Posts

উপন্যাস

শঙ্কর এর নতুন অভিযান: সূর্যশিলার সন্ধানে, ২য় পর্ব

September 14, 2025

প্রকৌশলী জেড আর চৌধুরী

90
View

অধ্যায় ২: আলভারেজের সিন্দুক

শ্রাবণের দুপুর। আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘে মেঘে অন্ধকার। বেলা দশটা নাগাদ ঝিরঝির করে যে বৃষ্টি নেমেছিল, দুপুর গড়াতে না গড়াতেই তা মুষলধারে বৃষ্টিতে পরিণত হয়েছে। কলকাতার আকাশ যেন একটা ধূসর চাদর মুড়ে দিয়েছে, রাস্তাঘাটে লোকচলাচল কম। এমন দিনে মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। শঙ্করেরও আজ আর পাটকলে যাওয়া হয়নি। বাইরের বৃষ্টিভেজা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে তার মনটাও পুরনো স্মৃতিতে ভিজছিল।

এই বিরাট বাড়িটার দোতলার এক কোণে একটা ছোট ঘর আছে, শঙ্কর সেটাকে নিজের গুদামঘর বানিয়েছে। তার পুরনো দিনের নানা টুকিটাকি জিনিস, বইপত্র, সাঝ সরঞ্জাম সেখানে যত্ন করে তোলা আছে। আজ দুপুরে কোনো কাজ না থাকায় শঙ্কর সেই ঘরেই ঢুকল। উদ্দেশ্য, পুরনো কিছু বই বা ম্যাপ খোঁজা।

ঘরের ভেতরে একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব, পুরনো কাগজ আর কাঠের মেশানো এক ধরনের গন্ধ। একপাশে সারিসারি ট্রাঙ্ক ও বাক্স রাখা। সেগুলোর ওপর ধুলোর মোটা আস্তরণ পড়েছে। এক কোণে, অন্যান্য জিনিসপত্রের আড়ালে প্রায় অদৃশ্য একটা মাঝারি আকারের লোহার সিন্দুক দেখে শঙ্করের বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।

এ তো সেই সিন্দুক! আলভারেজ মৃত্যুশয্যায় তার হাতে এই সিন্দুকটা তুলে দিয়েছিল। দেশে ফেরার পর নানা ব্যস্ততায় ও মানসিক অশান্তিতে এর কথা সে একরকম ভুলেই গিয়েছিল। এতদিন ধরে এই সিন্দুকটা যে তার বাড়িতেই এমন অবহেলায় পড়ে আছে, তা ভেবে নিজের ওপরই কেমন মায়া হলো।

আলভারেজের মুখটা স্পষ্ট মনে পড়ল তার। রোগা, জীর্ণ শরীর, কিন্তু চোখ দুটোতে তখনও কী ভীষণ দ্যুতি! দুর্বল গলায় বলেছিল, "My boy, this is for you. Everything I had... my knowledge, my dreams... it's all in there. One day, you will understand."

শঙ্কর সিন্দুকটাকে টেনে ঘরের মাঝখানে আনল। বেশ ভারী। মরচে ধরা কব্জা আর শক্ত লোহার পাতে তৈরী। ওপরে একটা জটিল নকশার তালা ঝুলছে। চাবি কোথায়, তা সে জানে না। রতনকে ডেকে সে একটা হাতুড়ি আর ছেনি আনালো।

কিছুক্ষণ ঠোকাঠুকির পর মরচে ধরা তালাটা ভেঙে গেল। শঙ্কর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল। তার বুকটা জোরে জোরে ধুকপুক করছিল। কী আছে এর ভেতরে? আলভারেজের কোন স্মৃতি, কোন রহস্য সে আজ আবিষ্কার করতে চলেছে?

অনেকটা জোর লাগিয়ে সে সিন্দুকের ডালাটা খুলল। ক্যাঁচ করে একটা জোরে শব্দ করে ডালাটা খুলে গেল। আর সাথে সাথেই ভেতর থেকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এসে লাগল। এ গন্ধ শুধু পুরনো দিনের গন্ধ নয়। এর সাথে মিশে আছে পুরনো চামড়া, শুকনো তামাক আর আফ্রিকার কোনো এক অজানা বুনো ফুলের হালকা গন্ধ। এক মুহূর্তে শঙ্করের মনে হলো, এ তো শুধু সিন্দুক নয়, এ যেন আলভারেজের ফেলে আসা জীবনের একটা টুকরো।

কাঁপা হাতে সে ভেতরে হাত দিল। ওপরেই ছিল একটা সেক্সট্যান্ট, নোনা জলে এর পেতলের গা-টা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তার পাশেই একটা জার্মান কম্পাস, এখনো ঠিক রাস্তা দেখায়। একটা শক্ত চামড়ার খাপে ঢাকা ধারালো ছোরা। এই জিনিসগুলো হাতে নিতেই শঙ্করের মনে হলো, সে যেন আবার সেই পুরনো দিনগুলোতে ফিরে গেছে। এই কম্পাস কতবার দুর্গম পথে তাদের বাঁচিয়েছে, এই ছোরা কতবার বন্য জন্তুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে কাজে এসেছে!

