এই দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাই শঙ্করের মনে নতুন করে আশা জাগালো। আফ্রিকা মহাদেশ বিশাল। তার কতটুকুই বা মানুষ জানে! কত রহস্য, কত বিস্ময় যে তার গভীর জঙ্গলে, দুর্গম পাহাড়ে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে আছে, তার কোনো হিসাব নেই। হয়তো আলভারেজই প্রথম ও একমাত্র সভ্য মানুষ যে ওই অগ্নি-পর্বতের সন্ধান পেয়েছিল।
এই বিশ্বাসটুকু মনে আঁকড়ে ধরে সে তার অনুসন্ধান চালিয়ে গেলো। সে এখন আর সরাসরি আগ্নেয়গিরির খোঁজ করছিল না। সে পড়তে শুরু করলো কঙ্গোর বিভিন্ন উপজাতিদের সম্পর্কে, বিশেষ করে ইটোরি অরণ্য ও তার আশেপাশের অঞ্চলের বাসিন্দা পিগমি বা আজান্দে উপজাতিদের লোককথা। তার মনে হলো, যদি এই কিংবদন্তীর কোনো ভিত্তি থাকে, তবে তার সামান্যতম আভাস অন্তত স্থানীয় মানুষদের গল্প-গাথায় পাওয়া যাবে।
এইভাবেই চলতে লাগলো শঙ্করের একার, নীরব সাধনা। বাইরের জগৎ থেকে সে নিজেকে প্রায় আলাদা করে ফেলেছে। ব্যবসা লাটে ওঠার জোগাড়। কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। তাকে এক নেশায় পেয়েছে। এক দুর্ভেদ্য রহস্যের জট সে খুলবেই। যতই সে ব্যর্থ হচ্ছিল, ততই তার জেদ বেড়ে যাচ্ছিল। সে জানতো, এই রহস্যের শেষেই হয়তো অপেক্ষা করছে তার জীবনের সেরা অভিযান।
অধ্যায় ৬: অন্তরের টানাপোড়েন
লাইব্রেরির চার দেওয়ালের মধ্যে দিনের পর দিন কাটলেও শঙ্করের মনের ভেতরে চলছিল একটা নীরব, কিন্তু তীব্র ঝড়। দিনের বেলাটা তার কেটে যায় বইয়ের পাতায়, ম্যাপের আঁকিবুকিতে, কিন্তু রাত নামলেই শুরু হয় তার আসল লড়াই। নিজের সাথে নিজের লড়াই।
বিছানায় শুয়ে যখন সে চোখ বন্ধ করে, তখন তার চোখের সামনে দুটো আলাদা ছবি ভেসে ওঠে। একটা ছবি তার এখনকার জীবনের— এই বিশাল বাড়ি, নরম বিছানা, চাকর-বাকরে ঘেরা আরামের জীবন। যেখানে কোনো অনিশ্চয়তা নেই, খাবারের চিন্তা নেই, প্রাণ হারানোর ভয় নেই। সমাজ তাকে একজন সফল মানুষ বলে মানে, তার কথায় লোকে গুরুত্ব দেয়। এই জীবনটা শান্ত, নিরাপদ, মসৃণ।
আর তার পাশেই ভেসে ওঠে আরেকটা ছবি— আফ্রিকার সেই রুক্ষ, বন্য সৌন্দর্যের ছবি। যেখানে প্রত্যেক পদে বিপদ, প্রত্যেক মুহূর্তে সংগ্রাম। যেখানে সভ্যতার কোনো চিহ্ন নেই, আছে শুধু প্রকৃতির আদিম, অপ্রতিরোধ্য রূপ। সেখানে ম্যালেরিয়ার জ্বর আছে, বিষাক্ত সাপের ভয় আছে, ক্ষুধার কষ্ট আছে, আর আছে প্রত্যেক মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানি। কিন্তু সেই জীবনের মধ্যে কী একটা অদ্ভুত, দুর্নিবার আকর্ষণও রয়েছে! সেই জীবনের প্রত্যেকটা দিন নতুন, প্রত্যেকটা মুহূর্ত উত্তেজনায় ভরা। সেই জীবন মানুষকে শেখায় প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে বাঁচতে, নিজের ভেতরের আদিম শক্তিকে আবিষ্কার করতে।
শঙ্কর এপাশ-ওপাশ করে। কোনটা তার আসল জীবন? এই আরামের, নিশ্চিন্ত জীবন, নাকি সেই বিপদে ভরা, অনিশ্চিত জীবন?
