
আলেকজান্দর দুগিন, ৬২ বছর বয়সী রুশ দার্শনিক। সারা জীবন কাটিয়েছেন মস্কোতে। তরুণ বয়সে ছিলেন নগন্য সোভিয়েতবিরোধী, আর এখন সারা বিশ্বে সুপরিচিত মুখ। ইংরেজি ভাষার সংবাদমাধ্যমে তাঁকে প্রায়ই আখ্যা দেয়া হয় “পুতিনের মস্তিষ্ক” বলে যদিও রাশিয়ায় তিনি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন। তিনি স্রেফ একজন দার্শনিক, যদিও অনেকেই তাঁর চিন্তাধারাকে আক্রমণাত্মক বলে মনে করেন।
২০২২ সালের আগস্টে এক গাড়ি বোমার বিস্ফোরণে তাঁর একমাত্র কন্যা মস্কোতে নিহত হন। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, ইউক্রেন সরকার তাঁকে হত্যা করেছে, এবং আমরা সেই কথাকেই সত্য হিসেবে ধরে নিচ্ছি। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে আলেকজান্দর দুগিন কোনো সামরিক নেতা কিংবা ভ্লাদিমির পুতিনের দৈনন্দিন কাজের পরামর্শদাতা নন। তিনি একজন লেখক, যিনি “বড় বড় ধারণা” নিয়ে লেখা লেখি করেন। এবং উনার চিন্তাধারা নাকি অত্যন্ত বিপজ্জনক - এই অজুহাতে অ্যামাজনে তার বই বিক্রি করা বন্ধ হয়ে গেছে। ইংরেজি ভাষার সংবাদমাধ্যমে তাঁকে প্রায়ই “অতিডানপন্থী” বলে আখ্যায়িত করা হয়। তার ভাবনাগুলো পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে এতটাই বিপজ্জনক মনে হয়েছে যে সেগুলোর কারণে তাঁর একমাত্র কন্যা খুন হয়েছেন এবং তাঁর বই অ্যামাজন থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
সম্প্রতি ইংরেজিভাষী দেশগুলোতে বিচিত্র কিছু ঘটনা ঘটছে। যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, গ্রেট ব্রিটেন, নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া—দেশগুলোতে হঠাত করে যেন একই সাথে অন্তর্কলহ শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রতিটি দেশের ভিতরে চলছে এক বিশাল অস্থিরতা, তাদের অনেক আচরণই দেখে মনে হচ্ছে আত্মঘাতী। এর উৎস সন্ধান করতে গিয়ে দুগিন বলেন,
“আমার মতে, সবকিছুর শুরু হয়েছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (Individualism) থেকে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ হলো মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে ভুল বোঝাপড়া। যখন আপনি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে মানুষের আসল চরিত্র বলে ধরে নেন, তখন প্রকৃতির সঙ্গে আপনি তার সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করা শুরু করে দিলেন।
এর শুরু অ্যাংলো-স্যাক্সন জগতে প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার আর নামমাত্রবাদ (nominalism) থেকে। নামমাত্রবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের বলে যে, ভাব বা ধারণা বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই, আছে কেবল বস্তু, বিশেষ করে প্রতিটি বস্তুর স্বতন্ত্র পরিচয়।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এখন উদারনৈতিক মতাদর্শ (Liberal Ideology) এবং লিবারালিজমের কেন্দ্রীয় ধারণা। আমার মতে, এটি একটি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং দার্শনিক প্রক্রিয়া, যা ব্যক্তিকে সব ধরনের সমষ্টিগত বা গোষ্ঠীগত পরিচয় (Collective Identity) থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। অথচ সমষ্টিগত পরিচয় একজন ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিপরিচয়ের ঊর্ধে তুলে ধরতে সক্ষম।
