Posts

উপন্যাস

ফেলুদা ফ্যান ফিকশন - ‘দিঘি রহস্য’

September 10, 2025

প্রকৌশলী জেড আর চৌধুরী

56
View

‘দিঘি রহস্য’
লেখক: ইঞ্জিনিয়ার জেড আর চৌধুরী


প্রথম অধ্যায়:

পুজোর ছুটিটা এবার কোথায় কাটানো যায়, তাই নিয়ে আমাদের বৈঠকখানায় বেশ একটা গরম আলোচনা চলছিল। আমি সদ্য ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠেছি, তাই আমার মতামতের যে খুব একটা গুরুত্ব থাকবে না, তা জানা কথা। আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন আমার কাকা, প্রমোদেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ওরফে প্রমোদা, এবং তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু, লেখক মধুসূদন গুহ বা মধুবাবু।

মধুবাবু তাঁর ভূঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, প্রমোদেশ, আমার তো মনে হয় এবার একটু গ্রাম-বাংলার দিকে যাওয়া যাক। বুঝলে হে, ওই সবুজ ধানক্ষেত, মাটির সোঁদা গন্ধ, পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরা...আহা! একেবারে আইডিলিক ব্যাপার! আমার আগামী ডিটেকটিভ উপন্যাসের প্লটটাও মাথায় ঘুরছে, একটা গ্রামীণ প্রেক্ষাপট হলে জমে যাবে।

প্রমোদা তাঁর প্রিয় শার্লক হোমসের একটি পুরনো সংস্করণে চোখ বোলাচ্ছিলেন। বই থেকে চোখ না তুলেই বললেন, তোমার উপন্যাসের প্লট তো যেখানে-সেখানেই ঘোরে, মধু। শেষবার দার্জিলিং গিয়ে তো বললে পাহাড়ের চূড়ায় এক ইয়তির হত্যারহস্য লিখবে। তার কী হলো?

মধুবাবুর মুখটা একটু কাঁচুমাচু হলো। আরে সে তো... ক্লাইম্যাক্সটা ঠিক জমছিল না। তবে এবার যা ভেবেছি, একেবারে ফাটাফাটি! গ্রামের জমিদারবাড়ির পুরনো দিঘি, তার পাশে এক পোড়ো মন্দির, আর অমাবস্যার রাতে ঘটে যাওয়া এক হত্যাকাণ্ড! ভাবো একবার!

আমি আর থাকতে না পেরে বললাম, মধুবাবু, আপনার সব গল্পেই তো অমাবস্যার রাত থাকে।

মধুবাবু আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমি তাঁর সৃজনশীলতায় বিরাট এক প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দিয়েছি। রহস্য ঘনীভূত করার জন্য অমাবস্যা একটা ক্লাসিক টুল, বুঝলি অভি? তোরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা গ্যাজেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে শিল্পের 'শ' বোঝাও ছেড়ে দিয়েছিস।

ঠিক এই সময়েই চিঠিটা এল। একটা হালকা নীল খাম, তাতে অদ্ভুত সুন্দর হস্তাক্ষরে প্রমোদার নাম লেখা। প্রেরকের জায়গায় নাম রয়েছে 'অনন্তনারায়ণ চৌধুরী' আর ঠিকানা—'চৌধুরী বাড়ি, গ্রাম: আমডাঙা, জেলা: বীরভূম'।

প্রমোদা চিঠিটা পড়লেন, তাঁর কপালে একটা সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। তারপর চিঠিটা মধুবাবুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মধুবাবুর চোখ গোল গোল হয়ে গেল। অনন্ত চৌধুরী! তোমার স্কুলের বন্ধু? সেই যে যাঁর পূর্বপুরুষরা জমিদার ছিলেন?

প্রমোদা বললেন, হুম। লিখেছে ওর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তাছাড়া ওদের পারিবারিক কিছু পুরনো সম্পত্তি নিয়ে বেশ কিছু আইনি জটিলতা তৈরি হয়েছে। ও চায় আমি একবার গিয়ে ওকে সাহায্য করি।

মধুবাবু প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। আমডাঙা! আরে এ তো একেবারে যাকে বলে মেঘ না চাইতেই জল! প্রমোদেশ, এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর হয় না। চলো, বেরিয়ে পড়া যাক। জমিদারবাড়ি, পুরনো দিঘি, সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ...আমার গল্পের সব মশলাই তো মজুত দেখছি!

আমার মনটাও নেচে উঠল। শহরের চার দেওয়ালের বাইরে, একটা গ্রামে পুজোর ছুটি কাটানোর সুযোগ, তার উপর একটা রহস্যের গন্ধ! এর চেয়ে আকর্ষণীয় আর কী হতে পারে?

দ্বিতীয় অধ্যায়:

শিয়ালদা থেকে ট্রেনে চেপে ঘন্টা তিনেকের পথ। কাটোয়া লাইনের একটা ছোট, অখ্যাত স্টেশনে আমাদের নামতে হলো। স্টেশনের নাম আমডাঙা রোড। এখান থেকে আসল গ্রাম আরও প্রায় মাইল পাঁচেক। যত শহরকে পিছনে ফেলে আসছিলাম, ততই যেন সবুজের ঘনত্ব বাড়ছিল। আর ট্রেনের জানলার বাইরে বাংলার যে রূপ চোখে পড়ছিল, তা বইয়ের পাতায় পড়া ছবির মতোই স্নিগ্ধ।

স্টেশনের বাইরে একটা ধুলোমাখা, পুরনো অ্যাম্বাসেডর গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। চালকের পাশের আসনে বসেছিলেন একজন বয়স্ক লোক, যাঁর পরনে খাকি হাফপ্যান্ট আর ফতুয়া, দেখলেই বোঝা যায় বাড়ির পুরনো কর্মচারী। আমাদের দেখে তিনি সবিনয়ে হাত জোড় করে নমস্কার করলেন। আমি নকুল দাস। বড়বাবু পাঠালেন।

গাড়ি যখন গ্রামের কাঁচা রাস্তার উপর দিয়ে চলতে শুরু করল, মধুবাবু তখন উত্তেজনায় ফুটছেন। এই তো! এই তো চাই! একেবারে যাকে বলে রাস্টিক বিউটি! বুঝলে প্রমোদেশ, আমার উপন্যাসের নায়ক এইরকমই একটা অ্যাম্বাসেডরে চেপে এসে নামবে, আর তারপরেই... ধাঁই করে একটা গুলি!

