Posts

গল্প

অব্যক্ত প্রেম

August 22, 2025

Zihad Sheikh

156
View

গত দুইদিন হলো সাবরিন কলেজে আসেনি। আজ কলেজে তার মা' ফোন করেছিলেন। সাবরিন খুব অসুস্থ। প্রচন্ড জ্বর, সাথে বমি। তাকে স্যালাইন দিয়ে রেখেছে। ফরম শিক্ষক যখন এসে এই খবরটি জানালেন, পুরো ক্লাস স্তব্ধ হয়ে গেল।

সবাই ফিসফিস করছে। কিন্তু কেউই জোরে কথা বলছে না। আড় চোখে নাঈমের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। তার দিকে তাকালেই সে হাতে যা পাবে তাই হয়ত ছুঁড়ে মারবে!

সাবরিন সবার খুব ভাল বন্ধু। খুবই মিশুক প্রকৃতির মেয়ে। সদা হাস্যজ্বল ও প্রাণচঞ্চল। পুরো ক্লাস মাতিয়ে রাখে। ক্লাসমেট, জুনিয়রদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও তাকে খুব পছন্দ করেন। এমনকি কালেভদ্রে আসা মিলিটারি প্রিন্সিপালও তার নাম জানেন। কলেজের  যে কোনো প্রোগ্রামে সবার আগে যার নাম আসে, সে হলো সাবরিন। এবং গত বছর একক প্রতিযোগীতার প্রায় সব পুরস্কারই সে জিতে নিয়েছে। তাই এমন একজনের অসুস্থতায় সবার মাঝেই স্তব্ধতা নেমে আসাই স্বাভাবিক।

সাবরিন সবার পছন্দের পাত্রী হবার পরেও একজনের চক্ষুশূল। সে হলো নাঈম। নাঈমের সাথে তার দা-কুমড়ো সম্পর্ক। গত দেড় বছরে কেউ তাদের মাঝে সম্পর্ক ভাল করতে পারেনি। শিক্ষকরাও চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেননি। শিক্ষকদের সম্পর্ক উন্নোয়নে এগিয়ে আসার কারণ, নাঈমের বিরুদ্ধে সাবরিনের করা শত শত অভিযোগনামা। তারাও এর বিচার করতে করতে ক্লান্ত। নাঈমের ক্যান্টিন থেকে বাঁকি খাওয়া, গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়া কিংবা ক্লাস ফাঁকি দেওয়া সবকিছুতে কারো কোনো অভিযোগ না থাকলেও, সাবরিন সবগুলোতেই তার নামে নালিশ করবে ইনচার্জের কাছে।

ওদের প্রথম দেখা হয়েছিলও একটি ঝামেলার মাধ্যমে। নাঈম একই স্কুল থেকে কলেজে ভর্তি হলেও, সাবরিন এসেছিল অন্য স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে। যেদিন সাবরিন কলেজে ভর্তি হতে এসেছিল ওর মা'য়ের সাথে, সেদিন নাঈমও ছিল। ওদের প্রথম দেখা হয় ক্যান্টিনে। নাঈম মেয়েদের অংশে দাঁড়িয়ে খাবার কিনছিল। অবশ্য তখন সেটা ফাঁকা ছিল। ঠিক তখন সাবরিনও খাবার কিনতে গিয়েছিল। নাঈমকে মেয়েদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাবরিন ভীষণ চটে গিয়েছিল। 

নাঈমের সামনে দাঁড়িয়ে সে বলেছিল, 'চোখে কম দেখেন নাকি পড়তে পারেন না? উপরে যে ছাত্রী লেখা, আজই শেষবার বলে দিলাম। সরুন।'

বলার অপেক্ষা রাখে না, নাঈমের অভিব্যক্তি তখন কেমন ছিল। কিছুটা সিংহের ডেরায় এসে সিংহকে শাসানো। প্রতিশোধ নিতে নাঈম বেশি দেরি করে নাই৷ বার্গার হাতে নিয়ে খেতে খেতে যাবার সময় ক্যান্টিনের চেয়ারে বসে থাকা সাবরিনের পা মাড়িয়ে দিয়েছিল।

