ডঃ সেনগুপ্ত হালকা হেসে বললেন, বলা তো যায় না, মিঃ রায়! আপনার ওই 'সূর্যশিলা' যদি সত্যিই তেজস্ক্রিয় হয়, তবে এই যন্ত্রই আমাদের আগে থেকে সাবধান করে দেবে।
সব জিনিসপত্র কেনা হওয়ার পর শুরু হলো সেগুলোকে গোছগাছ করার পালা। এমনভাবে জিনিসগুলোকে বিভিন্ন ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগে ভরা হতে লাগলো, যাতে দরকারের সময় সহজেই বের করা যায় এবং মালবাহকদের বইতেও সুবিধা হয়।
পুরো বাড়িটাতে যেন একটা সাজো সাজো রব পড়ে গেছে। শঙ্করের চাকর রতন তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না, তার বাবু আবার কেন এইসব পাগলামি শুরু করলো। সে শুধু অবাক চোখে দেখতো, আর বাবুর নির্দেশ মতো একটার পর একটা কাজ করে যেত।
প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে এই বিশাল প্রস্তুতি পর্ব চললো। শেষে একদিন সন্ধ্যায় সব গোছগাছ শেষ হলে শঙ্কর আর ডঃ সেনগুপ্ত তাদের পড়ার ঘরে এসে বসলেন। ঘরের মাঝখানে সারিসারি ব্যাগ আর বাক্স সাজানো। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে শঙ্কর এক গভীর তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তার মনে হলো, এবার তারা প্রস্তুত। এক ভয়ংকর, সুন্দর অভিযানের জন্য তারা পুরোপুরি প্রস্তুত। তাদের সামনে এখন শুধু অনন্ত সমুদ্র আর তার ওপারে এক রহস্যময়, অজানা মহাদেশের হাতছানি।
অধ্যায় ৬: বিদায়ের পালা
যাবার দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল, শঙ্করের বুকের ভেতরটা ততই এক অজানা আশঙ্কায় আর উত্তেজনায় ভরে উঠতে লাগল। সমস্ত জোগাড়যন্ত্র শেষ, জাহাজের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। কলকাতা বন্দর থেকে মোম্বাসাগামী জাহাজে তাদের দুটো কেবিন বুক করা হয়েছে। এখন শুধু পেছনের সব বাঁধন আলগা করে দেওয়ার পালা।
শঙ্কর তার ব্যবসার সমস্ত দায়িত্ব বিশ্বস্ত ম্যানেজার মশাইয়ের হাতে পুরোপুরি তুলে দিল। একটা পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি তৈরি করে তাকে সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দিয়ে দিল। ম্যানেজার মশাই পুরনো দিনের মানুষ, তিনি শঙ্করের বাবার আমল থেকে কাজ করছেন। শঙ্করের এই অদ্ভুত খেয়ালের কোনও মাথামুণ্ডু তিনি খুঁজে পেলেন না। ছলছল চোখে বললেন, খোকা, এই বয়সে আবার কেন ওসব ভয়ঙ্কর জায়গায় যাচ্ছ? এখানেই তো সব আছে।
শঙ্কর মৃদু হেসে তাঁর কাঁধে হাত রেখে বলল, সবকিছু থেকেও কী যেন একটা নেই, কাকাবাবু। আমাকে সেটারই খোঁজ করতে যেতে হবে। আপনি শুধু আশীর্বাদ করুন।
এরপর এল সবচেয়ে কঠিন কাজটা— প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া। শঙ্করের নিজের বলতে তেমন কেউ ছিল না। বাবা-মা আগেই গত হয়েছেন, ভাইবোনও নেই। কিন্তু তার গ্রামের বাড়িতে কয়েকজন দূর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন ছিলেন, যারা তাকে ছোটবেলা থেকে ভালোবাসতেন। আর ছিল তার ছেলেবেলার কয়েকজন বন্ধু।
শঙ্কর একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে তার গ্রামে গেল। এতদিন পর তাকে দেখে সবাই তো অবাক! কিন্তু যখন তারা শুনল যে, শঙ্কর আবার বিদেশে যাচ্ছে, এবং এবার হয়তো আর ফিরবে না, তখন সবার মুখগুলো কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তার বৃদ্ধা পিসিমা তো কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ওরে শঙ্কর, আর কত ঘুরবি? এবার ঘরে থিতু হ। তোর জন্য মেয়ে দেখেছি, বিয়েটা করে সংসারী হ।
বন্ধুরাও তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল। টাকাপয়সার তো তোর অভাব নেই। কীসের জন্য আবার জীবনটাকে বাজি রাখতে যাচ্ছিস?
