Posts

উপন্যাস

শঙ্কর এর নতুন অভিযান: সূর্যশিলার সন্ধানে, পর্ব ৬

September 18, 2025

প্রকৌশলী জেড আর চৌধুরী

57
View

একদলা চিঠি এল নিছকই ভাগ্যান্বেষীদের কাছ থেকে। তারা ধরে নিয়েছিল, শঙ্কর নিশ্চয়ই কোনও গুপ্তধনের সন্ধানে যাচ্ছে। তাদের চিঠিতে লোভে ভরা জিজ্ঞাসার ছড়াছড়ি— "কী পাওয়া যাবে? কত টাকা মিলবে? ভাগাভাগির শর্ত কী?"— এই ধরনের চিঠি দেখলেই শঙ্কর ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছিল।

শঙ্কর বুঝতে পারছিল, কাজটা সে যতটা সহজ ভেবেছিল, ততটা সহজ নয়। তার এমন একজন সঙ্গী প্রয়োজন, যার মধ্যে সাহস ও অভিজ্ঞতা তো থাকবেই, সেই সাথে থাকবে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা আর অজানাকে জানার বিশুদ্ধ কৌতূহল। আলভারেজের মতো একজন সঙ্গী পাওয়া হয়তো অসম্ভব, কিন্তু তার কাছাকাছি গুণের মানুষও কি এই শহরে একজনও নেই?

ধীরে ধীরে শঙ্করের মনে হতাশা জমতে শুরু করল। রোজ সকালে সে একরাশ আশা নিয়ে ডাকপিয়নের জন্য অপেক্ষা করে, আর দুপুরে একরাশ হতাশামাখা চিঠি পড়ে তার মনটা তেতো হয়ে যায়। সে প্রায় ধরেই নিয়েছিল যে, তাকে হয়তো একাই এই অভিযানে যেতে হবে। একা যাওয়ার বিপদ ও ঝুঁকির কথা ভেবে তার মনটা দমে যাচ্ছিল, কিন্তু সে হাল ছাড়তে রাজি ছিল না।

এইভাবেই প্রায় দুই সপ্তাহ কেটে গেল। রোজকার মতো সেদিনও একগাদা চিঠি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে শঙ্কর প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে। সবকটা চিঠিই প্রায় এক গোত্রের। সে চিঠিগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে যখন উঠতে যাবে, ঠিক তখনই তার চোখ পড়ল একটি খামের ওপর। খামটা অন্যগুলোর মতো নয়। বাদামী রঙের মোটা কাগজের খাম, আর তার ওপরে ঠিকানা লেখা হয়েছে টাইপরাইটারে। হাতের লেখা নয়। এক ধরনের পেশাদারিত্ব ও পরিচ্ছন্নতা আছে এর মধ্যে।

কৌতূহলবশে শঙ্কর খামটা খুলল। ভেতরে ভাঁজ করা একটিমাত্র কাগজ। সেটিও টাইপ করা। চিঠির বয়ান সংক্ষিপ্ত। শঙ্করের বুকের ভেতরটা হঠাৎই এক অজানা আশায় দুলে উঠল।

একদল চিঠি এল নিছকই ভাগ্যান্বেষীদের কাছ থেকে। তারা ধরে নিয়েছিল, শঙ্কর নিশ্চয়ই কোনও গুপ্তধনের সন্ধানে যাচ্ছে। তাদের চিঠিতে লোভে ভরা জিজ্ঞাসার ছড়াছড়ি— "কী পাওয়া যাবে? কত টাকা মিলবে? ভাগাভাগির শর্ত কী?"— এই ধরনের চিঠি দেখলেই শঙ্কর ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছিল।

শঙ্কর বুঝতে পারছিল, কাজটা সে যতটা সহজ ভেবেছিল, ততটা সহজ নয়। তার এমন একজন সঙ্গী প্রয়োজন, যার মধ্যে সাহস ও অভিজ্ঞতা তো থাকবেই, সেই সাথে থাকবে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা আর অজানাকে জানার বিশুদ্ধ কৌতূহল। আলভারেজের মতো একজন সঙ্গী পাওয়া হয়তো অসম্ভব, কিন্তু তার কাছাকাছি গুণের মানুষও কি এই শহরে একজনও নেই?

