রূপসা প্রতিদিনের মতো বিকেলে বারান্দায় বসে বই পড়ছিল। হঠাৎ ডাকপিয়ন একটা খাম দিয়ে গেল। খামে লেখা ছিল— “শুধু তোমার জন্য”।
চিঠিটা খুলতেই সে দেখল, কারো সুন্দর হাতের লেখা—
“তোমাকে আমি অনেক দিন ধরে দেখি। তোমার হাসিটা যেন পুরো শহরকে আলোকিত করে। আমি জানি না তুমি আমাকে চিনো কি না, তবে আমার হৃদয় তোমাকে ছাড়া আর কিছুই ভাবে না।”
রূপসা অবাক হয়ে গেল। কে হতে পারে?
পরের দিন কলেজে যাওয়ার পথে সে লক্ষ্য করল, পাশের ক্লাসের অর্ণব দূর থেকে তাকিয়ে আছে। চোখে এক অদ্ভুত কোমলতা। রূপসার মনে পড়ল চিঠির শব্দগুলো।
কয়েকদিন পরে আবার একটি চিঠি এল—
“যদি অনুমতি দাও, আমি একদিন তোমার সাথে গল্প করতে চাই। শুধু পাঁচ মিনিট।”
রূপসা অনেক ভেবেচিন্তে উত্তর দিল, ছোট্ট একটা কাগজে— “আগামী শুক্রবার, লালচত্বরের পুরোনো বটগাছের নিচে।”
শুক্রবার বিকেল। রূপসা এসে দাঁড়াল। কয়েক মিনিট পর অর্ণব এগিয়ে এল, হাতে একটা গোলাপ। চোখেমুখে লাজুক হাসি।
রূপসা কিছু না বলে শুধু মুচকি হাসল। সেই মুহূর্তে দু’জনের চোখের ভাষাই সব কথা বলে দিল।
সেদিন থেকে তাদের গল্প আর চিঠি শেষ হয়নি, বরং শুরু হয়েছিল এক নতুন ভালোবাসার যাত্রা।
সেদিনের পর থেকে রূপসা আর অর্ণবের আলাপ ধীরে ধীরে গভীর হতে লাগল। কলেজ শেষে দু’জনে প্রায়ই একসাথে বাড়ি ফিরত। অর্ণব রূপসার জন্য ছোট ছোট চমক রাখত—কখনো প্রিয় চকলেট, কখনো একটা ছোট্ট কবিতার খাতা।
রূপসা শুরুতে একটু দ্বিধায় থাকলেও বুঝতে পারল, অর্ণবের ভালোবাসা একেবারেই নিখুঁত আর সত্যি। ওর চোখে কোনো ভান নেই, শুধু একরাশ আন্তরিকতা।
একদিন রূপসা বলল,
— “তুমি কেন আমাকে চিঠি লিখেছিলে? সরাসরি বলতে পারতে তো।”
অর্ণব হেসে বলল,
— “কথায় আমি তেমন ভালো না, কিন্তু কাগজে-কলমে আমার মন খুলে যায়। তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম, তুমি হয়তো একেবারেই পাত্তা দেবে না।”
রূপসা হেসে উঠল।
— “আর এখন?”
