Posts

গল্প

সোনালী প্রান্তর (ভার্সিটির দিনগুলি) প্রথম পর্ব

August 26, 2025

Zihad Sheikh

Original Author জিহাদ শেখ

51
View

'আমি তোমার কত নম্বর প্রেম?' 


জেরিনের কথায় সাদাফের অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন হলো না৷ সে যেমন উদাস মনে দূরে তাকিয়ে ছিল, তেমনই থাকলো। ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টের ল্যাব খ্যাত পুকুর পাড়ে বসেছে দুজন। সকাল এখন দশটা। ক্লাস ছিলো সাদাফের, কিন্তু সে ক্লাস করবে না। জেরিনের এই সময়ে কোনো ক্লাস নেই। তাই দুজনে এসে বসেছে একসাথে। অবশ্য জেরিনের আরেকটি উদ্দেশ্যও রয়েছে, সাদাফকে নাস্তা করানো। সাদাফ সকালে এককাপ চা ও সিগারেট ছাড়া কিছু খায় না। খাবেই বা কি, হলে যা রান্না হয়, তার বর্ণনা অপ্রয়োজনীয়।

জেরিন যেন জবাব না নিয়ে থামার পাত্রী নয়। সেও সাদাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। জেরিন যে খুব উত্তেজিত, এমনটা নয়। তার মুখে হাসি। সে মিষ্টি হেসে সাদাফের দিকে তাকিয়ে আছে। সে জানে সাদাফকে বেশ ভাবনায় ফেলে দিয়েছে সে।

সাদাফ এমন প্রশ্নের মুখোমুখি বহুবার হয়েছে। প্রশ্ন একই থেকেছে কিন্তু প্রশ্নকর্তী বারবার পাল্টেছে। তাই সে বিচলিত নয়। সে সবাইকে যে উত্তর দিয়েছে, জেরিনকেও একই উত্তরই দেবে। তবে জেরিন কেন হঠাৎ এই প্রশ্ন করলো, তা সাদাফকে ভাবিয়ে তুলল। সম্পর্ক বলতে যা বোঝায়, তা এখনো সাদাফের মধ্যে অনুভূত হয় নাই৷ তার কাছে এখনও এমনই লাগে যে, শুধুমাত্র সিনিয়রদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতেও সে সাদাফের সাথে মিশেছে। আর সাদাফও নতুন নতুন মেয়েদের সাথে কিছুদিন ঘুরেফিরে সময় কাটায়। বন্ধু মহল ও ভার্সিটিতে প্রভাব দেখাতে হলে, একটা প্রেম করতেই হয়। এবং সে যেহেতু সিরিয়াস কোনো প্রেমে জড়াতে চায় না, তাই জুনিয়র মেয়েদের সাথে তার একটা সন্ধি বিশেষ তৈরি হয়ে যায়। যদিও দুজনই বিষয়টা স্বীকার করে নাই পরস্পরের কাছে, কিন্তু সাদাফ এটাই বিশ্বাস করে৷

'মানুষ যখন কারো প্রেমে পড়ে সেটাই তার প্রথম প্রেম' সাদাফ হেসে বলল।


'এই কথাটা তুমি কতবার বলেছো? এটা আমাকে বলো?' জেরিন মিষ্টি হাসছে। মেয়েটি যে প্রচন্ড চতুর ও বুদ্ধিমতী তা বুঝলো সাদাফ।

জেরিন প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্রী। সাদাফ তার তিন বছরের সিনিয়র। তাদের মধ্যে একটি বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে জেরিনের প্রথম সেমিস্টার থেকেই। জেরিন তুমি করে বলতে চাইতো না, সাদাফই তাকে অনুমতি দিয়েছে।  জেরিন যথেষ্ঠ সুন্দরী বা তার চাইতেও বেশি। সুন্দরীদের চেয়ে একটু বেশি লাবণ্যময়ী হলে তাকে রুপসী বলা যায়। জেরিন সেই শ্রেণীতে পড়ে। কিছু কিছু মেয়ে আছে যারা তাদের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে আগ্রহী নয়, জেরিন তাদের একজন। তার সৌন্দর্যের বর্ণনা হয়ত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভালো করতে পারতেন। অথবা এটা বলা যায়, বঙ্কিমের উপন্যাসের নায়িকা চরিত্রের সকল বৈশিষ্ট্য জেরিন যেন নিজের করে নিয়েছে। যে বঙ্কিমের লেখা পড়েনি, সে সৌন্দর্যের কল্পনা কখনো করতে পারবে না।

