কথাগুলো বলতে বলতে ডঃ সোমনাথ সেনগুপ্তের চোখ দুটো এক অদ্ভুত আলোয় চকচক করে উঠল। কিংবদন্তীর অবাস্তব খোলসটা ভেদ করে তার ভেতরের সম্ভাব্য বৈজ্ঞানিক সত্যটা যেন তাঁর সামনে উন্মোচিত হয়ে গেছে। তাঁর মুখের অবিশ্বাস আর সন্দেহের ভাবটা কেটে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠেছে এক তীব্র, দুর্নিবার কৌতূহল।
তিনি মুখ তুলে শঙ্করের দিকে তাকালেন। তাঁর সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এখন আরও উজ্জ্বল। তিনি আর একবারও 'অবাস্তব কল্পনা' বা 'পাগলামি'র কথা উচ্চারণ করলেন না। পরিবর্তে, তাঁর গলা থেকে বেরিয়ে এল মাত্র দুটি শব্দ, যা শোনার জন্য শঙ্কর এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল।
কবে বেরোচ্ছেন?
অধ্যায় ৪: শর্তসাপেক্ষে সম্মতি
ডঃ সেনগুপ্তের মুখ থেকে এই দুটো শব্দ শোনার পর শঙ্করের মনে হল, যেন সে এক মুহূর্তের জন্য শ্বাস নিতে ভুলে গেছে। যে মানুষটি কিছুক্ষণ আগেও পুরো বিষয়টাকে 'অবাস্তব কল্পনা' বলে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, তাঁর মুখে এই প্রশ্নটা শুনে শঙ্কর প্রথমে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারল না। তার সমস্ত ক্লান্তি, সমস্ত হতাশা যেন এক নিমেষে দূর হয়ে গেল।
সে সামলে নিয়ে বলল, আমি তো কালই বেরোতে প্রস্তুত। কিন্তু আপনার...?
ডঃ সেনগুপ্ত হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন। তাঁর মুখে আবার সেই আগের রাশভারী ভাবটা ফিরে এসেছে, কিন্তু চোখের কোণে কৌতূহলের ঝিলিকটা এখনো নেভেনি। তিনি বললেন, এত তাড়া দিলে চলবে না, মিঃ রায়। আপনি আবেগের বশে চলেন, কিন্তু আমি চলি যুক্তি আর পরিকল্পনা দিয়ে। আমি এই অভিযানে যাব, কিন্তু আমার কয়েকটি শর্ত আছে।
শঙ্কর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলল, বলুন, আপনার সব শর্ত আমি মানতে রাজি।
ডঃ সেনগুপ্ত তাঁর কাঁধের ঝোলা থেকে একটা নোটবুক আর পেন বের করলেন। যেন তিনি কোনও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার পরিকল্পনা করছেন। তিনি বললেন, প্রথমত, এই অভিযানের নামকরণ হবে 'কঙ্গো বোটানিক্যাল অ্যান্ড জিওলজিক্যাল সার্ভে এক্সপিডিশন'। বাইরে লোকে এটাই জানবে। 'সূর্যশিলা' বা অন্য কোনও কিংবদন্তীর কথা তৃতীয় কোনও ব্যক্তি জানতে পারবে না। এতে অযথা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হতে পারে এবং অন্য ভাগ্যান্বেষীরা আমাদের পিছু নিতে পারে।
শঙ্কর মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। শর্তটা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত।
দ্বিতীয়ত, ডঃ সেনগুপ্ত বলে চললেন, অভিযানের নেতৃত্ব দেবেন আপনি। পথঘাট, রসদ, আত্মরক্ষা— এই সবকিছুর দায়িত্ব আপনার। কারণ এ বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু, অভিযানের সমস্ত বৈজ্ঞানিক দিক— যেমন নমুনা সংগ্রহ, ভূতাত্ত্বিক পরীক্ষা, কিংবদন্তীর সত্যতা যাচাই— এই সবকিছুর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমি নেব। আমার কাজে আপনি কোনও বাধা দিতে পারবেন না।
