প্রথম অধ্যায় : কবরের নীরবতা
(তানভীরের দৃষ্টিকোণ থেকে)
শহরের ভিড়ভাট্টা, গাড়ির হর্ন, মানুষের হৈচৈ ফেলে যখন আমি পুরনো কবরস্থানের পথে হাঁটতে শুরু করলাম, তখনই মনে হলো—এক অজানা অন্ধকারের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছি। চারদিকে কেবল নিস্তব্ধতা।
সন্ধ্যার আলো ফিকে হয়ে আসছে, আকাশে আধো চাঁদ। ঝোপঝাড়ে ঢাকা শ্যাওলা ধরা কবরগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে—যেন অতীতের ভাঙা স্মৃতি। বাতাসে শুকনো পাতার খসখস শব্দ, দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল সময় এখানে থমকে আছে।
ঠিক সেই মুহূর্তেই চোখে পড়ল—একটা নামফলকহীন কবরের পাশে বসে আছে এক মানুষ।
প্রথমে মনে হলো, হয়তো কোনো ভিক্ষুক বা পথের মানুষ। কিন্তু কাছে আসতেই শরীর কেঁপে উঠল।
লোকটির গায়ে ছেঁড়া মলিন কাপড়। শরীরটা হেলে আছে, এক হাতে শক্ত করে লাঠি আঁকড়ে ধরে আছে, যেন দাঁড়িয়ে থাকাই তার জন্য যুদ্ধ। চোখের কোণে কষ্টের ছাপ। তার ডান পা মাটিতে ঠেকানো, বাম পা কাপড়ে মোড়ানো। গন্ধে বোঝা গেল—পা পচে যাচ্ছে।
এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো—আমি কি কোনো জীবন্ত লাশের সামনে এসে দাঁড়ালাম?
লোকটা চুপচাপ বসে আছে কবরের পাশে। তার চোখ ভিজে আছে, অশ্রু কবরের মাটিতে ঝরে পড়ছে। ঠোঁট নড়ছে—মনে হলো কারও সাথে কথা বলছে, অথচ সেই শব্দগুলো আমার কানে পৌঁছাচ্ছে না।
আমার বুক কেঁপে উঠল। অদ্ভুত এক টান অনুভব করলাম তার প্রতি। মনে হলো, এই মানুষটার বুকের ভেতর লুকিয়ে আছে এমন এক গল্প, যা পৃথিবী জানে না।
আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। কবরটা খুব নতুন নয়, কিন্তু যত্নের অভাবে ঘাসে ঢেকে গেছে। কোনো নামফলক নেই। শুধু নীরবতা।
আমি থেমে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলাম—
—ভাই, এখানে বসে আছেন কেন? কার কবর এটি?
লোকটা ধীরে মাথা তুলল। চোখ দুটো লালচে, ভেতরে জমে আছে গভীর যন্ত্রণা। ক্লান্ত, ক্ষয়িষ্ণু মুখে যেন দুঃখ খোদাই হয়ে আছে।
সে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ভাঙা গলায় ফিসফিস করে বলল—
—এ আমার মায়ের কবর।
শব্দগুলো যেন বজ্রাঘাতের মতো আঘাত করল আমাকে। বুকের ভেতর হাহাকার উঠল। আমি এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম।
আমার মনে হলো—এই কবরের নীরবতা, এই মানুষের কান্না—সব মিলিয়ে এখানে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর কাহিনী।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম—এই মানুষটার গল্প আমাকে শুনতেই হবে। কারণ তার চোখের ভেতর জমে থাকা যন্ত্রণা শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটা আমাদের সবার জন্য এক শিক্ষা।
অধ্যায় ২ : মায়ের আঁচল
(মাহিরের কণ্ঠে — তানভীর শুনছে)
এর মাঝেই তার সাথে পরিচয় হয়। সে বলে —