শঙ্কর তাদের কী করে বোঝাবে? কোন সে অজানার নেশা তাকে ঘরছাড়া করে, কোন সে দুর্নিবার আকর্ষণ তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়— এসব কথা কি আর সংসারী, আটপৌরে মানুষ বুঝতে পারে? সে শুধু হাসিমুখে সবার সব কথা শুনল। তাদের আশীর্বাদ চাইল। আসার সময় তার গলাটা কেমন ধরে আসছিল, বুকের ভেতরটা ফাঁকা লাগছিল। সে জানত, হয়তো এই মুখগুলো সে আর কোনোদিনও দেখতে পাবে না।
কলকাতায় ফিরে তার পুরনো ভৃত্য রতনের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পালা। রতন এতদিন ধরে তার সব আবদার, সব পাগলামি মুখ বুজে সহ্য করেছে। সে-ই শঙ্করের একমাত্র অভিভাবকের মতো। যাওয়ার আগের রাতে শঙ্কর যখন রতনকে তার মাইনের টাকা ছাড়াও মোটা অঙ্কের একটা বকশিশ দিতে গেল, রতন কেঁদে ফেলল। আমার টাকার দরকার নেই, বাবু। তুমি শুধু সাবধানে থেকো, আর শিগগির ফিরে এসো।
রতনই একমাত্র ব্যক্তি, যে তাকে আটকানোর চেষ্টা করেনি। হয়তো সে তার মনিবকে চিনতে পেরেছিল। সে জানত, এই মানুষটাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না।
যাওয়ার দিন সকালে ডঃ সেনগুপ্ত এসে হাজির হলেন। তাঁর বিদায় পর্বটা ছিল একেবারেই সাদামাটা। তাঁর স্ত্রী বা ছেলেমেয়ে কেউ তাকে ছাড়তে আসেনি। তিনি হয়তো চাননি, বিদায়বেলার চোখের জল তাঁর সংকল্পকে দুর্বল করে দিক। তিনি একেবারে তৈরি হয়েই এসেছেন, কাঁধে তাঁর চিরসঙ্গী চামড়ার ব্যাগ।
সকলেই বিষণ্ণ, সকলের চোখেই জল। শঙ্করের ম্যানেজার, তার পিসিমা, বন্ধুরা, রতন— প্রত্যেকের মুখেই একরাশ চিন্তা আর আশঙ্কা। তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে শঙ্করের মনটাও খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তার নিজের চোখে এক ফোঁটাও জল ছিল না।
তার চোখে ছিল স্বপ্ন। এক দুর্নিবার, ভয়ঙ্কর সুন্দর স্বপ্ন। তার দৃষ্টি যেন এই চেনা কলকাতা, এই প্রিয় মুখগুলো ছাড়িয়ে চলে গিয়েছিল বহু দূরে, সমুদ্রের ওপারে। সে যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল কঙ্গোর নিবিড় অরণ্য, Virunga পর্বতমালার মেঘে ঢাকা চূড়া, আর সেই 'অগ্নি-পর্বত'-এর গহনে লুকিয়ে থাকা সূর্যশিলার রহস্যময় আলো।