ধীরে ধীরে শঙ্করের মনে হতাশা জমতে শুরু করল। রোজ সকালে সে একরাশ আশা নিয়ে ডাকপিয়নের জন্য অপেক্ষা করে, আর দুপুরে একরাশ হতাশামাখা চিঠি পড়ে তার মনটা তেতো হয়ে যায়। সে প্রায় ধরেই নিয়েছিল যে, তাকে হয়তো একাই এই অভিযানে যেতে হবে। একা যাওয়ার বিপদ ও ঝুঁকির কথা ভেবে তার মনটা দমে যাচ্ছিল, কিন্তু সে হাল ছাড়তে রাজি ছিল না।

এইভাবেই প্রায় দুই সপ্তাহ কেটে গেল। রোজকার মতো সেদিনও একগাদা চিঠি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে শঙ্কর প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে। সবকটা চিঠিই প্রায় এক গোত্রের। সে চিঠিগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে যখন উঠতে যাবে, ঠিক তখনই তার চোখ পড়ল একটি খামের ওপর। খামটা অন্যগুলোর মতো নয়। বাদামী রঙের মোটা কাগজের খাম, আর তার ওপরে ঠিকানা লেখা হয়েছে টাইপরাইটারে। হাতের লেখা নয়। এক ধরনের পেশাদারিত্ব ও পরিচ্ছন্নতা আছে এর মধ্যে।

কৌতূহলবশে শঙ্কর খামটা খুলল। ভেতরে ভাঁজ করা একটিমাত্র কাগজ। সেটিও টাইপ করা। চিঠির বয়ান সংক্ষিপ্ত। শঙ্করের বুকের ভেতরটা হঠাৎই এক অজানা আশায় দুলে উঠল।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: নতুন সঙ্গী ও যাত্রারম্ভ


অধ্যায় ১: এক বিজ্ঞানীর পত্র

হতাশার শেষ বিন্দুতে পৌঁছে মানুষ যেমন খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়, শঙ্করও ঠিক তেমনভাবেই সেই বাদামী রঙের খামটা তুলে নিল। আর কি-ই বা নতুন থাকবে এর মধ্যে— এই কথা ভাবতে ভাবতেই সে খামের মুখটা ছিঁড়ল।

ভেতর থেকে বের হয়ে এল একটা দুধ-সাদা, বেশ দামি কাগজ। হাতে লেখা নয়, পরিপাটি করে টাইপ করা। শঙ্করের ভ্রু দুটো সামান্য কুঁচকে গেল। এই চিঠিটা যেন অন্যগুলোর থেকে গোড়াতেই আলাদা। সে টেবিল ল্যাম্পের আলোটা আর একটু বাড়িয়ে দিয়ে পড়তে শুরু করল।

মহাশয়,

কলকাতার এক ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত আপনার বিজ্ঞাপনটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে। বিজ্ঞাপনের ভাষা দেখিয়া আমার মনে স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্ন জাগিয়াছে। আপনার এই 'বিশেষ অনুসন্ধান' ব্যাপারটি কি কোনও গুপ্তধন বা হীরার খনির সন্ধানের নামান্তর? যদি তাহাই হইয়া থাকে, তবে গোড়াতেই জানাইয়া রাখি, ওই জাতীয় অর্থলোলুপ কার্যকলাপে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই এবং আমার সময় নষ্ট করিবার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

চিঠির প্রথম অংশটা পড়েই শঙ্করের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। আরও একজন উপদেশ দিতে এসেছে! কিন্তু পরের অংশটুকু পড়তেই তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

কিন্তু, যদি আপনার বিজ্ঞাপনের মধ্যে কোনও ফাঁকি না থাকে, এবং আপনি সত্যিই প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের কোনও অজানা রহস্যের সন্ধানে যাইতেছেন, তবে আমার কথা ভিন্ন। বিজ্ঞাপনে উল্লিখিত 'কঙ্গোর গহিন অরণ্য', বিশেষত ইটোরি অরণ্য ও তৎসংলগ্ন Virunga অঞ্চলের কথা আমাকে বিশেষভাবে আগ্রহী করিয়াছে। উদ্ভিদবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসাবে আমি জানি, ওই অঞ্চলটি পৃথিবীর অন্যতম দুর্গম এবং অনাবিষ্কৃত এলাকা। সেখানকার উদ্ভিদ জগৎ সম্পর্কে সভ্য জগতের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওই অঞ্চলের আগ্নেয়গিরি-সংলগ্ন ভূমিতে এমন অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ আজও লোকচক্ষুর অন্তরালে রহিয়া গিয়াছে, যাহা বিজ্ঞানের দরবারে এক নতুন দিগন্ত খুলিয়া দিতে পারে। ওইরূপ একটি অভিযানে সামিল হওয়া আমার জীবনের অন্যতম স্বপ্ন।

অতএব, যদি আপনার উদ্দেশ্য মহৎ হয় এবং প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের প্রতি আপনার সামান্যতম শ্রদ্ধা থাকে, তবে আমি আপনার সহিত একবার সাক্ষাৎ করিতে ইচ্ছুক। আপনার আসল উদ্দেশ্য জানিবার পরই আমি আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাইব।

বিনীত,
ডঃ সোমনাথ সেনগুপ্ত
উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ,
প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা।

চিঠিটা পড়া শেষ করে শঙ্কর স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তার মনে হল, যেন কেউ তার শরীরে একটা বৈদ্যুতিক শক দিয়েছে। সে আবার চিঠিটা পড়ল, তারপর আবার।

