Posts

গল্প

গল্প ছাতা

September 21, 2025

Sunatra Barua

107
View

ছাতা

এক সপ্তাহ আগে সেলাই করা নতুন প্যান্টটা হাঁটু অবধি গুঁজে জুতো জোড়া একহাতে আর অন্য হাতে শিক ভাঙ্গা ছাতাটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন হাসান সাহেব।অভিমানী আকাশ যেন আজকেই তার ক্রন্দন বারি সবটুকু ধরিত্রী মাতাকে বিসর্জন দেবে । পুরো শহর জুড়ে কোমর অবধি পানি জমে যাচ্ছেতাই অবস্থা। এই অবস্থায় বাসায় পৌঁছতে গাড়ি পাওয়া বিরম্বনার আরেক নাম। বিগত দেড় ঘন্টা যাবত পথের দিকে আকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি। পানি ঠেলে রিক্সা গুলো একে অন্যকে ধাক্কা দিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। জলপথেও যে স্থলযান চলা সম্ভব এই বোধহয় তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। শত বিরক্তির মাঝেও হাসান সাহেব মনে মনে হাসলেন। রাস্তার পাশের দোকান গুলোতে এক হাঁটু পানি। দোকানিরা আস্তে আস্তে ঝাঁপি ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর কিছুক্ষণ পর থেকে শুধু দোকানের নাম ফলক গুলো নিষ্প্রাণ শহরে জীবন্ত হয়ে থাকবে।

নাহ! আজ বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে। বাসায় নিতু আর বাচ্চারা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে।

পরীক্ষার আগের সময়টাতে টিউশনে একটু বেশি সময় পড়াতে হয়। গণিতের শিক্ষক হিসেবে তার ভীষণ জনপ্রিয়তা আছে এলাকায়। সেই সুবাদে অনেকগুলো টিউশন করেন তিনি। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর ছেলেমেয়েগুলো যখন বলে “স্যার আপনার জন্যই গণিতে ভালো করলাম” তখন তার পরিতৃপ্তির সীমা থাকে না। শিক্ষক হবার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বোধহয় এটাই।

অনেক পুরনো ছাত্রকে দেখে তিনি প্রায়সই চিনতে পারেন না। তারা কৈশোর পার করে যৌবনে পদার্পণ করেছে। শারীরিক অবয়বের সাথে অনেকের ব্যক্তিত্বেও পরিবর্তন এসেছে। তাদের এ পরিবর্তন হাসান সাহেবের খুব ভালো লাগে।

নাহ !আর কতক্ষন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কে জানে!

পাশের হোটেল থেকে ভেসে আসা খাবারের সুঘ্রাণ তার খিদেটাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। হোটেলের নাম ফলকের দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলেন তিনি। ‘হ্যাঁ রেস্তোরাঁ’ এটা আবার কেমন নাম! ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন “ড়ি”এর লাইট টা নষ্ট হয়ে গেছে। মনে-মনে আরেক দফা হাসলেন হাসান সাহেব। একটা অক্ষরের কত শক্তি! পুরো শব্দের মাধুর্যতাই বদলে হাস্যকর করে তুলেছে।

হোটেলের ভেতর বেঞ্চির উপর পা তুলে বসে এক লোক পত্রিকা পড়ছে। ওপরের পাতায় খবরের শিরোনামে হাসান সাহেবের চোখ আটকে যায়। ” ছাত্রের স্ট্যাম্পের আঘাতে গুরুতর আহত শিক্ষকের মৃত্যু।”

হাসান সাহেবের অজান্তেই তার মেরুদণ্ডের শিড়দাড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়। তিনি চোখ সরিয়ে অন্য দিকে দৃষ্টি দেওয়ার চেষ্টা করেন। তার মাথার ভেতরটা শূন্য লাগছে। বাতাসের বেগ তার ভাঙ্গা ছাতাটা উড়িয়ে নিতে চাইছে। শক্ত করে ছাতাটা তিনি আঁকড়ে ধরে থাকেন। তার মনে হতে লাগল ওই আহত শিক্ষকটি ত তিনিও হতে পারতেন।

হাসান সাহেবের মনে পড়ে যায়, গত সপ্তাহে তিনি তার ছোটবেলার স্কুলের প্রধান শিক্ষকের জানাজায় অংশ নেবার পর অঝোরে কেঁদেছিলেন। কারণ হাসান সাহেবের উচ্চ শিক্ষার যাত্রাটা তার প্রধান শিক্ষকের হাত ধরেই হয়েছিল। জীবনের এই পর্যায়ে এসেও তিনি তার শিক্ষকদের অবদান অস্বীকার করতে পারেন না।

হঠাৎ মোটর সাইকেলের হর্ন এর শব্দে তার চিন্তায় ছেদ পড়ল।

- স্যার ভাল আছেন? আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি রুদ্র। এসএসসি 2002 ব্যাচ। মাথার হেলমেট খুলে গোলগাল চেহারার এক তরুণ হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

- হাসান সাহেব একটু বিব্রত বোধ করেন। নামটা চেনা মনে হলেও ছেলেটার আগের অবয়ব তিনি কিছুতেই মনে করতে পারেন না।

গলায় অসস্তি নিয়েই উত্তর দেন, ভালো আছি ।তুমি ভালো?

