Posts

উপন্যাস

শঙ্কর এর নতুন অভিযান: সূর্যশিলার সন্ধানে, পর্ব ৭

September 18, 2025

প্রকৌশলী জেড আর চৌধুরী

59
View

তাঁর গলার স্বরটাও অদ্ভুত। শান্ত, গভীর, কিন্তু তার মধ্যে এমন একটা দৃঢ়তা আছে, যা উপেক্ষা করা কঠিন। শঙ্কর সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে বলল, "আজ্ঞে হ্যাঁ। ওটা আমার এক বন্ধুর দেওয়া।"

ডঃ সেনগুপ্ত একটা চেয়ারে বসলেন। শঙ্কর তাঁর জন্য চা বা সরবতের কথা জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ভদ্রলোকের চোখের ইশারায় সে থেমে গেল। মনে হল, তিনি এইসব লৌকিকতার ধার ধারেন না। তিনি সরাসরি কাজের কথায় আসতে চান।

কিছুক্ষণ এক গম্ভীর নীরবতা বিরাজ করল। নীরবতা ভাঙলেন ডঃ সেনগুপ্ত নিজেই। আপনার বিজ্ঞাপনটা আমি দেখেছি, মিঃ রায়। এবং আপনার চিঠিও পেয়েছি। এবার বলুন, আপনার আসল উদ্দেশ্যটা কী? এই 'বিশেষ অনুসন্ধান' বলতে আপনি ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন?

শঙ্কর বুঝতে পারছিল, এই মানুষটির কাছে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলে কোনও লাভ হবে না। সে ঠিক করল, যা বলার সোজাসুজিই বলবে। সে তার চাঁদের পাহাড় অভিযানের কথা সংক্ষেপে বলল। ডিয়েগো আলভারেজের কথা, রিখটারসভেল্ড পর্বতমালার কথা, সেই হীরার খনির কথা— কিছুই বাদ দিল না।

ডঃ সেনগুপ্ত পাথরের মূর্তির মতো নিঃশব্দে সবটা শুনলেন। তাঁর মুখে কোনওরকম বিস্ময় বা অবিশ্বাসের চিহ্ন ফুটে উঠল না। তাঁর স্থির দৃষ্টি শঙ্করের চোখের ওপর নিবন্ধ। শঙ্করের মনে হচ্ছিল, ভদ্রলোক তার কাহিনী শুনছেন না, বরং তার সততাটা মাপার চেষ্টা করছেন।

সবশেষে, শঙ্কর পকেট থেকে আলভারেজের ডায়েরি এবং সেই হলদে হয়ে যাওয়া কাগজের টুকরোটা বের করে ডঃ সেনগুপ্তের হাতে দিল। বলল, এই দেখুন। আমার এই নতুন অভিযানের একমাত্র ভিত্তি হল এই লেখাটা।

ডঃ সেনগুপ্ত কাগজটা হাতে নিয়ে মন দিয়ে পড়লেন। তারপর ডায়েরিটার পাতা উল্টে আলভারেজের শেষ লেখাগুলো দেখলেন। তাঁর কপালে কয়েকটা গভীর ভাঁজ পড়ল।

সব দেখা শেষ হলে তিনি কাগজটা আর ডায়েরিটা শঙ্করকে ফিরিয়ে দিলেন। তারপর একটা লম্বা শ্বাস ফেলে শান্ত, কিন্তু বরফশীতল গলায় বললেন, মিঃ রায়, আপনার পূর্বের অভিজ্ঞতা প্রশংসার যোগ্য। আপনার সাহসকেও আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আপনি এখন যা করতে চলেছেন, তা হল এক অলীক স্বপ্নের পেছনে ছোটা।

শঙ্কর চমকে উঠে বলল, তার মানে?