'দেখো, কথাটি আমি কতবার বলেছি এটা মুখ্য নয়, কথাটি আমি কতটা অনুভব করছি সেটাই আসল' সাদাফ সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে


'তোমার অনুভবের মাত্রা এখন কত?' জেরিন আড় চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো


'শতভাগ, এটাতে নিশ্চিত থাকতে পারো। আমি যখন সম্পর্ক করি,  তখন একটাই করি' যদিও আমরা জানি সাদাফ কখনোই প্রেম করেনি।


'তুমি কি কখনো ভেবেছো আমি কেন তোমার সাথে প্রেম করতে যাবো? আরও তো অনেকে রয়েছে, হয়ত তারা তোমার চেয়ে ভাল'


'আমি তো তোমাকে প্রেম করতে বলিনি। তুমি নির্দ্বিধায় অন্য কারো সাথে সম্পর্ক করতে পারো। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে এটা আমি তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি' 


'আজ নাহয় আমাকে ভাল লাগলো। সামনের সেমিস্টারে যদি অন্য কাউকে ভালো লাগে? নতুন বছরে নতুন মেয়েরা তো আসবেই।'


'এমনটা যে হবে না, সেটা বলতে পারব না। তবে আমার ধারণা সেই সুযোগ তুমি দিবে না।'


'দেখো, এইভাবে হয়ত তোমার সময় ভালো কাটে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী একটা সম্পর্ক তৈরি হবে না। সেটা তোমার জন্য ক্ষতিকর।'


'ভার্সিটিতে কি সম্পর্ক তৈরি করতে এসেছি?'


'না, তা নয়। কিন্তু যখন করছোই, তখন দু'জনের মতের মিল থাকাটা জরুরী। তুমি হয়তো সিরিয়াস নও, কিন্তু অন্যজন তো সিরিয়াস হতে পারে।'


'আমি কাউকে সিরিয়াসলি সম্পর্কে জড়াতে বলিনি। তোমাকেও নয়। তুমি চাইলে এখনই যেতে পারো। 


'তুমি কি জানো, তোমার কোন জিনিসটা বেশি বিরক্তিকর?


'জানি না। জানার দরকারও নেই।


'ভার্সিটিই তো শেষ না। এরপর আরও ধাপ রয়েছে৷ বাইরের দুনিয়া তোমার কথা মতো চলবে না'


'হুম।' সাদাফ সিগারেট ধরালো। কোনোকিছু মনযোগ দিয়ে শুনতে গেলে তার সিগারেটের নেশা জাগে। আবার বিরক্ত হলেও সিগারেটের নেশা জাগে। জেরিন এতে অভ্যস্ত, সে কিছু বলল না। অবশ্য বলেও লাভ নেই, আগের সম্পর্কে থাকা মেয়েরাও নিশ্চয় বহুবার তাকে সিগারেট খেতে নিষেধ করেছে।

'একটা সময় তুমি খুব একা হয়ে যাবে। তুমি হয়ত কাউকে চাইবে, কিন্তু সে আর তোমার কাছে আসতে পারবে না। আমি চাই না তোমার এমনটা হোক।'


'দেখা যাক। তুমি যাবে? 


'কোথায়?'


'ক্যাফেতে, খাব৷ ক্ষুধা পেয়েছে।'


'আচ্ছা। দাঁড়াও। আমি খাবার এনেছি। এতো বিরিয়ানি খাওয়া যাবে না। আমি নুডলস এনেছি, সাথে নাগেট আছে।'


'উহহ। এসবে কি পেট ভরে?' 


'ভরতে হবে না। রুটি আর মাংসও আছে।'


'তুমি তো দেখি আস্ত একটা সরাই খানা। আর কি কি আছে?' সাদাফ বিদ্রুপের হাসি হাসলো। 


'আর কিছু নেই।' লজ্জায় মুখ লুকালো জেরিন।

জেরিন বক্স খুলে সাদাফকে রুটি ও গরুর মাংসের ভূনা এগিয়ে দিল। সে জানতো নুডলস, নাগেট সাদাফের পছন্দ হবে না। তাই সে ওসব আনেওনি। 


কিন্তু জেরিন যে বিষয়টা ভাবেনি, তা হলো সাদাফ কখনো একা খায় না। পুকুরের অন্য পাড়ে তার বন্ধুরা বসে ছিলো। হাত তুলে তাদের কাছে আসতে বলল। সেখানে আট দশজন বসে ছিলো। নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করে দুজন উঠে আসলো বিষয়টা কি জানার জন্য। জেরিনের এই বিষয়টা একদমই ভালো লাগে না। কোনো মেয়েরই লাগার কথা নয়।