প্রমোদা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে নির্বিকারভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর ধূসর চোখ দুটো যেন চারপাশের দৃশ্য শুধু দেখছিল না, শুষে নিচ্ছিল। আমি জানলার বাইরে মুখ বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। রাস্তার দু'পাশে ঘন বাঁশঝাড়, মাঝে মাঝে আম-কাঁঠালের বাগান, আর তার পিছনে দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত। মাঝে মাঝে দু-একটা মাটির বাড়ি উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল। শহরের কংক্রিটের জঙ্গল থেকে এসে এই দৃশ্য চোখে আরাম দিচ্ছিল।

অবশেষে গাড়িটা যেখানে এসে থামল, তার সামনে একটা বিশাল লোহার গেট। মরচে ধরে গেছে, দুটো পিলারের উপর দুটো পাথরের সিংহ ছিল এককালে, এখন তাদের একটির মাথা ভাঙা, অন্যটির গায়ে শ্যাওলার পুরু আস্তরণ। এ-ই চৌধুরী বাড়ির সিংহদরজা। গেটের ওপারে বিশাল উঠোন পেরিয়ে যে প্রকাণ্ড দোতলা বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, তার চেহারায় আভিজাত্য আর জরাজীর্ণতা একসঙ্গে মিশে আছে। এককালে যে বাড়ির দাপটে গোটা গ্রাম চলত, তা আজ কালের ভারে ন্যুব্জ, থমথমে।

নকুল দাস আমাদের নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। লম্বা বারান্দা, মোটা মোটা থাম, দেওয়ালে টাঙানো পুরনো দিনের অয়েল পেন্টিং—সবই কেমন যেন একটা বিষণ্ণতার চাদরে ঢাকা। বাড়ির ভেতরটা অদ্ভুতরকমের শান্ত।

আমাদের সোজা দোতলার একটা বড় ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেই ঘরে, একটা বিশাল পালঙ্কের উপর শুয়ে ছিলেন অনন্তনারায়ণ চৌধুরী। এককালে হয়তো সুঠাম চেহারা ছিল, কিন্তু এখন অসুস্থতায় ভেঙে পড়েছেন। আমাদের দেখে তাঁর ফ্যাকাসে মুখে একটা ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে উঠল।

প্রমোদা এগিয়ে গিয়ে খাটের পাশের চেয়ারটায় বসলেন। কেমন আছিস, অনন্ত?

অনন্তনারায়ণ দুর্বল গলায় বললেন, আর থাকা! শরীরটা তো গেছেই, মনটাও আর সঙ্গ দিচ্ছে না। তোকে আসতে বলে ঠিক করেছি কি না জানি না, প্রমো... তবে আমার ভয় করছে।

ভয়? প্রমোদার কপালে একটা সূক্ষ্ম রেখা দেখা দিল।

ঠিক সেই সময়েই ট্রে-তে করে চা-বিস্কুট নিয়ে একজন মহিলা ঘরে ঢুকলেন। পরনে সাধারণ শাড়ি, মুখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। অনন্তনারায়ণ পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমার স্ত্রী, সুদেষ্ণা।

সুদেষ্ণা দেবী আমাদের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলেন। কিন্তু তাঁর চোখের কোণে যে দুশ্চিন্তার কালো ছায়া, তা আমার নজর এড়ালো না।

মধুবাবু তাঁর ভোজনরসিক স্বভাব অনুযায়ী বিস্কুটের প্লেটটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললেন, বৌদি, আপনার হাতের চায়ের গন্ধেই অর্ধেক রাস্তা আসার ক্লান্তি দূর হয়ে গেল! তা কর্তা, আপনার আবার কিসের ভয়? এইরকম জমিদার বাড়িতে তো ভূতের ভয় হওয়াই স্বাভাবিক! আমার উপন্যাসেও...

তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘরে ঢুকলেন আর একজন ভদ্রলোক। অনন্তনারায়ণের থেকে বয়সে কিছুটা ছোট, শক্তসমর্থ চেহারা। দাদা, এঁরা এসে গেছেন দেখছি, বলে তিনি আমাদের দিকে একবার দেখে নিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে স্বাগত জানানোর চেয়ে কৌতূহলই বেশি।

"আমার ছোট ভাই, বিমলেশ, অনন্তনারায়ণ পরিচয় দিলেন।

বিমলেশ চৌধুরী একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললেন, ও, আপনিই তাহলে কলকাতার গোয়েন্দা? দাদার মুখে আপনার অনেক গল্প শুনেছি। যদিও আমার মনে হয়, বাড়ির ব্যাপার বাড়িতেই মিটিয়ে নেওয়া ভালো। তাঁর গলার স্বরে একটা হালকা শ্লেষের আভাস পেলাম।

এই অস্বস্তিকর পরিবেশটা আরও জটিল করে দিয়ে প্রায় ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল একটি ছেলে। আমারই বয়সী বা বছর দুয়েকের বড় হবে। পরনে জিন্স আর টি-শার্ট। বাবা, তুমি আবার এইসব গোয়েন্দা-টয়েন্দা কেন জড়াচ্ছ? যা বলার উকিলকে বললেই তো হয়! সে প্রায় অভিযোগের সুরে কথাগুলো বলল।

পার্থ, আমার ছেলে, অনন্তনারায়ণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন।

প্রমোদা এতক্ষণ চুপ করে সবার কথা শুনছিলেন আর তাঁর এক্স-রে মেশিনের মতো চোখ দিয়ে প্রত্যেককে জরিপ করছিলেন। একটা কথাও না বলে তিনি যেন ঘরের ভেতরের সম্পর্কগুলোর একটা মানচিত্র তৈরি করে নিচ্ছিলেন।

মধুবাবু আমার কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, দেখলি অভি, দেখলি? একেবারে ক্লাসিক সিন! বিষয়সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক বিবাদ! খুনের মোটিভ রেডি!

আমি কিছু বলার আগেই প্রমোদা অনন্তনারায়ণের দিকে ফিরে শান্ত গলায় বললেন, চিঠিতে সবটা পরিষ্কার করে লিখিসনি। ঠিক কী হয়েছে, এবার খুলে বল।

অনন্তনারায়ণ একবার তাঁর ভাই, স্ত্রী আর ছেলের মুখের দিকে দেখলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এখানে নয়, প্রমো। বিকেলে, যখন বাগানে হাঁটতে বেরোব, তখন বলব। দেওয়ালেরও কান পাতা আছে যে!