এই সমষ্টিগত পরিচয়কে প্রত্যাখ্যান শুরু হয় পশ্চিমা সাম্রাজ্যের ক্যাথলিক চার্চ এর যে সমষ্টিগত পরিচয় তা প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে। এরপর এটি স্থানান্তরিত হয় জাতিরাষ্ট্রের (Nation State) সমষ্টিগত পরিচয়কে অস্বীকার করার দিকে, এবং এখন ধাবিত হচ্ছে শুধু নাগরিক সমাজকে (Civil Society) প্রাধান্য দেওয়ার দিকে।

বিংশ শতকে উদারনীতি (Liberalism), সাম্যবাদ (Communism) আর ফ্যাসিবাদের (Fascism) মধ্যে বেশ বড়সড় সংঘাত হয়েছিল যেখানে উদারনীতি বারবার বিজয়ী হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর উদারনীতিই হয়ে ওঠে পৃথিবীতে প্রধান মতাদর্শ। ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা তখন ঠিকই বলেছিলেন - উদারনীতিই এখন একমাত্র মতাদর্শ। এখানে উদারনীতির অর্থ হলো—ব্যক্তিকে যেকোনো সমষ্টিগত পরিচয় থেকে আলাদা করে ফেলা।
এখন কেবল দুটি সমষ্টিগত পরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন করা বাকি, একটি হলো লিঙ্গ পরিচয় (Gender Identity), কারণ এটি একটি সমষ্টিগত পরিচয়—আপনি পুরুষ বা নারী, অর্থাৎ একটি গোষ্ঠীর অংশ। সুতরাং লিঙ্গ থেকে মুক্তি মানে হলো ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের জন্ম দেওয়া, এবং এর সঙ্গে যুক্ত হলো LGBT আন্দোলন ও এক নতুন ধরনের যৌন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (Sexual Liberalism)। অর্থাৎ, ব্যক্তিগত যৌনতা এখন আর স্রেফ ব্যক্তিগত অভিরুচি নয় কিংবা উদারনীতির কোনো বিচ্যুতি বা বিকৃত রুপ নয়, বরং উদারনীতি প্রয়োগের এক অপরিহার্য উপাদান এবং অতি প্রয়োজনীয় ধাপ, যা এই মতাদর্শের বিজয় ইঙ্গিত করে।
আর শেষ ধাপ, যা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি, সেটি হলো মানব পরিচয় থেকে মুক্তি। মানবতা হবে ঐচ্ছিক। এখন পশ্চিমে আপনারা যেমন নিজের লিঙ্গ পছন্দ করতে পারেন, তেমনি এই প্রক্রিয়ার শেষ ধাপে উদারনীতির প্রয়োগের অর্থ হবে মানুষ হওয়া বা না হওয়া—এটি স্রেফ ব্যক্তিগত ইচ্ছা। আপনি আপনার ব্যক্তিগত পরিচয় বেছে নিতে পারবেন: মানুষ হতে চান কি চান না। এরই নাম ট্রান্সহিউম্যানিজম বা পোস্টহিউম্যানিজম।
ক্লাউস শোয়াব বা ইউভাল নোয়া হারারি কিন্তু প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছেন যে-সিঙ্গুলারিটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা- এগুলো মানবতার অনিবার্য ভবিষ্যৎ। আমরা এগিয়ে চলেছি ইতিহাসের যাত্রাপথের সর্বশেষ স্টেশনে, আমরা কিন্তু প্রায় পৌঁছেও গিয়েছি। পাঁচশ বছর আগে যে ট্রেনে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেটিই এখন শেষ স্টেশনে এসে থামতে যাচ্ছে।