ডঃ সেনগুপ্ত চশমাটা খুলে পরিষ্কার করতে করতে বললেন, তার মানে হল, এই সূর্যশিলা বা 'Sunstone' জাতীয় বস্তুর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। অন্ধকারে আলো দেওয়া পাথর হয়, যেমন ফসফরাস। কিন্তু জীবনদানকারী বা আরোগ্যকারী পাথর— এ নিছকই এক পৌরাণিক কল্পনা। অনেকটা এলডোরাডোর সোনার শহর বা অমরত্ব দানকারী ঝর্ণার মতো। আপনার বন্ধু আলভারেজ হয়তো মৃত্যুশয্যায় কোনও স্থানীয় উপকথা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এর ওপর ভিত্তি করে একটা আস্ত অভিযান পরিকল্পনা করাটা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

তিনি থামলেন। তারপর শঙ্করের দিকে সরাসরি তাকিয়ে তাঁর শেষ কথাটা বললেন, আমি দুঃখিত, মিঃ রায়। আপনার এই অবাস্তব কল্পনার সঙ্গী আমি হতে পারব না।


অধ্যায় ৩: আলভারেজের ডায়েরি ও মানচিত্র

ডঃ সেনগুপ্তের শেষ কথাটা যেন একটা চাবুকের মতো শঙ্করের কানে এসে বাজল। আপনার এই অবাস্তব কল্পনার সঙ্গী আমি হতে পারব না।"

ঘরের ভেতরটা হঠাৎ যেন বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল। শঙ্করের মনে হল, শেষ আশার প্রদীপটাও যেন দপ্ করে নিভে গেল। সে হতাশায় প্রায় ভেঙে পড়তে যাচ্ছিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, তার মনের গভীরে কোথাও একটা জেদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। না, এত সহজে সে হার মানতে পারে না। আলভারেজকে সে চেনে। আলভারেজ পাগল ছিল না, স্বপ্নবিলাসীও ছিল না। তার প্রতিটি কথার পেছনে কোনও না কোনও যুক্তি থাকত।

শঙ্কর আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। সে জানত, বিজ্ঞানের মানুষকে বিজ্ঞানের ভাষাতেই বোঝাতে হবে। আবেগ বা বীরত্বের গল্প শুনিয়ে কোনও লাভ হবে না। তাকে এমন কিছু দেখাতে হবে, যা ডঃ সেনগুপ্তের বিজ্ঞানীর মনকে নাড়া দিতে পারে।

সে প্রায় মরিয়া হয়ে তার তুরুপের তাসটি বের করল।

ডক্টর সেনগুপ্ত, দয়া করে আর পাঁচটা মিনিট আমাকে সময় দিন, শঙ্কর শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল। আপনি যাওয়ার আগে আমি আপনাকে আর একটা জিনিস দেখাতে চাই।

ডঃ সেনগুপ্তের মুখে তখনো অবিশ্বাসের ছাপ। তিনি যেন উঠবেন কি উঠবেন না, এমন একটা দোটানায় ভুগছেন। শঙ্কর সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে আলভারেজের সেই চামড়া বাঁধানো ডায়েরিটা আবার তুলে নিল।

আপনি হয়তো ভাবছেন, আলভারেজ কোনও অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোক ছিল, শঙ্কর ডায়েরিটা খুলতে খুলতে বলল। কিন্তু সত্যিটা হল, সে ছিল একজন অসাধারণ প্রকৃতিবিজ্ঞানী ও পর্যবেক্ষক। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হয়তো ছিল না, কিন্তু আফ্রিকার ভূগোল, ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদ আর প্রাণীজগৎ সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল অনেক বড় বড় পণ্ডিতের থেকেও বেশি। সে শুধু কিংবদন্তীর পেছনে ছোটেনি, সে নিজের চোখ দিয়ে যা দেখত, তা নিখুঁতভাবে তার ডায়েরিতে লিখে রাখত।

শঙ্কর ডায়েরির মাঝখানের কয়েকটা পাতা খুলে ডঃ সেনগুপ্তের দিকে এগিয়ে দিল। এই পাতাগুলো একবার দেখুন।

ডঃ সেনগুপ্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডায়েরিটা হাতে নিলেন। পাতাগুলোতে আলভারেজ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের উদ্ভিদের ছবি এঁকেছে। ছবির পাশে সেই উদ্ভিদের স্থানীয় নাম, তার বৈজ্ঞানিক বর্ণনা এবং ঔষধি গুণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লেখা। ছবির আঁকাগুলো কোনও পেশাদার শিল্পীর মতো নয়, কিন্তু এতটাই নিখুঁত যে, গাছগুলোকে সহজেই চেনা যায়।

ডঃ সেনগুপ্তের চশমার পেছনের চোখ দুটো হঠাৎই যেন একটু সজাগ হয়ে উঠল। তিনি একটি ছবির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, আশ্চর্য! এ তো Strophanthus gratus! এর বীজের রস থেকে আদিবাসীরা মারাত্মক বিষ তৈরি করে। কিন্তু এর সঠিক ব্যবহার যে হৃদরোগের চিকিৎসায় কাজে লাগতে পারে, এই তথ্য তো মাত্র কয়েক বছর আগে জার্মান বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন। আপনার বন্ধু এত আগে এই কথা জানল কী করে?