‘আহা, চোখে পড়ে নাই লম্বা পা' টা। আর পা'টাকেও একটু সঠিক জায়গায় রাখা দরকার। এটা নিশ্চয় ড্রইং রুম নয়!' এমনটাই বলেছিল নাঈম।

মেয়ের পাশে বসা ডাক্তার মা' বিষয়টা ভালভাবেই লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি মুচকি হেসে কুশল বিনিময় করেছিলেন এবং পরিচিত হয়েছিলেন নাঈমের গ্যাং-এর সাথে।

বিজ্ঞান শাখায় চারটা ফরম বা ক্লাসরুম থাকলেও কাকতালীয় ভাবে সাবরিন নাঈমের সেকশনেই পড়েছিল। নাঈম আগে থেকেই প্ল্যান করেছিল 'বি' ফরমে তার কাছের বন্ধুদের রাখতে৷ কিন্তু শত্রুও যে পড়ে যাবে, তা সে ভাবেনি। যথারীতি তাদের যুদ্ধ চলতেই থাকে। সবাই এটাকে শত্রুতার মত দেখলেও, অনেকেই এটাকে ভালোবাসার সম্পর্ক ভাবে। সাবরিনের দরদ ভরা নয়নে নাঈমের প্রতি যথেষ্ঠ দূর্বলতা আছে। এটা সাবরিন হয়ত কখনোই বুঝতে দেয়নি। কিন্তু নাঈমের ভেতরে অনুভূতির কোনো ছিটেফোঁটাও নাই। সে এই ধাতেরই না।

আজ তাই সবাই নাঈমের দিকে তাকাতে চাচ্ছিল এটা দেখার জন্য যে, সে কি ভাবছে। কোনো দূর্বলতা চোখে পড়ে কিনা। কিন্তু না, সে তার বাউণ্ডুলেপনা করেই চলেছে। 

টিফিন পিরিয়ডে সবাই একজোট হয়ে সিদ্ধান্ত নিলো আগামীকাল বিকেলে সাবরিনকে দেখতে যাবে। মিটিংয়ে নাঈম ছিল না। সে তখন আমতলা বসে আড্ডা দিচ্ছিল বন্ধুদের সাথে। 

সবাই মিলে জীবনকে পাঠালো নাঈমকে বিষয়টা জানানোর জন্য। নাঈমের কাছে গিয়ে জীবন বলল,
'সবাই তো কালকে সাবরিনকে দেখতে যেতে চাচ্ছে। যাবি তুই?

'সবাই কই? আমার সাথে তো বারোজন বসে আছে। তারা তো কিছু জানায়নি?' নাঈমের সপাট জবাব।

'তুই গেলে ওরাও যাবে। চল না যাই। সে হয়ত অনেক অসুস্থ ' জীবনের কথায় মনেহয় না নাঈম নরম হলো। বরং বলল,

'তোর যাবার দরকার হলে, তুই যা। বিরক্ত করিস না।'

জীবন গোমরা মুখে ফেরত আসলো মেয়েদের কাছে। সবাই ঠিক করলো আজই কলেজ শেষে কলেজ বাসে করে সাবরিনকে দেখতে যাবে। কিছুটা নাঈমের উপর জেদ থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া।

সেইদিন রাতে জীবনের সেলফোন বেজে উঠলো। নাঈম ফোন দিয়েছে। সে তড়িৎ গতিতে ফোনটা ধরলো।

'গিয়েছিলি দেখতে? কি অবস্থা ওর?' ওপাশ থেকে নাঈম বলল।

'না, যাইনি' জীবন ধীরে বলল। কিছুক্ষণ নীরবতা।

তারপর নাঈম বলল, 'কাল শুক্রবার। সকাল এগারোটায় যাবি। জুম'আ নামাযের পর আমাকে আপডেট জানাবি'

'আমার সাথে চল। ও তোকে দেখলে খুশী হবে।'

'যা বলি সেটাই কর' বলেই ফোনটা রেখে দিল নাঈম।

ফোনটা রেখে ঘড়ি দেখলো জীবন। রাত নয়টা বাজে। এখন সাবরিনকে ফোন দেয়া যায়। ওর মা' ধরতে পারে। যেই ধরুক, ওর জন্য সু-খবর আছে। আগামীকাল নাঈম ওকে দেখতে যাবে! কিন্তু রাতটা সাবরিনর অস্থিরতায় কাটবে ভেবে সে আর ফোন দিলো না।

