জাহাজের সব যাত্রীকে কেবিনের ভেতরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শঙ্কর আর ডঃ সেনগুপ্তও তাদের কেবিনে বন্দী। জাহাজের পোর্টহোল বা কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের সেই প্রলয়ংকর দৃশ্য দেখে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। মনে হয়, এই বুঝি একটা বিশাল ঢেউ এসে জাহাজটাকে দুই টুকরো করে ফেলবে। জাহাজের কাঠের কাঠামো থেকে অনবরত ক্যাঁচকোঁচ শব্দ হচ্ছে, যেন সে তার শেষ শক্তি দিয়ে প্রকৃতির এই ভয়ংকর আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
ডঃ সেনগুপ্ত তার সব বৈজ্ঞানিক গাম্ভীর্য ভুলে একটা বাঙ্কের লোহার রড শক্ত করে ধরে বসে আছেন। তার মুখ ফ্যাকাশে। এই বয়সে সমুদ্রের এমন ভয়াল রূপ তিনি আগে আর কখনও দেখেননি।
শঙ্করেরও ভয় করছিল, কিন্তু সেই ভয়ের সাথে মিশে ছিল এক ধরনের তীব্র উত্তেজনা। তার চাঁদের পাহাড়ের অভিযানের কথা মনে পড়ছিল। প্রকৃতি যে কতটা ভয়ংকর অথচ সুন্দর হতে পারে, তা সে জানে। সে পোর্টহোলের কাঁচের ওপর ঝুঁকে পড়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। বিদ্যুতের ঝলকানিতে যখন সমুদ্রের সেই ভয়ংকর রূপ আলোকিত হয়ে উঠছিল, তখন শঙ্করের মনে হচ্ছিল, প্রকৃতি যেন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে তাদের স্বাগত জানাচ্ছে। সে যেন বলছে— তোমরা যে পথে পা বাড়িয়েছ, তা ফুলের পথ নয়। প্রত্যেক পদে আমার এই ভয়ংকর রূপের সাথে তোমাদের লড়াই করতে হবে।
হঠাৎ একটা প্রচণ্ড বড় ঢেউয়ের ধাক্কায় জাহাজটা সাংঘাতিকভাবে একদিকে কাত হয়ে গেলো। কেবিনের ভেতরে তাদের বাক্স-প্যাঁটরা সব হুড়মুড় করে একদিক থেকে অন্যদিকে গড়িয়ে পড়লো। ডঃ সেনগুপ্ত ছিটকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম করতেই শঙ্কর শক্ত হাতে তাকে ধরে ফেললো।
দুজনেই কিছুক্ষণ হাঁপাতে লাগলেন। বাইরের ঝড়ের তাণ্ডব তখন চরমে উঠেছে। সেই ভয়ংকর শব্দ আর দুলুনির মধ্যে একে অপরের দিকে তাকিয়ে তারা যেন নিঃশব্দেই নিজেদের মনের ভাবটা বুঝে নিলেন।
তাদের দুজনের মুখেই ভয়ের বদলে ফুটে উঠলো এক অদ্ভুত, দৃঢ় সংকল্পের হাসি। ডঃ সেনগুপ্ত তার ফ্যাকাশে ঠোঁট নেড়ে প্রায় চিৎকার করেই বলে উঠলেন, এ তো সবে শুরু, মিঃ রায়!
শঙ্করও সেই ঝড়ের গর্জনের সাথে গলা মিলিয়ে উত্তর দিলো, আপনি ঠিকই বলেছেন, ডক্টর সেনগুপ্ত! আসল পরীক্ষা তো এখনো বাকি!