শঙ্কর বলল, অবশ্যই। আমি তো ঠিক এইরকমই একজনকে খুঁজছিলাম।
তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত, ডঃ সেনগুপ্ত শঙ্করের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, আমাদের সঙ্গে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম নিতে হবে। একটি পোর্টেবল মাইক্রোস্কোপ, উদ্ভিদ ও শিলা সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক, একটি গাইগার কাউন্টার (তেজস্ক্রিয়তা মাপার যন্ত্র), উন্নত মানের কম্পাস, সেক্সট্যান্ট, ব্যারোমিটার— এই সবকিছু আমাদের সঙ্গে যাবে। এর খরচের ভার আপনাকে নিতে হবে।
তিনি একটু থেমে যোগ করলেন, আর যদি আমরা সত্যিই ওই 'সূর্যশিলা'র সন্ধান পাই, তবে তার একটি বড় অংশ গবেষণার জন্য কলকাতায় নিয়ে আসা হবে। ওটা আপনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে বিবেচিত হবে না, হবে বিজ্ঞানের সম্পত্তি।
শঙ্করের মনটা এক অনাবিল আনন্দে ভরে গেল। এই তো সে চায়! আলভারেজের রেখে যাওয়া রহস্যের যদি কোনও বৈজ্ঞানিক সমাধান হয়, তার চেয়ে বড় কথা আর কী হতে পারে? সে সানন্দে বলল, আমি আপনার সব শর্তে রাজি, ডক্টর সেনগুপ্ত। খরচের চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। আপনি শুধু কী কী লাগবে, তার একটা তালিকা আমাকে দিন।
ডঃ সেনগুপ্ত সন্তুষ্টির ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। তাঁর মুখের কাঠিন্যটা পুরোপুরি কেটে গিয়ে সেখানে এক চিলতে হাসির আভাস দেখা গেল। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে শঙ্করের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন।
শঙ্কর শক্ত করে তাঁর হাতটা ধরল। দুটি ভিন্ন প্রকৃতির, ভিন্ন বয়সের, ভিন্ন জগতের মানুষের হাত এক হয়ে গেল। একজনের আছে দুর্গমকে জয় করার অদম্য সাহস আর অভিজ্ঞতা, অন্যজনের আছে প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করার তীব্র জ্ঞানতৃষ্ণা আর বৈজ্ঞানিক দূরদৃষ্টি।
সেই মুহূর্তে শঙ্কর বুঝতে পারল, সে শুধু একজন সঙ্গী পায়নি, সে একজন অভিভাবক, একজন শিক্ষক এবং একজন বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছে। আলভারেজের পর আবার সে এমন একজনকে পেল, যার ওপর চোখ বুজে ভরসা করা যায়।
এক নতুন বন্ধুত্ব আর নির্ভরতার সম্পর্ক সেই শ্রাবণের বিকেলে নীরবে গড়ে উঠল। এক অসমাপ্ত স্বপ্নের পেছনে ধাওয়া করার জন্য দুই অসমবয়সী অভিযাত্রীর পথচলা সেদিনই শুরু হয়ে গেল।
অধ্যায় ৫: সাজো সাজো রব
ডঃ সেনগুপ্তের সম্মতির পরদিন থেকেই শঙ্করের বিশাল বাড়িটাতে এক অদ্ভুত কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়ে গেলো। এতদিন ধরে বাড়িটা যেন এক ধরনের ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল, এখন হঠাৎ সেটা জেগে উঠলো। শঙ্করের অলস, অবসন্ন ভাবটা কেটে গিয়ে তার মধ্যে এক নতুন উদ্যম আর শক্তির সঞ্চার হয়েছে। তার হাঁটাচলা, কথাবার্তা— সবকিছুতেই এখন ব্যস্ততা আর উত্তেজনার ছাপ।
