Posts

উপন্যাস

শঙ্কর এর নতুন অভিযান: সূর্যশিলার সন্ধানে, ১ম পর্ব

September 13, 2025

প্রকৌশলী জেড আর চৌধুরী

102
View

শঙ্কর এর নতুন অভিযান: সূর্যশিলার সন্ধানে
লেখক: প্রকৌশলী জেড আর চৌধুরী

ভূমিকা:

কালজয়ী কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি 'চাঁদের পাহাড়'-এর নায়ক শঙ্কর আমাদের কৈশোরের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার দুঃসাহসিক অভিযান, অজানার প্রতি তীব্র আকর্ষণ এবং প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা বাঙালি পাঠকের মনে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছে। বিভূতিভূষণের লেখনীর এমনই গুণ যে, রিখটারসভেল্ড পর্বতমালার ভয়ঙ্কর অধ্যায় শেষ হইবার পরেও আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে— তারপর? শঙ্কর কি তার আরণ্যক সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে বাকি জীবনটা সভ্য জগতেই কাটিয়ে দিল? নাকি আফ্রিকার সেই আদিম, দুর্নিবার আকর্ষণ তাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল এক নতুন পথে, এক নতুন অভিযানে?

এই প্রশ্নই আমাকে তাড়িত করছে সব সময়। 'সূর্যশিলার সন্ধানে' সেই তাড়নারই এক বিনীত ফসল। এই 'চাঁদের পাহাড়'-এর কোনও সিক্যুয়েল বা অনুকরণ নয়, বরং বিভূতিভূষণের সৃষ্টি করা সেই অসাধারণ চরিত্রটির প্রতি এক মুগ্ধ পাঠকের শ্রদ্ধার্ঘ্য। এই উপন্যাসে আমি কল্পনা করতে চেষ্টা করছি, শঙ্কর যদি আবার আফ্রিকায় ফিরে যাইত, তবে তার সেই অভিযান কেমন হতে পারত। চেষ্টা করেছি বিভূতিভূষণের সেই সরল, অথচ গভীর জীবনবোধ ও নিসর্গপ্রেমকে আমার সীমিত সাধ্যের মধ্যে ধরে রাখার।

এই প্রচেষ্টা এক প্রকার ধৃষ্টতা, তা আমি জানি। বিভূতিভূষণের লেখনীর গভীরতা ও বিশালতাকে স্পর্শ করা আমার মতো নগণ্য লেখকের পক্ষে অসম্ভব। তবু, এই লেখার মাধ্যমে আমি শুধু এটুকুই বলতে চাহিয়াছি যে, শঙ্করের মতো চরিত্রেরা কখনো ফুরিয়ে যায় না। তারা যুগ যুগ ধরে পাঠকের কল্পনায় বেঁচে থাকে, আর নতুন নতুন অভিযানের স্বপ্ন দেখায়।

যদি এই কাহিনী পাঠ করে কোনো পাঠকের মনে মুহূর্তের জন্যও কঙ্গোর সেই গহিন অরণ্যের শিহরণ জাগে, অথবা বৃদ্ধ মাতুম্বোর জন্য চোখটা ছলছল করে ওঠে, তবেই আমি আমার এই দুঃসাহসিক লেখাকে সার্থক বলে মনে করব।

প্রাককথন: এক ক্ষমাপ্রার্থনা

যার লেখনী স্পর্শে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে, সেই মহান স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতির প্রতি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। তাঁরই সৃষ্ট চরিত্র শঙ্করকে নিয়ে একটি নূতন কাহিনী রচনা করবার যে দুঃসাহস আমি করেছি, তার জন্য আমি লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।

এই কাহিনী রচনা করবার পূর্বে শ্রদ্ধেয় বিভূতিভূষণের পরিবার বা তাঁর উত্তরাধিকারীদের নিকট হতে কোনও প্রকার অনুমতি গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। এটা আমার অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি এবং এক প্রকার অনধিকার চর্চা, তা আমি স্বীকার করি। আমার উদ্দেশ্য কোনোভাবেই বাণিজ্যিক বা অমর্যাদাকর ছিল না। কেবলমাত্র একজন একনিষ্ঠ পাঠক হিসাবে, 'চাঁদের পাহাড়'-এর প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা ও মুগ্ধতা হয়েই এই কাহিনীর জন্ম। আমি কেবল কল্পনা করতে চেয়েছি, বিভূতিভূষণ নিজে যদি শঙ্করের আর একটি অভিযানের কথা লিখতেন, তবে তা কেমন হতে পারত।

এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য আমি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবার, তাঁর অনুরাগী পাঠক এবং বাংলা সাহিত্য জগতের সকলের নিকট করজোড়ে মার্জনা ভিক্ষা করছি। আমার এই লেখাকে দয়া করে এক ভক্তের অক্ষম শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসাবেই গ্রহণ করবেন। যদি আমার এই প্রচেষ্টা কারো অনুভূতিতে আঘাত করে থাকে, তবে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। বিভূতিভূষণের প্রতি আমার সম্মান ও শ্রদ্ধা সর্বদা অক্ষুণ্ণ থাকবে।


উৎসর্গ:

হে মহান কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, আপনার অমর সৃষ্টি 'চাঁদের পাহাড়'-এর নায়ক শঙ্করের দুঃসাহসিক চেতনাকে পাথেয় করে আমি প্রকৌশলী জেড আর চৌধুরী রচনা করেছি "শঙ্কর এর নতুন অভিযান: সূর্যশিলার সন্ধানে"। আপনার দেখানো পথেই শঙ্কর আবার বেরিয়ে পড়েছে অজানা বিপদের সন্ধানে, জয় করেছে দুর্গম গিরি, কান্তার মরু।

এই কাহিনি আপনার চরণে এক বিনম্র অর্ঘ্য। আপনি শিখিয়েছেন কীভাবে প্রকৃতির রহস্য ও রোমাঞ্চের সাথে একাত্ম হতে হয়। শঙ্করের এই নতুন অভিযান আপনার সেই মূল সুরকেই বয়ে নিয়ে চলেছে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পাঠকদের অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাবে।


সূর্যশিলার সন্ধানে

প্রথম পরিচ্ছেদ: আবার আফ্রিকার ডাক


অধ্যায় ১: আরণ্যকের স্বপ্ন

বছর কয়েক কেটে গেছে। রিখটারসভেল্ড পর্বতমালার দুঃস্বপ্ন ও কালাহারি মরুভূমির বিভীষিকা এখন অতীত। সেই শঙ্করের জীবনে এখন অনেক পরিবর্তন। কলকাতার এক অভিজাত অঞ্চলের বিশাল দোতলা বাড়িটার মালিক এখন শঙ্কর রায়। পাটের ব্যবসা তার ফুলেফেঁপে উঠেছে, লোকে তাকে একডাকে চেনে। বিষয়-সম্পত্তি, সম্মান, প্রতিপত্তি— কিছুরই অভাব নেই। বাইরের জগতে শঙ্কর একজন সফল, স্থিতধী ব্যবসায়ী। কিন্তু তার অন্তরাত্মা জানে, এ তার আসল পরিচয় নয়। সে যেন এক অচেনা জীবনের অভিনয় করে চলছে।

প্রতিদিনকার জীবন একই বাঁধা ছকে চলে। সকালে উঠে ব্যবসার কাজকর্ম দেখা, বিকেলে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক, রাতে ক্লাবে গিয়ে তাস খেলা। কিন্তু এই আপাত শান্ত, গোছানো জীবনের আড়ালে শঙ্করের ভেতরটা ছিল অশান্ত, উথালপাতাল। তার মন পড়ে থাকত বহু দূরে, সমুদ্রের ওপারে, সেই আদিম, বন্য মহাদেশে।

সেদিনও সন্ধ্যে নামার পর শঙ্কর তার প্রিয় জায়গা, দক্ষিণের বিশাল বারান্দাটায় একটা আরামকেদারায় এসে বসল। এখান থেকে আকাশটা বড় পরিষ্কার দেখা যায়। ফুরফুরে বাতাসে জুঁই ফুলের মৃদু গন্ধ। শহরের কোলাহল এখানে তেমনভাবে পৌঁছায় না। ঠিক মাথার ওপরে জ্বলজ্বল করছে কালপুরুষ, তার কোমরবন্ধের তিনটি তারা স্পষ্ট দেখা যায়।