এগুলোর নিচেই ছিল আলভারেজের প্রিয় কাঠের পাইপটা। বাটির ভেতরে আধপোড়া তামাক এখনো লেগে আছে। শঙ্কর পাইপটা হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করল। সে যেন স্পষ্ট দেখতে পেল, গভীর জঙ্গলের মধ্যে আগুনের পাশে বসে আলভারেজ খুব আয়েশ করে পাইপ টানছে আর তার দিকে চেয়ে রহস্যময়ভাবে হাসছে।

সবকিছুর নিচে, একটা তেল-চিটচিটে ওয়াটারপ্রুফ কাপড়ে জড়ানো একটা জিনিস ছিল। শঙ্কর সাবধানে মোড়কটা খুলল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা লাল চামড়ায় বাঁধানো, ডায়েরি। পাতাগুলো পুরনো হয়ে হলুদ হয়ে গেছে, কয়েক জায়গায় পোকায় কেটেছে।

এই ডায়েরিটাই তাহলে আলভারেজের জ্ঞানের ভান্ডার!

শঙ্কর আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াল না। ডায়েরিটা বুকে জড়িয়ে সে নিজের পড়ার ঘরে চলে এল। বাইরের বৃষ্টি তখন আরও বেড়েছে, কিন্তু শঙ্করের সেদিকে খেয়াল নেই। তার পুরো দুনিয়াটা যেন ওই একটা ডায়েরির মধ্যে এসে আটকে গেছে। সে জানে, এই ডায়েরির পাতা খুললেই একটা নতুন দুনিয়ার দরজা তার সামনে খুলে যাবে। 

 

অধ্যায় ৩: ডায়েরির পাতা

বাইরে তখনও একটানা বৃষ্টি পড়ছে। শঙ্কর তার পড়ার ঘরের দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিলো, যাতে বাইরের জগতের কোনো শব্দ বা মনযোগে বাধা না আসে। টেবিল ল্যাম্পের নরম আলোয় সে আলভারেজের সেই লাল চামড়ায় বাঁধানো ডায়েরিটা খুললো। প্রথম পাতাটা ওল্টাতেই এক ধরনের তীব্র আবেগ তার বুকের ভেতরটা নাড়িয়ে দিলো। এ শুধু কালির আঁচড় নয়, এ যেন এক জীবন-মৃত্যুর ছাপ রেখে যাওয়া অভিযাত্রীর হৃদস্পন্দন।

ডায়েরির প্রথম কয়েকটা পাতা ছিলো পর্তুগীজ ভাষায় লেখা। আলভারেজের ছোট করে লেখা আত্মজীবনী— লিসবনের ছোটবেলা, সমুদ্রের প্রতি জন্ম থেকেই টান, নাবিকের জীবন ছেড়ে আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে হীরে আর সোনার খোঁজে নিজেকে সঁপে দেওয়ার গল্প। তার লেখা ছিল সহজ, সরল কিন্তু আশ্চর্যরকম জীবন্ত। পড়তে পড়তে শঙ্করের মনে হচ্ছিল, সে যেন আলভারেজের জীবনের ছবি দেখছে।

তারপর শুরু হয়েছে আফ্রিকার কথা। প্রত্যেকটা লাইন যেন এক একটা রোমাঞ্চকর অভিযানের দলিল। আলভারেজ লিখেছে গ্রেট জিম্বাবুয়ের সেই রহস্যময় ধ্বংসস্তূপের কথা। কীভাবে পূর্ণিমার রাতে পাথরের দেওয়ালের গায়ে অদ্ভুত ছায়া পড়ে, কীভাবে বাতাস কেঁপে একটা অদ্ভুত সুর ভেসে আসে— তার বর্ণনা পড়ে শঙ্করের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। সে লিখেছে ম্যাশোনা উপজাতির কথা, তাদের অদ্ভুত রীতিনীতি, সর্দার 'রুইয়া'র সাথে তার বন্ধুত্বের গল্প। রুইয়ার কাছ থেকেই সে প্রথম শুনেছিল 'চাঁদের পাহাড়' বা 'Mountain of the Moon'-এর কিংবদন্তী।