সাবরিনের মা' দেখলেন সকালে ফোনটা আসার পর থেকে তার মেয়ে অনেক অস্থির হয়ে গেছে। বিছানা থেকে উঠে নিজেই তার রুমটা পরিস্কার করছে৷ কাজের মেয়েটা তাকে সাহায্য করছে তবুও তার পছন্দ হচ্ছে না। সে নিজেও হাত লাগাচ্ছে।

বিছানার চাদর পাল্টানো হয়েছে, জানালার পর্দা গোছানো হয়েছে, ড্রেসিং টেবিল ও পড়ার টেবিল সাজানো হয়েছে এবং কাজের মেয়েটা রুমটাও মুছে দিয়েছে। এখন তার সামনে এসে মেয়েটা হাঁপাচ্ছে। 

'মা' কখন রান্না শুরু করবা? সাবরিন চেয়ারে বসতে বসতে বলল।

'এখনই করব মা'। কিন্তু তোমার এভাবে উঠে আসা তো ঠিক হয়নি'

'এখন অনেক ভাল লাগছে মা'। একটু পায়েশ রান্না করবা?' সাবরিনের ভালই জানা আছে নাঈম পায়েশ খুব পছন্দ করে। সে কিভাবে জানলো, এটার পেছনেও একটা ঘটনা আছে। এখন তার মা' পায়েশের আবদারের পেছনে অন্য কিছু বুঝতে পারলো কিনা সেটা ভেবে কিছুটা লজ্জা পেল সাবরিন।

একাদশ শ্রেণীতে থাকতে ক্লাস পার্টিতে এক তুলকালাম কান্ড ঘটেছিলো৷ ক্লাস পার্টির নিয়ম ছিলো প্রত্যেকেই বাসা থেকে কিছু খাবার আনবে এবং পুরো ক্লাসের সবাই ভাগ করে খাবে৷ ক্লাস পার্টির দিনে নাইমকে কলেজে খালি হাতে ঢুকতে দেখেছিলো সাবরিন৷ নাইমকে ছোটো করার এই সুযোগটা সে আর ছাড়তে চায়নি। সে অপেক্ষা করছিলো সঠিক সময়ের।

অনেকেই একাধিক খাবার এনেছিলো, সাথে এনেছিলো প্লেট, বাটি, চামচ প্রায় সবই। টেবিলগুলো একসাথে লাগিয়ে একটা বিশাল ডাইনিং টেবিলের আকার দেওয়া হলো। মেয়েরা সুন্দর করে খাবার সাজানো শুরু করলো। ছেলেরা রুম সাজাতে লেগে পড়লো। এবং যথারীতি ব্যাকবেঞ্চার বারোজন কোনো কাজ না করে বসে থেকে আড্ডা দিচ্ছিলো।

সাবরিন যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো। সে গলা উঁচু করে বললো, 'যারা খাবার আনেনি তারা অন্তত রুমটা ঝাড়ু দিলেও পারে!'

সব মেয়েরা হো হো করে হেসে উঠলো। ছেলেগুলো যেন কিছু না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। তারা যেন খোঁজার চেষ্টা করলো, কে খাবার আনেনি। তারা তো জানে সবাই খাবার এনেছে। আর না আনলেও সমস্যা কী, যত পরিমাণ খাবার আছে তা শেষ করতে আরও বিশজন মানুষ লাগবে।

'অন্যের খাবারে এতো লোভ কেন? বাপে সরকারী কর্মকর্তা বলে?' নাইম জবাব দিতে বেশি দেরি করেনি। এবং অন্যদের বাবা সরকারী কর্মকর্তা হলেও কথাটি যে শুধু সাবরিনের জন্য, তা বুঝতে হাইস্কুলেও পড়তে হয় না।

'অন্যের খাবারে লোভের বিষয়টা খালি হাতে কলেজে আসা মানুষের চেয়ে আর কে বেশি বোঝে?' সাবরিন কথা শেষে যে মুচকি হাসিটি দিলো তা যেনো নাইমের বুকে তীরের মতো বিঁধলো। তার হাতের কাছে একটা ক্যাসেট ছিলো, সে ছুঁড়ে মারলো সাবরিনের দিকে। সেটি সাবরিন খুব কাছে ঘেঁষে গিয়ে আঘাত করেছিলো দেয়ালে। প্রচন্ড শব্দ হয়েছিলো। সাথে সাথে শিক্ষক ও ইনচার্জ ছুটে এসেছিলেন।