—তানভীর ভাই, জানেন, আমার জীবনের প্রথম বড় আঘাত এসেছিল যখন আমার বয়স মাত্র দশ। সেদিন স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি খবর পেলাম—আমার বাবা আর নেই। সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা গেছেন।
এক মুহূর্তে আমার শৈশব ভেঙে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, পৃথিবী যেন হঠাৎ করে অন্ধকার হয়ে গেল।
সেদিন মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। তার চোখে অশ্রু ছিল, কিন্তু বুকের ভেতর ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা।
তিনি ফিসফিস করে বলেছিলেন—
“তুই কাঁদিস না বাবা, আমি আছি তো।”
তারপর থেকে আমার আকাশ–পাতাল সব হয়ে গেল মা।
আমাদের সংসার ছিল ছোট—এক কামরার টিনের ঘর, চৌকাঠের পাশে মাটির হাঁড়ি, আর মায়ের ঘামে ভেজা শাড়ি। বাবা না থাকায় সংসারের ভার পুরোপুরি এসে পড়ল তার কাঁধে।
ভোরের আলো ফুটতেই মা ঘর থেকে বের হতো। কারও বাসায় বাসন মাজত, কারও বাসায় কাপড় কাচত। সূর্যের তাপে তার শরীর পুড়ত, কিন্তু আমার স্কুল ফি আর খাতার টাকার জন্য সে যুদ্ধ করত প্রতিদিন।
আমি স্কুলে যাওয়ার আগে মা আমাকে খাওয়াত। ভাতের সাথে হয়তো সামান্য আলু ভর্তা বা ডাল থাকত, কিন্তু তার চোখের মমতা আমাকে রাজকুমারের মতো মনে করাত।
“আমার জাদু সোনা, খেয়ে নে—না হলে ক্লাসে ক্ষুধা লাগবে।”
রাতে ঘুম না এলে মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। ফিসফিস করে বলত—
“চোখ বন্ধ কর, ঘুম এলে স্বপ্নে আমি থাকব।”
তখন আমার ছোট্ট ঘরটা স্বর্গ হয়ে উঠত।
আমি বুঝতাম, মা কষ্ট করছে। কিন্তু ছোট বয়সের চোখে তা শুধু একটা গল্প মনে হতো।
কোনো কোনো দিন মা কাজ থেকে ফিরে এত ক্লান্ত হয়ে পড়ত যে খেতে বসে ঘুমিয়ে যেত। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম—এ পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ আমার মা।
পাড়ার লোকজন অনেক সময় তাচ্ছিল্য করে বলত—“ও তো ভিখারির মতো অন্যের বাসায় কাজ করে।”
কিন্তু আমার কাছে মা ছিল যোদ্ধা, নায়িকা।
আজ মনে হয়—আমার মা–ই ছিলেন আমার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়। তার ত্যাগের প্রতিটি মুহূর্তে ছিল শিক্ষা, ভালোবাসা আর বেঁচে থাকার প্রেরণা।
তবুও আমি বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই শিক্ষাগুলো ভুলে গিয়েছিলাম।
মাহির কিছুক্ষণ নীরব রইল। চোখ ভিজে এলো। তারপর ভাঙা কণ্ঠে বলল—
—তানভীর ভাই, এখন বুঝতে পারি… মা–এর প্রতিটি দিন ছিল আমার জন্য যুদ্ধ। আর আমি? আমি সেই মাকে অবহেলা করেছি। আমি মহাপাপী।
তার ঠোঁট কাঁপছিল। শব্দগুলো বাতাসে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছিল।
আমি তাকিয়ে রইলাম তার দিকে, আর ভেতরে ভেতরে অনুভব করলাম—এই স্বীকারোক্তির পেছনে লুকিয়ে আছে এক ভয়ঙ্কর গল্প, যা এখনও আমার কানে শোনা হয়নি।
অধ্যায় ৩ : প্রেমের বাঁক
(মাহিরের কণ্ঠে — তানভীর শুনছে)
—সময় নদীর স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছিল, তানভীর ভাই। শৈশবের সেই ক্ষুধা-দুঃখ পেরিয়ে আমি তখন কলেজে উঠলাম। মনে হলো, জীবনে নতুন এক দরজা খুলে গেছে।
