Posts

উপন্যাস

শঙ্কর এর নতুন অভিযান: সূর্যশিলার সন্ধানে, পর্ব ৫

September 17, 2025

প্রকৌশলী জেড আর চৌধুরী

55
View

এই বয়সে, এই আরাম ছেড়ে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপ দেওয়াটা হয়তো চরম বোকামি। লোকে তাকে পাগল বলবে। কিন্তু তাতে কী আসে যায়? নিজের আত্মার ডাককে উপেক্ষা করার মতো বড় বোকামি আর কিছু হতে পারে না।

যে মুহূর্তে সে মনে মনে প্রতিজ্ঞাটা করে ফেলল— 'আমি যাবই'— ঠিক সেই মুহূর্তে এক অবিশ্বাস্য শান্তি তার মনটাকে ভরে দিল। এতদিনের সব দ্বিধা, সব দ্বন্দ্ব, সব যন্ত্রণা যেন এক নিমেষে উধাও হয়ে গেল। তার নিজেকে ভীষণ হালকা লাগল, যেন কাঁধ থেকে ভারী একটা পাথর নেমে গেছে।

সে ভোরের আকাশের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসল। তার মনে হল, এতদিন পর সে আবার ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছে। তার রক্তে যে অজানার নেশা, যে অ্যাডভেঞ্চারের টান, সেটা আবার জেগে উঠেছে।

শঙ্কর আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করল না। সোজা নিজের পড়ার ঘরে গিয়ে একটা কাগজ-কলম নিয়ে বসল। তার ব্যবসার কী হবে, তার বিষয়-সম্পত্তির কী হবে, সবকিছুর একটা ব্যবস্থা তো করে যেতে হবে।

তার মনস্থির। আলভারেজের স্বপ্ন সে পূরণ করবে। কঙ্গোর সেই 'অগ্নি-পর্বত' আর 'সূর্যশিলা'র রহস্য তাকে ভেদ করতেই হবে। কারণ এটাই তার নিয়তি। ব্যবসায়ী শঙ্কর রায়ের খোলস ছেড়ে সে আবার তার আসল পরিচয়ে ফিরে চলেছে। সে আবার হতে চলেছে এক নির্ভীক, অপরাজেয় অভিযাত্রী। এক নতুন, আরও ভয়ঙ্কর চাঁদের পাহাড় তাকে ডাকছে।


অধ্যায় ৮: প্রস্তুতির সূচনা

মনস্থির করে ফেলার পর শঙ্কর আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করল না। তার ভেতরের দ্বিধাগ্রস্ত, চিন্তিত মানুষটা যেন পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছে। তার জায়গায় ফিরে এসেছে সেই পুরনো শঙ্কর— উদ্যমী, কর্মঠ এবং লক্ষ্যে স্থির।

প্রথমেই সে তার ব্যবসার সমস্ত দায়িত্ব ম্যানেজারের হাতে পাকাপাকিভাবে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করল। উইল তৈরি করে তার বিষয়-সম্পত্তি এক অনাথ আশ্রমের নামে লিখে দিল, কেবল যাত্রার খরচের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থটুকু নিজের কাছে রাখল। সে জানত, এই যাত্রা থেকে সে ফিরতেও পারে, আবার না-ও ফিরতে পারে। তাই পেছনের কোনও পিছুটান সে রাখতে চাইল না।

কিন্তু যত সে অভিযানের পরিকল্পনা করতে লাগল, ততই বুঝতে পারল, এবারের লড়াইটা আগেরবারের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। রোডেসিয়ার ভেল্ড বা কালাহারি মরুভূমির বিপদ একরকম, আর কঙ্গোর বর্ষারণ্যের বিপদ আরেকরকম। লাইব্রেরিতে পড়া বইগুলো থেকে সে জেনেছে, কঙ্গোর জঙ্গল আফ্রিকার সবচেয়ে দুর্ভেদ্য অরণ্য। সেখানে সূর্যের আলো মাটিতে পৌঁছায় না, পদে পদে বিষাক্ত সাপ, পোকামাকড় আর অজানা রোগের ভয়। পথঘাট বলতে কিছুই নেই, পুরোটাই নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে।