ক্লাসের অনেকেই স্যারদের কাছে এগিয়ে গেলো এবং একটি মিথ্যা দূর্ঘটনার গল্প বলল। দুজন ছাত্রকে বকাবকি করে স্যাররা চলে গেলেন। শুধু দুজন নিজেদের স্থানেই দাঁড়িয়ে রইলো। একজন নাইম ও অন্যজন সাবরিন। সাবরিনের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো।

স্যার ম্যাডামরা চলে গেলে অন্য শাখার বন্ধুরও রুমে চলে আসলো। ঘটনাটি বুঝতে পেরে সবাই সাবরিনের কাছে গেলো, তাকে স্বান্তনা দিলো। 

জেরিন নামের একজন এসে সাবরিনের কানে আস্তে আস্তে বললো, 'সাইন্স, আর্টস ও কমার্স মিলে আমাদের যে নয়টি শাখা, তার প্রত্যেকটিতে কাচ্চি বিরিয়ানি, দই ও পেপসি গিয়েছে নাইমের তরফ থেকে। তোমার না জানারই কথা। কিন্তু আমরা জানি, স্কুল থেকে দেখে আসছি। '

জেরিনের কথা শুনে যেন সাবরিন আকাশ থেকে পড়লো। সে খেয়াল করেছে একটা বড় বক্সে কাচ্চি রাখা। আরও পাঁচজন কাচ্চি বিরিয়ানি এনেছে, তাই তার আর জানা হয়নি, বড় বক্সটি কে এনেছে। সে ভেবেছিলো ক্যান্টনমেন্ট যার বাসা তারাই কেউ এনেছে। কারণ নাইমকে সে খালি হাতেই ঢুকতে দেখেছে। এতো বড় বক্স দূর থেকে টেনে আনা কোনো ছাত্রের পক্ষেই সম্ভব নয়। 

পরে সে জানতে পেরেছিলো খাবারের বক্সগুলো গাড়িতে করে আনা হয়েছিলো। তারপর ছাত্ররা যে যার ক্লাসে নিয়ে গেছে৷ সাবরিনের সেদিন খারাপ লেগেছিল পাশাপাশি অবাকও হয়েছিলো।

এরপর ক্লাস পার্টি চললো। সবাই হৈ-হুল্লোড় করে খেতে শুরু করলো। মেয়েরা খাবার বেড়ে দিচ্ছিলো, ছেলেরা একটার পর একটা খাবার খাচ্ছিলো শুধু একজন ছাড়া। সাবরিন নাইমের সত্যটা জানার পর স্বাভাবিক হয়ে এসেছিলো। তার মনে কিছুটা অনুতপ্ত বোধ হচ্ছিল, কিন্তু নাইম যা করেছে তার কোনো ক্ষমা হয় না। জেরিন, মিথিলা ও মায়েশা ক্যাকবেঞ্চারদের জন্য খাবার সাজিয়ে দিলো।

সাবরিনের অবাক হওয়া আরও বাঁকি ছিলো৷ ছেলেরা সব খাবার একটু করে খেয়ে মিছিল করতে করতে চলে গেলো অন্য ক্লাসে। অন্য ক্লাসের ছেলে-মেয়েরাও আসলো সাবরিনের ক্লাসে। তাদেরকেও খাবার বেড়ে দিচ্ছিলো সাবরিন, জেরিন ও মিথিলা।

সাবরিন খেয়াল করেছিলো, যারা আসছিলো তাদের অনেকের হাতেই ছিলো ছোটো সাইজর খাবারের বক্স। এবং তারা যাবার সময় নাইমের কাছে গিয়ে ফোনে কারো সাথে কথা বলিয়ে দিচ্ছিলো। আজ যেহেতু পার্টি, তাই সেলফোন আনার বাধা ছিলো না। কিছুক্ষণ পর দেখলো নাইমের পাশের টেবিলে বিশ-পঁচিশটা খাবারের বক্স জমে গেছে। এবং সে একটি করে খাচ্ছিলো।