আমি নরসিংদীর নামকরা এক কলেজে ভর্তি হলাম। নতুন বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, খেলাধুলা—সব মিলিয়ে আমার জগৎ বদলে গেল।
কিন্তু সেই বদলের ভিড়ে, আমার জীবনে এক মানুষ এসে ঝড় তুলল—মাইশা।
প্রথম দেখাতেই মাইশা আলাদা মনে হয়েছিল। সাদা গায়ের রঙ, ঘন কালো চুল, হাঁটার ভঙ্গি—সবকিছুতে এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। ক্লাসে পড়াশোনায় সে ভালো, আর কথা বলত ভীষণ মিষ্টি করে।
ধীরে ধীরে আমাদের আলাপ বাড়ল। ক্লাস শেষে একসাথে দাঁড়িয়ে গল্প করতাম, কখনো কলেজের মাঠে বসে সূর্যাস্ত দেখতাম।
সেই বয়সে মনে হয়েছিল, এটাই ভালোবাসা।
আমি প্রতিদিন তার সাথে দেখা করার অজুহাত খুঁজতাম। এর জন্য ঘরে ফিরতে দেরি হতো। মা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত, কিন্তু আমি হাসিমুখে মাইশার সাথে কাটানো সময়ের স্মৃতি বুকে নিয়ে ফিরতাম।
মা জিজ্ঞেস করলে বিরক্তি নিয়ে বলতাম—
“আরে মা, একটু তো দেরি হবেই।”
তখন বুঝিনি, মায়ের হৃদয় প্রতিদিন কতটা ভেঙে যাচ্ছিল।
একদিন মাইশা বলল—
“তুমি কি জানো, আমার পরিবার আমাকে তোমার সাথে সম্পর্ক রাখতে দেবে না?”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম।
“কেন?”
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—
“আমরা দুই ভিন্ন পরিবার, তারা মানবে না।”
আমার বুকের ভেতর আগুন জ্বলে উঠল। মনে হলো, আমি যদি তাকে না পাই, তাহলে আমার জীবনই বৃথা।
আমি তখনো তরুণ, রক্ত গরম। না ভেবে, না বুঝে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। এক রাতে মাইশাকে নিয়ে পালালাম। লুকিয়ে বিয়ে করলাম।
আমার মনে হয়েছিল—এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জয়। আমরা সুখী হব, মা–কে পাশে নিয়েই ছোট্ট একটা সংসার গড়ে তুলব।
কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।
যখন মা খবর পেলেন, তিনি ভেঙে পড়লেন। তার চোখে ছিল কান্না, কণ্ঠে ছিল হতাশা।
তবুও তিনি আমার জন্য মুখ বুজে সব মেনে নিলেন।
আমি তখন বুঝিনি, সেই মুহূর্ত থেকেই আমার জীবনের অন্ধকার অধ্যায় শুরু হয়ে গেছে।
অধ্যায় ৪ : অশান্তির আগুন
(মাহিরের কণ্ঠে — তানভীর শুনছে)
—প্রথম কয়েক মাসে মনে হয়েছিল আমি স্বপ্নের ভেতর আছি। তানভীর ভাই, মাইশা আর আমি—আমাদের ছোট্ট সংসারটায় সুখ যেন কড়াইভাতের মতো সহজে মিশে গেছে। মা প্রথমে চুপ ছিলেন, কষ্ট পেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার জন্য সবকিছু মেনে নিয়েছিলেন।
আমি ভেবেছিলাম, মা আর স্ত্রী মিলে সংসারটা গড়ে তুলবে।
কিন্তু জানতেন না, সুখ নামের সে ফুলটা আসলে অনেকটা আগুনে ঝলসে যাওয়া কাগজের মতো ক্ষণস্থায়ী।
ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলাম—মায়ের সাথে মাইশার সম্পর্ক তেমন ভালো যাচ্ছে না। বাইরে মানুষের সাথে ইমরা দেবদূতের মতো ব্যবহার করত। প্রতিবেশীরা তাকে ভালো বলে জানত। কিন্তু ঘরের ভেতরে তার অন্য চেহারা বেরিয়ে আসত।