শঙ্করের বুকের ভেতরটা একবার কেঁপে উঠল। চাঁদের পাহাড়ের অভিযানে আলভারেজ ছিল তার সঙ্গে। আলভারেজের অভিজ্ঞতা, তার জ্ঞান প্রতি পদে তাকে রক্ষা করেছিল। কিন্তু এবার সে একা। এত বড়, এত ভয়ঙ্কর একটা জঙ্গলে একা পাড়ি দেওয়ার কথা ভাবতেই তার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল।

তার বয়স বেড়েছে, আগের মতো শারীরিক শক্তিও হয়তো কিছুটা কমেছে। শুধু সাহস আর মনের জোর দিয়ে সবটা হবে না। তার এমন একজনকে প্রয়োজন, যার আফ্রিকার জঙ্গল সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। শুধু তাই নয়, আলভারেজের ডায়েরিতে সূর্যশিলার যে ঔষধি গুণের কথা লেখা আছে, তার সত্যতা যাচাই করার জন্য একজন বিজ্ঞানী বা ডাক্তার গোছের লোক হলেও খুব ভালো হয়। একজন সঙ্গী থাকলে বিপদে-আপদে ভরসা পাওয়া যায়, কঠিন সময়ে একে অপরের মনের জোর হয়ে ওঠা যায়।

কিন্তু এমন লোক সে পাবে কোথায়? তার পরিচিত মহলে সবাই ব্যবসায়ী বা চাকুরিজীবী। এমন কেউ নেই যে, সব ছেড়েছুড়ে এক অনিশ্চিত, বিপদসংকুল অভিযানে তার সঙ্গী হবে।

অনেক ভেবেচিন্তে শঙ্কর একটা উপায় বের করল। সে ঠিক করল, খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেবে। বিজ্ঞাপনটা কেমন হবে, তা সে নিজেই লিখতে বসল। অনেক কাটাকুটির পর সে যা লিখল, তার সারমর্ম হল:

"দুঃসাহসিক অভিযানে সঙ্গী চাই

মধ্য আফ্রিকার কঙ্গো অঞ্চলের গহিন ও বিপদসংকুল অরণ্যে এক বিশেষ অনুসন্ধানের জন্য একজন অভিজ্ঞ, নির্ভীক ও কষ্টসহিষ্ণু সঙ্গী আবশ্যক। প্রার্থীর বয়স ৩০-এর ঊর্ধ্বে এবং আফ্রিকায় ভ্রমণের পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকা চাই। উদ্ভিদবিদ্যা বা ভূতত্ত্বে জ্ঞান থাকলে অগ্রাধিকার দেওয়া হইবে। মনে রাখিবেন, এই অভিযান অত্যন্ত বিপদসংকুল এবং ইহাতে প্রাণহানির সমূহ সম্ভাবনা রহিয়াছে। কেবল যাঁহারা অজানার আহ্বানে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করিতে প্রস্তুত, তাঁহারাই আবেদন করিবেন। উপযুক্ত ব্যক্তিকে আকর্ষণীয় পুরস্কার দেওয়া হইবে।"

বিজ্ঞাপনের শেষ লাইনটা সে ইচ্ছে করেই একটু লোভনীয় রাখল, যাতে অন্তত কিছু মানুষের নজর কাড়ে। তবে 'প্রাণহানির সমূহ সম্ভাবনা'— এই কথাটাও সে স্পষ্ট করে লিখে দিল। কোনও অনভিজ্ঞ বা অল্পবয়সী ছেলেছোকরা আবেগের বশে এসে বিপদে পড়ুক, তা সে চায়নি।