সাবরিন জেরিনের হাতে টোকা দিয়ে ইশারা করলো। জেরিন বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বললো, ‘ওগুলো ওর বন্ধুদের মা পাঠিয়েছে ওর জন্য আলাদা করে। বেশিরভাগই পায়েশ, না-হয় বিরিয়ানি। উনি আবার পায়েশ ঠান্ডা ছাড়া খান না৷ তাই আজ থেকে ক্যান্টিনের ফ্রিজে তার পায়েশ থাকবে কয়েকদিন। তাকে জানিয়ে যে কেউ চাইলে খেতে পারবে। ফোনে আন্টিদের সাথে কথা বলছে।’ জেরিন থামলো। 

সাবরিন একটানা অনেকক্ষণ নাইমের দিকে তাকিয়ে রইলো। কোনো এক অদ্ভুত কারণে তার মনটা ভালো হয়ে গেলো। বাসায় ফিরে সে জীবনের এক অস্থিরময় রাত কাটিয়েছিলো। 

পরেরদিনের ঘটনা মনে পড়লো সাবরিনের। নিজের ভুল স্বীকার ও নাইমের অপরাধের বিহিত করতে সে চলে গিয়েছিলো ক্যান্টিনে। লেইজার পিরিয়ড চলছিলো। এই সময় নাইম আসবে পায়েশ খেতে। তাই সাবরিন আগে থেকেই ফ্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো। ফ্রিজটি ছিলো ক্যান্টিনের ভেতরের দিকে আলাদা একটি রুমে। জেরিন ও মায়েশাকে বলে রেখেছিলো জীবন যেন নাইমকে একা পাঠায়।

নাইম ট্রে হাতে রুমে ঢুকতেই থমকে দাঁড়ালো। সাবরিনকে দেখতে পেলো। সে ফিরে যেতে উদ্যত হলে সাবরিন বললো, 'কিছু কথা ছিলো। বাইরে সবার সামনে যেমনই হোক একাকিত্বে নাইম আশাকরি ভদ্র মানুষের মত আচরণ করবে?'

কথাটি যথারীতি নাইমের লেগে গেলো। সে সোজা হয়ে সাবরিনের মুখোমুখি দাঁড়াল। দাঁত কিটিমিটিয়ে বললো, 'কী কথা?'

'যে ছেলেটিকে বিশজন মা আলাদা করে খাবার পাঠায়, তার মধ্যে স্পেশাল কিছু তো আছেই!' নাইমের চোখে চোখ রেখে সাবরিন বললো।  সাবরিনের চোখে অভিভূত হবার লক্ষণ স্পষ্ট ছিলো।  


"যে সিভিলিয়ান হয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দাঁড়োয়ানের দায়িত্ব পায়, সেও কম স্পেশাল নয়!' নাইমের কথায় সাবরিন ফিক করে হেসে দিলো।


এই প্রথম সাবরিনকে হাসতে দেখলো নাইম। মেয়েটার হাসি দারুণ সুন্দর। কখনো খেয়াল করা হয়নি। শুধু তার ব্যবহারটাই তিতা। নাইমের মনের ভেতরে কী চলছিলো বোঝা গেল না। তবে নাইমের চোখের চাহনি অনেকটাই শীতল হয়ে এসেছিলো৷ তার সার্কেলের বাইরেও যে আকর্ষণ করার মত মানুষ রয়েছে, এটা ভেবে কিছুটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।


'আমাদের দু'জনেরই পরস্পরকে সরি বলা উচিৎ। আমি সত্যটা না জেনেই ওই কথা বলে ফেলেছি।' সাবরিন নরম কন্ঠে বলল।

"আমি এসব আদিখ্যেতায় বিশ্বাস করি না।'


'সরি বললে মানুষ ছোটো হয় না।' সাবরিনেে সপাট জবাব। 


'সরি, ধন্যবাদ বলে কেউ বড়ও হয় না।'


'আমি আমারটা বলে গেলাম। কেউ যেদিন বুঝবে তার কাজটি ভুল ছিলো, সেদিন বললেও চলবে।' সাবরিন চলে যেতে লাগলো। 


নাইম বলে উঠলো, 'আমি বন্ধুদের সরি বা ধন্যবাদ বলি না। তাদেরটা গ্রহনও করি না।'


