হিমশীতল রাতের রহস্য
লেখক: ইঞ্জিনিয়ার জেড আর চৌধুরী (সত্যজিৎ রায়ের অনুপ্রেরণায় লেখা)
অধ্যায় ১:
পৌষের রাত। কনকনে ঠান্ডায় শহরটা যেন জবুথবু হয়ে লেপের তলায় সেঁধিয়ে গেছে। বাইরে উত্তুরে হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। আমাদের রজনী সেন রোডের বাড়ির বৈঠকখানায় ডিটেকটিভ প্রমোদ চন্দ্র ভট্টাচার্য, আমার কাকা প্রমোদা, তাঁর ইজিচেয়ারে বসে একটা পুরনো পুঁথিতে চোখ বোলাচ্ছিলেন। তাঁর মুখের চুরুট থেকে ওঠা নীল ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘরের আবছা আলোয় অদ্ভুত সব আকার তৈরি করছিল। আমি, অভিজিৎরঞ্জন, সংক্ষেপে অভি, নতুন ল্যাপটপে একটা জটিল সাইবার সিকিউরিটি প্রোগ্রামের কোডিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কাকার মতো আমারও রহস্যের প্রতি অদম্য আকর্ষণ, তবে আমার জগৎটা কি-বোর্ড আর মনিটরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
হঠাৎ দরজায় পর পর তিনবার মৃদু টোকা পড়ল। শব্দটা এতটাই মৃদু যে প্রথমে মনে হয়েছিল উত্তুরে হাওয়ারই খেলা। কিন্তু টোকাটা আবার পড়তেই প্রমোদদা পুঁথি থেকে মুখ তুললেন। তাঁর তীক্ষ্ণ চোখে প্রশ্ন। এত রাতে কে আসতে পারে?
প্রমোদা দরজা খুলতেই প্রায় কাকভেজার মতো এক ভদ্রলোক টলতে টলতে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর পরনে দামি উলের ওভারকোট, কিন্তু তা সত্ত্বেও শীতে ঠকঠক করে কাঁপছিলেন। ভদ্রলোকের ফর্সা কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, আর চোখেমুখে তীব্র আতঙ্ক।
আপনিই কি ডিটেকটিভ ভট্টাচার্য? কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক। আমার নাম রত্নেশ্বর সেন। আমি... আমি একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ।
প্রমোদা ইশারায় তাঁকে সোফায় বসতে বললেন। ভদ্রলোক ধপ করে বসে পড়লেন। আমি ল্যাপটপ বন্ধ করে এগিয়ে এলাম। নতুন কোনো রহস্যের গন্ধ পাচ্ছিলাম আমি।
রত্নেশ্বর সেন এক চুমুকে পুরো গ্লাসের জল শেষ করে বললেন, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে, স্যার! আমার বাড়ি থেকে চুরি হয়ে গেছে!
প্রমোদার মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। তিনি শান্তভাবে চুরুটে একটা টান দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী চুরি হয়েছে, মিস্টার সেন?
চন্দ্রকান্ত মণি! ভদ্রলোকের গলায় এমন এক আর্তনাদ ফুটে উঠল, যা আমাদের দুজনকেই চমকে দিল। হিমালয়ের এক গহীন মঠ থেকে পাওয়া একশো বছরের পুরনো এক অলৌকিক পাথর! এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তিব্বতের এক অভিশপ্ত রাজার কিংবদন্তি।
আমি উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসলাম। চন্দ্রকান্ত মণি! এর কথা তো বইয়ে পড়েছি। কথিত আছে, এই মণি চাঁদের আলোয় এক অদ্ভুত নীল আভা ছড়ায় এবং এর অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে।
প্রমোদা রত্নেশ্বর সেনের দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কিংবদন্তিটা কী?