নিজে হেঁটে গিয়ে বাজার করে, হলে সবার থেকে লুকিয়ে রান্না করে সাদাফের জন্য এনেছে, আর সে কিনা জনে জনে ডেকে খাওয়াচ্ছে। জেরিন জানতো আজ সাদাফের ক্লাস থাকবে, তাই অন্য বন্ধুরা হয়তো থাকবে না তার কাছে। কিন্তু সে ভুল ছিলো। তার পিছু পিছু আরও তিনজন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। আর তাদের সাথে জুটেছে অন্য ডিপার্টমেন্টের আর দুই হালি। জেরিনের মাথায় রক্ত উঠে গেলো। কিন্তু সে নিরুপায়। রাগ প্রকাশ করার কোনো উপায়ও তার হাতে নেই। সবাই তার সিনিয়র। সে শুধু হাসিমুখে ভাইয়া নিন, খান, এসবই বলতে পারলো। কিন্তু হাসিমাখা মুখমন্ডলের চোখে যদি কেউ তাকাতো, তবে দেখতো সেখানে কি আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে।

তারা দুজন সাকুল্যে দুটা রুটি ও দু পিস মাংস খেতে পারলো। হাফ কেজির মতো মাংস গেলো বন্ধুদের পেটে। সাদাফ সবই বুঝতে পারলো, জেরিনের মনের মধ্যে কি চলছে। সে মনে মনে হাসছে।

'তুমি আমার জন্য কষ্ট করে রান্না করে এনেছো, এটা আরও বেশি মনে থাকবে সেগুলো আমি বন্ধুদের মাঝে ভাগ করে দিয়েছি দেখে। তুমি আমাকে প্রায়ই রান্না করে খাওয়াও, তাই ভবিষ্যতে তুমি মনে রাখতে পারবা না কোনদিন কি খাইয়েছো। কিন্তু এই বিষয়টা তোমার স্পষ্ট মনে থাকবে কোনদিন কতজন কোন খাবারে ভাগ বসিয়েছে৷ মন খারাপ করো না, আমি তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছি। রান্নাটা দিন দিন আরও সুস্বাদু হচ্ছে।' সাদাফ জেরিনের দিকে তাকিয়ে বলল। জেরিন শুধু হাসলো।

জেরিনের ফোন আসলো। তাদের ক্লাস এখন শুরু হবে। জেরিন উঠে পড়লো। সাদাফ তাকে এগিয়ে দিতে গেলে জেরিন মানা করলো। জেরিন একাই যেতে লাগলো। এর পেছনে জেরিনের একটা উদ্দেশ্য আছে। সে দেখতে চায় সাদাফ তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কিনা। এমনটা সে মাঝে মধ্যে পরীক্ষা চালায়, এবং প্রতিবারই হতাশ হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এবারও তাই ঘটলো। সাদাফ হনহন করে বন্ধুদের মাঝে চলে গেলো। তার আজ দুপুরে আর খেতে হবে না। ক্যাম্পাসের বাইরে সারাদিন কাটানো যাবে।  দিনটা ভালো যাবে বোঝা গেলো।



ক্যাম্পাস থেকে এক কিলোমিটার দূরে একটি বাসস্ট্যান্ড রয়েছে। গ্রাম্য এলাকা। এখানে তেমন কোনো লোকজন আসে না। তবে পাকা রাস্তায় প্রতি বিশ মিনিটে একটি করে বাস চলে। টিনের ছাউনির নিচে বসার জন্য ইটের তৈরি পাকা বেঞ্চ রয়েছে। সেখানেই দুপুরে সাদাফ ও তার বন্ধুরা শুয়ে বসে থাকে। ক্লাসগুলো সব শেষ হয়ে গেলে তারা হলে ফিরে যায়। যদি কোনোদিন ল্যাব থাকে, সেদিন অবশ্য তারা ল্যাবে যায়।

জেরিনকে বিদায় দিয়ে এখানেই তারা এসেছে। কম্পিউটার সাইন্স, মাইক্রোবায়োলজি ও ফিশারিজের বন্ধুরা এখানে আসে নি। তার সাথে রয়েছে নিজ ডিপার্টমেন্টের মামুন, আসিফ ও নোবেল। তিনজনই তার জিগরি দোস্ত। ভার্সিটি লাইফের প্রথম দিন থেকেই তারা একে অপরের অন্তরঙ্গ বন্ধু। অবশ্য আরেকজন রয়েছে। সে তাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। তবে সবচেয়ে উপকারী। কারণ সে ক্লাস করে, নোট নেয় ও সুযোগ পেলে তাদের এটেনডেন্সও দিয়ে দেয়। তার নাম নীরব। সে এখনও ক্লাসেই আছে। 