ডঃ সোমনাথ সেনগুপ্ত! নামটা তার পরিচিত। উদ্ভিদবিদ্যা জগতে অত্যন্ত সম্মানজনক একটি নাম। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দুর্লভ অর্কিড ও ঔষধি গাছপালা নিয়ে লেখা তাঁর প্রবন্ধ শঙ্কর আগেও পড়েছে। এ তো যে সে লোক নয়! এ একজন সত্যিকারের জ্ঞানী ও গুণী মানুষ।

শঙ্করের মনটা এক মুহূর্তে পাল্টে গেল। এতদিন ধরে যে হতাশার কালো মেঘ তার মনকে ঢেকে রেখেছিল, তা যেন এক ঝটকায় সরে গিয়ে এক বিরাট আশার সূর্যোদয় হল। এই তো! ঠিক এইরকম একজন মানুষকেই তো সে মনে মনে খুঁজছিল!

এই চিঠিতে কোনও লোভ নেই, কোনও ফাঁপা বীরত্ব দেখানোর চেষ্টা নেই। আছে কেবল জ্ঞানের প্রতি বিশুদ্ধ কৌতূহল আর অজানাকে জানার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ডঃ সেনগুপ্তের সন্দেহ প্রকাশ করাটাও শঙ্করের খুব ভালো লাগল। এটা প্রমাণ করে যে, তিনি হুট করে কোনও সিদ্ধান্ত নেন না, যথেষ্ট বিচার-বিবেচনা করে চলেন।

শঙ্করের মনে হল, আলভারেজের মধ্যে সাহস, অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান— এই তিনটে গুণের এক অপূর্ব সমন্বয় ছিল। এতদিন সে কেবল সাহসী বা অভিজ্ঞ সঙ্গী খুঁজছিল। কিন্তু এই চিঠির মধ্যে সে যেন আলভারেজের জ্ঞানের দিকটার একটা প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেল।

তার সব হতাশা, সব ক্লান্তি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেল। সে আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। একটা নতুন কাগজ আর কলম টেনে নিয়ে তখুনি ডঃ সোমনাথ সেনগুপ্তের চিঠির উত্তর লিখতে বসল। তার মন বলছিল, এইবার হয়তো তার অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে। সূর্যশিলা অভিযানের প্রথম দরজাটা হয়তো খুলতে চলেছে।

অধ্যায় ২: প্রথম সাক্ষাৎ

নির্দিষ্ট দিনে, ঠিক বিকেল চারটের সময় শঙ্করের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল। শঙ্করের বুকের ভেতরটা এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল। সে নিজে গিয়েই দরজাটা খুলল।

বাইরে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁকে দেখেই শঙ্কর বুঝে গেল, ইনিই ডঃ সোমনাথ সেনগুপ্ত। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। রোগা, লম্বা, ঋজু চেহারা। পরনে একটি সাদামাটা ধুতি আর খদ্দরের পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলানো একটি চামড়ার ব্যাগ। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, কিন্তু কপালটা অস্বাভাবিক চওড়া। চোখে মোটা কাঁচের গোল ফ্রেমের চশমা। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে শঙ্করের দৃষ্টি আকর্ষণ করল ভদ্রলোকের চোখ দুটো। চশমার কাঁচের পেছনে সেই চোখদুটি ছিল ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ আর স্থির। মনে হয়, যেন তিনি কেবল বাইরের জিনিসটা দেখেন না, এক নিমেষে তার ভেতরটা পর্যন্ত পড়ে ফেলতে পারেন।

শঙ্কর নমস্কার করে বলল, "আসুন, আমি আপনারই অপেক্ষা করছিলাম।"

ভদ্রলোক প্রতিনমস্কার করে ভেতরে ঢুকলেন। তাঁর হাঁটাচলার মধ্যে কোনও জড়তা নেই, প্রতিটি পদক্ষেপ অত্যন্ত মাপা। তিনি শঙ্করের বসার ঘরের আসবাবপত্রের দিকে একবারও তাকালেন না। তাঁর চোখ দুটো যেন চারপাশের পরিবেশটাকে নীরবে স্ক্যান করে নিচ্ছিল।

শঙ্কর তাঁকে তার পড়ার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। এই ঘরটাই তার সবচেয়ে প্রিয়। দেওয়ালে আফ্রিকার বিশাল মানচিত্র, আলমারিতে সারি সারি চামড়া বাঁধানো বই, আর এক কোণে রাখা তার পুরনো কিছু সরঞ্জাম।

ডঃ সেনগুপ্ত ঘরে ঢুকেই দেওয়ালে টাঙানো মানচিত্রটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কয়েক মুহূর্ত সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় বললেন, "কঙ্গোর এই মানচিত্রটা বেশ পুরনো। অনেক জায়গার নামই এখন বদলে গেছে।"


চলবে.....

Comments

    Please login to post comment. Login

  • Chameli Akter 2 months ago

    শঙ্কর নমস্কার করে বলল, "আসুন, আমি আপনারই অপেক্ষা করছিলাম।"