Posts

গল্প

অভিযান অনীলা!

August 22, 2025

Zihad Sheikh

Original Author জিহাদ শেখ

46
View

'ভাই, বিয়া করবেন না?' আকাশ মুখ টিপে হেসে জিজ্ঞেস করলো। প্ল্যান ছিল পাড়ার সব ছেলেরা একসাথে এসে অনিক ভাইকে জ্বালানো এবং বিয়ে কেন করছে না, তা জানা। ২০০৮ সাল প্রায় শেষ হতে চললো। এবারও বিয়ের নাম নেই। 

অনিক ভাই এক আজীব জিনিস। তিনি একজন প্রকৌশলী। কিন্তু তার প্রকৌশল সম্পর্কিত কাজ ভাল লাগে না। তিনি সারাদিন বই পড়েন, আর আমাদের ডেকে এনে জ্ঞান আওড়ান। 

গত দুই বছর হলো এই জ্ঞান বিতরণ চর্চা চলে আসছে। একবছরে পাঁচটি কোম্পানিতে চাকরি করে বাসায় এসে, দুই বছর হলো তিনি একটি স্কুল চালান।

তবে তার স্কুলটা অভিনব। একটাই ক্লাস। আর সেই ক্লাসে বারো-তেরোজন স্টুডেন্ট। মানে আমরাই সেই স্টুডেন্ট। সবাই একাদশ শ্রেণীতে পড়লেও, অনিক ভাইয়ের স্কুলে আমরা সবে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি!

গতবছর পুরোটা শিখেছি মানসিক মূল্যবোধের স্বরুপ। এবছর শিখছি মানবিক গুণের পরিচয়। অদ্ভুত!  স্কুলের পরীক্ষার ধরণটাও আলাদা। ডিসেম্বরে যখন কলেজে ছুটি পেলাম, তখন অনিক ভাই আমাদের পরীক্ষার ডেট দিলেন। তিনদিন এক গরীব কৃষকের ঘরে থাকতে হবে। দশজনের জন্য তিনি আলাদা দশটা গ্রামে আমাদের রেখে এসেছিলেন। তারপর সেই তিনদিনের যাবতীয় ঘটনা তাকে হাতে লিখে জমা দিতে হইছিল।

এমন অত্যাচার থেকে বাঁচতেই, আমরা প্ল্যান করেছি ভাইকে এবার বিয়ে দেবার। চার বছর ধরে বলে আসছি। বিয়েটা হলেই আমাদের মুক্তি। ভাবী আসলে, ভাইয়ের অত্যাচার কমবে।

বই থেকে চোখ না সরিয়েই অনিক ভাই বলল, 'আমি বিয়ে করলে তোদের লাভ তো দেখছি না। তাহলে কেন জিজ্ঞেস করছিস?'

'কি যে বলেন ভাই, আপনি বিয়ে করলে হেব্বি খাওয়া হবে, নাচ-গান পার্টি হবে, সাদা পানির ফোয়ারা হবে আর সুন্দরী বিয়ান পাব না? লাভ তো আমাদেরই। ' মুহিত বলল

'কয় বছর ধরে এই একই কথা বলে যাচ্ছিস? পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বললেন অনিক ভাই।

'চার বছর ভাই।'

'চার বছরে কত কিছু পাল্টালো, আমার মত পাল্টাইছে?'

'না, ভাই' শোভন বলল

'তাহলে?

'তাই বলে বিয়ে করবেন না? আমরা ভাবী পাব না?'

'এলাকায় কি ভাবীর অভাব?'

'না, কিন্তু আপনার ঘরে এসে ভাবীকে পাই না। কষ্টে বুকটা জ্বলে।'

'কাল একটা সাইনবোর্ড আনিস তো আকাশ। লিখবি এ বাড়িতে ভাবী নাই'

'ভাই, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা ভাবী খুঁজতে যাব। আপনি তাতে হ্যাঁ বলেন আর না বলেন'

'এখন যা, ডিস্টার্ব করিস না।'

হতাশ হয়ে ভাইয়ের রুম থেকে বের হয়ে আসলাম।

কেমন ভাবি চাই, তা নিয়ে সবাই আলোচনা করছি। মিটিং হচ্ছে শাহিন ভাইয়ের বাসায়। শাহিন ভাই অনিক ভাইয়ের বন্ধু। তিনি অনিক ভাইয়ের সব ঘটনাই জানেন। আমরা তার কাছে থেকেই জেনেছি, কুয়েটে পড়ার সময় অনিক ভাইয়ের ছয় মাসের প্রেম এবং তারপর বিচ্ছেদের। অনিক ভাই তারপর জেদ ধরেছেন আর প্রেম ভালোবাসা বা বিয়ে কিছুই করবেন না। তার জীবনে আর কোনো নারীকেই আনবেন না।