দুই ঘন্টা হলো শুয়ে বসে আছে তারা। অনেকগুলো সিগারেটও শেষ হয়েছে। হাতে আছে আর দুটো। সবে দুইটা বাজতে চললো।

'আজ নোবেল সিগারেট আনতে যাবি। গতকাল আসিফ গিয়েছিলো।' সাদাফ বলল।


'আমি জানি, তাই আগেই কিনে এনেছি' বলেই হি হি করে হাসলো নোবেল।


'সালা, ঝানু মাল' মামুন বলার পর সবাই হোহো করে হাসলো।


'দে, একটা। তাহলে ধরাই।' সাদাফ একটা সিগারেট ধরাতেই তার ফোন কেঁপে উঠলো।

সাদাফের ফোনটা নোবেলের কাছে। সবাই ভাবলো জেরিন হয়তো ফোন দিয়েছে। ইতিমধ্যেই সে ১৫ বার ফোন দিয়েছে। ক্লাস করো, গোসল দাও, ভাত খাও- এসব শুনতে আর ভালো লাগে না। তাই ফোনটা সাইলেন্ট করে নোবেলের কাছে ফোটা রাখা। 


কোনো এক কারণে নোবেল ফোনটা বের করতেই চিল্লায়ে দাঁড়িয়ে গেলো। 'আরে সালা, চেয়ারম্যান স্যার ফোন দিয়েছে!' নোবেল বলে উঠলো।

নির্বিকার ভঙ্গিতে সাদাফ বলে উঠলো, ' এ আর নতুন কী। হয়তো কোনো কাজে ফোন দিয়েছে।' সাদাফের আরেকটি পরিচয় রয়েছে। সে ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের ভিপি। ডিপার্টমেন্টের সকল অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগীতা তার হাত দিয়েই হয়। তাকে সাহায্য করে তারই কাছের বন্ধুরা।

সিগারেটে লম্বা পান দিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো, 'স্লামালাইকুম স্যার।'


'সাদাফ, এখন কোথায়?'


'স্যার, একটু দূরে আসছি। একটা কাজে।'


'তুমি ও তোমার সাথে থাকা তিনজনই এখনই চলে আসো। আমি ক্লাসে যাচ্ছি।'


'স্যার, আমরা সত্যিই একটা গ্রামে এসেছি।'


'জানি। ১০ মিনিট সময় দিলাম।' 


ফোনটা রেখে সাদাফের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। তার অবস্থা দেখে অন্যরাও বুঝলো। নোবেল আগেই যাবার জন্য রেডি।

'এখন তো তিন ঘন্টা ক্লাস নেবে-রে! মামুন বলল


'এখন কি করার? কিন্তু স্যার বুঝলো কিভাবে আমরা তিনজন একসাথে আছি?' আসিফ বলল


'বোঝাই যাচ্ছে কেউ বলে দিয়েছে।' সাদাফ বলল


'কে বলে দিলো?' নোবেল বলল


'নীরব বলতে পারবে। বের করেই ফেলব। এখন চল।'

তারা সবাই ক্লাসের দিকে হাঁটা দিলো। যখন তারা পৌছালো ততক্ষণ ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। তারা ঢুকতেই ক্লাসের সবাই হেসে উঠলো। এরা চারজনও হাসলো। 


'সাদাফ সামনে বসো। বাঁকি তিনজন ক্লাসের তিন জায়গায় বসো৷' স্যার বললেন। 


সাদাফ তার কথামতো সামনেই বসলো। তিনি আবার বললেন 'তোমরা দুপুরে লাঞ্চ করেছো?'