শুরু হলো এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। শঙ্কর তার পড়ার ঘরটাকে অভিযানের সদর দপ্তর বানিয়ে ফেলেছে। ঘরের মাঝখানে একটা বিশাল টেবিলের ওপর কঙ্গোর ম্যাপ পাতা, তার ওপর দুই অসমবয়সী অভিযাত্রী ঝুঁকে পড়ে যাত্রাপথ ঠিক করছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তাদের আলোচনা চলে। কোন পথে গেলে সুবিধা, কোথায় নদী পড়বে, কোন অঞ্চলে কোন উপজাতির বাস— সবকিছুই তারা চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে লাগলো।
অভিযানের সরঞ্জাম জোগাড় করাই ছিল সবচেয়ে বড় কাজ। শঙ্কর তার পুরনো অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এক লম্বা তালিকা বানালো। প্রথমেই আসলো অস্ত্রের কথা। কঙ্গোর জঙ্গলে আত্মরক্ষার জন্য ভালো অস্ত্রের বিকল্প নেই। শঙ্কর নিজে গিয়ে আর্মেনিয়ান স্ট্রিটের এক পুরনো দোকান থেকে একটা ভারী .৪৫০ ডাবল ব্যারেল রাইফেল আর একটা হালকা ওজনের দোনালা শটগান কিনলো। সঙ্গে প্রচুর কার্তুজ— রাইফেলের জন্য সলিড বুলেট আর শটগানের জন্য এল.জি. (লার্জ গেম) ও এস.এস.জি. (স্মল শট) কার্তুজ।
তারপর আসলো অন্যান্য জিনিসপত্রের পালা। মজবুত ক্যানভাসের দুটো ওয়াটারপ্রুফ তাঁবু, দুটো স্লিপিং ব্যাগ, শক্তিশালী টর্চলাইট, শিকারের জন্য ভালো ছুরি, কয়েকশো ফুট ম্যানিলা রোপ বা দড়ি, একটা ছোট কুঠার, রান্নার জন্য অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র, দেশলাই, মোমবাতি, মশা তাড়ানোর জন্য সিট্রোনেলা তেল— তালিকাটা যেন আর শেষই হয় না।
ডাক্তারি সরঞ্জামের ওপর শঙ্কর বিশেষ জোর দিলো। কুইনাইন ট্যাবলেট, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, কার্বলিক অ্যাসিড, ব্যান্ডেজ, তুলো, টিংচার আয়োডিন, সাপে কাটার জন্য অ্যান্টি-ভেনম সিরাম— কিছুই বাদ গেলো না।
খাবারের ব্যবস্থাও বড় কম ঝামেলার ছিল না। টিনভর্তি বিস্কুট, ঘনীভূত দুধ, কফি, চিনি, নুন, শুকনো মাংস আর মাছ— সবকিছু এমনভাবে প্যাক করা হতে লাগলো, যাতে কম জায়গায় বেশি জিনিস ধরে এবং অনেকদিন পর্যন্ত ভালো থাকে।
শঙ্কর যখন এইসব জোগাড়যন্ত্রে ব্যস্ত, তখন ডঃ সেনগুপ্তও চুপ করে বসে ছিলেন না। তিনি প্রায় প্রতিদিনই কলেজ থেকে সোজা শঙ্করের বাড়িতে চলে আসতেন এবং তার নিজস্ব তালিকা অনুযায়ী জিনিসপত্র কেনাকাটা করতেন। তার জিনিসপত্রগুলো ছিল অবশ্য একদম অন্য ধরনের।
তিনি আনলেন উদ্ভিদ ও শিলাচাপা দেওয়ার জন্য মজবুত প্রেস, নমুনা সংগ্রহের জন্য শত শত কাঁচের টেস্ট টিউব ও শিশি, পোকামাকড় ধরার জন্য নেট বা জাল, মাটি পরীক্ষার জন্য যন্ত্রপাতি। তার সবচেয়ে মূল্যবান সরঞ্জাম ছিল একটা জার্মানির পোর্টেবল মাইক্রোস্কোপ, একটা অত্যন্ত সংবেদনশীল ব্যারোমিটার ও একটা গাইগার কাউন্টার। এই গাইগার কাউন্টার যন্ত্রটা দেখে শঙ্কর তো অবাক! তেজস্ক্রিয়তা মাপার যন্ত্র নিয়ে তারা জঙ্গলে কী করবে!
চলবে......