এই নক্ষত্রপুঞ্জকে সে চেনে। খুব ভালোভাবেই চেনে। রোডেসিয়ার জনমানবহীন প্রান্তরে, উগান্ডার গভীর অরণ্যে রাতের আকাশে ঠিক এভাবেই উদয় হতো কালপুরুষ। আলভারেজের সাথে কত রাত তারা আগুন জ্বেলে বসে খোলা আকাশের নিচে কাটিয়েছে, আর এই কালপুরুষ ছিল তাদের মাথার ওপরের নিঃশব্দ প্রহরী। এক মুহূর্তে শঙ্করের মনটা হু হু করে উঠল। এই আরাম, এই নিরাপত্তা, এই অর্থ— সবকিছুর বিনিময়ে সে যদি একবারের জন্য সেই ভেল্ডের মুক্ত বাতাস বুকে ভরে নিতে পারত!

রাত্রি গভীর হলে শঙ্কর ঘুমাতে যায়। কিন্তু ঘুম তার জন্য শান্তি নিয়ে আসে না, নিয়ে আসে এক ভয়ঙ্কর সুন্দর অতীত। ঘুমের অতলে সে প্রায়ই তলিয়ে যায়, এক স্বপ্নের জগতে যেখানে বাস্তব আর কল্পনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আবার সে ফিরে যায় সেই মহাদেশে। কানের পাশে শুনতে পায় বুনিপের সেই হাড়-হিম করা গর্জন, চোখের সামনে ফণা তোলে বিষাক্ত ব্ল্যাক মাম্বা, জিম্বাবুয়ের ধ্বংসস্তূপের গোলকধাঁধায় সে পথ হারিয়ে ফেলে। আবার কখনও দেখে, চাঁদের পাহাড়ের গুহার ভেতরে লক্ষ লক্ষ হীরা তারার মতো জ্বলছে, আর পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে তার প্রিয় বন্ধু ও পথপ্রদর্শক, ডিয়েগো আলভারেজ।

ঘামে ভেজা শরীরে ধড়মড় করে উঠে বসে শঙ্কর। হৃৎপিণ্ডটা তখনও ধুকপুক করছে। ঘরের মৃদু আলোয় সে তাকিয়ে দেখে— মিশরীয় তুলার নরম চাদর, মাথার ওপর ভিক্টোরীয় আমলের পাখাটা ধীরে ধীরে ঘুরছে, জানলার বাইরে কলকাতার নিঝুম রাত। স্বপ্ন ভেঙে যায়, কিন্তু তার রেশটুকু থেকে যায়। এক তীব্র শূন্যতাবোধ তাকে গ্রাস করে।

সকালে পাটকলে গিয়েও তার মন বসে না। ম্যানেজারের কথার উত্তরে সে অন্যমনস্কভাবে হুঁ-হাঁ করে। হিসাবের খাতার সংখ্যাগুলো তার চোখে অর্থহীন লাগে। পাটের আঁশের পরিচিত গন্ধের মধ্যে সে যেন খুঁজে ফেরে আফ্রিকার স্যাঁতস্যাঁতে জঙ্গলের সোঁদা গন্ধ, শুকনো ঘাসের গন্ধ। তার শ্রমিকদের কর্মব্যস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ে যায় মাসাই বা জুলু উপজাতির সেই ঋজু, নির্ভীক মানুষগুলোর কথা।

এই বিরাট অট্টালিকা, এই সম্মান, এই প্রতিপত্তি— সবকিছুকে তার এক সোনালী খাঁচা বলে মনে হয়। যে পাখি একবার অনন্ত আকাশের স্বাদ পেয়েছে, তাকে কি আর সোনার খাঁচায় বেঁধে রাখা যায়? শঙ্করের ভেতরটা মুক্তির জন্য ছটফট করে। সে জানে, এই শান্ত, নিরাপদ জীবন তার জন্য নয়। তার রক্তে যে দূরদেশের ডাক, সে ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য তার নেই।

প্রতি রাতে সে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, তাকিয়ে থাকে দক্ষিণের আকাশের দিকে। সে জানে, ওই অন্ধকারের ওপারেই আছে তার আসল জগৎ। এক অদম্য, অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ তাকে টানছে। সে জানে, আফ্রিকা তাকে আবার ডাকছে। সে ডাক উপেক্ষা করার শক্তি তার আর অবশিষ্ট নেই।

Comments

    Please login to post comment. Login