রান্নায় একটু লবণ বেশি হলে সে মায়ের দিকে চিৎকার করে উঠত।
বাসন একটু দেরি করে ধোয়া হলে কটূকথা বলত।
মা কিছু বলতেন না। নীরবে সব সহ্য করতেন।
আমি তখন অন্ধ ছিলাম। মাইশার কথাই সত্যি মনে হতো।
একদিন মা অনেক যত্ন করে আমার জন্য ভাত রান্না করেছিলেন।
ইমরা ফিসফিস করে কানে বলল—
“তোমার মা ইচ্ছে করে এমন করেছে, তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য।”
রাগে আমি খাবারের থালা মাটিতে আছড়ে ফেললাম।
মা কিছু বললেন না। শুধু চুপচাপ চোখের জল মুছলেন।
সেই দৃশ্য আজও আমার বুক ছিঁড়ে দেয়।
দিন যেতে যেতে সংসারে অশান্তি বেড়ে গেল।
মাইশা চাইত আমি কেবল তার কথাই শুনি।
মায়ের প্রতি যত্ন কমে গেল, বরং অবহেলা শুরু করলাম।
মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
তার ওষুধ কেনার টাকা আমি দিলাম না—কারণ বউয়ের মুখ ভার ছিল।
রাতে ঘরে ঘুমাতে গিয়ে মায়ের কাশির শব্দ শুনতাম।
কিন্তু বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ভান করতাম কিছু শুনিনি।
একদিন মা মৃত্যুশয্যায় আমাকে কাছে ডাকলেন।
আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, কিন্তু হাত ধরলাম না।
তিনি কাঁপা কণ্ঠে শুধু বললেন—
“ভালো থেকো বাবা।”
তারপর চোখ বন্ধ করলেন।
সেদিন আমি শুধু এক মা–কে হারাইনি—নিজেকেও হারিয়েছিলাম।
অধ্যায় ৫ : অপরাধবোধ
(মাহিরের কণ্ঠে — তানভীর শুনছে)
—তানভীর ভাই, মা চলে যাওয়ার পর আমার জীবনের ভেতরে এক শূন্যতা নেমে এলো। মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতর থেকে কেউ হৃদয়টা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। চারপাশে মানুষ ছিল, সংসার ছিল, মাইশা ছিল—তবুও আমি প্রতিটি মুহূর্তে একা হয়ে যাচ্ছিলাম।
বাইরে সবাই ভাবত আমি সুখে আছি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমি প্রতিদিন মরছিলাম।
মায়ের মৃত্যুর পর প্রথম কয়েক সপ্তাহ আমি যেন দিশেহারা হয়ে গেলাম।
ঘুমাতে গেলেই মনে হতো মা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে দেখি ঘর খালি—শুধু নিস্তব্ধতা।
মাইশা আমার কানে ফিসফিস করে বলত—
“তোমার মা আমাদের সংসারটা ভাঙতে চাইত। এখন দেখো, আমরা শান্তিতে আছি।”
কথাগুলো শুনে আমি চুপ থাকতাম।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে বুক কেঁপে উঠত।
আমি জানতাম, মাইশার শান্তি আসলে আমার অশান্তি।
বাইরে বন্ধুদের সাথে বসে থাকলেও আমি হাসতে পারতাম না।
কাজে মন বসত না।
প্রতিটি আয়নায় নিজের মুখ দেখলে মনে হতো—এই আমি, যে নিজের মায়ের চোখে অশ্রু এনেছিল।
একদিন আয়নায় তাকিয়ে নিজেকেই বলেছিলাম—
“তুই আসলে একজন খুনি। নিজের মায়ের খুনি।”
শব্দগুলো আমার কানে প্রতিধ্বনি হয়ে বাজছিল।
আমি মনে করতে শুরু করলাম মায়ের প্রতিটি কথা।
মা যখন বলতেন—“খেয়ে নে বাবা, ক্ষুধা লাগবে”—
তখন আমি বিরক্ত হতাম।