আমাদের এখন অনিক ভাইয়ের এই জেদ ভাঙিয়ে তাকে বিয়ে করিয়ে নিজেদের মুক্তি পেতে হবে। বড়ই অসাধ্য কাজ।

'মাত্র ছয় মাসে এমন কি ঘটলো যে,  অনিক ভাই সবকিছু ছেড়ে দিলেন?' মুহিত জিজ্ঞেস করলো।

'তার এই ছন্নছাড়া লাইফের জন্যই প্রেমটা টিকে নাই। এখন আরো বেশি ছন্নছাড়া জীবন যাপন করছে।' শাহিন ভাই বলল

'তাহলে আমরা কি করতে পারি? তার বাবা-মা'ও তো হাল ছেড়ে দিয়েছেন' আকাশ বলল অনেকটা হতাশ হয়ে।

'চল, মেয়ে খুঁজি। যদি কাউকে মনে ধরে, তাহলে হয়ত ভাইয়ের মত পাল্টাতে পারে।' শোভন বলল

'কিভাবে খুঁজব? আর কই খুঁজব?' মুহিত প্রশ্ন করলো।

'চল ফেসবুকে খুঁজি! এখন তো ফেসবুকে সবাই আইডি খুলছে। ভাবীও নিশ্চয় আইডি খুলেছে। আচ্ছা শাহিন ভাই, ভাবীর নাম কি ছিল?' আমি যথেষ্ঠ আশাবাদী হয়ে বললাম।

'কথায় কথায় ফেসবুক! কিছুদিন পর যে কি হবে?' মুহিত বলল বিরক্ত হয়ে। জাভা ফোনে ফেসবুক চালাই আমরা। ব্যায়বহুল হলেও অনেক মজার!

'নীলাঞ্জনা নামে ডাকতো অনিক। ভালো নাম জানি না।' শাহিন ভাই বললেন। ভাইয়ের কথায় হতাশ হলাম। আসল নামটা জানা জরুরী ছিল। অনিক ভাই তো কখনোই নাম বলবে না।

অবশেষে সবাই আমার সহজ উপায়টা গ্রহন করলো। আমরা আটজন একসাথে নিবির ভাবে কম্পিউটারে ফেসবুকে একটার পর একটা মেয়ের নাম সার্চ করে চলেছি। যার কাছে যে নাম পছন্দ সেই নাম লিখে সার্চ দিচ্ছে।  নীলঞ্জনা নামও বহুবার সার্চ দেওয়া হয়েছে।

কত সুন্দর মেয়ে খোঁজার উপায়। এলাকা, স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি, বয়স সব ফিল্টার করে সার্চ দেয়া যায়। এবং সুন্দর সুন্দর মেয়েদেয় ছবি আসতে থাকে। কিন্তু একই ছবি দিয়ে যখন পাঁচ ছয়টা আইডি দেখি, তখন তো মেজাজ বিগড়ে যায়।

বহু মেয়ের ছবি আসছে। কেউ বিবাহিত, কেউ রিলেশনে, কেউ কম্পলিকেটেড, কেউবা ওপেন রিলেশনে।

'কমপ্লিকেটেড আর ওপেন রিলেশনের পার্থক্য কি-রে?' শোভন তখনও ফেসবুকে এতটা একটিভ না। আর যারা প্রেম করুক আর না করুক সবাই রিলেশন দিবেই।

'ওপেন মানে হচ্ছে সে সবার আর কমপ্লিকেটেড মানে যারা তাকে চায় সে তাদের' আকাশের কথায় হাসির রোল উঠলো সবার মাঝে।

'একটা ডিভোর্সি দেখতো, মালটারে ডিভোর্সির সাথে বিয়া দিয়া দিই' শোভন বিরক্ত হয়ে বলল

'আরে না, ভাল করে দেখ। সুন্দরী না হলে ওই বাড়িতে খাইতে যেতে ইচ্ছে করবে না।' আকাশের কথায় আমরা একমত হলাম।