'জ্বী না স্যার।'


'আমি বলে দিচ্ছি, তোমাদের জন্য সিঙ্গারা আনার জন্য। বাঁকি সবাই তো খেয়েছো।' স্যার বলার পর সবাই হ্যাঁ বললো৷ 


এরপর সাদাফের মতে সবচেয়ে বিরক্তিকর ক্লাস শুরু হলো। এবং তাদের আশঙ্কাই সত্যি হলো। স্যার আড়াই ঘন্টা ক্লাস নিলেন। এর মাঝে দশ মিনিট সময় তাদের দিয়েছিলেন নাস্তা করার জন্য৷ স্যার সিঙারার সাথে মিষ্টিও এনেছেন। 

জেরিনও এসেছিলো সাদাফকে দেখতে। মিটিমিটি হেসে সে চলে গেছে। শুধু যাবার সময় বলে গেছে 'আমার ফোনটা ধরলে অন্তত গোশত-ভাতটা জুটতো'


আসিফ কিছু বলতে গেলে সাদাফ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,'এই সাহস তার হয়নি, স্যারকে আমাদের কথা বলবে।'


বিকেলটা হলের নিচতলায় ডিপার্টমেন্টের রুমে তাস খেলে কাটিয়ে দিলো তারা। অনেক বন্ধুই এসেছে তাতের ডাকতে। কেউ খেলতে ডেকেছে, কেউ ঘুরতে ডেকেছে, কেউবা ফটোগ্রাফির জন্য ডেকেছে। কিন্তু খেলার নেশা এতোটাই চেপেছিলো যে তারা এসবে পাত্তা দেয়নি৷  ডিপার্টমেন্ট নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে। নিজ ডিপার্টমেন্টের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে সাদাফ খেলেই চলেছে। তার পার্টনার কামাল। দুজনই ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টের তুখোড় তাস খেলুড়ে। মোটামুটি হলের সব রুমে গিয়ে সবাইকে হারিয়ে এসেছে তারা। হলে তাদের একটি সুনাম রয়েছে। তাদের প্রতিপক্ষ মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্ট। তারাও নামকরা খেলোয়াড়৷ বলা যায় এ হলের তাসের এল ক্লাসিকো ম্যাচ চলছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেলো সাদাফদের দুই গেইম খেলতে। দুইটা গেইম তারাই জিতেছে। প্রতিদিনই যে তারা জেতে, এমন না। তবে আজ কার্ডের হাত ভালো ছিলো।

নিচতলার প্রতিটি রুমে গল্প করে, দুই তলায় কেমিক্যাল, বায়োটেকনোলজি ও কম্পিউটার সাইন্স ডিপার্টমেন্টের রুমে আড্ডা দিয়ে, তিন তলায় নিজেদের রুমে আসতে আসতে রাত দশটা বেজে গেলো। এমনটা প্রতিদিনই ঘটে। শুধু আড্ডার স্থানগুলো হয়তো পরিবর্তন হয়।  ইনভাইরোনমেন্টাল সাইন্স ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরা এসে হাজির৷ আজ বৃহস্পতিবার। যথারীতি হলের ছাদে গান বাজনা হবে। তাতের হাতে ওয়াটার হিটার, চা ও চিনি। সাদাফ নোবেলকে ফোন দিয়ে কয়েক প্যাকেট ডার্বি সিগারেট আনতে বলল আর নিজেদের জন্য গোল্ডলিফ। ফিশারিজ ও পেট্রোলিয়াম ডিপার্টমেন্টের বন্ধুদের ফোন দিয়ে সিদ্ধির ব্যবস্থা করতে বললো। তারপর কাপড় পাল্টিয়ে চলে গেলো পাঁচতলার ছাদে। 


৩.
ছাত্রী হলের ৩০৫ নম্বর রুমে জেরিন থাকে। তার সাথে বায়োটেকনোলজির দুজন আলভি ও সাবরিনা এবং নিজ ডিপার্টমেন্টের আশা থাকে। চারজনেই একই ইয়ারের ছাত্রী। তাই তাদের মধ্যে বন্ধুত্বটাও ভালো। সারাদিন ত্লাস করে এসে সবাই বিকেলে ঘুরতে যায়। আজও গিয়েছিলো তারা। ক্যাম্পাসে এক চক্কর দিয়ে বাইরেও গিয়েছিলো তারা। প্রতিটা স্থানেই জেরিনের চোখ খুঁজেছে সাদাফকে। কিন্তু আমরা তো জানি সাদাফ ছিলো কার্ডের নেশায়। রুমে ফিরে সারাদিন কে কি করলো তা নিয়ে গল্প করে। 


ভার্সিটির প্রথম বর্ষে মেয়েদের না চাইলেও একটা সম্পর্ক হয়ে যায়। বা তারা করে ফেলে। যাদের পূর্বেই কোনো সম্পর্ক থেকে তাদের কথা আলাদা। যারা আবার চতুর তারা মিথ্যা সম্পর্কের কথা বলে সিনিয়রদের এড়িয়ে চলে। যারা পড়ুয়া বা পর্দানশীল, তাদের কেউ বিরক্ত করে না৷ বাঁকি যারা থাকে, তাদের প্রথম বর্ষে কিছুটা চাপে থাকতে হয়। এটা যে নিয়ম তাও নয়।