কথাটা শেষ হতেই ঘরের মধ্যে যেন একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। প্রত্যেকেই কেমন যেন একটু আড়ষ্ট হয়ে উঠল। আমি দেখলাম, নকুল দাস দরজার পাশ থেকে নিঃশব্দে সরে গেলেন, কিন্তু যাওয়ার আগে তাঁর চোখে যে ভয় আমি দেখেছিলাম, তা সহজে ভোলার নয়।

বুঝতে পারলাম, আমডাঙার এই চৌধুরী বাড়িতে শুধু পুজোর ছুটি কাটাতে আসিনি। এক ঘন অন্ধকারে ঢাকা রহস্যের জালে আমরা জড়িয়ে পড়তে চলেছি।

তৃতীয় অধ্যায়:

দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর চৌধুরী বাড়িতে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এল। অনন্তনারায়ণ চৌধুরী তাঁর ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। প্রমোদা তাঁর প্রিয় একটি ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের রেকর্ড চালিয়ে ইজিচেয়ারে চোখ বুজেছিলেন, তবে আমি জানি কাকা চোখ বুজলেও তাঁর মস্তিষ্ক সজাগ থাকে। এই নিস্তব্ধতা মধুবাবুর একেবারেই সহ্য হচ্ছিল না। তিনি পায়চারি করতে করতে আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, অভি, চল, একটু বাড়ির চৌহদ্দিটা ঘুরে আসা যাক। আমার উপন্যাসের ঘটনাস্থলটা একবার স্বচক্ষে না দেখলে কল্পনার ঘোড়া ছুটবে কী করে?

প্রস্তাবটা আমার মন্দ লাগল না। এই থমথমে পরিবেশের চেয়ে বাইরেটা অনেক ভালো। আমরা দু'জন বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে এলাম। বিশাল বাগান, এককালে হয়তো খুব যত্ন ছিল, কিন্তু এখন আগাছার জঙ্গল। সেই জঙ্গল পেরিয়ে সরু একটা পায়ে-চলা পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে একটা দিঘির দিকে।

আমরা যত এগোতে লাগলাম, চারপাশের আলো যেন তত কমে আসতে লাগল। বড় বড় প্রাচীন গাছের ডালপালা এমনভাবে দিঘিটার উপর ঝুঁকে আছে যে, দিনের বেলাতেও জায়গাটা কেমন ছায়া-ছায়া, অন্ধকার। জলের রঙ ঘন সবুজ, প্রায় কালো। এতটাই স্থির যে মনে হয় যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একভাবেই আছে। দিঘির পাড়ের একপাশে একটা ভাঙা শিব মন্দির, তার চূড়াটা ভেঙে পড়েছে, দেওয়াল জুড়ে বট-অশ্বত্থের ঝুরি নেমেছে।

মধুবাবু জায়গাটা দেখে মুগ্ধ গলায় বললেন, অসাধারণ! একেবারে পারফেক্ট লোকেশন! এই দিঘির নাম নিশ্চয়ই কিছু রহস্যময় হবে, তাই না রে অভি?

তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই পাশ দিয়ে যাওয়া এক গ্রামবাসী বলে উঠল, একে আমরা ছায়াঘেরা দিঘি বলি গো বাবু। দিনের বেলাতেও গা ছমছম করে। রাতের বেলা তো কথাই নেই। চৌধুরী বাড়ির অনেক পুরনো কথা এই দিঘির জলে ডোবানো আছে।

মধুবাবু যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। লোকটির কাছ থেকে আরও দু-চারটে আজগুবি গল্প শুনে তিনি দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলেন, বুঝলি অভি, এই দিঘির তলায় নির্ঘাত গুপ্তধন আছে! আর সেই গুপ্তধনের পাহারায় আছে এক ভয়ঙ্কর প্রেত! অমাবস্যার রাতে সে...

তাঁর কথা শেষ হলো না। হঠাৎ দিঘির মাঝখানটায়, যেখানে সবচেয়ে গভীর অন্ধকার, জলের মধ্যে থেকে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে একটা অদ্ভুত শব্দ উঠল। তার সাথে সাথেই বড় বড় বুদবুদ উঠতে লাগল, যেন জলের তলা থেকে বিশাল কিছু একটা নিঃশ্বাস ফেলছে!

মধুবাবু "বাপ রে!" বলে যে চিৎকারটা দিলেন, তাতে দিঘির পাড়ের একটা গাছের ডালে বসা কয়েকটা পাখি ভড়কে উড়ে গেল। তাঁর মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। পালা অভি, পালা! ওটা নির্ঘাত ওই প্রেত! আজ আর আমাদের রক্ষে নেই!

আমারও বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল, কিন্তু ভয় পাওয়ার থেকেও আমার কৌতূহলটা বেশি কাজ করল। আমার নতুন কেনা ডিজিটাল ক্যামেরাটায় জুম লেন্স লাগানো ছিল। আমি চট করে কাঁধ থেকে ক্যামেরাটা নামিয়ে পর পর কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম ওই বুদবুদ ওঠা জায়গাটার দিকে লক্ষ্য করে। চোখে তেমন কিছু না দেখলেও, ক্যামেরায় যদি কিছু ধরা পড়ে!

আমরা যখন প্রায় দৌড়ে বাড়ির দিকে ফিরে আসছি, তখন দেখলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন বিমলেশ চৌধুরী। তাঁর মুখে একটা অদ্ভুত হাসি। আমাদের ওই অবস্থা দেখে তিনি বললেন, কী, দিঘির প্রহরী দেখা দিয়ে গেল নাকি? ও কিছু না, মাঝে মাঝে বড় মাছ বা কচ্ছপ ওরকম শব্দ করে।

তাঁর কথাটা আমার ঠিক বিশ্বাস হলো না। ওই শব্দটা কোনও মাছের বলে মনে হয়নি।

সন্ধ্যা নামার পর চৌধুরী বাড়ির থমথমে ভাবটা আরও যেন জেঁকে বসল। অনন্তনারায়ণ চৌধুরী প্রমোদাকে নিয়ে বাগানের এক কোণে রাখা দুটো বেতের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আমি আর মধুবাবু দূর থেকে লক্ষ্য রাখছিলাম।

অনেকক্ষণ নিচু গলায় কথা বলার পর প্রমোদা যখন ফিরে এলেন, তখন তাঁর মুখ অসম্ভব গম্ভীর। রাত বাড়ছিল। খাওয়ার পর আমরা যে যার ঘরে চলে গেলাম। আমার আর মধুবাবুর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল দোতলার একটা বড় ঘরে। মধুবাবু ভয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন, কিন্তু আমার চোখে ঘুম ছিল না। দিঘির ওই অদ্ভুত শব্দটা কানে ভাসছিল, আর তার সাথে ভাসছিল বিমলেশ চৌধুরীর সেই বিচিত্র হাসি।

অনেক রাতে, যখন চারিদিক নিস্তব্ধ, তখন হঠাৎ আমার জানলার বাইরে একটা খসখস শব্দ শুনতে পেলাম। কেউ যেন খুব সন্তর্পণে বাড়ির পেছন দিকে, ওই দিঘির পথেই এগিয়ে যাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি উঠে জানলার কাছে গেলাম। আবছা চাঁদের আলোয় দেখলাম, একটা ছায়ামূর্তি বাগানের জঙ্গল পেরিয়ে দিঘির অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। মূর্তিটা আমি চিনতে পারলাম না, কিন্তু বুকের ভেতরটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। আমডাঙার এই রাত যে মোটেই শান্ত নয়, তা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম।

