Posts

উপন্যাস

শঙ্কর এর নতুন অভিযান: সূর্যশিলার সন্ধানে। পর্ব ১১

September 21, 2025

প্রকৌশলী জেড আর চৌধুরী

49
View

শঙ্কর চুপচাপ জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে। এই দৃশ্য তার চেনা। কিন্তু যতবারই সে দেখে, ততবারই তার মনটা এক ব্যাখ্যাতীত শান্তিতে ভরে যায়।

ট্রেন যাত্রা শেষ হল ভিক্টোরিয়া হ্রদের কিনারায়, কিসুমু শহরে। সেখান থেকে স্টিমারে করে লেক পার হয়ে উগান্ডা। তারপর আবার ছোট ছোট গাড়ি ও নৌকায় করে নানা দুর্গম পথ পার হয়ে, প্রায় তিন সপ্তাহ পর, তারা এসে পৌঁছাল কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসায়।

কিনশাসা এক অদ্ভুত শহর। একদিকে চওড়া রাস্তা, ইউরোপীয় ধাঁচের বাড়িঘর, অন্যদিকে ধুলোমাখা রাস্তা আর স্থানীয় মানুষদের কোলাহলে ভরা বাজার। এ যেন সভ্যতা আর অরণ্যের সীমানা। এখান থেকেই তাদের আসল অভিযান শুরু হবে।

কিনশাসায় পৌঁছেই তাদের প্রথম এবং সবচেয়ে জরুরি কাজ ছিল একজন নির্ভরযোগ্য পথপ্রদর্শক বা গাইড খুঁজে বের করা। ভরসা করা যায়, এমন লোক পাওয়া যে কত কঠিন, তা শঙ্কর ভালোভাবেই জানত। সে স্থানীয় বাজারে, সরাইখানায় খোঁজখবর নিতে শুরু করল। অনেকেই তাদের নিয়ে যেতে রাজি হল, কিন্তু তাদের চোখের লোভী চাহনি দেখেই শঙ্কর বুঝে গেল, এদের নিয়ে দু-পা গেলেই হয় এরা সব ফেলে পালাবে, নয়তো সুযোগ বুঝে সবকিছু লুট করে নেবে।

ডঃ সেনগুপ্ত অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন, কিন্তু শঙ্কর তাঁকে বোঝাল যে, এই একটি কাজেই তাড়াহুড়ো করলে চলবে না। একজন ভুল পথপ্রদর্শক মানে নিশ্চিত মৃত্যু।

অবশেষে, এক বৃদ্ধ আরব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তারা একজনের সন্ধান পেল। ব্যবসায়ীটি বলল, শহরের বাইরে, নদীর ধারে এক বুড়ো থাকে। নাম তার মাতুম্বো। লোকে তাকে পাগল বলে। কিন্তু জঙ্গলের নাড়িনক্ষত্র তার চেয়ে ভালো আর কেউ চেনে না। যদি তাকে রাজি করাতে পারো, তাহলে তোমাদের কপাল ফিরে যাবে।

পরদিন সকালে শঙ্কর আর ডঃ সেনগুপ্ত সেই নদীর ধারের বস্তিতে গিয়ে হাজির হল। একটি ছোট, মাটির ঘরের সামনে এক বৃদ্ধ লোক বসে একটা মাছ ধরার জাল মেরামত করছিল। বয়সের ভারে শরীরটা নুয়ে পড়েছে, চামড়া কুঁচকে গেছে, মাথার চুল সব সাদা। কিন্তু লোকটির চোখ দুটো আশ্চর্য রকমের সজাগ ও তীক্ষ্ণ।

শঙ্কর সোয়াহিলি ভাষায় তাকে সম্ভাষণ করল। বৃদ্ধ মুখ তুলে তাকাল। তার দৃষ্টিতে কোনও ভাবান্তর নেই।

শঙ্কর ধীরে ধীরে তাদের উদ্দেশ্যের কথা বলল। সে সরাসরি সূর্যশিলার কথা বলল না, শুধু বলল যে তারা Virunga পর্বতমালার উত্তরে, ইটোরি অরণ্যের গভীরে একটি বিশেষ পর্বত সম্পর্কে গবেষণা করতে চায়।

বৃদ্ধ মাতুম্বো চুপচাপ সবটা শুনল। তার মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই। শঙ্কর যখন তার কথা শেষ করল, তখন সে শান্ত গলায় বলল, ওই জঙ্গলে শয়তান বাস করে। কেন সেখানে গিয়ে প্রাণ দিতে চাও, সাহেব?