'আমি এসবে বিশ্বাস করি। সবাই হিউম্যান বিয়িং। ভুল করবে, সরি বলবে। ধন্যবাদ জানাবে। এবং তোমাকেও তা করতে হবে।' হুকুম দেবার এই বিষয়টা নাইমকে বেশ অবাক করলো। সে হাসি আটকাতে পারলো না।


'হা হা হা। কোনো শর্ত ছাড়াই পায়েশ খেলে বুঝবো কেউ আমাকে সরি বলেছে।' 


সাবরিন ঘুরে দাঁড়ালো। তার চোখে অবিশ্বাস, রাগ ও জেদের সংমিশ্রণ। নাইমের দিকে আগুন দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকালো। বুঝতে পারলো ছেলেটর চোখে কিছু আছে, তাকিয়ে থাকলে রাগ চলে যায়। একটুপর মৃদু হেসে বললো, ‘ঠিক আছে।  ট্রে টা দাও।’ ট্রে ছিনিয়ে নিলো সে।

 
সেদিন সবাই মিলে পায়েশ খেয়েছিলো। জীবনের মত সেদিন অনেকেই বুঝতে পেরেছিলো নাইমের প্রতি সাবরিনের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে। ক্যান্টিনে যারাই আসছিলো তারাই অবাক হচ্ছিলো নাইম ও সাবরিনকে একই টেবিলে বসতে দেখে।

এরপর থেকে দুটো ঘটনা ঘটেছিলো। নাইম আর কোনোদিন ক্লাস ফাঁকি দিতে পারেনি এবং ক্যান্টিনের ফ্রিজে প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো খাবার থাকতো কিন্তু কোনোদিনই সাবরিন ও নাইমকে একসাথে বসে খেতে দেখা যায়নি৷

মেয়েকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাবরিনের মা জিজ্ঞেস করলেন, 'আরও কিছু খেতে ইচ্ছে করছে?' 


ডাক্তার রোকসানা হাসলেন তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে। সাবরিন মাথা নিচু করে রইলো। মা' বুঝতে পেরেছেন। তিনি আবার বললনে, 'সবই রান্না করব, কিন্তু রান্না ঘরে আসা যাবে না।'

সাবরিন মাথা নাড়িয়ে সায় দিল।

বিছানায় শুয়ে সাবরিনের একটুও ভাল লাগছিল না। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল। কখন এগারোটা বাজবে। সবেমাত্র ন'টা বাজে।


সকালে উঠে যখন সে ভাবছিল আজকের দিনটাও বাজে ভাবে শুয়ে শুয়ে যাবে। শরীরে একটুও শক্তি নেই উঠে একটু বাইরে হাঁটার। ঠিক তখনই তার ফোনটা বেজে উঠলো। তার ইচ্ছা করলো না ফোনটা রিসিভ করতে। কলটা কেটেই গেল। আবার যখন বাজতে শুরু করলো, তখন বিরক্ত হয়েই ফোনটা হাতে নিল। নিয়েই সে অবাক, জীবন ফোন দিয়েছে। কতবার সে ভেবেছে জীবনকে একটিবার ফোন দিবে। কিন্তু লজ্জায় পারেনি৷ জীবনের কাছেই যে নাঈমের সব খবর থাকে। ফোনটা দ্রুত ধরল।

'এখন শরীর কেমন তোমার?' ফোনের ওপাশ থেকে জীবন বলল।

'ভাল। তুমি ভাল আছো?'

'ভাল এবার তোমার হবার পালা। নাঈম আসবে তোমায় দেখতে' কথা পুরোটা শেষ করতে না দিয়ে সাবরিন বিছানায় উঠে বসে বলল,

'কী?'

‘হ্যাঁ, আমাকে যেতে বলেছে। আমার ধারণা আমার পিছে পিছে সেও আসবে। তোমার কি মনেহয়?’