কিন্তু এখন সেই শব্দগুলো যেন আমাকে তাড়া করে ফেরে।
রাতে ঘুম আসে না।
অপরাধবোধের আগুনে আমি জ্বলতে থাকি।
মানুষ ভাবে আমি সংসারে সুখী।
কিন্তু ভেতরে আমি ভেঙে পড়েছি, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছি।
—তানভীর ভাই, আজ আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি।
আমি আমার মায়ের ভালোবাসাকে, তার ত্যাগকে, তার অশ্রুকে অবহেলা করেছি।
তাই আল্লাহ আমাকে শান্তি দেন।
আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস আমাকে মনে করিয়ে দেয়—
আমি আমার মায়ের খুনি।
অধ্যায় ৬ : পতন
(মাহিরের কণ্ঠে — তানভীর শুনছে)
—তানভীর ভাই, মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই আমার মনে হচ্ছিল, আল্লাহ আমাকে ছেড়ে দিয়েছেন। অপরাধবোধের আগুনে আমি প্রতিদিন জ্বলছিলাম। কিন্তু সেই আগুন যেন এবার শরীরে নেমে এলো।
প্রথমে ছোট্ট একটা ক্ষত হয়েছিল আমার পায়ে। ভেবেছিলাম, সামান্য কেটে গেছে, কয়েকদিনে সেরে যাবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।
ক্ষত ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। লালচে হয়ে ফুলে উঠল।
আমি প্রথমে পাত্তা দিইনি।
ভাবতাম, অল্প কিছু ওষুধেই ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু একসময় ক্ষতটা কালো হয়ে গেল।
মাংস পচে যেতে লাগল।
গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল।
ডাক্তারকে দেখালাম। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—
“তোমার পায়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। দ্রুত অপারেশন না করলে বিপদ আছে।”
আমি অপারেশনের খরচ জোগাড় করতে পারিনি।
বাড়িতে বসে বসে দেখলাম আমার পা আস্তে আস্তে মৃত হয়ে যাচ্ছে।
একসময় আমি লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারতাম না।
প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল যন্ত্রণার পাহাড়।
পচনের গন্ধে আশেপাশের মানুষ আমার কাছাকাছি আসত না।
শিশুরা আমাকে দেখে ভয় পেত।
কেউ কেউ বলত—“ও তো অর্ধেক লাশ।”
আমি মাথা নিচু করে থাকতাম।
মনে হতো—এটাই আমার শাস্তি।
মাইশা প্রথমে পাশে ছিল।
আমার ক্ষত ধুয়ে দিত, খাবার এনে দিত।
কিন্তু ধীরে ধীরে তার চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল।
সে আমার দিকে তাকাত, আবার ঘৃণা নিয়ে চোখ সরিয়ে নিত।
আমার শরীর থেকে আসা দুর্গন্ধ সহ্য করতে পারত না।
এক রাতে আমি শুনলাম সে বলছে—
“আমি আর পারছি না। আমি এভাবে বাঁচতে চাই না।”
কিছুদিন পর মাইশা আমাকে ছেড়ে চলে গেল।
একটি বাক্যই ছিল তার শেষ কথা—
“আমি পচে যাওয়া মানুষকে নিয়ে বাঁচতে পারব না।”
সে দরজাটা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল। আর ফিরে তাকাল না।
আজ আমি একা।
আমার একমাত্র সঙ্গী এই লাঠি আর মায়ের কবর।
আমি জানি, এ কোনো কাকতাল নয়।
এ আমার মাকে অবহেলা করার শাস্তি।
অধ্যায় ৭ : শিক্ষা
(তানভীরের দৃষ্টিকোণ থেকে)