চতুর্থ অধ্যায়:

পরদিন সকালটা শুরু হলো একটা তীব্র চিৎকারে। ভোরের শান্ত, স্নিগ্ধ বাতাসকে চিরে দিয়ে সেই আর্তনাদটা ভেসে আসছিল বাড়ির পিছন দিক থেকে, ওই ছায়াঘেরা দিঘির পাড় থেকেই। বাড়ির সবাই যে যেখানে ছিল, ছুটে গেল সেদিকে। আমরাও গেলাম।

দিঘির ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছিল গ্রামের গোয়ালা, কানাই। তার দুধের বালতিটা মাটিতে উল্টে পড়ে আছে। তার বিস্ফারিত চোখ আর কাঁপা আঙুলটা দিঘির জলের দিকে নির্দেশ করা।

সেই ঘন সবুজ, নিস্তরঙ্গ জলের উপর ভাসছিল একটা দেহ। উপুড় হয়ে ভাসা শরীরটার পরনের ফতুয়াটা ফুলে ঢোল হয়ে আছে। দেহটা নকুল দাসের।

মুহূর্তের মধ্যে যেন গোটা চৌধুরী বাড়ির উপর একটা হিমশীতল আতঙ্ক নেমে এল। সুদেষ্ণা দেবী শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বিমলেশ চৌধুরীর মুখটা পাথরের মতো কঠিন, কোনও অভিব্যক্তি নেই। পার্থর চোখেমুখে একটা স্পষ্ট ভয় আর অস্বস্তির ছাপ। অনন্তনারায়ণ চৌধুরী খবরটা পেয়ে নিজের ঘরেই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন।

মধুবাবু ফিসফিস করে আমার কানে বললেন, যা ভেবেছিলাম, তাই! মার্ডার! আমার উপন্যাসের প্লট একেবারে জ্যান্ত হয়ে উঠল রে অভি! তাঁর চোখে ভয়ের চেয়েও বেশি ছিল এক ধরনের পেশাগত উত্তেজনা।

প্রমোদা কিন্তু নির্বিকার। তিনি ভিড় ঠেলে একেবারে ঘাটের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, যেন স্ক্যালপেল দিয়ে দৃশ্যটাকে চিরে বিশ্লেষণ করছেন। তিনিই প্রথম শান্ত গলায় বললেন, পুলিশে খবর দেওয়া হোক।

ঘন্টাখানেকের মধ্যে পুলিশ এসে হাজির হলো। থানার দারোগা, ইন্সপেক্টর সান্যাল, বেশ রাশভারী চেহারার লোক। তিনি এসেই প্রাথমিক কাজকর্ম শুরু করে দিলেন। দেহটা জল থেকে তোলার ব্যবস্থা করা হলো।

ইন্সপেক্টর সান্যাল চারপাশটা দেখে বললেন, আপাতদৃষ্টিতে তো মনে হচ্ছে অ্যাক্সিডেন্টাল কেস। রাতে অন্ধকারে ঘাটে এসেছিলেন হয়তো, পা পিছলে জলে পড়ে গেছেন। মাথায় সম্ভবত ঘাটের পাথরেই চোট লেগেছে।

সবাই যখন এই তত্ত্বটাকেই মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত, তখন প্রমোদার শান্ত গলা শোনা গেল। ইন্সপেক্টর, দুটো জিনিস যদি একটু লক্ষ্য করেন।

সবাই ঘুরে তাকালো। প্রমোদা জলের কিনার থেকে একটু দূরে একটা ঝোপের দিকে আঙুল দেখালেন। প্রথমত, নকুল দাসের চটিজোড়া ওখানে পড়ে আছে। ঘাট থেকে প্রায় দশ হাত দূরে। পা পিছলে পড়ে গেলে, চটি খুলে অতদূরে ছিটকে যাওয়ার কথা নয়।

ইন্সপেক্টর সান্যালের কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি একজন কনস্টেবলকে ইশারা করলেন চটিজোড়া তুলে আনার জন্য।

প্রমোদা বলে চললেন, দ্বিতীয়ত, ওর কপালের আঘাতটা দেখুন। ঘাটের পাথরে আছাড় খেলে যেরকম ছেঁচড়ে যাওয়ার দাগ থাকার কথা, তা কিন্তু নেই। বরং মনে হচ্ছে, কোনও ভারী, ভোঁতা জিনিস দিয়ে নির্দিষ্ট এক জায়গায় আঘাত করা হয়েছে।

ঘরের ভেতর যেন পিন পড়ার শব্দও শোনা যাবে, এমন নিস্তব্ধতা। ইন্সপেক্টর সান্যালের মুখের ভাব বদলে গেল। তিনি প্রমোদার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি তো মশাই আমাদের আগেই কাজ শুরু করে দিয়েছেন দেখছি! আপনার পরিচয়?

প্রমোদা নিজের পরিচয় দিলেন। ইন্সপেক্টর সান্যাল তাঁর নাম শুনেছিলেন। একটু সমীহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে, আমি আপনার পয়েন্টগুলো নোট করছি। বডি পোস্টমর্টেমে গেলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।

পুলিশ তাদের কাজ শেষ করে মৃতদেহ নিয়ে চলে গেল। চৌধুরী বাড়ির পরিবেশ আরও ভারী, আরও বিষাক্ত হয়ে উঠল। প্রত্যেকেই যেন প্রত্যেককে সন্দেহের চোখে দেখছে।

আমি আর প্রমোদা আমাদের ঘরে ফিরে এলাম। আমার মনটা সারাক্ষণ খচখচ করছিল। কাল রাতে দেখা ওই ছায়ামূর্তিটার কথা কাকাকে বললাম। কাকা সবটা মন দিয়ে শুনলেন, কিন্তু কোনও মন্তব্য করলেন না।

হঠাৎ আমার গতকাল তোলা ছবিগুলোর কথা মনে পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি আমার ল্যাপটপটা খুলে ক্যামেরাটা কানেক্ট করলাম। দিঘির সেই বুদবুদ ওঠা জায়গার ছবিগুলো একে একে দেখতে লাগলাম। প্রথম কয়েকটা ছবিতে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না, শুধু জলের উপর বুদবুদের ছাপ। কিন্তু শেষ ছবিটা, যেটা তোলার সময় আমার হাতটা সামান্য কেঁপে গিয়েছিল, সেটাকে জুম করতেই আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।

ছবিটা সামান্য ঝাপসা হলেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ঘন সবুজ জলের ঠিক নিচেই একটা অস্পষ্ট অবয়ব। কোনও মাছ বা কচ্ছপ নয়, তার থেকে অনেক বড়। চৌকোণা ধরনের কোনও বস্তু... অনেকটা পুরনো দিনের সিন্দুকের মতো দেখতে।

আমি প্রায় চিৎকার করে কাকার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। কাকা, দ্যাখো!