এতক্ষণ সাবরিন নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছে। সে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলল, 'তুমি আসো। ওকে আসতে হবে না। প্রায় সবাই আসছিল আমায় দেখতে। তোমরা আসোনি।'

কিছুটা লজ্জিত হয়ে জীবন বলল, 'আমি আগে তোমাকে দেখতে গেলে নাঈমকে কে আনতো?' জীবন হাসলো। 'এগারোটায় আসছি।'

ফোনটা রাখার পরই সে বিছানা ছেড়ে উঠেছে। ঘড়িতে দেখে আট'টা বাজে। মা'কে ডাকতে ডাকতে সে রুম থেকে বের হলো। তার মা' তাকে দেখে অবাক। গত তিনদিন ধরে যে মেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে নাই, আজ সে হাঁটছে। তিনি বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করলেন।

'মা' আমার কিছু বন্ধু আসবে। তুমি কি কিছু রান্না করবা?' কথাগুলো বলতে সাবরিনের বারবার দম ফেলতে হচ্ছিল এবং সে হাঁপাচ্ছিল।

মা' আরেকটু তথ্য বের করার জন্য জিজ্ঞেস করলেন, 'সবাই তো গতকালই এসেছিল। আজ আবার কে আসবে?'

'মা' জীবন আসবে। হয়ত সাথে আরেকজন আসতে পারে' দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না সাবরিন, সে সোফায় বসে পড়ল।

মা' বুঝলেন এই আরেকজনটাই স্পেশাল। তার জন্যই মেয়েটা ছটফট করছে আবার আনন্দিতও হচ্ছে। এই লাজুক প্রেম তিনিও অনুভব করেছেন কোনো একসময়। তিনি হাসলেন, বললেন 'রান্না করব মা'। তুমি যেয়ে রেস্ট করো।'

সাবরিনের তারপর থেকে আর রেস্ট নেয়া হয় নাই। একটার পর একটা কাজ করেই যাচ্ছে। মা' তাকে জোর করে নুডলস খাওয়ালেন। সে কাজের মেয়েকে ড্রইং রুমটা পরিস্কার করতে বললো। তার রুমের ব্যলকণিও পরিস্কার করতে বলল। একা একা শুয়ে সিদ্ধান্ত নিলো, আজ নাঈমের সাথে কোনো তিক্ষ্ণ করে কথা বলবে না। শুধু তার দিকে চেয়ে থাকবে। মা' যদি অনুমতি দেয় তবে ব্যালকণিতে দুজনে একসাথে বসবে।
                           
সকাল দশটায় জীবন বাসা থেকে বের হলো। তার বাসা থেকে সাবরিনের বাসা প্রায় চল্লিশ মিনিটের পথ। সিএনজি ও বাস দুটোতেই যাওয়া যায়। সে সিএনজিতেই উঠে পড়লো। তাতে সময় কিছুটা কম লাগবে। সাড়ে দশটা নাগাদ বগুড়া সাতমাথায় পৌছে গেল। ফলমূলের দোকানে গেল কিছু ফল কিনতে। ফল কিনে নিয়ে রিক্সায় চড়ে সাবরিনের বাসার দিকে রওনা দিল।

বাসার কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে গেল। জীবন বাসায় ঢুকে দেখল সাবরিনের মা' সোফায় বসে আছেন। জীবনকে দেখে তিনি উঠে আসলেন। জীবন সালাম দেওয়ার পর সাবরিনের মা' জিজ্ঞেস করলেন, 'ভাল আছো বাবা?'

'জ্বী, আন্টি ভাল আছি।'

'তুমি একা আসছো?'

'জ্বী, আন্টি। নাঈম আসতে চেয়েছিল কিন্তু ওর একটা কাজে আটকে গেছে'

'আচ্ছা, নাঈম... ওই ছেলেটা না, যার বিরুদ্ধে সাবরিন বারবার নালিশ করে?'  তিনি নাঈমের কথা বহুবার সাবরিনের মুখে শুনেছেন। যেদিনই কলেজে কোনো ঝামেলা হতো, সাবরিনের মন খারাপ থাকতো তার জন্য সে নাঈমকেই দায়ী করত। আর আজ তার জন্যই এত অস্থীরতা। ডা. রোকসানা হাসলেন তার মেয়ের দূর্বলতা বুঝতে পেরে।

তিনি জীবনকে নিয়ে সোফায় বসলেন। সাবরিন তার ঘরে শুয়ে আছে। কিন্তু সে থাকতে পারছে না, তার অস্থীর লাগছে। তার বলতে ইচ্ছে করছে, 'আমি এখন সুস্থ, আমার কোনো অসুখ নেই। তোমরা আমাকে উঠতে দাও। দাঁড়িয়ে থাকতে দাও দরজা খুলে। সে আসবে, যার জন্য এই অসুস্থতা। সেই এর প্রতিষেধক!'