অর্ণব বলল,
— “এখন শুধু চাই, তুমি যেন আমার সাথে স্বপ্ন বুনো।”
রূপসা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর মাথা নিচু করে বলল,
— “তাহলে আমিও একটা স্বপ্ন বলি—আমরা দু’জনে মিলে একদিন নদীর ধারে একটা ছোট্ট কুটির বানাবো। বই, গান আর ভালোবাসা দিয়ে সাজানো।”
অর্ণব বিস্মিত হয়ে তাকাল, তারপর মৃদু হাসল।
সেই মুহূর্তে দু’জনের চোখে চোখ মেলেই যেন ভবিষ্যতের ছবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠল।
ভালোবাসা আসলে চিঠি দিয়ে শুরু হলেও, তার যাত্রা হলো দু’জনের হৃদয়ের গভীরে।
অর্ণব আর রূপসার দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল খুব সুন্দরভাবে। কিন্তু ভালোবাসার পথে সবসময় রোদের মতো আলো থাকে না, মাঝেমাঝেই মেঘ জমে।
একদিন হঠাৎ রূপসার বাবা তাদের কথা জেনে গেলেন। তিনি কঠোর স্বরে বললেন,
— “কলেজের পড়াশোনার বয়সে এসব প্রেম-ভালোবাসা মানায় না। অর্ণবকে আর দেখবে না তুমি।”
রূপসা ভীষণ ভেঙে পড়ল। সে অর্ণবকে কিছু না বলেই কয়েকদিন কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দিল।
অর্ণব বারবার খুঁজতে লাগল, কিন্তু কোনো উত্তর পেল না। শুধু একদিন তার লকারে একটা ছোট্ট কাগজ পেল—
“ক্ষমা করো, আমি বাবার কথা অমান্য করতে পারব না। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে ভুলে যাব না।”
চিঠিটা পড়ে অর্ণবের চোখ ভিজে গেল।
কিছুদিন পরে রূপসা কলেজে ফিরল, কিন্তু অর্ণবের সাথে কথা বলত না। শুধু দূর থেকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকত। দু’জনের মাঝের দূরত্ব যেন বেড়ে যাচ্ছিল।
অর্ণব একদিন সাহস করে বলল,
— “রূপসা, তুমি যদি একবার আমাকে বিশ্বাস করো, আমি তোমার বাবার কাছে গিয়ে বলব আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি।”
রূপসা কাঁপা গলায় বলল,
— “না অর্ণব, এখন না। সময় আসুক। যদি আমাদের ভালোবাসা সত্যি হয়, তবে একদিন সব বাধা কেটে যাবে।”
অর্ণব শুধু মাথা নত করে চুপ করে রইল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে প্রতিজ্ঞা করল—
“যা-ই হোক, রূপসাকে আমি ছাড়ব না।”
সময় কেটে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। রূপসা আর অর্ণব দু’জনেই নিজেদের মতো চেষ্টা করছিল পড়াশোনায় মন দেওয়ার। কিন্তু হৃদয়ের ভেতরে একে অপরের নামই ঘুরপাক খাচ্ছিল।
অর্ণব একদিন সিদ্ধান্ত নিল—ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তবে লুকিয়ে রাখলে চলবে না। সে সাহস করে রূপসার বাবার বাড়িতে গেল।
রূপসার বাবা প্রথমে খুব রেগে গেলেন।
— “তুমি আবার এখানে কেন? আমার মেয়ের কাছে আসার সাহস কীভাবে হলে?”
অর্ণব শান্ত গলায় বলল,
— “কাকা, আমি রূপসাকে ভালোবাসি। কিন্তু এটুকু প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি—আমি পড়াশোনা শেষ না করে, নিজের পায়ে দাঁড়ানো ছাড়া ওকে কোনোদিন বিয়ে করার কথা বলব না। আমি শুধু চাই, আপনি যেন জানেন আমার ভালোবাসা কোনো খেলার মতো নয়।”
রূপসার মা তখন পাশে এসে দাঁড়ালেন। তিনি স্বামীকে বললেন,
— “ছেলেটার চোখে ভরসা আছে। হয়তো সত্যিই মনের মতো ভালোবাসে।”
বাবা যদিও তৎক্ষণাৎ রাজি হলেন না, তবে তিনি আর অর্ণবকে তাড়িয়ে দিলেন না।
দিন যায়। অর্ণব কঠোর পরিশ্রম শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো, পাশাপাশি একটি চাকরিও পেয়ে গেল। কয়েক বছর পর আবার এক সন্ধ্যায় সে রূপসার বাড়িতে গেল।
এইবার রূপসার বাবার চোখে আগের সেই রাগ ছিল না। বরং এক নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
— “তুমি তোমার কথা রেখেছো। এবার আমি আর বাঁধা দেব না।”
রূপসা খুশির অশ্রুতে ভিজে গেল। অর্ণবের দিকে তাকিয়ে শুধু ফিসফিস করে বলল,
— “আমি বলেছিলাম তো, সত্যিকারের ভালোবাসা কোনো বাধা মানে না।”
সেই দিন থেকেই তাদের ভালোবাসার যাত্রা নতুন রূপ পেল—অচেনা চিঠি দিয়ে শুরু হওয়া গল্প শেষ হলো এক চিরন্তন বন্ধনে।