আশা পড়ুয়া মেয়ে। পড়াশোনা ছাড়া তার কোনো চিন্তা কাজ করে না। সে ফার্স্ট হতে চায়, হয়তো হয়েও যাবে। যদিও গত সেমিস্টারে সে তৃতীয় হয়ে ছিলো৷ আলভি ও সাবরিনা ওতোটা পড়ুয়া নয়, জেরিনের মতো অল্প পড়ে মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করে। আশা হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসেছে। আলভি ফোন টিপছে ও সাবরিনা রান্না করছে। জেরিন বিছানায় শুয়ে উদাসমনে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে৷ আলভিকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে বললেও জেরিনকে সাবিরানা কিছু বলল না।

জেরিনের এই অবস্থা বান্ধবীদের চোখ এড়ায়নি। আর এই ঘটনাটা নতুনও নয়। প্রায় ছয়মাস হলো এমনটাই ঘটছে। দিন দিন জেরিনের উতলা মনা বাড়ছে। বান্ধবীরা তাকে সতর্কও করেছে। সাদাফ ভালো ছেলে নয়, তার ভবিষ্যৎ ভাৱো নয়। সে বন্ধু ও পার্টি নিয়েই পড়ে থাকে। পড়াশোনা নিয়ে তার উদাসীনতা ভার্সিটির প্রতিটা ডিপার্টমেন্ট জানে। শুধু তার লিডারশিপের জন্য ভার্সিটিতে তার একটা নামডাক রয়েছে। এর বেশি কিছু না।


'কোথায় হারাইলি বান্ধবী?' আশা মুচকি হেসে বলল


'জানি না রে। খুঁজতেছি।' জেরিনের অভিব্যক্তিহীন জবাব


'এতো মজে গেছিস যে, আশেপাশের কিছু আর খেয়াল রাখিস না।' আলভি বলল।


'কেন কি হয়েছে?'


'গোশত রান্না করেছিস বুঝতে পারছি। আমাদের জন্য তো কিছু রাখতে পারতি।' সাবরিনা বলল


'সরি দোস্তো, আমি তোদের কালকে খাওয়াব। আগামীকাল শুক্রবার। প্রমিস'


'পেট ভরে খাওয়াতে পারলি গোশত-রুটি?' আলভি বলল।


'পারলাম আর কই, বন্ধুদেরই তো সব দিয়ে দিলো। দুজন মিলে একটা খাইলাম।'


বলিস কি? সাদাফ ভাইয়ার বন্ধু পিরিতি একটু বেশিই' আশা বলল।


'এতো পিরিতি ভালো না!' সাবরিনা মুচকি হেসে বলল


'আমাকে বললি নাকি ওকে?'


'দুজনকেই বললাম। তোর ওনার প্রতি আর ওনার বন্ধুর প্রতি।' 


'আর জ্ঞান দিস না। আমি আছি ঝামেলায়।


কেন কি হয়েছে?'


'কোনোকিছুতে মন বসছে না। সন্ধ্যা থেকে ফোন দিচ্ছি, একবারও রিসিভ করেনি।'


'নিশ্চিত তাস খেলে বেড়াচ্ছে। ওরা তো আবার হলের চ্যাম্পিয়ন।'


'এতো খবর যে কই পাস তোরা?'


'কোন ছেলে কোন কালারের লুঙ্গি পড়ে, সবই এই হলের মেয়েরা জানে।' আলভি বলল।


'কিভাবে বল তো?' আশা বই থেকে মাথা তুলে জিজ্ঞেস করলো। 


'ওরাই বলে দেয়। সারারাত জেগে সিনিয়র আপুরা আর কি গল্প করবে বল, এসবই করে। কান পাতলে আমরাও শুনতে পাই' সাবরিনার কথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।

