লারিনার হিংসা ও ভয়ংকর পরিণতি
লাগুনা দে বাই-এর তীরঘেঁষা এক ছোট্ট গ্রামে থাকত দুই বোন—লারিনা আর মাঙ্গিতা। দু’জনের রূপ ছিল অপূর্ব, কিন্তু স্বভাব ছিল আকাশ-পাতাল পার্থক্যের মতো। মাঙ্গিতা ছিল দয়ালু, পরিশ্রমী আর সবার প্রিয়। সে বাবাকে জালে মাছ ধরায় সাহায্য করত, অসুস্থ প্রতিবেশীর খোঁজ নিত, এমনকি ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের জন্য নিজের খাবারটুকু পর্যন্ত ভাগ করে দিত। তাই গ্রামবাসীর মুখে মুখে সবসময় থাকত মাঙ্গিতার প্রশংসা।
কিন্তু লারিনা ছিল আলাদা। সুন্দরী হলেও সে ছিল অহংকারী, হিংসুক আর স্বার্থপর। যখনই মাঙ্গিতার নাম শুনত, তার ভেতর এক অদৃশ্য আগুন জ্বলে উঠত। সে ভাবত—
“মাঙ্গিতা থাকলে আমি কেউ নই। সবাই কেবল ওকেই ভালোবাসে। কেন? আমি কি কম সুন্দর নাকি?”
হিংসার বীজ।
এক বিকেলে লারিনা লেকের ধারে বসে নিজের চুল আঁচড়াচ্ছিল। সূর্যের শেষ আলো পানির উপর সোনালি ঝিলিক ছড়াচ্ছিল। ঠিক তখনই সে দেখল, মাঙ্গিতা বাবার পাশে বসে জাল মেরামত করছে। চারপাশে গ্রামবাসী তাকে ঘিরে রয়েছে। কেউ বলছে—
“কি মায়াবী মেয়ে!”
আবার কেউ বলছে—
“এমন পরিশ্রমী মেয়ে আজকাল আর কোথায় পাওয়া যায়!”
এই দৃশ্য লারিনার হৃদয়ে কাঁটার মতো বিঁধল। তার চোখে যেন রক্ত নেমে এল। হিংসা আর ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করল—
“আজই শেষ করব সব! মাঙ্গিতা আর থাকবে না। ও থাকলে আমায় কেউ কখনো মনে রাখবে না।”
ভয়ংকর পরিকল্পনা
সেই রাতেই, চারদিক নিস্তব্ধ যখন শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর পানির ঢেউয়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল, লারিনা মাঙ্গিতার কাছে গেল। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি, চোখে ভেতরের বিষ লুকানো। সে বলল—
“বোন, চলো আজ একটু লেকের ধারে হাঁটি। আজকের চাঁদটা কী সুন্দর দেখাচ্ছে, পানিতে যেন রূপার প্রতিচ্ছবি পড়েছে।”
সরল হৃদয়ের মাঙ্গিতা সন্দেহহীনভাবে রাজি হলো। দু’জন পাশাপাশি হেঁটে গেল লেকের ধারে। বাতাসে কাদামাটির গন্ধ, দূরে পাখিদের রাতের ডাক, আর পানিতে চাঁদের প্রতিফলন যেন অদ্ভুত জাদুর মতো ভেসে উঠছিল।
হঠাৎ লারিনা নিঃশব্দে মাঙ্গিতাকে ঠেলে দিল গভীর জলে।
শেষ আর্তনাদ
অপ্রস্তুত মাঙ্গিতা হঠাৎ জলে পড়ে আতঙ্কে চিৎকার করল। সে সাঁতারের চেষ্টা করল, কিন্তু লেকের নিচে জমে থাকা কাদায় তার পা আটকে গেল। শ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল। হাত-পা ছুড়ে কাঁদতে কাঁদতে সে চিৎকার করল—
“লারিনা! আমাকে বাঁচাও, আমি তোমার বোন!”
কিন্তু লারিনা? সে কোনো সাহায্যের হাত বাড়াল না। বরং পেছন ফিরে হাঁটতে লাগল। ঠোঁটে ঠান্ডা হাসি, চোখে তৃপ্তির ঝলক।
মাঙ্গিতার কান্না ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল রাতের নীরবতায়।
অলৌকিক রূপান্তর
পরদিন ভোরে, গ্রামবাসী লেকের তীরে ভিড় করল। তারা ভেবেছিল মাঙ্গিতার দেহ ভেসে উঠবে। কিন্তু আশ্চর্য! তার কোনো চিহ্নই নেই। বরং লেকের পানির উপর ভেসে আছে সবুজ অজানা গাছ, দেখতে অনেকটা লেটুস পাতার মতো। প্রথমে মানুষ ভয় পেল, কিন্তু পরে তারা বলল—
“এ তো মাঙ্গিতার দয়া ও সৌন্দর্যের প্রতিফলন। প্রকৃতি তাকে নতুন রূপে ফিরিয়ে এনেছে।”
ধীরে ধীরে সেই সবুজ ভাসমান উদ্ভিদ ছড়িয়ে পড়ল পুরো লাগুনা দে বাই ও পাসিগ নদীতে। আজও নদীর বুকে ভেসে থাকা সেই গাছ দেখে মানুষ মাঙ্গিতার কথা মনে করে।
লারিনার পতন
কিন্তু লারিনার কী হল?
গ্রামবাসী তার দিকে ঘৃণার চোখে তাকাতে লাগল। অনেকে ফিসফিস করে বলত—
“এ মেয়ে-ই তো মাঙ্গিতার সর্বনাশ করেছে।”
শুরু হলো লারিনার দুঃখের দিন। দিন দিন সে অসুস্থ হতে লাগল। রাতে ঘুমোতে গেলেই শোনার মতো লাগত মাঙ্গিতার আর্তনাদ—
“লারিনা… আমাকে বাঁচাও…”
হিংসা, অপরাধবোধ আর গ্রামবাসীর ঘৃণা মিলিয়ে তার অন্তর ভেতর থেকে পুড়ে যেতে লাগল। এক ঝড়ের রাতে, যখন চারদিক অন্ধকার আর বজ্রপাত আকাশ কাঁপাচ্ছিল, হঠাৎ লারিনা হারিয়ে গেল। কেউ জানল না সে কোথায় গেল। কেউ বলে, লেকের গভীরে অদৃশ্য হলো, কেউ বলে, ঝড়ো বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল অন্ধকারে।
তারপর থেকে আর কোনোদিন গ্রামবাসী তাকে খুঁজে পায়নি।
শিক্ষণীয় বার্তা
এই কাহিনি মানুষের মনে অমর শিক্ষা দিয়ে গেছে—
ভালোবাসা আর দয়ার শক্তি কখনো হারায় না, বরং প্রকৃতি তাকে নতুন রূপে ফিরিয়ে আনে।
কিন্তু হিংসা, স্বার্থপরতা আর নিষ্ঠুরতার ফল ভয়ংকর।
লারিনার মতো শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যেতে হয় অন্ধকারে।