শঙ্কর মৃদু হেসে বলল, কারণ সে বই পড়ে শেখেনি, ডক্টর সেনগুপ্ত। সে শিখেছিল আফ্রিকার জঙ্গল আর তার মানুষদের কাছ থেকে।

ডঃ সেনগুপ্তের মুখের কাঠিন্যটা এবার একটু একটু করে নরম হতে শুরু করেছে। তিনি পাতা উল্টে যাচ্ছেন আর মাঝে মাঝেই বিস্ময়ে বিড়বিড় করছেন। ডায়েরিতে এমন সব দুর্লভ অর্কিড আর ফার্নের বর্ণনা ছিল, যা আধুনিক উদ্ভিদবিজ্ঞানের কাছেও প্রায় অজানা।

ঠিক এই সুযোগটাই নিল শঙ্কর। সে সেই হলদে হয়ে যাওয়া কাগজের টুকরোটা আবার হাতে নিল। তবে এবার সে কিংবদন্তীর গল্পটার দিকে নজর দিল না। সে কাগজের উল্টো পিঠটা ডঃ সেনগুপ্তের সামনে মেলে ধরল।

এই দিকটা দেখুন, শঙ্কর বলল।

কাগজের উল্টো পিঠে পেন্সিল দিয়ে খুব হালকা করে একটা মানচিত্র আঁকা। কয়েকটা রেখা দিয়ে পর্বতমালার আভাস দেওয়া, একটা নদীর গতিপথ দেখানো আর তার মাঝখানে একটা ক্রস চিহ্ন। আর তার পাশে লেখা কয়েকটা দুর্বোধ্য সংখ্যা আর সংকেত।

শঙ্কর বলল, আলভারেজ লিখেছে, 'অগ্নি-পর্বত'। আপনি কিংবদন্তীটা অবিশ্বাস করতেই পারেন, কিন্তু এই ভৌগোলিক ইঙ্গিতগুলো দেখুন। এগুলো তো আর কল্পনা নয়। এই যে দ্রাঘিমাংশ আর অক্ষাংশের একটা আভাস দেওয়া আছে, এটা তো কোনও একটা বাস্তব জায়গাকেই নির্দেশ করছে, তাই না?

ডঃ সেনগুপ্ত প্রায় ছিনিয়ে নেওয়ার মতো করে কাগজটা নিলেন। তিনি ঝুঁকে পড়ে মানচিত্রটা দেখতে লাগলেন। তার বিজ্ঞানীর চোখ তখন জেগে উঠেছে। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, "Virunga পর্বতমালার উত্তরে... ইটোরি অরণ্যের সীমানায়... এই অক্ষাংশ অনুযায়ী জায়গাটা... হ্যাঁ, এখানে একটা মানচিত্রবিহীন আগ্নেয়গিরি থাকার কথা... কিন্তু...

তাঁর চোখ আটকে গেল সূর্যশিলার বিবরণের একটি লাইনে— 'এটি অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে।


তিনি আপনমনেই বলে উঠলেন, Bioluminescence... না, সেটা তো জৈব পদার্থে হয়। তাহলে কি এটা Triboluminescence? ঘর্ষণের ফলে আলো? নাকি... Radioactivity? যদি পাথরটার মধ্যে পিচব্লেন্ড বা ইউরেনিয়ামের মতো কোনও খনিজ থাকে... তাহলে তো তেজস্ক্রিয়তার কারণে আভা দেখা যেতেই পারে! আর যদি তাই হয়... তাহলে তার ঔষধি গুণ থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়... রেডিয়াম থেরাপির কথাই তো আমরা জানি...

চলবে.....

Comments

    Please login to post comment. Login