গাড়িতে ওঠার আগে সে শেষবারের মতো তার বাড়িটার দিকে তাকাল। তারপর আকাশের দিকে। এক অদ্ভুত ভালো লাগায় তার মনটা ভরে গেল। সে সব পিছুটান ছিঁড়ে ফেলেছে। এখন সে মুক্ত। এখন সে আবার এক বেপরোয়া অভিযাত্রী। নিয়তি তাকে যে পথে নিয়ে যাবে, সে সেই পথেই নির্ভয়ে এগিয়ে যাবে।
অধ্যায় ৭: উত্তাল সমুদ্র
কলকাতা বন্দরের জেটি ছেড়ে 'এস. এস. ভারক্যালা' নামের জাহাজটা যখন ধীরে ধীরে হুগলি নদীর ঘোলা জল কেটে সমুদ্রের দিকে এগোতে লাগলো, তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। নদীর ধারের ঘরবাড়ি, গাছপালা, মন্দিরের চূড়া— সবকিছুকে পেছনে ফেলে শঙ্কর আর ডঃ সেনগুপ্ত এক নতুন জীবনের দিকে যাত্রা শুরু করলো। যতক্ষণ পর্যন্ত ডাঙার শেষ চিহ্নটুকু দেখা যাচ্ছিল, শঙ্কর রেলিং ধরে একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে ছিল। তার মনে কোনো বিষণ্ণতা ছিল না, ছিল শুধু এক তীব্র উত্তেজনা।
বঙ্গোপসাগরে পড়ার পর সমুদ্র শান্তই ছিল। বিশাল নীল জলের বুকে জাহাজটা যেন একটা দোলনার মতো দুলতে দুলতে চলেছে। দিনের বেলা শঙ্কর আর ডঃ সেনগুপ্ত জাহাজের ডেকে পায়চারি করতেন অথবা তাদের কেবিনে বসে কঙ্গোর ম্যাপ আর আলভারেজের ডায়েরি নিয়ে আলোচনা করতেন। ডঃ সেনগুপ্ত তার মাইক্রোস্কোপ নিয়ে সমুদ্রের জল থেকে সংগ্রহ করা প্ল্যাঙ্কটন পরীক্ষা করতেন, আর শঙ্কর দূরবীন চোখে দিয়ে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকতো, যদি কোনো ডলফিন বা উড়ুক্কু মাছের দেখা মেলে।
কিন্তু এই শান্ত, মনোরম যাত্রা বেশিদিন টিকলো না। শ্রীলঙ্কা পার হয়ে জাহাজ যখন আরব সাগরে ঢুকলো, তখন থেকেই আকাশের চেহারা বদলাতে শুরু করলো। পরিষ্কার নীল আকাশ কোথায় মিলিয়ে গিয়ে তার জায়গায় দেখা দিলো এক ধরনের থমথমে ধূসর রঙ। বাতাসও যেন ভারি হয়ে উঠলো, সমুদ্রের ঢেউগুলোর আকার ক্রমশ বড় হতে লাগলো। জাহাজের অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন, তার কপালে চিন্তার ভাঁজ।
একদিন বিকেল থেকে শুরু হলো ঝড়। প্রথমে নামলো মুষলধারে বৃষ্টি, সাথে শোঁ শোঁ শব্দে হাওয়া। দেখতে দেখতে সেই হাওয়া এক ভয়ংকর রূপ নিলো। আকাশ আর সমুদ্র যেন মিশে একাকার হয়ে গেলো। কুড়ি-পঁচিশ ফুট উঁচু বিশাল বিশাল ঢেউ দৈত্যের মতো এসে জাহাজের ওপর আছড়ে পড়তে লাগলো। তাদের গর্জনে কান পাতা দায়। জাহাজটা তখন আর জাহাজ নেই, যেন একটা শুকনো পাতার মতো উত্তাল সমুদ্রের বুকে একবার আকাশে উঠছে, আবার পরক্ষণেই পাতালে নেমে যাচ্ছে।
চলবে.....