ক্যাম্পাসে জেরিনের আপন বলতে এখানে এই চারজনই। তারাই ওকে হাসায়, ওকে ভালো রাখে। ক্যাম্পাসে এদের সাথেই বেশি সময় কাটায়। সাদাফ তো থেকেই নেই। সিনিয়র কিছু আপু আছে, যারা হয়তো সাদাফের কারণেই তাকে বেশ স্নেহ করে। পরিবার ছেড়ে এসে এরাই একটি পরিবার হয়ে গেছে। নিজেরা যেমন লুকিয়ে রান্না করে খায়, তেমনি প্রেমিকের জন্যও লুকিয়ে রান্না করে নিয়ে যায়। অন্য মেয়েরা অবশ্য ছেলেদের দিয়ে সব কাজ করিয়ে নেয়। কিন্তু এই তিনজন, আশার কোনো প্রেমিক  নেই, তেমনটা করে না। হয়তো আরোও কিছু সময় গেলে তারাও করবে।

'আমি বলি কি, এখন তো পড়ার সময়। প্রেম ট্রেমে সময় ব্যয় না করে পড়লে ভালো হয় না?' আশা বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল।


'আমি প্রেম করছি না, আশা। আবার এটা প্রেম ছাড়া অন্য কিছু না। আমি আসলে কি করছি জানি না।' আশার দিকে তাকিয়ে বলল জেরিন।

আশা তার বিছানা ছেড়ে উঠে এসে জেরিনের পাশে বসলো। জেরিনও উঠে সোজা হয়ে বসলো, কোলে বালিশ নিয়ে নিজের ফোনটা হাতে ঘোরাতে লাগলো। 


'তোকে শুরুতেই বলেছিলাম, কিছুদিন ঘুরে ফিরে ছেড়ে দে। কিন্তু তুই দিন দিন সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছিস। ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না' আশা বেশ গম্ভীরভাবে বলল।


'ছেলেটা তো খারাপ না' আলু কাটতে কাটতে আলভি বলল।


'কিন্তু লাইফ নিয়ে তো সে সিরিয়াসও না' আশা জবাব দিলো।


'এখন না, হয়তো সামনে হবে। বাবার টাকা আছে তাই এমন উড়নচণ্ডী হয়েছে।' আলভি বলল।


'ভালো হবে নাকি খারাপ হবে, তা জানি না। কিন্তু সিকিউরড ফিউচারের জন্য ভালো চয়েস সে নয়।' সাবরিনা বলল।

জেরিন কোনো কথা বলছে না। তার মাথাতে এমন চিন্তাও এসেছে।  কিন্তু কোথাও যেন কোনকিছু অনুভব করে সে। সে এমন নয় ভালোবাসা দিয়ে এমন বাউণ্ডুলে ছেলেকে ভালো করে দেবে। বা লাইফ নিয়ে সিরিয়াস করে তুলবে। কিন্তু সাদাফের যে জিনিসটা তার সবচেয়ে ভালো লেগেছে তা হলো তার পরোপকারীতা। বিনা স্বার্থে যে মানুষ যে কাউকে সাহায্য ও উপকার করতে পারে, এর ছোট্ট নমুনা সে দেখেছিলো যেদিন সে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছিলো। 


'জেরিন, তুই বল। তুই কি এসব ভেবেছিস?' আশা জিজ্ঞেস করলো 


কিছুক্ষণ আশার দিকে তাকিয়ে জেরিন বলল 'আমি সবই ভেবেছি। কিছু বিষয় হয়তো চাইলেও নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আমি তার থেকে বড় আঘাত না পাওয়া পর্যন্ত হয়তো তাকে ভুলতে পারবো না।'


'এমনটা হোক তা আশা করি না। আমার মনেহয় অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস সাদাফ ভাইয়াকে এরকম করে দিয়েছে।' সাবরিনা বলল


'কিভাবে?'


'দেখ, সারাদিন ক্লাস বাঙ্ক করে, ফাঁকি দিয়ে থার্ড ইয়ার পরেও তার রেজাল্ট কিন্ত যথেষ্ট ভালো। তারমানে সে প্রচন্ড মেধাবী। কিন্তু সে পড়ুয়া নয়। ছেলেরা এমন হয়ই।'


'তা ঠিক। কিন্তু' আশার কথা থামিয়ে দিয়ে আলভি বলল


'কোনো কিন্তু না। যা হবার হবে। এখন আমাকে বল আমি কি করব? কালকে শহরে যেতে বলেছে, যাব?'