অবশেষে অবিবাহিত ও সুন্দরী একজনকে পাওয়া গেল। রায়গঞ্জ কমিউনিটি ক্লিনিকের ডাক্তার। নাম দেয়া ডা. অ-নীলা। বাড়ি কুষ্টিয়া। দেখতে খুব সুন্দরী। এবং ফেসবুকে মাত্র বিশজন ফ্রেন্ড। সবার পছন্দ হয়ে গেল। কিন্তু আমার তো সন্দেহ হলো আইডি ফেক কিনা।

এখন অনিক ভাইয়ের সাথে অনীলা ভাবির কেমনে বিয়ে দেয়া যায় সেটা নিয়েই পরিকল্পনা করছে সবাই।

'ভাইকে ফুসলিয়ে ভাবির চেম্বারে নিয়ে গেলে কেমন হয়?' আকাশ বলল

'লাভ হবে না। পুরনো প্রেমিকাকে তিনি এখনো ভুলেন নাই। মেয়েটারে দেখেও তার প্রেম জাগবে না' মুহিত বলল

'ভাবিকে কিডন্যাপ করে আনি। এনে ভাইয়ের বাসায় তুলে রাখি। কেমন হয় বল-তো?' শোভন বলল

'তারপর সবাই মিলে পুলিশের প্যাঁদানি খাই!'

'পুলিশ!' কথাটা শুনেই আমার মাথায় একটা বুদ্ধি চলে এলো। বলে উঠলাম 'আই গট অ্যান আইডিয়া'

হিস ফিস করে সে সবাইকে আইডিয়াটা বললাম। সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। আইডিয়াটা হলো পোস্টারিং করা, অনীলা ভাবীকে রাগিয়ে পুলিশের মাধ্যমে বিয়ে দেয়া। পুলিশ যেন মধ্যস্থতা করে দুই পক্ষকে বসিয়ে বিয়েতে রাজি করায়। মেয়েটাও যেন কেলেঙ্কারি থেকে বাঁচতে বিয়েতে রাজি হয়। হাজার হোক, সে তো সিঙ্গেল!

জানিনা পরিকল্পনাটা সফল হবে কিনা, তবে বাজিয়ে দেখা যায়। আর অনিক ভাইয়ের মামা এসপি, খুব বেশি ঝামেলা মেয়ে পক্ষ করতে পারবে না।  

সবাই হারুন ভাইয়ের প্রেসে গেলো রঙিন পোস্টার বানাতে। আমি ও মুহিত গেলাম আঞ্চলিক সংবাদপত্রের অফিসে একটি বিজ্ঞাপন দিতে। আকাশ গেল হবু ভাবীর বাড়ি ও চেম্বার দেখে আসতে৷

পোস্টারে লেখা হলো,
"আমি অনিলাকে বিয়ে করতে চাই,
কিন্তু সে সময় নিচ্ছে,
আমার বয়স হচ্ছে, তার কি হচ্ছে না।"
শাহ আরেফিন আহমেদ অনিক
প্রকৌশলী 
০১৭১*******
বগুড়া।

পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলাম, "ডাঃ অনীলার  চিকিৎসা নিয়ে আজও আমার বুকটা ধরফর করে। কিন্তু সে কেন বোঝে না!"

পোস্টারে ভাইয়ের ছবি আর পত্রিকায় ভাবীর ছবি দিয়ে দিলাম। ভাবীর ছবি দিতে গিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে৷ পত্রিকার কেউতো রাজি হচ্ছিলো না। মামলার ভয় পাচ্ছিল। পরে আসিফ ভাইকে রাজি করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে পেরেছি। উনি এমপির ভাতিজা ও অনিক ভাইয়ের বন্ধু। তিনিও চান অনিক ভাইয়ের বিয়ে হোক। যদিও আমাদের প্ল্যান তার কাছে আনাড়ি ও অপরিপক্ক  মনে হয়েছে৷

আমরা সন্ধ্যায় মিটিং করলাম। একটা অভিযান চালাব। অভিযানের নাম ঠিক করলাম। 'অভিযান অনীলা'


আমাদের কাজ এখন গভীর রাতে পত্রিকার কপি নিয়ে অনীলা ভাবির চেম্বার ও বাসায় দিয়ে আসা। আর পোস্টার সাটানো।

