গল্প: কলেজ স্ট্রিটের প্রাচীন ঘড়ি রহস্য
লেখক: ইঞ্জিনিয়ার জেড আর চৌধুরী
অভিজিৎরঞ্জন ভট্টাচার্যের বয়ানে
আমার কাকা, শ্রী প্রমোদেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ওরফে প্রমোদা, মানুষটা সাধারণ নন। ওঁর ধূসর চোখ দুটো যেন সর্বক্ষণ সবকিছুর এক্স-রে করে চলেছে। এই সেদিন কলেজ স্ট্রিট থেকে একটা পুরনো বই কিনে বাড়ি ফিরেছি, প্রমোদা বইটার দিকে একবার তাকিয়েই বলে দিলেন, বইটা ভালোই কিনেছিস অভি, কিন্তু এর আগের মালিক যে বাঁ-হাতি ছিল, সেটা খেয়াল করেছিস? আমি তো অবাক! পাতা উল্টে দেখি, সত্যিই তাই, বইয়ের পাতার কোণগুলো বাঁ-দিক থেকেই বেশি মুড়েছে। এই হচ্ছেন প্রমোদা।
সেদিন বিকেলে আমাদের বসার ঘরে বেশ জম্পেশ আড্ডা জমেছিল। আমি, প্রমোদা আর কাকার বন্ধু, লেখক মধুসূদন গুহ, অর্থাৎ মধুবাবু। মধুবাবু সবে একটা গরম শিঙাড়া মুখে পুরেছেন, এমন সময় আমাদের বাড়িতে এলেন এক ভদ্রলোক। নাম আশুতোষ সান্যাল। ভদ্রলোকের মুখটা শুকনো, দেখেই বোঝা যাচ্ছে বড় কোনও সমস্যায় পড়েছেন।
প্রমোদা তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, বসুন। আপনার সমস্যাটা বলুন।
আশুতোষবাবু কাঁপা কাঁপা গলায় যা বললেন, তার সারমর্ম হলো, তাঁর কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বাড়ি থেকে একটা প্রাচীন দেয়াল ঘড়ি চুরি হয়ে গেছে। ঘড়িটা আমার প্রপিতামহের আমলের, ভদ্রলোক বললেন, শুধু অ্যান্টিক হিসেবেই নয়, ওটার সাথে আমাদের পরিবারের সম্মান জড়িয়ে আছে।
মধুবাবু শিঙাড়ার প্লেটটা একপাশে সরিয়ে রেখে বললেন, ঘড়ি? বলেন কী মশাই! আমার এক পরিচিত অ্যান্টিক ডিলার আছে, তার কাছে এমন ঘড়ি...
প্রমোদা হাত তুলে মধুবাবুকে থামিয়ে দিলেন। ঘড়িটার কোনও বিশেষত্ব ছিল?
হ্যাঁ, আশুতোষবাবু বললেন। ঘড়িটার ডায়ালে কোনও সংখ্যা ছিল না, তার বদলে ছিল বারোটা বিভিন্ন ফুলের ছবি। আর প্রতি ঘন্টায় একটা মিষ্টি ফ্লুটের সুর বাজত।
মধুবাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, জার্মান মেক! আমি একটা বইতে পড়েছিলাম, বাডেন-বাডেনের এক কারিগর...
প্রমোদা আশুতোষবাবুকে আশ্বস্ত করে বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি কাল সকালে আপনার বাড়ি যাব।
পরদিন সকালে আমরা আশুতোষবাবুর বাড়িতে পৌঁছলাম। উত্তর কলকাতার এক পুরনো বনেদি বাড়ি। চারদিকে পুরনো দিনের আসবাব, দেওয়ালে ঝোলানো বিবর্ণ অয়েল পেন্টিং। যেখান থেকে ঘড়িটা চুরি গেছে, সেই দেওয়ালে একটা আবছা দাগ ছাড়া আর কিছুই নেই।
প্রমোদা চারদিকটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। আমি আমার স্মার্টফোন দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। হঠাৎ প্রমোদার চোখ পড়ল ঘরের কোণে রাখা একটা পুরনো গ্রামোফোনের ওপর। সেটার পাশে কয়েকটা রেকর্ডের স্তূপ। প্রমোদা রেকর্ডগুলো একটা একটা করে দেখতে লাগলেন।
মধুবাবু বললেন, এসব তো দেখছি পুরনো ক্লাসিক্যাল। আমার সংগ্রহেও এমন কিছু আছে। আসলে...
প্রমোদা মধুবাবুর কথায় কান না দিয়ে একটা রেকর্ডের দিকে বিশেষভাবে তাকালেন। রেকর্ডটার লেবেলে লেখা 'ফুলের সাজি'।
আচ্ছা, আশুতোষবাবু, প্রমোদা বললেন, এই রেকর্ডটা কি আপনি শোনেন?