শঙ্কর পাতা ওল্টাতে লাগলো। এক জায়গায় সে বুনিপের কথা পেলো। ভিক্টোরিয়া হ্রদের কাছাকাছি এক জলাভূমিতে এই ভয়ংকর জন্তুটার সাথে তার দেখা হয়েছিল। আলভারেজ তার বিশাল চেহারা, কুমিরের মতো শক্ত চামড়া আর ঘোড়ার মতো মুখের যে বর্ণনা দিয়েছে, তা যে কোনো মানুষের মনে ভয় ধরানোর জন্য যথেষ্ট। কীভাবে সে একাই রাইফেল হাতে বুনিপের সাথে লড়াই করে প্রাণ বাঁচিয়েছিল, সেই গল্প পড়তে পড়তে শঙ্করের নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠলো।

ডায়েরির পাতায় পাতায় ছিল আফ্রিকার কঠিন, বন্য প্রকৃতির আশ্চর্য সুন্দর বর্ণনা। রোডেশিয়ার এবড়োখেবড়ো ঘাসজমি বা ভেল্ড, কঙ্গোর ঘন জঙ্গল, কালাহারির প্রাণহীন মরুভূমি— আলভারেজের লেখায় তারা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সে শুধু সোনার খনি বা হীরের খোঁজ করেনি, সে আফ্রিকার আত্মাকে খুঁজেছিল। তার লেখায় ছিল গভীর প্রকৃতিপ্রেম আর পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা। কোন গাছের পাতা সাপের বিষ নামাতে পারে, কোন পাখির ডাক বিপদের সঙ্কেত দেয়, কোন তারা দেখে মরুভূমিতে পথ খুঁজতে হয়— এই সব খুঁটিনাটি তথ্যে ডায়েরিটা ভরা ছিল।

পড়তে পড়তে শঙ্কর সময়ের জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। বাইরের বৃষ্টি কখন থেমে গেছে, সন্ধ্যা কখন নেমেছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে যেন ডায়েরির পাতায় ভর করে আলভারেজের সঙ্গী হয়ে আফ্রিকার পথে পথে ঘুরছে। আলভারেজের আনন্দ-কষ্ট, তার ভয় আর অবাক হওয়া— সবকিছু সে নিজের মধ্যে অনুভব করছিল। তার মনে হচ্ছিল, আলভারেজ যেন তার পাশেই বসে আছে, আর তার গমগমে গলায় নিজের জীবনের গল্প তাকে শোনাচ্ছে।

ডায়েরির প্রায় শেষের দিকে এসে শঙ্কর চাঁদের পাহাড়ের অভিযানের কথা পেলো। তাদের পরিচয়, একসাথে পথ চলা, রিখটারসভেল্ড পর্বতমালার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা, গুহার মধ্যে হীরের খোঁজ— সবকিছুই আলভারেজ খুব যত্ন করে লিখে রেখেছে। নিজের কথা পড়তে শঙ্করের কেমন লজ্জা করতে লাগলো। আলভারেজ তার সাহস, বুদ্ধি আর সহনশীলতার যে প্রশংসা করেছে, নিজেকে তার যোগ্য বলে মনে হলো না।

সেই ভয়ংকর আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের বর্ণনা ছিল শেষ পাতায়। কীভাবে সে শঙ্করকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে মারাত্মকভাবে জখম হয়েছিল, কীভাবে শঙ্করের সেবা-যত্নে সে কিছুদিন বেঁচে ছিল— সবকিছুই সে লিখেছে। লেখার শেষে কালির রঙটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে, অক্ষরগুলো কাঁপাকাঁপা।

ডায়েরিটা শেষ করে শঙ্কর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। তার চোখ দুটো জলে ভরে উঠেছে। এ শুধু একটা ডায়েরি নয়, এ এক মহৎ আত্মার ছবি। আলভারেজ শুধু একজন ভাগ্য খোঁজা অভিযাত্রী ছিলো না, সে ছিলো একজন দার্শনিক, একজন প্রকৃতিপ্রেমী, একজন খাঁটি বন্ধু।

শঙ্কর ডায়েরিটা যত্ন করে বন্ধ করে বুকের কাছে চেপে ধরলো। এই ডায়েরি এখন তার কাছে এক অমূল্য সম্পদ। এটা শুধু তাকে অতীত মনে করিয়ে দেবে না, হয়তো ভবিষ্যতের পথও দেখাবে। কিন্তু সে তখনও জানতো না, এই ডায়েরির শেষ পাতায়, একটা গোপন ভাঁজের আড়ালে তার জন্য কী সাংঘাতিক বিস্ময়, কী রোমাঞ্চকর এক নতুন অভিযানের ডাক অপেক্ষা করে আছে।
 

Comments

    Please login to post comment. Login