কবরস্থানের সেই নির্জন পরিবেশে মাহিরের কণ্ঠ থেমে গেল। চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল, যেন প্রতিটি গাছপালা, প্রতিটি কবর তার কথা শুনছিল। আমি তার দিকে তাকিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। মনে হচ্ছিল—আমি কোনো সাধারণ মানুষের গল্প শুনছি না, বরং ইতিহাসের এক ভয়াবহ উপাখ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
তার ভাঙা শরীর, পচে যাওয়া পা, লাঠি আঁকড়ে ধরা হাত—সব মিলে জীবন্ত শাস্তির প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
মাহিরের প্রতিটি স্বীকারোক্তি আমার হৃদয়ে তীরের মতো বিঁধছিল।
সে বলেছিল—
“আমি আমার মায়ের খুনি। আমি তার চোখের জলকে অবহেলা করেছি। আজ আমি একা, ভগ্নদেহ, আর মায়ের কবরই আমার একমাত্র আশ্রয়।”
আমি অনুভব করলাম, মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় শক্তি আসলে মায়ের দোয়া। সেই দোয়া হারালে মানুষ আর মানুষ থাকে না—সে হয়ে যায় শূন্য, ভাঙা, অভিশপ্ত।
আমি কবরের দিকে তাকালাম। আগাছায় ঢাকা নামফলকহীন মাটির ঢিবি। কিন্তু মনে হচ্ছিল, সেই মাটির ভেতর থেকে অশ্রুভেজা এক অদৃশ্য কণ্ঠ আমাকে প্রশ্ন করছে—
“তুমি তোমার মাকে কেমন রাখছো?”
মাহিরের চোখ ভিজে ছিল, কিন্তু তার কণ্ঠে এবার এক ধরনের শান্তি ফুটে উঠেছিল।
সে ফিসফিস করে বলল—
“তানভীর ভাই, আমি চাই না আর কোনো সন্তান আমার মতো হোক। মাকে অবহেলা করলে তার ফল এমনই হয়। আমি পচে যাওয়া মানুষ, এটা আমার জীবন্ত প্রমাণ।”
তার এই স্বীকারোক্তি যেন আমার বুকের ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে দিল।
আমি হঠাৎ আমার নিজের মায়ের মুখ মনে করতে লাগলাম—তিনি কেমন করে প্রতিদিন আমার জন্য কষ্ট করেন, হাসিমুখে ত্যাগ করেন। আমি ভেবে উঠতে পারছিলাম না—আমি কি তাকে যথেষ্ট মূল্য দিচ্ছি?
আমি মাহিরের হাত ধরে বললাম—
“ভাই, আপনার গল্প শুধু আপনার নয়। এটা আমাদের সবার জন্য শিক্ষা। আমাদের মা–বাবার প্রতি দায়িত্ববোধ যদি আমরা হারাই, তবে আমাদের জীবনও একদিন অভিশাপে ভরে যাবে।”
মাহির নিঃশব্দে মাথা নুইয়ে কবরের দিকে তাকাল। তার চোখে এক অদৃশ্য শান্তি ছড়িয়ে পড়ছিল।
আমি ধীরে ধীরে কবরস্থানের পথ ধরলাম।
কিন্তু আমার ভেতরে তখন এক সিদ্ধান্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—
আমি আর কখনো মাকে অবহেলা করব না।
উপসংহার
সেই দিন, সেই সন্ধ্যা, সেই কবরস্থান আর মাহিরের স্বীকারোক্তি—সবকিছু আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।
আমি বুঝলাম—
👉 মায়ের দোয়া ছাড়া সন্তানের জীবনে কোনো বরকত নেই।
👉 মাকে অবহেলা করা মানে নিজের জীবন ধ্বংস করে ফেলা।
👉 প্রতিটি মায়ের চোখের জল একদিন সন্তানের ভাগ্যে আগুন হয়ে ফিরে আসে।
মাহিরের জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু তার গল্প আমার হৃদয়ে শিক্ষা হয়ে রইল।
এক জীবন্ত উপাখ্যান, যা চিরকাল মনে করিয়ে দেবে—
“মা–ই সন্তানের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।”