সেই উত্তাল সমুদ্রের বুকে, প্রকৃতির সেই ভয়ংকর রুদ্ররূপের সাক্ষী থেকে দুই অসমবয়সী অভিযাত্রী যেন এক নতুন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠলেন। তারা বুঝলেন, তাদের আগামী দিনগুলো এই ঝড়ের মতোই বিপদসংকুল হতে চলেছে। কিন্তু তারাও এটাও বুঝলেন, তারা একসঙ্গে থাকলে যে কোনো ঝড়কেই মোকাবিলা করতে পারবেন।
অধ্যায় ৮: আফ্রিকার মাটিতে
আরব সাগরের সেই ভয়ংকর ঝড় তিন দিন আর তিন রাত ধরে চলেছিল। চার দিনের দিন সকালে যখন ঘুম ভাঙলো, তখন শঙ্কর দেখলো জাহাজের সেই পাগলাটে দুলুনি আর নেই। কেবিনের পোর্টহোল দিয়ে একফালি উজ্জ্বল রোদ এসে পড়েছে। সে ধড়মড় করে উঠে বাইরে তাকালো। আকাশ আবার ঘন নীল, সমুদ্র শান্ত, যেন গত কয়েকদিন ধরে কিছুই হয়নি। প্রকৃতি তার তাণ্ডব শেষ করে এখন এক শান্ত, স্নিগ্ধ রূপ নিয়েছে।
ঝড়ের পর যাত্রার বাকি অংশটা নির্বিঘ্নেই কাটলো। অবশেষে একদিন ভোরে, একজন খালাসির চিৎকারে তাদের ঘুম ভাঙলো— "Land ahoy! Land ahoy!" (ডাঙা দেখা যায়!)
শঙ্কর আর ডঃ সেনগুপ্ত প্রায় দৌড়ে জাহাজের ডেকে এসে দাঁড়ালেন। দূরে, অনেক দূরে, ভোরের আবছা কুয়াশার মধ্যে একটা লম্বা, কালচে রেখা দেখা যাচ্ছে। প্রথমে ভালো করে বোঝা যায় না, কিন্তু জাহাজ যতই এগোতে লাগলো, ততই সেই রেখাটা আরও স্পষ্ট হতে লাগলো। ওটা আর কিছু নয়, ওটাই আফ্রিকা!
দেখতে দেখতে বাতাসে এক ধরনের পরিবর্তন এলো। নোনা হাওয়ার সাথে মিশে এক অদ্ভুত, পরিচিত গন্ধ শঙ্করের নাকে এসে লাগলো। এ গন্ধ তার চেনা। এ গন্ধ মাটি, বুনো ফুল আর অজানা সব গাছপালার মেশানো এক আদিম গন্ধ। এ গন্ধ আফ্রিকার নিজস্ব গন্ধ। এই গন্ধ নাকে আসতেই শঙ্করের বুকের ভেতরটা এক অনাবিল আনন্দে ভরে গেলো। তার মনে হলো, কতদিন পর সে যেন নিজের ঘরে ফিরে আসছে।
দুপুরের দিকে 'এস. এস. ভারক্যালা' কেনিয়ার মোম্বাসা বন্দরের বিশাল জেটিতে এসে ভিড়লো। বন্দরে নেমে ডঃ সেনগুপ্তের তো চোখ স্থির! তিনি জীবনে এই প্রথম আফ্রিকার মাটিতে পা রাখলেন। বন্দরের কোলাহল, নানা রঙের, নানা ভাষার মানুষের ভিড়, মাল ওঠানো-নামানোর চিৎকার, ক্রেনের ঘরঘর শব্দ, আর সবকিছুর ওপরে এক তীব্র গরম— সবকিছুই তার কাছে নতুন আর বিস্ময়কর।
কিন্তু শঙ্করের অনুভূতি ছিল একদম অন্যরকম। সে এই পরিবেশের সাথে আগে থেকেই পরিচিত। সোয়াহিলি ভাষায় কুলিদের সাথে মালপত্র নামানো নিয়ে সে যখন অনর্গল দরাদরি শুরু করলো, তখন ডঃ সেনগুপ্ত অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। যে শঙ্করকে তিনি এতদিন কলকাতার বাড়িতে এক সভ্য, শিক্ষিত বাঙালি যুবক হিসেবে দেখে এসেছেন, আফ্রিকার মাটিতে পা রাখার সাথে সাথেই সে যেন এক অন্য মানুষে পাল্টে গেছে। তার হাঁটাচলা, তার কথাবার্তা, তার চাহনি— সবকিছুতেই এক অদ্ভুত স্বাচ্ছন্দ্য আর আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠেছে।
