Posts

উপন্যাস

শঙ্কর এর নতুন অভিযান: সূর্যশিলার সন্ধানে, ৩য় পর্ব

September 15, 2025

প্রকৌশলী জেড আর চৌধুরী

51
View

অধ্যায় ৪: এক চিলতে রহস্য

ডায়েরিটা পড়া শেষ করে শঙ্কর অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। টেবিল ল্যাম্পের আলোটা তার মুখের ওপর এসে পড়েছে, কিন্তু সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। তার মন তখন ভেসে বেড়াচ্ছে আফ্রিকার বিশাল প্রান্তরে, আলভারেজের স্মৃতির জগতে। বাইরের জগৎটা যেন তার চেতনা থেকে পুরোপুরি মুছে গেছে।

কতক্ষণ এইভাবে কেটেছে কে জানে। একসময় তার জ্ঞান ফিরলো। সে যত্ন করে ডায়েরিটা বন্ধ করলো। পুরনো চামড়ার মলাটটার ওপর আলতো করে হাত বোলালো, যেন সে তার মৃত বন্ধুর সাথে স্পর্শ বিনিময় করছে। ডায়েরিটা সিন্দুকে তুলে রাখবে ভেবে সে যেই উঠতে যাবে, অমনি তার একটা খটকা লাগলো।

ডায়েরির শেষ পাতাটা, যেখানে আলভারেজ অগ্ন্যুৎপাতের কথা লিখেছে, সেটা যেন অন্য পাতাগুলোর থেকে একটু বেশি শক্ত আর মোটা। কৌতূহলী হয়ে শঙ্কর পাতাটা আবার খুললো। টেবিল ল্যাম্পের আলোর কাছে নিয়ে সে ভালো করে দেখতে লাগলো। হ্যাঁ, তার অনুমান মিথ্যে নয়। মলাটের সাথে যে চামড়া দিয়ে পাতাটা আটকানো, সেই চামড়ার ভাঁজের মধ্যে কী একটা যেন রয়েছে। ভাঁজটা এমন নিখুঁতভাবে আটকানো যে সহজে চোখে পড়ে না।

শঙ্করের বুকের ভেতরটা দুরুদুরু করে কেঁপে উঠলো। এ কী! আলভারেজ কি কোনো গোপন বার্তা রেখে গেছে?

সে তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা কাগজ কাটার ছোট ছুরি বের করলো। খুব সাবধানে, যাতে পুরনো পাতাটার কোনো ক্ষতি না হয়, সে চামড়ার ভাঁজটা সাবধানে খুলতে লাগলো। কয়েক মিনিটের চেষ্টায় ভাঁজটা খুলে গেলো। আর তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ভাঁজ করা একটা ছোট, হলদে হয়ে যাওয়া কাগজের টুকরো। কাগজটা এতটাই পুরনো আর ভঙ্গুর যে, সামান্য জোরে চাপ দিলেই গুঁড়ো হয়ে যাওয়ার ভয়।

কাঁপা হাতে শঙ্কর ভাঁজটা খুললো। তাতে পেন্সিল দিয়ে লেখা কয়েকটা লাইন, সেটাও প্রায় মুছে এসেছে। অক্ষরগুলো কাঁপাকাঁপা, অস্পষ্ট— যেন মৃত্যু পথযাত্রী কোনো মানুষ তার শেষ শক্তিটুকু এক করে এই কথাগুলো লিখেছে। লেখাটা পর্তুগীজ ভাষায়। শঙ্কর খুব কষ্টে, প্রত্যেকটা অক্ষরকে আলাদা করে মানে বোঝার চেষ্টা করলো।

শঙ্কর মনে মনে অনুবাদ করলো

"কঙ্গো... ইতুরি বনের উত্তরে... ভিরুঙ্গা পর্বতমালার পিছনে, একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি যাকে স্থানীয়রা 'ফায়ার মাউন্টেন' বলে। তার ভেতরে শুয়ে আছে সূর্যশিলা।"

তার নিচেই আরও কয়েকটা লাইন:

অনুবাদটা দাঁড়ায়: "এটা অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে। কিংবদন্তী বলে, এর আরোগ্য করার ক্ষমতা আছে... জীবনদান করার ক্ষমতা আছে। আমার শেষ স্বপ্ন... আমার শেষ চ্যালেঞ্জ... তোমার জন্য, আমার ছেলে।"

কাগজের টুকরোটা শঙ্করের হাত থেকে খসে টেবিলের ওপর পড়লো। সে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। তার সারা শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে। এ কী পড়েছে সে! কঙ্গোর গভীর জঙ্গলে এক অজানা আগ্নেয়গিরি, আর তার ভেতরে এক রহস্যময় পাথর যা অন্ধকারে আলো দেয় এবং মৃতকে জীবন দিতে পারে!