শঙ্কর বুঝতে পারল, এই লোকটিকে টাকা দিয়ে ভোলানো যাবে না। সে তার শেষ অস্ত্রটা প্রয়োগ করল। সে নিচু গলায় বলল, আমরা সেই পাহাড়টা খুঁজছি, যাকে তোমাদের পূর্বপুরুষেরা বলত 'অগ্নি-পর্বত'।

'অগ্নি-পর্বত'— এই দুটো শব্দ উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বৃদ্ধের চোখের মণি দুটো এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল। সে তার কাজ থামিয়ে শঙ্করের চোখের দিকে সরাসরি তাকাল। তার সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন শঙ্করের ভেতরটা পড়ে ফেলার চেষ্টা করছে।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর মাতুম্বো এক অদ্ভুত, চাপা গলায় বলল, ওই পাহাড়ের কথা সবাই বলতে সাহস পায় না, সাহেব। আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা ছিল ওই পাহাড়ের প্রহরী। তাদের কাজ ছিল, বাইরের লোককে ওই পবিত্র জায়গায় যেতে বাধা দেওয়া।

সে থামল। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, কিন্তু এখন দিন বদলে গেছে। পাহাড় তার প্রহরীকে নিজেই ডেকে নেয়। আমি তোমাদের নিয়ে যাব।

তার কথায় এমন একটা দৃঢ়তা ছিল, যা শুনে শঙ্কর আর ডঃ সেনগুপ্ত দুজনেই অবাক হয়ে গেল। তারা বুঝতে পারল, তারা শুধু একজন পথপ্রদর্শক পায়নি, পেয়েছে এমন একজনকে, যার রক্তে মিশে আছে সেই কিংবদন্তীর ইতিহাস। তাদের সবচেয়ে কঠিন কাজটা যেন এভাবেই সবচেয়ে সহজে হয়ে গেল।
 

অধ্যায় ১০: জঙ্গলের দোরগোড়ায়

মাতুম্বোকে পথপ্রদর্শক হিসেবে পাওয়ার পর কিনশাসায় আর এক সপ্তাহ কেটে গেল। এই সময়টা লাগল অভিযানের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সারতে। মাতুম্বোর পরামর্শে তারা আরও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিল, যেমন— জল शुद्ध করার জন্য ফিল্টার, স্থানীয় বিষাক্ত পোকার কামড় থেকে বাঁচার জন্য বিশেষ ধরনের মলম, আর শক্ত চামড়ার লম্বা বুট।

সবচেয়ে বড় কাজ ছিল মালবাহক বা পোর্টার জোগাড় করা। মাতুম্বো তার নিজের গ্রাম থেকে দশজন শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত লোক জোগাড় করে আনল। এরা সকলেই জঙ্গলের মানুষ, সভ্য জগৎকে ভয় পেলেও জঙ্গলকে পায় না। তাদের মজবুত কাঁধেই থাকবে অভিযানের সমস্ত রসদ ও সরঞ্জামের বোঝা।

অবশেষে যাত্রার দিন এসে গেল। একটা পুরনো লরিতে করে মালপত্র ও লোকজন নিয়ে তারা কিনশাসা শহর ছাড়ল। লরিটি তাদের যতটা সম্ভব জঙ্গলের কাছাকাছি নামিয়ে দেবে, তারপর থেকে শুরু হবে পদযাত্রা।

শহর ছাড়িয়ে যতই তারা এগোতে লাগল, ততই সভ্যতার চিহ্ন পেছনে মিলিয়ে যেতে শুরু করল। পিচঢালা রাস্তার জায়গায় এল কাঁচা, মাটির রাস্তা। ইউরোপীয় ধাঁচের বাড়ির জায়গায় দেখা গেল আদিবাসীদের ছোট ছোট গ্রাম। দু-ধারে ফসলের খেতের পর শুরু হল লম্বা লম্বা ঘাসের প্রান্তর, আর তারপর দিগন্ত জুড়ে দেখা দিল এক জমাট বাঁধা, নিবিড় সবুজের প্রাচীর।