শঙ্করের মনে হচ্ছিল, তার শরীরের প্রত্যেকটা শিরা-উপশিরায় যেন এক নতুন শক্তি, এক নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। কলকাতার সেই ক্লান্তি, সেই অবসন্ন ভাবটা কোথায় উবে গেছে। এই কড়া রোদ, এই ঘাম, এই কোলাহল— কিছুই তার কাছে কষ্টকর বলে মনে হচ্ছিল না। বরং তার মনে হচ্ছিল, এই মাটিই তার আসল মাটি, এই আকাশই তার আসল আকাশ। সভ্য জগতের কৃত্রিম আবরণ ভেদ করে তার ভেতরের সেই আদিম, জংলী সত্তাটা যেন আবার জেগে উঠেছে।
তারা বন্দরের কাছেই একটা হোটেলে উঠলো। হোটেলের ঘরে জিনিসপত্র রেখে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শঙ্কর বন্দরের কর্মচাঞ্চল্য দেখছিল। ডঃ সেনগুপ্ত তখনও এই নতুন পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি শঙ্করকে বললেন, আশ্চর্য! এখানকার বাতাসেতেই যেন কী একটা আছে! কলকাতায় থাকতে আপনাকে যতটা ক্লান্ত দেখাতো, এখানে নেমেই আপনি যেন দশ বছরের ছোট হয়ে গেছেন!
শঙ্কর হাসলো। সে কী করে বোঝাবে যে, কিছু কিছু মানুষের জন্য নির্দিষ্ট কিছু জায়গা থাকে। কারও মন টানে পাহাড়ে, কারও মন টানে সমুদ্রে। আর তার মন, তার আত্মা বাঁধা পড়ে আছে এই বিশাল, রহস্যময় আফ্রিকান মহাদেশের সাথে।
সে ব্যালকনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে এক গভীর শ্বাস নিলো। সেই শ্বাসের সাথে সে যেন আফ্রিকার আত্মাকে নিজের ভেতরে গ্রহণ করলো। এই মাটিই একদিন তাকে প্রায় মেরে ফেলেছিল, আবার এই মাটিই তাকে দিয়েছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এবারও সে জানে না, এই মাটির গভীরে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে— সম্পদ, নাকি মৃত্যু। কিন্তু সেটুকুই জানার জন্যই তো তার আসা। শঙ্করের মনে হলো, তার আসল যাত্রাটা এতদিনে শুরু হলো।
অধ্যায় ৯: পথপ্রদর্শকের সন্ধান
মোম্বাসায় আর দেরি করা চলে না। প্রয়োজনীয় কিছু গরম জামাকাপড় ও স্থানীয় মুদ্রা সংগ্রহ করে শঙ্কর ও ডঃ সেনগুপ্ত চেপে বসলেন ট্রেনে। এই ট্রেন লাইনটি ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল উগান্ডা পর্যন্ত, যা 'লুনাটিক এক্সপ্রেস' নামেও পরিচিত ছিল। কারণ, এই লাইন তৈরি করতে গিয়ে বহু কর্মী সিংহ ও অন্যান্য বন্য জন্তুর আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছিল।
ট্রেনের যাত্রাটা ছিল এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে ডঃ সেনগুপ্তের জন্য। সমুদ্রতীরের আর্দ্র গরম ছেড়ে ট্রেন যত দেশের ভেতরে ঢুকতে লাগল, ততই দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করল। প্রথমে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি বা সাভানা, মাঝে মাঝে দুই-একটি বাওবাব গাছ। দূরে দেখা যায় জিরাফ বা জেব্রার পাল নিশ্চিন্তে ঘাস খাচ্ছে। ডঃ সেনগুপ্ত তো উত্তেজনায় প্রায় শিশুর মতো হয়ে উঠলেন। তিনি তাঁর নোটবুকে খসখস করে কী যেন সব লেখেন, আবার কখনও বাইনোকুলার চোখে দিয়ে দূরের পাহাড়ের আবছা নীল রেখার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
চলবে.....