প্রমোদা ঝুঁকে এসে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকালেন। ছবিটা দেখার সাথে সাথে তাঁর ধূসর চোখদুটি জ্বলে উঠল। তিনি স্ক্রিনের উপর আঙুল বুলিয়ে স্থির গলায় বললেন, নকুলের মৃত্যুটা তাহলে নিছক দুর্ঘটনা নয়, অভি। ও কিছু একটা জেনে ফেলেছিল, বা দেখে ফেলেছিল। এই দিঘির জলে শুধু নকুলের দেহই ডোবেনি, এর তলায় আরও গভীর কোনও রহস্য ডুবে আছে।

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদের তদন্ত এখন শুরু হলো।"

পঞ্চম অধ্যায়:

নকুল দাসের মৃত্যুর পর চৌধুরী বাড়ির থমথমে ভাবটা আতঙ্কে রূপান্তরিত হলো। বাড়ির পুরনো ভৃত্যের এমন আকস্মিক মৃত্যু যে নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটা এখন প্রায় সকলেই বুঝতে পারছিল। পুলিশি তদন্তের পাশাপাশি প্রমোদা তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে রহস্যের গভীরে প্রবেশ করার প্রস্তুতি নিলেন।

একটা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত অনেকটা ভাঙা কাঁচের টুকরো জোড়া লাগানোর মতো, অভি, কাকা তাঁর ঘরে বসে আমাকে বলেছিলেন। প্রত্যেকটা চরিত্র, তাদের কথাবার্তা, তাদের গোপন রাখা উদ্দেশ্য—এগুলোই হলো সেই কাঁচের টুকরো। সবগুলোকে ঠিকঠাক জায়গায় বসাতে পারলেই আসল ছবিটা ফুটে ওঠে।

প্রমোদা ঠিক করলেন, তিনি পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের সাথে আলাদা করে কথা বলবেন। শুরু করলেন বিমলেশ চৌধুরীকে দিয়ে।

বিমলেশ বাবুকে বসার ঘরে একা পাওয়া গেল। তিনি তখন অস্থিরভাবে পায়চারি করছিলেন। প্রমোদার মুখোমুখি হতেই তাঁর হাবভাব কেমন যেন আত্মরক্ষামূলক হয়ে উঠল।

দেখুন মিঃ ভট্টাচার্য, তিনিই প্রথম কথা বললেন, নকুল আমাদের বহু পুরনো লোক। তার এভাবে চলে যাওয়াটা খুবই দুঃখের। কিন্তু এর মধ্যে অন্য কিছু খোঁজাটা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না।

প্রমোদা তাঁর ধূসর চোখজোড়া বিমলেশ চৌধুরীর উপর স্থির রেখে শান্ত গলায় বললেন, আমি শুধু সত্যিটা জানতে চাই, বিমলেশ বাবু। নকুলের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?

যেমন মনিব-ভৃত্যের হয়, তেমনই, চটজলদি জবাব এল।

আমি শুনেছি, আপনার দাদার সাথে আপনার বিষয়সম্পত্তি নিয়ে কিছু মতবিরোধ আছে, প্রমোদা সরাসরি আসল জায়গায় আঘাত করলেন।

বিমলেশ চৌধুরীর মুখটা শক্ত হয়ে গেল। সেটা আমাদের পারিবারিক ব্যাপার। এর সাথে নকুলের মৃত্যুর কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে না। তবে হ্যাঁ, একটা কথা বলতে পারি। ইদানীং নকুলকে বেশ কয়েকবার বাবার পুরনো পড়ার ঘরে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন পুরনো দলিলপত্র বা ওই জাতীয় কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করছে। হয়তো ও কিছু খুঁজে পেয়েছিল যা ওর কাল হয়েছে। কথাটা বলে তিনি এমনভাবে প্রমোদার দিকে তাকালেন যেন একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সূত্র ধরিয়ে দিলেন।

এরপর ডাক পড়ল পার্থর। সে ঘরে ঢুকেই প্রায় ফেটে পড়ল। আপনারা কি আমাকে সন্দেহ করছেন? আমি এসবের কিছুই জানি না!

প্রমোদা আগের মতোই শান্ত। তোমার সাথে নকুলের শেষ কবে কথা হয়েছিল?

পার্থ একটু ইতস্তত করে বলল, দু-তিন দিন আগে। ও আমার কাছে কিছু টাকা চেয়েছিল।

কেন?

এইবার পার্থর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমতা আমতা করে বলল, ও... ও আমাকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছিল। আমার একটা ব্যক্তিগত ব্যাপারে ও জেনে গিয়েছিল। হুমকি দিচ্ছিল যে বাবাকে সব বলে দেবে। কিন্তু আমি ওকে একটা টাকাও দিইনি! এর সাথে ওর মৃত্যুর কোনও সম্পর্ক নেই, আমি হলফ করে বলতে পারি!

পার্থর ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এলেন সুদেষ্ণা দেবী। তাঁর চোখ দুটো কেঁদে কেঁদে ফুলে আছে। তিনি একটা চেয়ারে বসে আঁচলে মুখ ঢাকলেন। প্রমোদা অত্যন্ত নরম গলায় তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেছিলেন?

সুদেষ্ণা দেবী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, ও খুব পাল্টে গিয়েছিল। সারাক্ষণ কী যেন একটা ভয়ে ভয়ে থাকত। আমি নিজে দেখেছি, গত সপ্তাহে দু-তিনবার ও গভীর রাতে চোরের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে পিছনের দিঘির দিকে যেত। জিজ্ঞেস করলে বলত, গরমে ঘুম আসছে না তাই একটু হাওয়া খেতে যাচ্ছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি। আমার মনে হয়, ও কোনও খারাপ সঙ্গে পড়েছিল।

প্রত্যেকের সাথে কথা বলে প্রমোদা যখন ফিরে এলেন, তখন তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও গভীর। প্রত্যেকটা কাঁচের টুকরোই যেন এক একটা নতুন রহস্যের দিকে ইঙ্গিত করছে।

এরই মধ্যে মধুবাবু তাঁর নিজস্ব 'তদন্ত' সেরে ফিরে এলেন। গ্রামের চায়ের দোকানে গিয়ে তিনি একরাশ আজগুবি গল্প সংগ্রহ করে এনেছেন। উত্তেজিত হয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন, প্রমোদেশ, যা খবর এনেছি না! একেবারে সলিড! গ্রামের লোকরা বলছে, চৌধুরী বাড়ির পূর্বপুরুষরা নাকি বর্গী হামলার সময় তাদের সমস্ত সোনাদানা একটা বিশাল সিন্দুকে ভরে ওই ছায়াঘেরা দিঘির জলে ফেলে দিয়েছিল। আর সেই গুপ্তধনের পাহারায় আছে এক ভয়ঙ্কর জলদৈত্য! নকুল নির্ঘাত সেই গুপ্তধনের লোভ করতে গিয়েছিল, আর দৈত্যের হাতে প্রাণ দিয়েছে!