বিজ্ঞাপনটা কলকাতার সবচেয়ে প্রচারিত ইংরেজি দৈনিকে ছাপতে দিয়ে এসে শঙ্কর কিছুটা নিশ্চিন্ত হল। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। সে জানত, এই অদ্ভুত বিজ্ঞাপনের উত্তরে হয়তো অনেকেই তাকে পাগল ভাববে, অনেকে হাসাহাসি করবে। কিন্তু তার বিশ্বাস ছিল, এই বিশাল শহরের ভিড়ের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন এক-আধজন মানুষ লুকিয়ে আছে, যার রক্তেও তারই মতো অজানার নেশা।

এখন শুধু সেই সঠিক মানুষটিকে খুঁজে বের করার অপেক্ষা। কারণ সে ভালোভাবেই জানত, এই অভিযানে একজন ভুল সঙ্গী পাওয়ার চেয়ে একা যাওয়াও অনেক ভালো। একজন ভুল সঙ্গী গোটা অভিযানটাকেই এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নে পরিণত করতে পারে।


অধ্যায় ৯: সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন

পরের রবিবার শহরের সবচেয়ে নামী ইংরেজি দৈনিকটির ভেতরের পাতায়, অন্য সব গতানুগতিক বিজ্ঞাপনের ভিড়ে শঙ্করের বিজ্ঞাপনটি ছাপা হল। ছোট্ট একটি চৌকো বক্সের মধ্যে কালো কালিতে লেখা কয়েকটি লাইন। কিন্তু তার প্রতিটি শব্দ যেন আর পাঁচটা বিজ্ঞাপনের থেকে নিজেকে আলাদা করে রেখেছিল।

"Wanted: An Adventurous Companion

An experienced, fearless, and resilient companion is sought for a special expedition into the deep and perilous jungles of the Congo region in Central Africa. Candidate must be above thirty years of age with prior travel experience in Africa. Preference will be given to those with knowledge in Botany or Geology. Be warned, this journey is fraught with extreme danger and carries a high probability of fatality. Only those who are willing to risk their lives at the call of the unknown should apply. A handsome reward awaits the suitable person."

শহরের হাজার হাজার মানুষ সেদিন সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজে চোখ বুলিয়েছিল। অনেকেই হয়তো বিজ্ঞাপনটা দেখেও দেখেনি। কেউ হয়তো এক পলক দেখে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে, ভেবেছে— এ নিশ্চয়ই কোনও পাগলের কাণ্ড বা বড়লোকের অদ্ভুত খেয়াল। কেউ হয়তো ভেবেছে, এটা কোনও সিনেমার প্রচারের কৌশল।

কিন্তু বিজ্ঞাপনটা যার বা যাদের জন্য লেখা, তাদের চোখে ঠিকই পড়ল।

বিজ্ঞাপন প্রকাশের পরের দিন থেকেই শঙ্করের বাড়ির ঠিকানায় চিঠি আসতে শুরু করল। প্রথম কয়েকদিন যা চিঠি এল, তা দেখে শঙ্করের মাথায় হাত। বেশিরভাগ চিঠিই এসেছে অল্পবয়সী, রোমাঞ্চপ্রিয় যুবকদের কাছ থেকে। তাদের কারোরই আফ্রিকা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, কেবল অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় তারা জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত। শঙ্কর সবিনয়ে তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে উত্তর দিল। সে জানত, এই ধরনের অনভিজ্ঞ বিপদ বাড়ানো ছাড়া আর কোনও কাজে আসবে না।

কিছু চিঠি এল অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের কাছ থেকে। তারা কষ্টসহিষ্ণু এবং সাহসী বটে, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য মূলত অর্থ। শঙ্করের এমন কাউকে প্রয়োজন ছিল না, যার কাছে অভিযানের মূল লক্ষ্যের চেয়ে পুরস্কারের আকর্ষণ বেশি।
 

Comments

    Please login to post comment. Login