জীবন সাবরিনের পাশে বসে। তাকে এখানেই নাস্তা দেয়া হয়েছে। সবাই বের হয়ে গেলে, সাবরিন মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো, 'নাঈম কি সত্যিই আসবে না?'

জীবন সাবরিনের চোখে দেখল এক বিশাল শূণ্যতা ও মায়ার মেলবন্ধন। এই একটি প্রশ্নের ভার জীবন সইতে পারলো না। সে ওই সিক্ত চোখের দিকে তাকাতে পারলো না। নিচের দিকে চেয়ে বলল, 'বিশ্বাস রাখো, আমি বিশ্বাস করি সে আসবে।'

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাবরিন নিজেকে সামলে নিল। 'তুমি এসেছো, আমি ভীষণ খুশী হয়েছি জীবন। আমি আজ সত্যিই ভাল বোধ করছি।'

'তোমাকে ভাল হতে হবে দ্রুত। তোমাকে আমাদের দরকার। নাইমের ভালো ভবিষ্যতের জন্য তোমাকে তার প্রয়োজন।' জীবন হাসলো।

'এই দায়িত্ব তো আমি নিইনি। আমি কি তার কিছু লাগি?'

'অনেক কিছু হও। তুমি আসার পরেই সে একটু স্থির হয়েছে, শান্ত হয়েছে। তাকে ছেড়ে যেও না। আমরা তাকে সামলাতে পারব না'

'জীবন তোমার কথা বলো। তুমি কেমন পড়াশোনা করছো? মায়শা'র খবর কি?'

সাবরিন কথা বলে সময় ব্যয় করার চেষ্টা করছিল। দুজনই কথার ছলে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে বারবার। এগারোটা বাজার ঘন্টা পড়লো। দুজনই অস্থির; নাঈম আসবে কি আসবে না!

দশ মিনিট পর জীবনের ফোনটা বেজে উঠলো। জীবন খুশীতে ফোনটা সাবরিনকে দেখালো। সাবরিন লজ্জায় মুখ লুকালো। জীবন ফোনটা কানে ধরল। একটি কন্ঠের কথা সে শুনতে পেল, যেটা সে চেনে না। আওয়াজ আসলো, 'বনানীতে এক্সিডেন্ট হইছে। আপনি দ্রুত মেডিকেলে চলে আসুন। ছেলেটি মনেহয় বাঁচবে না।'

জীবন লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল, চিৎকার করে বলল, 'কী?' ভ্যাঁক করে কেঁদে দিল। আবার সামলেও নিল। তার মাথায় কিছু খেলছে না। সাবরিনকে কি বলবে, নাঈমের বাবা-মা'কে কি বলবে? পুরো অন্ধকার হয়ে গেল তার সামনে। বুকের ভেতরে তীক্ষ্ণ ছুড়ির আঘাত বোধ করল সে।

সাবরিনকে কিছু জানানো যাবে না। সে বলল, 'নাঈমের এক আত্মীয় মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালে, আমাকে যেতে বলল। আমি আসছি সাবরিন।'

সে তড়িৎগতিতে রুম থেকে বের হলো, ততক্ষণে চিৎকার করে কেঁদে দিয়েছে। দৌড়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। সাবরিনের মা' কিছু বুঝতে পারলেন না। তিনি সাবরিনের রুমে গেলেন। সাবরিন ওর মা'র দিকে শিশুর মত তাকিয়ে আছে। তার চোখে পানি। সে কি সব বুঝে গেছে?

পরের দিন একটি দৈনিকের খবর এমন 'বনানী মোড়ে সড়ক দূর্ঘটনায় একজনের মৃত্যু!' 


সেই একজন যে কতজনের চোখের মণি ছিল, কতজনের আপন ছিল, তা কি পত্রিকা জানাতে পেরেছে? পারেনি। ওই একজনের সাথে অন্যজনও চলে গেছে। রেখে গেছে সন্তানশূণ্য দুটি পরিবার। 

Comments

    Please login to post comment. Login