আশুতোষবাবু অবাক হয়ে বললেন, না তো! ওটা তো কবে থেকে পড়ে আছে। আমার প্রপিতামহের খুব শখ ছিল।
প্রমোদা আর কিছু না বলে আমাদের নিয়ে বেরিয়ে এলেন। পথে মধুবাবু বললেন, ব্যাপারটা কিছুই বুঝলাম না, প্রমোদেশ। ঘড়ি চুরির সাথে গ্রামোফোন রেকর্ডের কী সম্পর্ক?
প্রমোদা হাসলেন। মধুবাবু, গোয়েন্দাগিরিটা অনেকটা ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের মতো। আসল সুরটা ধরার জন্য অনেকগুলো নোটকে একসাথে মেলাতে হয়।
বিকালে প্রমোদা আমাকে নিয়ে গেলেন কলেজ স্ট্রিটের এক পুরনো ঘড়ির দোকানে। দোকানের মালিক বৃদ্ধ হরিনাথবাবু কাকাকে দেখে খাতির করে বসালেন। প্রমোদা তাঁকে আশুতোষবাবুর ঘড়িটার বর্ণনা দিলেন।
হরিনাথবাবু সব শুনে বললেন, এমন ঘড়ি তো সচরাচর দেখা যায় না। তবে হপ্তাখানেক আগে একজন লোক এসেছিল এমন একটা ঘড়ির খোঁজ করতে। বেশ তাড়াহুড়োয় ছিল।
প্রমোদা লোকটার চেহারার বর্ণনা চাইতেই হরিনাথবাবু যা বললেন, তা শুনে আমার ভুরু কুঁচকে গেল। বর্ণনাটা আশুতোষবাবুর বাড়ির কেয়ারটেকার রঘুনাথের সাথে হুবহু মিলে যায়।
বাড়ি ফিরে প্রমোদা সোজা মধুবাবুকে ফোন করলেন। মধুবাবু, আপনার সেই অ্যান্টিক ডিলারের ঠিকানাটা একবার দেবেন?
মধুবাবুর দেওয়া ঠিকানা নিয়ে আমরা যখন সেই অ্যান্টিক ডিলারের দোকানে পৌঁছলাম, তখন প্রায় সন্ধ্যে। দোকানে ঢুকতেই আমাদের চোখ পড়ল একটা বড় দেয়াল ঘড়ির ওপর। ডায়ালে সংখ্যার বদলে আঁকা বারোটা ফুল।
প্রমোদা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। ঘড়িটা তো পাওয়া গেল।
দোকানের মালিক প্রথমে অস্বীকার করলেও, প্রমোদার জেরার মুখে ভেঙে পড়ল। স্বীকার করল যে, রঘুনাথই ঘড়িটা তাকে বিক্রি করে গেছে।
রাতে আশুতোষবাবুর বাড়িতে পুলিশ এসে রঘুনাথকে ধরে নিয়ে গেল। আশুতোষবাবু তো প্রমোদার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
আমি বললাম, কাকা, তুমি প্রথম থেকেই রঘুনাথকে সন্দেহ করেছিলে?
প্রমোদা বললেন, প্রথম থেকেই নয়। তবে গ্রামোফোন রেকর্ডটা দেখে আমার খটকা লাগে। 'ফুলের সাজি' নামের রেকর্ডটা একটা ক্লু ছিল। ঘড়ির ডায়ালে ছিল ফুলের ছবি। আমার মনে হলো, চোর এমন কেউ যে বাড়ির ভেতরের খবর জানে এবং পুরনো জিনিসপত্রের কদর বোঝে। রঘুনাথ অনেকদিন ধরে ওই বাড়িতে কাজ করছে। হরিনাথবাবুর কাছে লোকটার বর্ণনা শুনে আমার সন্দেহটা আরও দৃঢ় হয়।
মধুবাবু বললেন, কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম, এটা কোনও বড়সড় অ্যান্টিক পাচারকারী দলের কাজ! আমার নতুন উপন্যাসের প্লটটা প্রায় ভেবেই ফেলেছিলাম।
প্রমোদা হেসে বললেন, মধুবাবু, সব রহস্য অত জটিল হয় না। মাঝে মাঝে উত্তরটা আমাদের চোখের সামনেই থাকে, শুধু দেখার মতো চোখ থাকা চাই।
আমি কাকার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, সত্যিই, প্রমোদার ওই ধূসর চোখ দুটো যেন সাধারণের মধ্যে থেকেও অসাধারণকে খুঁজে বের করার জন্যই তৈরি।