সেই সবুজ প্রাচীর দেখেই ডঃ সেনগুপ্ত এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন। এ সাধারণ জঙ্গল নয়। এ যেন এক সবুজ সমুদ্র। গাছের মাথাগুলো একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, আকাশ প্রায় দেখাই যায় না। পুরো জঙ্গলটা জুড়ে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, অথচ তার ভেতর থেকেই যেন লক্ষ কোটি প্রাণের গুঞ্জন ভেসে আসছে।

নির্দিষ্ট জায়গায় লরিটা তাদের নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিল। এবার সভ্য জগতের সাথে তাদের শেষ সংযোগটুকুও ছিন্ন হয়ে গেল। সামনে কেবল আদিম, অপ্রতিরোধ্য প্রকৃতি।

শঙ্কর, ডঃ সেনগুপ্ত, মাতুম্বো এবং দশজন মালবাহক— এই তেরো জনের ছোট্ট দলটি এসে দাঁড়াল সেই সবুজ প্রাচীরের সামনে, কঙ্গো জঙ্গলের দোরগোড়ায়। এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল শঙ্করের। এর আগে সে অনেক জঙ্গলে ঢুকেছে, কিন্তু এই জঙ্গলের সামনে দাঁড়িয়ে তার মনে হল, সে যেন এক বিশাল, জীবন্ত প্রাণীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই জঙ্গলের যেন নিজস্ব এক আত্মা আছে।

মালবাহকেরা মালপত্র কাঁধে তুলে নেওয়ার আগে নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় প্রার্থনা করে নিল, তাদের আরাধ্য দেবতার কাছে সুরক্ষার জন্য। ডঃ সেনগুপ্ত তাঁর নোটবুকে শেষবারের মতো কিছু নোট লিখে নিলেন। শঙ্কর তার রাইফেলটা একবার পরীক্ষা করে কাঁধে ঝুলিয়ে নিল।

সবাই যখন প্রস্তুত, তখন বৃদ্ধ মাতুম্বো একবার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে কয়েকটা শকুন উড়ছিল। মাতুম্বো সেদিকে তাকিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করে উঠল। তার ঠোঁট নড়ছিল, কিন্তু কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছিল না।

তারপর সে শঙ্কর আর ডঃ সেনগুপ্তের দিকে ফিরে তাকাল। তার সেই তীক্ষ্ণ চোখ দুটোতে এক অদ্ভুত, রহস্যময় দ্যুতি। সে শান্ত কিন্তু গম্ভীর গলায় বলল, এখন থেকে আর ফেরার পথ নেই, সাহেব। জঙ্গলের নিজের নিয়ম আছে। সে ঠিক করে, কে ভেতরে যাবে আর কে বাইরে আসবে। জঙ্গলের আত্মারা তোমাদের পরীক্ষা নেবে। যদি তোমাদের উদ্দেশ্য সৎ হয়, তবে জঙ্গল তোমাদের পথ ছেড়ে দেবে। আর যদি তোমাদের মনে লোভ থাকে, তবে এই জঙ্গলই তোমাদের কবর হবে।

কথাগুলো বলে সে আর দাঁড়াল না। হাতের লম্বা লাঠিটা দিয়ে সামনের ঘন ঝোপঝাড় সরিয়ে সে জঙ্গলের মধ্যে প্রথম পা বাড়াল। তার পেছনে মালবাহকেরা, আর সবার শেষে শঙ্কর ও ডঃ সেনগুপ্ত।

এক পা, দু-পা করে তারাও প্রবেশ করল সেই আদিম, অন্ধকার অরণ্যে। সভ্য জগতের শেষ আলোটুকু পেছনে মিলিয়ে গেল। এক স্যাঁতস্যাঁতে, পচা পাতার গন্ধ, পোকামাকড় ও সরীসৃপের একটানা শব্দ আর এক অজানা আতঙ্ক তাদের স্বাগত জানাল।

চলবে.....
 


 

Comments

    Please login to post comment. Login