কথিত আছে, এই মণি যার কাছে থাকে, সে হয় চরম সৌভাগ্যের অধিকারী হয়, নতুবা তার জীবনে নেমে আসে ভয়ঙ্কর অভিশাপ। মণিটা নাকি নিজেই তার মালিক নির্বাচন করে, রত্নেশ্বর সেনের গলা ভয়ে শুকিয়ে গিয়েছিল। আমার ভয় হচ্ছে, ভুল হাতে পড়লে এটা ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনবে।
প্রমোদা চিন্তিত মুখে চুরুটের ছাই ঝাড়লেন। এই হিমশীতল রাত যে এক গভীর এবং সম্ভবত বিপজ্জনক রহস্যের সূচনা করতে চলেছে, তা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম।
অধ্যায় ২:
পরদিন সকালে আমরা রত্নেশ্বর সেনের আলিপুরের বিশাল বাগানবাড়িতে পৌঁছলাম। বাড়ির বাইরেটা যতটা শান্ত, ভেতরটা ঠিক ততটাই বিপর্যস্ত। বিশেষ করে লাইব্রেরি ঘরের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। ঘরের মাঝখানে একটা ভাঙা কাঁচের বাক্স পড়ে আছে, আর মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কাঁচের টুকরো।
প্রমোদা ঘরের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অসাধারণ। তিনি বললেন, অভি, ঘরের একটা নিখুঁত স্কেচ তৈরি করে ফেল। প্রতিটা জিনিসের অবস্থান যেন ঠিক থাকে।
আমি আমার নোটবুক আর পেনসিল নিয়ে কাজে লেগে গেলাম। প্রমোদা ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলো পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। রত্নেশ্বর বাবু বললেন, আমি কাল সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি এই অবস্থা। সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। চোর কীভাবে ঢুকল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
প্রমোদা ঘরের জানালার কাছে গিয়ে গ্রিলগুলো পরীক্ষা করলেন। জানালা বা দরজায় জোর করে ঢোকার কোনো চিহ্ন নেই। তার মানে চোর আপনার পরিচিত কেউ এবং তার কাছে বাড়ির চাবি ছিল।
রত্নেশ্বর বাবু চমকে উঠলেন। অসম্ভব! আমার স্ত্রী এখন বাপের বাড়িতে। আর আমার বিশ্বস্ত ভৃত্য শিবু, সেও কাল সকালে তার অসুস্থ মায়ের কাছে গ্রামে গেছে। বাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না।
এই সময় আমাদের সঙ্গে আসা প্রমোদার বন্ধু মধুবাবু, যিনি পেশায় একজন খাদ্যরসিক এবং শখের গোয়েন্দা, তিনি রান্নাঘর থেকে একটা প্লেটে কয়েকটা শিঙাড়া নিয়ে ঢুকলেন। মুখে একটা শিঙাড়া পুরে বললেন, প্রমোদ, একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম।
কী? প্রমোদা ভুরু কোঁচকালেন।
ফ্রিজে একটাও সবজি বা মাছ নেই। এমনকি দুধের প্যাকেটটাও খালি। মনে হচ্ছে, গত দু-তিন দিন ধরে বাড়িতে কোনো রান্না হয়নি, মধুবাবু বললেন।
প্রমোদার চোখ জ্বলে উঠল। তিনি রত্নেশ্বর সেনের দিকে ফিরে বললেন, মিস্টার সেন, আপনার রাঁধুনি কবে থেকে ছুটিতে?
রত্নেশ্বর বাবু ইতস্তত করে বললেন, সে তো দিন তিনেক হলো গেছে। কিন্তু তাতে কী...
প্রমোদা তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আপনার স্ত্রী এবং ভৃত্যও বাড়িতে নেই। রাঁধুনিও ছুটিতে। তার মানে, গত কয়েকদিন ধরে আপনি বাড়িতে একাই খাচ্ছিলেন। কিন্তু ফ্রিজ খালি কেন? আপনি কি বাইরে থেকে খাবার আনাতেন?