পোস্টারগুলো নিয়ে আমরা রাতে অনীলা ভাবির চেম্বারের বাইরে সাটিয়ে আসলাম। পত্রিকার একটি কপি দরজার ভেতর দিয়ে দিলাম। তেমন কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি। মাত্র এক ঘন্টায় সব কাজ শেষ করলাম। তারপর চলে এলাম।

পরেরদিন আমরা সবাই কলেজে, অনেক দুশ্চিন্ত হচ্ছে। কাজটা যে ঠিক করি নাই তা সকালে বুঝতে পেরেছি। এখন তো বাসাতে যেতেই সবার ভয় করছে। না জানি কত বড় কেলেঙ্কারি হয়।

ভয়ে ভয়ে আমরা কলেজ বাস থেকে বাসস্ট্যান্ডে নামলাম। দেখি সব বড় ভাই দাঁড়িয়ে আছে মোটরসাইকেল নিয়ে। বুঝলাম, হয়ত বড় কোনো বিচার বসবে আমাদের নিয়ে। সবাই ভরসা দিল, তারা আমার পাশে থাকবে যে কোনো বিপদে। তাছাড়া যাই করি, যত অপরাধই করি অনিক ভাই আমাদের সাথে থাকবেনই।

আমাদের ইশারা করে আসিফ ভাই ডাকলেন। শাহিন ভাই হাসতেছেন। নাকিব ভাই হেসে হেসে বললেন, 
'ঘটনা তো ঘটে গেছেরে বিচ্ছুর দল! সামনের সপ্তাহে অনিকের এনগেজমেন্ট!'

আমরা তো আকাশ থেকে পড়লাম। কিভাবে হলো, কেমনে হলো। যার থানায় থাকার কথা, সে কিনা জেলে যাচ্ছে৷ কিভাবে সম্ভব!

আমরা রিক্সা নিয়ে অনিক ভাইয়ের বাসায় গেলাম। দৌড়ে তার রুমে গিয়ে বললাম, 'ভাই, আপনি নাকি বিয়েই করবেন না। তাহলে আবার বাগদান? একরাতেই কে কি গুল খাওয়ালো ভাই?'

অনিক ভাই হাসলেন। এখনও বই পড়ছিলেন। বইটা বন্ধ করে বললেন,

'তোরা মনেহয় সব জানিস না? বুদ্ধিটা কার?'

আমি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম। অনিক ভাই আমার পিঠে চাপড় দিলেন।

'এই নীলা-ই সেই মেয়ে যার সাথে চার বছর আগে আমার ব্রেকাপ হয়েছিল। সে জানতো আমার বাড়ি সিরাজগঞ্জ, তাই ওখানে বদলি নিয়েছিল এই বছরে। এতই বাউন্ডুলে ছিলাম, নিজের পুরো নাম ও ঠিকানাও ওকে জানানো হয় নাই। জানাবো কিভাবে সম্পর্কটা ছিলোই তো ছয়মাস।'

'ভাই, মনেহয় একটু ভুল হচ্ছে। ভাবীর নাম তো অনীলা।' আমি শুধরাতে চেয়ে বললাম।

অনিক ভাই হো হো করে হাসলেন। বললেন, 'ওর নাম নীলা। 'অ' উপসর্গটা আমি! ফেসবুকটা খুলেছিল আমাকে খুঁজে পেতে। কিন্তু আমি তো ফেসবুকেই নাই। তোরাই তাকে খুঁজে পেতে সাহায্য করলি। সে তো বিষ্ময়ে কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ ছিল।' ভাই থামলেন, হেসে নিয়ে বললেন, 'ভাগ্যিস ওর ভোরে ওঠার অভ্যাস, নয়ত বড় কেলেঙ্কারি হয়ে যেত পোস্টারগুলো না সরালে। নীলা কাল আসছে তোদের সাথে দেখা করতে৷ জিহাদ, তুই মাইরও খেতে পারিস ওর হাতে!'

আমরা এবার সুযোগ পেয়ে গেলাম, অনিক ভাইয়ের থেকে সব কাহিনি শুনব আজ। আকাশ বলল, 'ভাই, বলেন না, কিভাবে পরিচয় হলো?'

ভাই আজ গল্পের ডালা নিয়ে বসলেন, শুরু করলেন। 'আমি তখন ফাইনাল ইয়ারে। তখন সে মেডিক্যালের ছাত্রী। কুয়েট ক্যাম্পাসে একদিন প্রচন্ড মারামারি হলো...'
 

Comments

    Please login to post comment. Login