আমার পাঠ হলো— এই সমস্ত উপাদান বা এই সমস্ত ধাপ সব কিছুর উদ্দেশ্য অতীতের সঙ্গে সব রকম সম্পর্ক ছিন্ন করা। তাই এখন আপনি আর প্রোটেস্ট্যান্ট নন; আপনি একজন ধর্মনিরপেক্ষ নাস্তিক বস্তুবাদী। আপনি আর জাতিরাষ্ট্র নন—যেটি একসময় সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন থেকে মুক্তির হাতিয়ার ছিল। জাতিরাষ্ট্রকে এখন তুলে ধরা হচ্ছে এক বাধা হিসেবে, মানুষকে যেখান থেকে মুক্ত হতে হবে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে ভেঙে ফেলা হচ্ছে পরিবারও। যৌন পরিচয় ভেঙ্গে ফেলার ধাপ এখন প্রায় অতিক্রান্ত—যৌনতা এখন ঐচ্ছিক। লিঙ্গ রাজনীতিতে কেবল এক ধাপ বাকি, যেখান থেকে পৌঁছে যাওয়া যাবে এই বিচ্ছিন্নকরণ প্রক্রিয়ার শেষ প্রান্তে: মানব পরিচয়কে ত্যাগ করা। মানুষ বলতে আপনি যা বোঝেন সেটা পূর্বনির্ধারিত কোনো কিছু হবে না বা এর কোনো সংজ্ঞা থাকবে না—অর্থাৎ আপনার মানুষ হওয়া বা না হওয়া হবে সম্পূর্ণ আপনার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। এটাই আগামী দিনের রাজনৈতিক ও আদর্শিক এজেন্ডা।
আমি মনে করি—এই প্রক্রিয়ার অগ্রদূত (vanguard) হচ্ছে অ্যাংলো-স্যাক্সন দুনিয়া। কারণ এর সূচনা হয়েছিল অ্যাংলো-স্যাক্সনদের সাম্রাজ্যবাদ, অভিজ্ঞতাবাদ, নামমাত্রবাদ আর প্রোটেস্ট্যান্টিজম থেকে। আর এখন মার্কিনীরা অন্য ইউরোপীয়দের চেয়ে উদারনীতির প্রতি সবচেয়ে বেশি নিবেদিত।
সাধারণ মানুষের কাছে উদারনীতি মানে হলো ব্যক্তির স্বাধীনতা ও পছন্দ, দাসত্ব থেকে মুক্তি। অর্থাৎ—ব্যক্তি তার বিবেক অনুসরণ করবে, যা খুশি বলতে পারবে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। অন্যদিকে এর বিপরীত হলো রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ, স্বৈরতন্ত্র, যা নিয়ে সোভিয়েত সরকারের মধ্যেই আমরা লড়াই করেছিলাম। বেশিরভাগ আমেরিকানও উদারনীতিকে এভাবেই বোঝেন। তাহলে পার্থক্য কোথায়?
উদারনীতির প্রচলিত সংজ্ঞায় কিছু সমস্যা রয়েছে। আমার মনে হয় সমস্যাটি রয়েছে উদারনীতির দুই ভিন্ন সংজ্ঞায়—একটি হলো নব্য উদারনীতি, আরেকটি হলো চিরায়ত (ক্লাসিক্যাল) উদারনীতি।
ক্লাসিক্যাল উদারনীতি গণতন্ত্রের পক্ষে ছিল—যা সংখ্যাগরিষ্ঠের ঐকমত্যের শক্তি হিসেবে দেখা হতো, তবে এর সঙ্গে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অন্যের স্বাধীনতাও যুক্ত ছিল। কিন্তু এখন আমরা এসে পৌঁছেছি পরবর্তী ধাপে—নতুন উদারনীতি তে। এখন আর এটি সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের ব্যাপার নয়, বরং সংখ্যালঘুদের শাসনের ব্যাপার। এখন আর এটি ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপার নয়, বরং wokism এর ব্যাপার।