রত্নেশ্বর বাবুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। হ্যাঁ, মানে... আমিই তো...
প্রমোদা মেঝেতে পড়ে থাকা একটা প্রায় অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ধুলোর আস্তরণের দিকে আঙুল দেখালেন। ঘরের সব পরিষ্কার থাকলেও, এই ভাঙা কাঁচের বাক্সের চারপাশে এক ধরনের সাদা ধুলো জমে আছে। এটা সাধারণ ধুলো নয়। এটা প্লাস্টার অফ প্যারিসের গুঁড়ো।
তিনি ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকালেন। একটা কোণে একটা ছোট্ট গর্ত দেখা যাচ্ছিল। চোর ফলস সিলিং দিয়ে ঢুকেছে, তাই না, মিস্টার সেন? আর তাই বাইরে থেকে ঢোকার কোনো চিহ্ন নেই।
রত্নেশ্বর সেনের কপালে ঘাম দেখা দিল। তিনি চুপ করে রইলেন। প্রমোদা তাঁর মগজাস্ত্রের ব্যবহার শুরু করে দিয়েছেন, আর আমি বুঝতে পারছিলাম, এই চুরির পেছনে এক গভীর ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে।
অধ্যায় ৩:
প্রমোদা লাইব্রেরির বইয়ের তাকগুলো খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর চোখ আটকে গেল একটা পুরনো অ্যালবামের উপর। তিনি অ্যালবামটা হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতে শুরু করলেন। একটা ছবিতে এসে তিনি থেমে গেলেন। ছবিতে তরুণ রত্নেশ্বর সেনের সঙ্গে আরও দুজন যুবককে দেখা যাচ্ছে। একজনের মুখে একটা কাটা দাগ।
এই ছবিতে বাকি দুজন কে, মিস্টার সেন? প্রমোদা জিজ্ঞেস করলেন।
রত্নেশ্বর বাবু ছবিটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। এরা আমার কলেজের বন্ধু। অনেকদিন যোগাযোগ নেই। যার মুখে কাটা দাগ, ওর নাম ছিল রঞ্জিত। আর অন্যজন সুধীর।
প্রমোদা ছবিটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। তারপর ঘরের এক কোণায় রাখা ছাইদানির দিকে এগিয়ে গেলেন। তার মধ্যে একটা দামী বিদেশি ব্র্যান্ডের সিগারের পোড়া অবশিষ্টাংশ পড়ে ছিল।
আপনি কি সিগার খান?
না, আমি ওসব খাই না, রত্নেশ্বর বাবু দ্রুত উত্তর দিলেন।
তাহলে এই সিগারটা কার? প্রমোদার গলায় হালকা চাপের সুর।
ঠিক সেই মুহূর্তে, অভি, যে এতক্ষণ তার ল্যাপটপে কিছু একটা করছিল, সে বলে উঠল, কাকা, একটা অদ্ভুত জিনিস খুঁজে পেয়েছি। রত্নেশ্বর সেনের বাড়ির পুরনো সিকিউরিটি সিস্টেমের লগ ফাইল ঘেঁটে দেখলাম, গত পরশু রাতে কেউ একজন সিস্টেমটা সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছিল। আর সেটা বাড়ির ভেতর থেকেই করা হয়েছিল।
সবকিছু যেন এক সুতোয় বাঁধা পড়ছিল। প্রমোদা আবার সেই ছবির দিকে তাকালেন। রঞ্জিত আর সুধীরের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল, মিস্টার সেন? সত্যিটা বলুন।
রত্নেশ্বর সেন এবার ভেঙে পড়লেন। আমরা তিনজন মিলে একসময় প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসের চোরাকারবার করতাম। চন্দ্রকান্ত মণিটা আমরা একসঙ্গেই পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি ওদের ঠকিয়ে একা মণিটা নিয়ে নিই। ভেবেছিলাম, ওরা আর আমার নাগাল পাবে না।