তার বিবেক তাকে প্রশ্ন করে— "শঙ্কর, তোর কিসের অভাব? টাকা, সম্মান, প্রতিপত্তি— সবই তো পেয়েছিস। বয়সও তো কম হলো না। এখন এই সব ছেড়ে কেন আবার সেই মৃত্যুর মুখে ঝাঁপ দিতে যাবি? আলভারেজের স্বপ্ন তো আলভারেজের! তার জন্য তুই কেন নিজের জীবন বিপদে ফেলবি?"
কথাগুলো মিথ্যে নয়। শঙ্কর ভাবে, সত্যিই তো। তার এখন থিতু হওয়ার বয়স। এই ব্যবসা-বাণিজ্য, বিষয়-সম্পত্তি— এগুলো রক্ষা করাও তো একটা দায়িত্ব। সে যদি ফিরে না আসে, তবে এই সবকিছু কে দেখবে? তাছাড়া, চাঁদের পাহাড়ের অভিযান তাকে শুধু সম্পদই দেয়নি, দিয়েছে গভীর মানসিক ও শারীরিক ক্ষত। সেই ভয়ংকর দিনগুলোর স্মৃতি আজও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসে। আবার নিজে থেকে সেই যন্ত্রণার মধ্যে ফিরে যাওয়া কি বুদ্ধির কাজ?
কিন্তু মনের অন্য দিক থেকে আরেকটা স্বর ভেসে আসে। সে স্বর যেন আলভারেজের, সে স্বর যেন আফ্রিকার সেই আদিম আত্মার। সে বলে— "শঙ্কর, তুই কি এই খাঁচার জীবন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবি? তোর রক্তে যে দূরদেশের ডাক, তা কি তুই শুনতে পাস না? টাকা, সম্পদ— এ তো সবই সাময়িক। কিন্তু অজানাকে জানার যে আনন্দ, দুর্গমকে জয় করার যে গৌরব, তার কি কোনো তুলনা হয়?"
এই দ্বিতীয় স্বরটাই যেন বেশি শক্তিশালী। শঙ্কর বুঝতে পারে, সে মনেপ্রাণে একজন অভিযাত্রী। ব্যবসায়ী শঙ্কর রায় তার বাইরের খোলস মাত্র। তার আসল সত্তা বাঁধা পড়ে আছে আফ্রিকার জঙ্গলে, পাহাড়ে, মরুভূমিতে। এই আরামের জীবন, এই সামাজিক প্রতিপত্তি— সবকিছুই তার কাছে অর্থহীন বলে মনে হয়। তার মনে হয়, সে যেন অভিনয় করে চলেছে।
একদিন সন্ধ্যায় সে তার ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। আকাশ পরিষ্কার, তারাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে ভাবছিল তার গ্রামের কথা। তার বাবা-মায়ের কথা। তারা বেঁচে থাকলে কি তাকে এই ভয়ংকর অভিযানে যাওয়ার অনুমতি দিতেন? হয়তো দিতেন না। কিন্তু তার বাবা-ই তো তাকে পৃথিবীর ম্যাপ দেখিয়ে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখাতেন!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শঙ্কর। সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুব কঠিন। একদিকে আছে যুক্তি, নিরাপত্তা আর দায়িত্ববোধ। অন্যদিকে আছে স্বপ্ন, নেশা আর এক মৃত বন্ধুর প্রতি না-বলা প্রতিজ্ঞা। এই দুটোর টানাপোড়েনে তার ভেতরটা ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু সে জানতো, এই দ্বন্দ্ব বেশিদিন চলবে না। কারণ সে এটাও জানতো যে, যুক্তি যতই শক্তিশালী হোক না কেন, স্বপ্নের ডাককে উপেক্ষা করার ক্ষমতা তার নেই। সে জানে, একদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই সে মনস্থির করে ফেলবে। সে জানে, আফ্রিকার সেই দুর্নিবার আকর্ষণই শেষ পর্যন্ত জিতবে। কারণ খাঁচার পাখি যতই আরামে থাকুক, তার মন পড়ে থাকে নীল আকাশে। শঙ্করও সেই নীল আকাশের পাখি, মাটির খাঁচায় তাকে বেশিদিন বেঁধে রাখা যাবে না।