প্রথমটা তার বিশ্বাস হলো না। মনে হলো, এ নিশ্চয়ই আলভারেজের শেষ সময়ের প্রলাপ। মৃত্যুশয্যায় মানুষ কত কী কল্পনা করে! কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মন বললো, না। আলভারেজকে সে চেনে। লোকটা কল্পনাপ্রবণ হলেও, ভিত্তিহীন কোনো কথায় বিশ্বাস করার মতো ছিলো না। তার প্রত্যেকটা অভিযানের পেছনে থাকতো গভীর গবেষণা আর অকাট্য যুক্তি। সে যদি এই কথা লিখে থাকে, তবে নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো না কোনো সত্যি লুকিয়ে আছে।

'আমার শেষ স্বপ্ন... আমার শেষ চ্যালেঞ্জ...'

কথাগুলো যেন শঙ্করের কানের মধ্যে বাজতে লাগলো। এ তো শুধু একটা তথ্য নয়, এ যে তার প্রতি আলভারেজের শেষ নির্দেশ, শেষ অনুরোধ। চাঁদের পাহাড়ের অভিযান অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছিল। আলভারেজ যা পারেনি, সেই অসমাপ্ত কাজ শেষ করার দায়িত্ব যেন সে শঙ্করের ওপরই দিয়ে গেছে।

শঙ্করের চোখের সামনে থেকে কলকাতার এই নিরাপদ, আরামের জীবনটা এক মুহূর্তে মুছে গেলো। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো কঙ্গোর সেই দুর্ভেদ্য জঙ্গল, Virunga পর্বতমালার উঁচু শিখর আর সেই 'অগ্নি-পর্বত'। তার শিরায় শিরায় আবার সেই পুরনো নেশা জেগে উঠলো। অজানাকে জানার, দুর্গমকে জয় করার সেই তীব্র, অপ্রতিরোধ্য নেশা।

সেই মুহূর্তে শঙ্কর রায় নামের সফল ব্যবসায়ীটির মৃত্যু ঘটলো। জন্ম হলো এক নির্ভীক অভিযাত্রীর, যার একমাত্র লক্ষ্য এখন কঙ্গোর সেই অগ্নি-পর্বত আর তার গভীরে লুকানো সূর্যশিলার রহস্যভেদ করা। আলভারেজের স্বপ্নকে সে নিজের স্বপ্ন করে নিলো। যাত্রাটা যে কতটা কঠিন, কতটা বিপদসঙ্কুল হতে পারে, তা ভেবেও সে একটুও বিচলিত হলো না। বরং এক অদ্ভুত উত্তেজনায় তার পুরো শরীর-মন চঞ্চল হয়ে উঠলো।

 

অধ্যায় ৫: অনুসন্ধানের শুরু

পরদিন সকালে শঙ্কর যখন ঘুম থেকে উঠলো, তখন তার মধ্যে আগের রাতের সেই উত্তেজনা আর নেই। তার বদলে জায়গা নিয়েছে এক গভীর, শান্ত সংকল্প। আলভারেজের সেই ছোট কাগজের টুকরোটা এখন আর তার কাছে শুধু একটা রহস্য নয়, সেটা এখন তার জীবনের ধ্রুবতারা।

পাটকল বা ব্যবসার কথা সে মন থেকে পুরোপুরি মুছে ফেললো। তার জগৎ এখন ওই এক চিলতে কাগজকে ঘিরে ঘুরতে শুরু করেছে। কঙ্গো, অরণ্য, Virunga পর্বতমালা, অগ্নি-পর্বত, সূর্যশিলা— এই কয়েকটা শব্দই এখন তার দিনরাতের ধ্যানজ্ঞান। কিন্তু শুধু মনের জোরে তো আর দুর্গম অভিযানে বের হওয়া যায় না। এর জন্য দরকার তথ্য, দরকার সঠিক পথের নির্দেশ।