প্রমোদা মধুবাবুর ভৌতিক তত্ত্বে কান না দিলেও, 'গুপ্তধন' কথাটা তাঁর কানে বাজল। আমার তোলা সেই সিন্দুকের মতো বস্তুর ছবি, বিমলেশ চৌধুরীর বলা নকুলের দলিলপত্র ঘাঁটার কথা আর এখন এই গুপ্তধনের গুজব—তিনটে সূত্র যেন একই সরলরেখায় মিলে যাচ্ছে।

কাকা আমার দিকে ফিরে বললেন, অভি, তোর একটা কাজ আছে। তুই তো সহজেই সবার সাথে মিশে যেতে পারিস। গ্রামের ছেলেদের সাথে কথা বলে দ্যাখ তো, ইদানীং কোনও অচেনা লোককে এই গ্রামে, বিশেষ করে চৌধুরী বাড়ির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে কি না।

আমি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলাম। ডিটেকটিভের সহকারীর মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ পেয়ে আমার বেশ লাগছিল।

সন্ধ্যাবেলা, প্রমোদা তাঁর ঘরে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসেছিলেন। আমি জানতাম, তাঁর মস্তিষ্কের ভেতরে তখন সমস্ত টুকরোগুলো নড়াচড়া করছে। বিমলেশের সম্পত্তির লোভ, পার্থর ব্ল্যাকমেল হওয়ার ঘটনা, সুদেষ্ণা দেবীর দেখা নকুলের নিশুতি অভিসার, আর তার সাথে জড়িয়ে থাকা এক গুপ্তধনের কিংবদন্তি—সব মিলিয়ে রহস্যটা ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে।

প্রমোদা চোখ না খুলেই বিড়বিড় করে বললেন, সবাই কিছু না কিছু লুকাচ্ছে, অভি। আমাদের সেই লুকানো সত্যিটাকেই খুঁজে বের করতে হবে।

ষষ্ঠ অধ্যায়:

কাকার নির্দেশ পেয়ে আমি পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। চৌধুরী বাড়ির গুমোট পরিবেশ থেকে বেরিয়ে গ্রামের খোলা হাওয়ায় বেশ ভালো লাগছিল। গ্রামের কাঁচা রাস্তার ধারে একটা বড় অশ্বত্থ গাছের তলায় গ্রামের ছেলেরা মার্বেল খেলছিল। আমি গিয়ে তাদের পাশে বসলাম। শহরের ছেলে হওয়ায় প্রথমে তারা একটু আড়ষ্ট ছিল, কিন্তু আমার পকেট থেকে বের করা একটা নতুন ধরনের স্পিনিং টপ (লাট্টু) দেখে তাদের চোখ চকচক করে উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের সাথে আমার বেশ ভাব জমে গেল।

বিশেষ করে হাবলু নামের একটি ছেলে, যে সবার চেয়ে চালাকচতুর, সে আমার প্রায় বন্ধু হয়ে গেল। একই আলাপকালে আমি চৌধুরী বাড়ি আর ওই ছায়াঘেরা দিঘির প্রসঙ্গ তুললাম।

হাবলু আমার দিকে ঝুঁকে এসে চাপা গলায় বলল, জানো তো দাদা, ওই দিঘিটার কাছে না আজকাল রাতে যাওয়া বারণ।

কেন রে? আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

আমার বাবা বলেছে, ওখানে নাকি ভালুকের উৎপাত বেড়েছে। কিন্তু আমি জানি, সব মিথ্যে কথা, হাবলু চোখ মটকে বলল। দিন দশেক আগে, রাতে পেচ্ছাপ করতে উঠেছিলাম, তখন দেখেছিলাম দুটো জিপগাড়ি এসে গ্রামের বাইরের রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল। আর কয়েকজন অচেনা লোক টর্চ জ্বেলে ওই দিঘির দিকেই যাচ্ছিল। তারা কিন্তু গ্রামের লোক নয়। তাদের চালচলন একদম অন্যরকম।

এই তথ্যটা ছিল bombshell-এর মতো। তার মানে, এই রহস্যে চৌধুরী বাড়ির লোকজন ছাড়াও বাইরের কেউ জড়িত আছে! আমি হাবলুকে আরও কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তার মা এসে কান ধরে তাকে বাড়ি নিয়ে গেল। কিন্তু আমি যা জানার, তা জেনে গিয়েছিলাম।

আমি যখন উত্তেজিত হয়ে বাড়ি ফিরছি, তখন দেখলাম প্রমোদা অনন্তনারায়ণ চৌধুরীর পুরনো পড়ার ঘর থেকে বেরোচ্ছেন। তাঁর হাতে ধুলোমাখা, চামড়া দিয়ে বাঁধানো একটা পুরনো ডায়েরি। তাঁর মুখে একটা অদ্ভুত তৃপ্তির হাসি, যা আমি তখনই দেখি যখন তিনি কোনও জটিল রহস্যের সমাধানের কাছাকাছি পৌঁছে যান।

আমরা নিজেদের ঘরে ফিরলে কাকা ডায়েরিটা টেবিলের উপর রাখলেন। এটা অনন্তনারায়ণের প্রপিতামহের লেখা ডায়েরি। বিমলেশ বাবু ঠিকই বলেছিলেন, নকুল এই ঘরেই কিছু খুঁজছিল। তবে ও দলিল নয়, এই ডায়েরিটাই খুঁজছিল।

ডায়েরির পাতাগুলো হলদেটে, ভঙ্গুর হয়ে গেছে। তাতে দুর্বোধ্য ভাষায় অদ্ভুত সব সংকেত আর ছবি আঁকা। কয়েকটা পাতা পড়ার পর কাকা বললেন, এটা কোনও গুপ্তধনের নকশা নয়, অভি। এটা আসলে চৌধুরী বাড়ির একটা পুরনো কলঙ্কের ইতিহাস। পরিবারেরই একজন সদস্য বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজদের হাতে বাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্র তুলে দিয়েছিল। কিন্তু তার আগে, সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসগুলো—হিরে-জহরত—সে ওই দিঘির তলায় একটা গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে রেখেছিল। এই ডায়েরিতে সেই কুঠুরি খোলার সাংকেতিক উপায় লেখা আছে।