অধ্যায় ৭: যাত্রার সংকল্প
কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল এই মানসিক দোলাচলে। দিনের বেলা লাইব্রেরির পড়াশোনা আর রাতের বেলা নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ— শঙ্করের শরীর-মন দুটোই যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। ব্যবসা শিকেয় উঠেছে, ম্যানেজারের মুখ গম্ভীর, কিন্তু সেসবে শঙ্করের হুঁশ নেই। সে যেন এক ঘোরের মধ্যে বাস করছিল।
সেদিন ছিল আশ্বিন মাসের শেষ দিক। ভোরের দিকে হালকা শীতের আমেজ লাগে। শঙ্কর রোজকার মতোই এক দুঃস্বপ্ন দেখে মাঝরাতে জেগে উঠল। স্বপ্নে সে দেখছে, এক বিশাল আগ্নে-য়গিরির সামনে সে একা দাঁড়িয়ে, আর ভেতর থেকে আলভারেজ ভাঙা গলায় তাকে ডাকছে, "My boy, come… don't be late…"
ঘামে ভেজা শরীরে শঙ্কর বিছানায় উঠে বসল। ঘরের ভেতরটা আবছা অন্ধকার। জানলা দিয়ে ভোরের ধূসর আলো সবেমাত্র ঢুকতে শুরু করেছে। বাইরেটা নিস্তব্ধ, শুধু দূরে কোথাও একটা দুটো কাক কা-কা করে উঠছে।
শঙ্কর আর বিছানায় ফিরে গেল না। সোজা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। ভোরের ঠান্ডা বাতাসটা তার শরীরে লাগতেই ভেতরের সব অস্থিরতা, সব দ্বিধা যেন এক মুহূর্তে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। সে পূর্ব দিকে তাকিয়ে দেখল। আকাশটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। একটু পরেই সূর্য উঠবে।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে, ওই নতুন দিনের আলোর মতোই তার মনের ভেতরটা একদম পরিষ্কার হয়ে গেল।
সে মনে মনে বলল, 'নাঃ, আর নয়। এই দোটানা, এই আরামের জীবন আমার জন্য নয়।'
তার হঠাৎ মনে হল, এই যে এত ঐশ্বর্য, এত সম্মান— এসবের কী দাম আছে যদি সে নিজে ভেতর থেকে খুশিই না থাকে? সে তো রোজ একটু একটু করে মরে যাচ্ছে। তার ভেতরের আসল মানুষটা, সেই অজানার নেশায় পাগল অভিযাত্রীটা তো কবেই মরে ভূত হয়ে গেছে। বেঁচে আছে শুধু এক ব্যবসায়ী শঙ্কর রায়, যার জীবনে কোনও রোমাঞ্চ নেই, কোনও স্বপ্ন নেই।
আলভারেজের মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। সেই বিশ্বাসভরা চোখ, সেই শেষ অনুরোধ— 'আমার শেষ স্বপ্ন… তোমার জন্য, আমার বালক।'
এই কথাটা মনে পড়তেই শঙ্করের বুকের ভেতরটা এক অদ্ভুত আবেগে ভরে গেল। সে ভাবল, আলভারেজ শুধু তাকে হীরের খনির সন্ধান দেয়নি, তাকে একটা নতুন জীবন দিয়েছিল। যে জীবনটা হল ভয়কে জয় করার জীবন, অজানাকে ভালোবাসার জীবন। সেই বন্ধুর শেষ ইচ্ছেটা কি সে পূরণ করবে না?
না, করতেই হবে।
চলবে…