এখন আপনাকে এতটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হতে হবে যে আপনি কেবল রাষ্ট্র নয়, এমনকি নিজস্ব ব্যক্তিসত্ত্বাকেও সমালোচনা করবেন। ব্যক্তিসত্তার পুরনো ধারণা আর প্রাসঙ্গিক নয়। এখন আপনাকে আহ্বান করা হচ্ছে এই ধারণা থেকেও মুক্ত হয়ে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে।
একবার আমি টিভিতে ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার সঙ্গে কথা বলছিলাম। তিনি বলছিলেন, আগে গণতন্ত্র মানে ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। কিন্তু এখন গণতন্ত্র মানে হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের শাসন। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠরা হিটলার বা পুতিনকে বেছে নিতে পারে—তাহলে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠদেরকে সংখ্যালঘুদের দিয়ে খুব সাবধানে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানেই গণতন্ত্র নয়; বরং সেটি ইতিমধ্যেই এক ধরনের সর্বগ্রাসিতা (totalitarianism)।
এখন আমরা আর ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার কথা বলছি না, বরং সংজ্ঞায়িত করছি আধুনিক ও প্রগতিশীল হওয়ার মানে কী। আপনি প্রগতিশীল হবেন কি হবেন না এটি বেছে নেওয়ার অধিকার আর আপনার থাকবে না— প্রগতিশীল হওয়া এবং এই এজেন্ডা অনুসরণ করার দায়িত্ব এখন আপনার ঘাড়ে নিতেই হবে। আপনি কেবল এটুকু স্বাধীন যে আপনি বামপন্থী উদারবাদী হতে পারেন, কিন্তু এতটুকু স্বাধীন নন যে ডানপন্থী উদারবাদী হতে পারবেন। আপনাকে বামপন্থী উদারবাদী হতেই হবে—এটি এক ধরনের কর্তব্য, পূর্ব নির্ধারিত নির্দেশনা।
ইতিহাসে উদারনীতি সবসময় যে কোনো ধরনের পূর্ব নির্ধারিত নির্দেশনার বিরুদ্ধে লড়াই করে এসেছে, অথচ এখন এটি নিজেই এক ধরনের নির্দেশনামূলক সর্বগ্রাসী ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে, স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছে।
এটি সম্ভবত অনিবার্যই ছিল এবং আমি একে বিকৃতি বা বিচ্যুতি হিসেবে না দেখে যৌক্তিক পরিণতি হিসেবে দেখি। যখন আপনি কোন ব্যক্তিকে পূর্বের ধারণা থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবেন, উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হওয়ার পরও কিন্তু আপনাকে আরও এগোতে হবে। তখন ব্যক্তিসত্তার পুরনো ধারণা থেকেও আপনাকে মুক্ত হতে হবে এবং আরও প্রগতিশীল ধারণার দিকে যেতে হবে। তাই মাঝপথে থামা সম্ভব নয়। এটাই আমার দৃষ্টিভঙ্গি।
যদি আপনি বলেন, “আমি চিরায়ত (ক্লাসিক্যাল) উদারনীতিকে পছন্দ করি,” প্রগতিশীলরা বলবে—এটি উদারনীতি নয়, এটি ফ্যাসিবাদ। আপনি ঐতিহ্যবাদ, রক্ষণশীলতা, ফ্যাসিবাদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন। তাই থামুন—হয় প্রগতিশীল উদারবাদী হোন, নইলে এখানেই আপনার যাত্রা শেষ, অথবা বাতিলের খাতায় আপনার নাম তুলে দেব (Cancel Culture)। আমরা লক্ষ্য করেছি, এখন এগুলোই ঘটছে।
কিন্তু যখন ব্যক্তি কোন কিছু থেকেই নিজেকে মুক্ত করতে পারে না, আবার সে আর পূর্বের মানুষও থাকে না, তখন পরবর্তী ধাপ কী?