সেই দিনই শঙ্কর গেলো চৌরঙ্গীর ওপর রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির বিশাল লাইব্রেরিতে। এই লাইব্রেরিটা তার পরিচিত। আগে চাঁদের পাহাড়ের অভিযানে যাওয়ার আগেও সে এখানে অনেক সময় কাটিয়েছে। এখানকার বয়স্ক লাইব্রেরিয়ান মিস্টার ডসওয়েল তাকে ভালোভাবেই চেনেন। শঙ্করের মুখে আবার আফ্রিকার কথা শুনে তার ঘুমন্ত চোখ দুটো যেন হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠলো।

শঙ্কর সরাসরি সূর্যশিলার কথা বললো না। কিংবদন্তীকে ভরসা করে অভিযানে বের হতে চলেছে, এটা শুনলে লোকে তাকে পাগল মনে করতে পারে। সে শুধু জানালো যে, কঙ্গোর Virunga পর্বতমালা লাগোয়া অঞ্চলের ভূগোল ও ভূতত্ত্ব সম্পর্কে সে কিছু গবেষণা করতে চায়।

মিস্টার ডসওয়েল তাকে লাইব্রেরির এক নির্জন কোণে নিয়ে গেলেন, যেখানে সারিসারি আলমারিতে আফ্রিকা বিষয়ক বই আর ম্যাপ থরে থরে সাজানো। বললেন, "Take your time, Mr. Roy. Africa is not a country, it's a world in itself."

শুরু হলো শঙ্করের অনুসন্ধান। দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগলো। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে সেই লাইব্রেরির ধূসর, শান্ত পরিবেশে নিজেকে ডুবিয়ে দিলো। হেনরি মর্টন স্ট্যানলি থেকে শুরু করে মেরি কিংসলে, রিচার্ড বার্টন— বিখ্যাত সব অভিযাত্রীর ভ্রমণকাহিনী সে এক এক করে পড়ে ফেললো। কঙ্গোর ওপর লেখা যত বই, যত গবেষণা-পত্র পেলো, একটাও বাদ দিলো না।

সে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলো 'অগ্নি-পর্বত' বা 'Mountain of Fire'-এর উল্লেখ। Virunga পর্বতমালা আগ্নেয়গিরি-অধ্যুষিত এলাকা, এটা সে জানতো। মাউন্ট নিরাগঙ্গো, মাউন্ট নিয়ামুরাগিরা— এই সব জীবন্ত আগ্নেয়গিরির কথা বইতে রয়েছে। কিন্তু আলভারেজের বলা সেই ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরিটার কোনো সন্ধান সে পেলো না। স্থানীয় উপকথা বা কিংবদন্তীর ওপর লেখা বইগুলোতেও 'সূর্যশিলা' বা ওই জাতীয় কোনো জিনিসের উল্লেখ কোথাও নেই।

বিষয়টা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছিল। শঙ্কর লাইব্রেরির পুরনো ম্যাপের সংগ্রহশালায় ঢুকলো। আঠারো বা উনিশ শতকের হাতে আঁকা ম্যাপ, আধুনিক জরিপ বিভাগের ছাপানো ম্যাপ— সব সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। Virunga পর্বতমালার উত্তরে, অরণ্যের সীমানায় সে অনেক ছোট-বড় পাহাড়-পর্বতের চিহ্ন দেখলো, কিন্তু কোনোটাকেই আলভারেজের বর্ণনার সাথে মেলাতে পারলো না।

সপ্তাহ কেটে গেলো। শঙ্করের মনের মধ্যে ধীরে ধীরে এক ধরনের হতাশা জমতে শুরু করলো। তবে কি আলভারেজের কথাটি পুরোপুরি কাল্পনিক? কোনো এক নাবিকের কাছে শোনা গল্পকে সে সত্যি বলে বিশ্বাস করেছিল? অথবা হয়তো সেই আগ্নেয়গিরিটা এতটাই দুর্গম আর অখ্যাত যে, সভ্য জগতের কোনো অভিযাত্রীর চোখেই তা আজ পর্যন্ত পড়েনি।

চলবে.......
 


 

Comments

    Please login to post comment. Login