'এদিকে একজন চেয়েও সময় পায় না, ওদিকে আরেকজন প্রতি সপ্তাহে ডেটিং করতে যায়।'


'আর বলিস না। কেউ যদি তার টাকা খরচ করে আমাকে খাওয়াতে চায়, আমি কেন মানা করব?' আলভির কথায় সবাই হেসে উঠলো।

রাতের খাওয়া শেষ করে আলভি ও সাবরিনা গেছে টিভি রুমে। আজ তারা ডিম ভূনা রান্না করেছিলো। জেরিনের মনটা এখন ভালো। সাদাফের মেসেজ এসেছিলো। সেও খেয়েছে। জেরিন খেয়েছে কিনা তার খোঁজ সাদাফ নিয়মিত নেয়। কিন্তু এ পর্যন্তই। এর বাইরে যে দুটি কথা থাকতে পারে, তা সাদাফ কখনো বলেনি৷ শেষে একটাই মেসেজ, পড়তে বসো।

তাই জেরিন পড়তে বসেছে। আশা বিষয়টি উপভোগ করে। সে সাদাফের সাথে সম্পর্কটা মানতে পারে না, কিন্তু সাদাফ কখনো জেরিনের সময় নষ্ট করায় না। যদিও সাদাফের কারণে জেরিন উদাস মনে বসে থাকে।

কিছুক্ষণ পড়ার পরেই আলভি ও সাবরিনা রুমে ঢুকলো। তারা বেশ বিরক্ত। 


শান্তিমতো একটু টিভি দেখব তার জো নেই। এমনিতেই সিনিয়রদের কারণে কিছু দেখতে পারি না। যখন পারলাম, তখন শুরু হলো হৈ-হুল্লোড়' আলভি বলল


'কিসের হৈ-হুল্লোড়?  জেরিন জানতে চাইলো


'ছেলেদের হলের ছাদের উপরে গানবাজনা চলছে। হলের ওইপাশে থাকা যাচ্ছে না। 


জেরিনদের রুম হলের দক্ষিণ দিকে। উত্তর দিকে ছেলেদের হল। হলের বর্ধিত একটি অংশ আবার মেয়েদের হলের খুব কাছে। সেখানেই ছেলেরা পালাক্রমে আড্ডা দেয়।


'আজ তো বৃহস্পতিবার। এমনটা তো হবেই।' আশা বলল।


জেরিন কিছু বলল না। গত দশমাস ধরে এটা তারা শুনে আসছে। সে এটাও জানে এসবের পেছনে সাদাফই রয়েছে। তার উপর কাল পূর্ণিমা। তাই আজ তো ওদের গানের আসর আরও জমবে। ছেলেদের হলে নানান ধরনের প্রতিভা থাকে। কেউ হঠাৎ মাঝরাতে মায়াবী সুরে বাঁশি বাজায়। কেউ পানির ট্যাংকির উপরে উঠে সুরেলা কন্ঠে গান গায়। সেসব বেশ শ্রুতিমধুর। কিন্ত পূর্ণিমা ও বৃহস্পতিবার রাতে যা হয় তা অসহনীয়। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটা করে সাদাফ ও তার বন্ধুরা।

'আপুরা এবার অনেক ক্ষেপেছে। তারা নাকি প্রভোস্টকে ফোন দিয়ে জানাবে।' সাবরিনা বলল


'নিশি আপু, মালিহা আপু তারা ওখানে ছিলো না?' জেরিনের কণ্ঠে জড়তা স্পষ্ট। নিশি ও মিথিলা সাদাফের ক্লাসমেট। সাদাফ গ্যাং-এর বিরুদ্ধে ছাত্রী হল থেকে অভিযোগ উঠলে তারা বিষয়টা সামাল দেয়। 


'তারা আর কি বলবে, তারাও তো বিরক্ত। 


'এবার যদি প্রভোস্টকে বলে কোনো কাজ হয়।


'এর আগেও তো বলেছিল। কোনো কাজ হয়েছে?' আশা বলল


'এবার তো নতুন প্রভোস্ট। আর তোদের ডিপার্টমেন্টের ম্যাডাম। দেখা যাক কি হয়।' জেরিনকে বলল আলভি।

জেরিন খুব চিন্তায় পড়ে গেলো। এবার যিনি প্রভোস্ট তিনি অনেক কড়া। যদি সত্যিই কোনো এ্যাকশন তিনি নিয়ে নেন, তখন সাদাফের কি হবে। ফোনটা হাতে নিয়ে সে সাদাফকে ফোন দিলো৷ রিং হচ্ছে কিন্তু ফোন ধরছে না। কয়েকবার ফোন দিয়েও সাদাফকে পাওয়া গেলো না। জেরিন ওদেরকে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।

(চলবে)

পুনশ্চঃ ভার্সিটি জীবনের এমন ঘটনা অনেকের সাথেই মিলে যেতে পারে। তারা আওয়াজ তুলুন। 

Comments

    Please login to post comment. Login