এটিও আমেরিকান চলচ্চিত্রে নানা উপায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। আমি ধারণা আপনি জানেন, উনিশ শতকে কী ঘটবে তা ১৯২০-এর বেশিরভাগ কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক চলচ্চিত্রেই (Science Fiction) চিত্রায়িত হয়েছিল। সুতরাং সায়েন্স ফিকশনের চেয়ে বাস্তববাদী কিছু নেই।
যদি আপনি ম্যাট্রিক্স (The Matrix) বা টার্মিনেটর (Terminator) এর কথা বিবেচনা করেন, আপনি ভবিষ্যতের জগতের সাথে বহু মিল খুঁজে পাবেন বা এর কাছাকাছি ঘটনা খুঁজে পাবেন—যেখানে পোস্টহিউম্যান বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রাধান্য পাচ্ছে। হলিউড অনেক অনেক সিনেমা বানিয়েছে, আর আমি মনে করি সেগুলো আসন্ন ভবিষ্যৎকে সঠিকভাবেই চিত্রিত করেছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) তার শক্তিশালী নিউরাল নেটওয়ার্ক আর বিশাল ডাটাবেস নিয়ে পুরো পৃথিবীর অধিপতি হয়ে উঠতে সক্ষম। আমি বলব এটি কেবল বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণই নয়, তৈরিও করতে পারবে। ম্যাট্রিক্সে তাই দেখিয়েছে। কারণ বাস্তবতা কেবল চিত্র, অনুভূতি, আর আবেগ এর সমন্বয় মাত্র।
তাই আমি মনে করি পোস্টহিউম্যানিস্ট ভবিষ্যতবাদ (Posthumanist Futurism) স্রেফ এক সম্ভাব্য কিংবা সম্ভাব্যতম ভবিষ্যতের বাস্তব বিবরণই নয়, বরং এটি এক ধরনের রাজনৈতিক ইশতেহারও, যা মোটেও কাল্পনিক কিছু নয়।
আবার এও সত্য যে—পশ্চিমা কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক চলচ্চিত্রে কখনো পুরনো সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, রীতিনীতি ধরে রেখে পরিবার, সন্তান-সন্ততি নিয়ে সমৃদ্ধির জীবন যাপন করছে - এমন কাহিনী দেখা যায় না। সবকিছুই কেমন ছায়াচ্ছন্ন, নিস্তব্ধ, অন্ধকার। বিশেষত ভবিষ্যৎকে সবসময় অন্ধকারের রঙে আঁকা হয়েছে।
যখন সেই অন্ধকার ভবিষ্যৎ এসে পৌঁছাবে—তখন আমি মনে করি না আমাদের আর কোনো বিকল্প থাকবে। হয় ম্যাট্রিক্স, নয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, নয় টার্মিনেটর। বেছে নেয়ার ক্ষমতা এখন মানবতার সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। এটা এখন স্রেফ কল্পনা নয়, রীতিমত এক ধরনের রাজনৈতিক প্রকল্পও চলমান। আমি বলব, এই এজেন্ডাই হলো প্রগতিশীল এজেন্ডা।
গত ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমা দেশগুলোতে এবং যুক্তরাষ্ট্রে একদল উদারপন্থী কার্যত সোভিয়েত ব্যবস্থা এবং স্তালিনবাদের পক্ষ নিয়েছিল। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে স্তালিনবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, স্তালিনের জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করেছিল, আবার আমাদের গণমাধ্যমে তাঁদের সমর্থনও করেছিল। ২০০০ সাল পর্যন্ত তারা বরিস ইয়েলৎসিনকেও ভালোবাসত, কারণ তিনি মাতাল ছিলেন। কিন্তু ২০০০ সালে রাশিয়ার নেতৃত্ব বদলাল, আর রাশিয়া হয়ে উঠল তাদের প্রধান শত্রু। ৮০ বছরেরও বেশি সময় রাশিয়াকে সমর্থন করার পর হঠাৎ তারা এর বিরুদ্ধে চলে গেল। এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে কখনো ভেবে দেখেছেন?