আমার চোখের সামনে যেন সবটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল। নকুল এই ডায়েরির কথা জানতে পেরেছিল। সে হয়তো ভেবেছিল এটা গুপ্তধনের নকশা।

ঠিক সেই সময়েই মধুবাবু ঘরে ঢুকলেন। তাঁর হাতে চায়ের কাপ, মুখে গভীর দার্শনিকতার ছাপ। তিনি হতাশ গলায় বললেন, আমার মাথায় কিচ্ছু আসছে না, প্রমোদেশ! খুনি কে হতে পারে, কিচ্ছু আন্দাজ করতে পারছি না! তবে জানিস তো, আমার এক ডিটেকটিভ উপন্যাসে আমি লিখেছিলাম, খুনি সব সময় সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ব্যক্তি হয়! ধর, ওই যে শান্তশিষ্ট, শোকার্ত বিধবা... মানে ওই সুদেষ্ণা দেবী... ওই হয়তো আসল ভিলেন! হাহাহা!

কথাটা বলে মধুবাবু নিজেই তাঁর রসিকতায় হেসে উঠলেন। কিন্তু তাঁর কথাটা শেষ হওয়ার মুহূর্তে একটা ঘটনা ঘটল। সুদেষ্ণা দেবী আমাদের ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। মধুবাবুর কথাটা তাঁর কানে গিয়েছিল। আমি দেখলাম, দরজার ফাঁক দিয়ে তাঁর মুখটা এক মুহূর্তের জন্য যেন বরফের মতো জমে গেল। তাঁর চোখেমুখে যে ভাবটা ফুটে উঠেছিল, সেটা শুধু দুঃখ বা শোক নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু—একটা তীব্র ভয় আর ধরা পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে গেলেন।

ঘটনাটা আমার চোখ এড়ালেও, প্রমোদার এক্স-রে চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না। তাঁর মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। তিনি স্থির দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

হাবলুর দেওয়া বাইরের লোকের খবর, ডায়েরিতে পাওয়া সাংকেতিক ভাষার রহস্য আর সুদেষ্ণা দেবীর ওই অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া—তিনটে আলাদা আলাদা সূত্র যেন প্রমোদার মস্তিষ্কের ভেতরে জুড়ে গিয়ে একটা স্পষ্ট আকার নিচ্ছিল। রহস্যের জট প্রায় খুলে এসেছে। এখন শুধু শেষ ধাক্কাটা দেওয়ার অপেক্ষা।

প্রমোদা আমার দিকে ফিরে শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বললেন, অভি, ইন্সপেক্টর সান্যালকে ফোন করে আজ সন্ধ্যায় চৌধুরী বাড়ির বৈঠকখানায় আসতে বল। সবাইকে আমার প্রয়োজন হবে। আজ রাতেই এই নাটকের শেষ অঙ্ক অভিনীত হবে।

সপ্তম অধ্যায়:

সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে চৌধুরী বাড়ির পরিবেশ যেন আরও দশগুণ ভারী হয়ে উঠল। টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৈঠকখানার বিশাল হলঘরে টিমটিমে আলো জ্বলছে। ঘরের একপাশে অনন্তনারায়ণ চৌধুরী একটা হুইলচেয়ারে বসে আছেন, তাঁর মুখে গভীর উদ্বেগ। বাকিরা—বিমলেশ চৌধুরী, সুদেষ্ণা দেবী এবং পার্থ—একে অপরের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে সোফায় বসে। প্রত্যেকের মুখেই চাপা টেনশন। একটু পরেই ইন্সপেক্টর সান্যাল তাঁর দুই কনস্টেবলকে নিয়ে এসে হাজির হলেন।

মধুবাবু উত্তেজনায় প্রায় ঘেমে যাচ্ছিলেন। তিনি আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, এইবার ক্লাইম্যাক্স! বুঝলি অভি, একেবারে Hercule Poirot-এর মতো সবাইকে এক জায়গায় ডেকে রহস্যভেদ! আমি ঠিক জানতাম প্রমোদেশ এটা করবেই!

সবাই উপস্থিত হওয়ার পর প্রমোদা ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে সেই পুরনো ডায়েরিটা। তিনি একবার সবার মুখের উপর তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। তারপর শান্ত, অথচ কর্তৃত্বপূর্ণ গলায় বলতে শুরু করলেন।

নকুল দাসের মৃত্যু কোনও দুর্ঘটনা নয়, এটা একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ইন্সপেক্টর সান্যাল, পোস্টমর্টেম রিপোর্টেও নিশ্চয়ই সেরকমই ইঙ্গিত মিলেছে?

ইন্সপেক্টর সান্যাল মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। হ্যাঁ, মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করার ফলেই মৃত্যু হয়েছে। জলে ডোবাটা গৌণ কারণ।

প্রমোদা বলে চললেন, এই হত্যাকাণ্ডের মূলে রয়েছে লোভ। এক কিংবদন্তির লোভ। চৌধুরী বাড়ির ছায়াঘেরা দিঘির তলায় লুকানো গুপ্তধনের লোভ।

কথাটা শুনেই বিমলেশ চৌধুরী আর পার্থর মুখে একটা চকিত পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।

নকুল দাস কোনওভাবে এই পুরনো ডায়েরিটার কথা জানতে পারে, প্রমোদা ডায়েরিটা তুলে ধরে বললেন। ও ভেবেছিল এটা গুপ্তধনের নকশা। ও এটা হাতানোর চেষ্টা করছিল এবং সফলও হয়েছিল। কিন্তু ও একা এই কাজ করতে পারত না। ওর একজন সঙ্গীর প্রয়োজন ছিল। এমন একজন, যার এই বাড়িতে অবাধ যাতায়াত আছে এবং যার এই গুপ্তধনের প্রতি সমান লোভ আছে।

প্রমোদা থামলেন। ঘরের নিস্তব্ধতা ভাঙল দূর থেকে ভেসে আসা মেঘের গুরগুর শব্দে।

নকুল প্রথমে যোগাযোগ করেছিল পার্থর সাথে, প্রমোদা সরাসরি পার্থর দিকে তাকালেন।

পার্থ প্রায় লাফিয়ে উঠল। মিথ্যে কথা! আমি এর কিছুই জানি না!