তার মানে রঞ্জিত বা সুধীরই এই চুরির পেছনে আছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
কিন্তু ওরা বাড়ির ভেতরে ঢুকল কীভাবে? মধুবাবু শিঙাড়া চিবোতে চিবোতে প্রশ্ন করলেন।
প্রমোদা হাসলেন। বাড়ির ভেতরে ঢোকার প্রয়োজনই হয়নি। কারণ চোর বাড়ির বাইরে যায়নি। মণিটা এখনও এই বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে রাখা আছে। এই চুরির নাটকটা সাজানো হয়েছে শুধু আমাদের এবং পুলিশকে বিভ্রান্ত করার জন্য।
আমরা সবাই অবাক হয়ে প্রমোদদার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
অধ্যায় ৪:
প্রমোদা ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, রত্নেশ্বর বাবু, আপনি ভেবেছিলেন আপনার পুরনো সঙ্গীরা মণিটা নিতে আসবে। তাই আপনি শিবুকে গ্রাম থেকে জরুরি তলব আসার নাটক করে সরিয়ে দিয়েছেন। আপনার স্ত্রীকেও বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। আর ফ্রিজ খালি করে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে বাড়িতে কেউ ছিল না।
তিনি আরও বললেন, আপনি নিজেই ফলস সিলিং-এর একটা অংশ ভেঙে প্লাস্টারের গুঁড়ো ছড়িয়েছেন, আর কাঁচের বাক্সটা ভেঙেছেন। যাতে মনে হয়, চোর ওপর থেকে নেমে এসে চুরি করে পালিয়েছে।
কিন্তু সিগারের ছাই? আমি প্রশ্ন না করে পারলাম না।
ওটা রঞ্জিতের, প্রমোদা বললেন। রত্নেশ্বর বাবুর ফোন রেকর্ড পরীক্ষা করে আমি দেখেছি, গত কয়েকদিন ধরে তিনি রঞ্জিতের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন। আমার ধারণা, রঞ্জিত এসে তাঁকে হুমকি দিয়েছে এবং মণিটা ফেরত চেয়েছে। রত্নেশ্বর বাবু ভয় পেয়ে এই চুরির নাটক সাজিয়েছেন, যাতে তিনি বিমার টাকাটা পেতে পারেন এবং সেই টাকা দিয়ে রঞ্জিতকে শান্ত করতে পারেন।
রত্নেশ্বর বাবু মাথা নিচু করে সোফায় বসে পড়লেন। তাঁর সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে।
কিন্তু মণিটা কোথায়? মধুবাবু শেষ শিঙাড়াটা মুখে পুরে জিজ্ঞেস করলেন।
প্রমোদা লাইব্রেরির এক কোণে রাখা একটা পুরনো গ্রামোফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি সেটার ঢাকনা খুলতেই আমরা দেখলাম, ভেতরে একটা কালো কাপড়ে মোড়া সেই কিংবদন্তির 'চন্দ্রকান্ত মণি' রাখা আছে। চাঁদের আলো না থাকলেও, তার ভেতর থেকে এক অপার্থিব নীল আভা ঠিকরে বেরোচ্ছিল।
প্রমোদা মণিটা হাতে নিয়ে বললেন, কিংবদন্তি সত্যি হোক বা না হোক, মানুষের লোভ আর ভয়ই সবচেয়ে বড় অভিশাপ।
রত্নেশ্বর সেনের মিথ্যা চুরির নাটক শেষ হলো। কিন্তু এক হিমশীতল রাতের এই রহস্য প্রমাণ করে দিল, মানুষের মনের ভেতরের জটিলতা যেকোনো কিংবদন্তির চেয়েও অনেক বেশি রহস্যময়। প্রমোদার মগজাস্ত্রের কাছে আরও একবার হার মানল এক ধূর্ত অপরাধীর পরিকল্পনা।