আমার বিশ্বাস, একজন ঐতিহ্যবাদী (Traditionalist) নেতা হিসেবে পুতিন ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাশিয়ার অভ্যন্তরে বৈশ্বিক প্রভাব কমানোর জন্য কাজ করে চলেছেন। যার কারণে তিনি গ্লোবাল প্রগ্রেসিভিস্ট এজেন্ডার (Globalist Agenda) সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে যান। যারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমর্থন করেছিল, তাদের প্রগ্রেসিভিস্ট হিসেবে দেখা হতো। এখনও তারাই প্রগ্রেসিভ, কিন্তু তারা বুঝতে পেরেছে যে তারা এমন একজন নেতার মুখোমুখি হয়েছে, যিনি এই প্রগ্রেসিভ এজেন্ডায় বিশ্বাসী নন; বরং তিনি ঐতিহ্য ও দেশীয় সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং পরিবারের ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে চলেছেন—এবং সফলতাও অর্জন করেছেন।

প্রথমদিকে বাইরে থেকে এটি খুব একটা স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু যখন পুতিন ধীরে ধীরে এই ঐতিহ্যবাহী (Traditionalist) এজেন্ডায় আরও বেশি করে জোর দিতে লাগলেন—রুশ সভ্যতার নিজস্বতা ও বিশেষত্বকে পৃথিবীকে দেখার একটি আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে সামনে আনলেন, যা গ্লোবালিস্ট বা প্রগ্রেসিভিস্ট এজেন্ডা বা দৃষ্টি ভঙ্গিগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়—তখনই পশ্চিমা প্রগ্রেসিভ শিবিরের পর্যবেক্ষকরা বুঝে ফেললেন তিনি কোন ধাঁচের নেতা।
তারা পুতিনের মধ্যে স্পষ্ট দেখলেন—তিনি এমন এক রাজনৈতিক নেতা, যিনি ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ (Traditional Values) রক্ষা করছেন। সম্প্রতি, এক বছর আগেই, পুতিন আনুষ্ঠানিকভাবে “ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের রাজনৈতিক প্রতিরক্ষার” জন্য একটি ডিক্রি জারি করেছেন। এই ঘটনাকে আমি বলব, ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য বাঁকবদল। এমনটি যে ঘটবে তা পশ্চিমা প্রগ্রেসিভ শিবিরের লোকেরা তাঁর শাসনের শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছিল।
তাহলে এই ঘৃণা কোনো আকস্মিক বিষয় নয়, বা কোনো মুড সুইং নয়। এটি গুরুতর এবং অতীন্দ্রিয় (metaphysical)। যদি আপনার মূল কাজ ও প্রধান লক্ষ্য হয় ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ, ঐতিহ্যবাহী পরিবার, ঐতিহ্যবাহী রাষ্ট্র, ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ক, ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাস ধ্বংস করা—আর কেউ যদি পারমাণবিক অস্ত্র হাতে সেই ঐতিহ্য রক্ষায় দাঁড়িয়ে যায়—তাহলে আপনি তাকে নিশ্চিতভাবেই নিশ্চিহ্ন করতে চাইবেন।
আমি মনে করি এই রুশভীতি (Russophobia) আর পুতিনবিদ্বেষের একটি ভিত্তি আছে। এটি আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়, সোভিয়েতপ্রীতি থেকে হঠাৎ রাশিয়াবিদ্বেষে চলে যাওয়া কোনো অযৌক্তিক পরিবর্তন নয়। আমি বলব, এটি আরও গভীর কিছু।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কোনো এক ব্যক্তি বা একক সংগঠনের চেয়ে অনেক বড়। সমাজকে সংজ্ঞায়িত করা যায় তারা কী সহ্য করে না তার ভিত্তিতে। আমরা এখন যা দেখছি, সেটি হলো মানবিক গুণাবলীর সম্পূর্ণ উল্টে যাওয়া (total inversion of virtue)। অর্থাৎ মানবিক গুণাবলী বলতে আপনি যা বোঝেন তা সম্পূর্ণ পালটে দেয়া হচ্ছে।
**২০২৪ সালের ৩০ এপ্রিল আলেক্সান্দর দুগিন রাশিয়াতে টাকার কার্লসন কে এক সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। এই সাক্ষাৎকার এর ই লিখিত গদ্যরুপ উক্ত প্রবন্ধ। নিচে ইন্টারভিউ লিংক সংযুক্ত করে দেয়া হলো**