প্রমোদর গলা কঠিন শোনাল। মিথ্যে বলছ, পার্থ। তুমি শুধু জানতে তাই নয়, তুমিও এই পরিকল্পনায় জড়িয়ে পড়েছিলে। তোমার অনেক টাকার দরকার ছিল শহরে ব্যবসা শুরু করার জন্য। তাই তুমি বাইরের কিছু দুষ্কৃতীর সাথে যোগাযোগ করেছিলে। গ্রামের ছেলে হাবলু সেই রাতে তোমার সঙ্গীদেরই জিপে করে আসতে দেখেছিল। তোমরা সবাই মিলে দিঘি থেকে সেই সিন্দুক তোলার পরিকল্পনা করেছিলে। কিন্তু নকুল তোমাদের থেকে এক ভাগ বেশি চাইছিল। সে তোমাকে ব্ল্যাকমেল করছিল তোমার ব্যক্তিগত কিছু দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে।

প্রমোদা বলতে লাগলেন, হত্যাকাণ্ডের রাতে দিঘির পাড়ে তোমাদের মধ্যে টাকার ভাগাভাগি নিয়ে বচসা হয়। আর সেই সময়েই রাগের মাথায় তুমি হাতের কাছে পড়ে থাকা একটা বড় পাথর দিয়ে নকুলের মাথায় আঘাত করো। নকুল সাথে সাথে জলে পড়ে যায়। এরপর তোমরা প্রমাণ লোপাট করার জন্য ওর চটিজোড়া দূরে ছুঁড়ে ফেলে দাও আর ঘটনাটাকে একটা দুর্ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করো।

পার্থর মুখটা কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। সে থরথর করে কাঁপছিল। আমি... আমি ওকে মারতে চাইনি... ওটা একটা দুর্ঘটনা...

ইন্সপেক্টর সান্যাল কনস্টেবলদের ইশারা করলেন পার্থকে হেফাজতে নেওয়ার জন্য।

সবাই যখন ভাবল রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে, তখন প্রমোদা বললেন, দাঁড়ান ইন্সপেক্টর। গল্প এখনও শেষ হয়নি। নকুলকে হত্যার অপরাধী পার্থ হতে পারে, কিন্তু এই বাড়ির আসল ষড়যন্ত্রকারী সে নয়।

ঘরের সবাই চমকে উঠল। প্রমোদা এবার ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন হুইলচেয়ারে বসা অনন্তনারায়ণ চৌধুরীর স্ত্রীর দিকে।

সুদেষ্ণা দেবী, তাই না?

সুদেষ্ণা দেবী পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলেন। তাঁর চোখে কোনও অভিব্যক্তি নেই।

প্রমোদা বললেন, আপনার স্বামী, অনন্তনারায়ণ বাবু, তাঁর ছেলের এই কুকীর্তির কথা জানতে পেরে গিয়েছিলেন। তিনি ঠিক করেছিলেন, তাঁর সমস্ত সম্পত্তি তিনি একটি চ্যারিটেবল ট্রাস্টকে দান করে দেবেন, যাতে সেই সম্পত্তি আর কোনও অনর্থের কারণ না হয়। আপনি এই কথাটা আড়াল থেকে শুনে ফেলেন।

অনন্তনারায়ণ চৌধুরী অবিশ্বাস্যভাবে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। সুদেষ্ণা, এ কী বলছে প্রমো?

আপনার ছেলের ভবিষ্যৎ আর চৌধুরী বাড়ির সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে আপনি আপনার স্বামীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন, প্রমোদার গলা বরফের মতো শীতল শোনাল। আপনি বেশ কিছুদিন ধরে ওঁর খাবারে বা ওষুধে অল্প মাত্রায় আর্সেনিক জাতীয় বিষ মেশাচ্ছিলেন, যাতে তাঁর মৃত্যুটা প্রাকৃতিক বলে মনে হয়। অনন্তবাবু যে চিঠিতে লিখেছিলেন তাঁকে ধীরে ধীরে বিষ প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে তাঁর সন্দেহ হয়, সেই সন্দেহটা অমূলক ছিল না।

মধুবাবু উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁর নিজেরই বলা রসিকতাটা যে এভাবে সত্যি হয়ে যাবে, তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি।

প্রমোদা সুদেষ্ণা দেবীর দিকে ঝুঁকে বললেন, আপনার ঘরের ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রাখা আয়ুর্বেদিক চূর্ণের কৌটোটা পরীক্ষা করলেই সত্যিটা বেরিয়ে আসবে, তাই না?

এইবার সুদেষ্ণা দেবী ভেঙে পড়লেন। তিনি কান্নায় ফেটে পড়ে অনন্তনারায়ণ চৌধুরীর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। তাঁর কান্নার শব্দে চৌধুরী বাড়ির বহু পুরনো পাপ যেন মূর্ত হয়ে উঠল।

অষ্টম অধ্যায়:

পুলিশ পার্থ আর সুদেষ্ণা দেবীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল। একটা গোটা পরিবার কীভাবে লোভ আর ষড়যন্ত্রের জালে জড়িয়ে সব ধ্বংস করে দিল, তা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অনন্তনারায়ণ চৌধুরী স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলেন। তাঁর চোখ দিয়ে শুধু জল গড়িয়ে পড়ছিল।

পরদিন সকালে আমরা কলকাতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। আমডাঙার আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। চৌধুরী বাড়ির থমথমে ভাবটা এখনও কাটেনি।

অনন্তনারায়ণ চৌধুরী আমাদের বিদায় জানাতে এলেন। তাঁর দুর্বল গলায় ছিল কৃতজ্ঞতা আর গভীর যন্ত্রণা। তুই না এলে আমি হয়তো কোনওদিনই সত্যিটা জানতে পারতাম না, প্রমো।

প্রমোদা তাঁর বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বললেন, সত্যি সব সময় কঠিন হয়, অনন্ত। কিন্তু তাকে গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নেই।

গাড়িতে ওঠার সময় মধুবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমার ডিটেকটিভ গল্পের প্লটটা তো একেবারে মাঠে মারা গেল! তবে যা অভিজ্ঞতা হলো, তাতে দশ-বারোটা উপন্যাস আরামে লেখা হয়ে যাবে।

আমি গাড়ির জানলা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। পিছনে মিলিয়ে যাচ্ছিল চৌধুরী বাড়ির ভাঙা সিংহদরজা আর ছায়াঘেরা দিঘির রহস্যময় অন্ধকার। একটা পুজোর ছুটি কাটাতে এসে জীবনের এতটা কাছ থেকে যে মৃত্যু আর বিশ্বাসঘাতকতাকে দেখতে হবে, তা আমি কল্পনাও করিনি।

প্রমোদা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। তাঁর ধূসর চোখদুটি যেন বলছিল, এটাই তো জীবন, অভি। আলো আর অন্ধকারের এক অদ্ভুত খেলা।

গাড়ি চলতে শুরু করল শহরের দিকে। পিছনে পড়ে রইল একটা গ্রাম, একটা দিঘি আর তার জলে ডুবে থাকা একরাশ অন্ধকার রহস্য।

Comments

    Please login to post comment. Login