হ্যাঁ বলে দিলাম। আমার কোন কাজ নেই। ওর সাথে তাল দেয়া ছাড়া। টিলা থেকে নিচে নেমে এলাম। ঘাট। সারি সারি নৌকা বাঁধা। জুয়েল একটা নৌকা খুলে ফেলে। বৈঠা মেরে ভিতরের দিকে যাই। এর আগে আমি কখনও নৌকার বৈঠা মারিনি। আস্তে আস্তে শিখে নেই। 

একটা খাড়ির নিচে কয়েক জন পুলিশ কাকা জাল টেনে ধরছে। কচুরিপানাসহ জালে উঠছে বড় বড় মাছ। এত সহজে এত মাছ ধরা যায়, কল্পনাতেও ছিলো না। আমরাও যোগ দেই। বড় বড় মাছ কোলে নিয়ে উপরে উঠি। এখনও চোখ বন্ধ করলে সেই মাছ ধরার দৃশ্য দেখতে পাই।                  

      

আগস্ট ২০২৫  

Comments

    Please login to post comment. Login