- হ্যাঁ স্যার। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন বোধহয়। পেছনে উঠে বসেন। আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

হাসান সাহেব ঘড়ি দেখলেন, রাতের 10:30। বিব্রত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাসা কোথায় বাবা?

- মুরাদপুর স্যার ,জি এ সি তে একটা কাজ ছিল তাই এদিকে আসা। তাড়াতাড়ি উঠুন স্যার। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে।

হাসান সাহেব আবার বিব্রত বোধ করতে থাকেন, সেকি! আমিতো চৌমুহনী যাব। তোমার বাসা তো উল্টো পথে। থাক, তুমি বরং বাসায় যাও বাবা। অনেক রাত হয়ে গেছে ,ঘরের মানুষ চিন্তা করবে।

ছেলেটা এবার হাত ধরে টেনে জোর করে বাইকের পেছনে বসিয়ে দিলো হাসান সাহেব কে।

-স্যার শক্ত করে বসেন। রাস্তার যা অবস্থা!

হাসান সাহেব কি বলবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। পানি ঠেলে একটু একটু করে তারা এগিয়ে যেতে থাকে।

অনেকক্ষণ হাসান সাহেব কিছু বলার জন্য খুঁজে পাচ্ছিলেন না। মৌনতা ভেঙে ছেলেটি আবার প্রশ্ন করে, স্যার বোধহয় এখনো আমাকে চিনতে পারেননি! ওই যে স্যার, আমি আর শুভ টিফিনে স্কুলের পেছনে লুকিয়ে সিগারেট খেতে গিয়ে আপনার হাতে ধরা পড়েছিলাম। আপনি আমাদের দুজনকে খুব মেরেছিলেন।

এবার হাসান সাহেবের স্মৃতিতে ছবির মত সবকিছু ভেসে ওঠে। ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে শুভ আর রুদ্র। স্কুলের সকল দস্যিপনার নাটের গুরু ছিল এই দুজন। তাদের কীর্তিকলাপ মনে করে মনে মনে আরেক দফা হাসলেন হাসান সাহেব।

এবার তিনি মৌনতা ভেঙে ছেলেটার কাঁধে আলতো করে হাত রাখলেন।

- মনে পড়েছে বাবা। তোমরা কেউ তো আর আগের মত নেই ,তাই হঠাৎ চিনতে পারিনা। কিছু মনে করোনা ।

এবার রুদ্র হো হো করে হেসে ওঠে। কি যে বলেন স্যার! শুভর সাথে কথা হলেই আপনার কথা মনে পড়ে। পরীক্ষার্থীদের সবাইকে পরীক্ষার আগে যে কলম গুলো উপহার দিয়েছিলেন, আমি আর শুভ আমাদের কলম দুটো যত্ন করে রেখে দিয়েছি। ও হ্যাঁ! আপনি স্যার আমাকে আর শুভকে সিগারেট নিয়ে বরাবরই সন্দেহ করতেন, কিন্তু সেদিনের পর থেকে আমরা আর সিগারেট খাইনি স্যার।

এবার হাসান সাহেব আর রুদ্র দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠে। যানবাহনের শব্দে তাদের হাসির আবেগ বেশি দূর পৌঁছতে পারেনা।

মোটরসাইকেল যখন হাসান সাহেবের বাসার সামনে থামল, তখন ঘড়িতে এগারোটা বেজে দশ মিনিট।

হাসান সাহেব ছেলেটাকে বলতে যাচ্ছিলেন, ভেতরে চলো। তার আগেই রুদ্র বলল , স্যার চলুন আপনার বাসা থেকে ঘুরে আসি।

হাসান সাহেব ছাতাটা বন্ধ করতে করতে একটু হাসলেন।

বেল বাজাতেই রাফি এসে দরজা খুলে দিল। রাফি হাসান সাহেবের ছোট ছেলে। এবার অনার্স ফাস্ট ইয়ার এ ভর্তি হয়েছে।

জুতো জোড়া তাকের উপর রেখে, মানিব্যাগ আর ছাতাটা রাফির দিকে এগিয়ে দিলেন।

- মাকে গিয়ে বল আমার এক ছাত্র এসেছে।

রুদ্রকে ড্রয়িং রুমে বসতে দিয়ে তিনি ভেতরে গেলেন। যাবার সময় স্ত্রী নিতুকে ডেকে বললেন ছেলেটাকে কিছু খেতে দাও।

ভেতর থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলেন, রুদ্র যাবার জন্য তৈরি হয়ে আছে। হাসান সাহেব কে দেখে একটা মৃদু হাসি হেসে বলল ,স্যার আজ তবে আসি। অনেক রাত হয়ে গেছে ।সামনে থাকা টেবিলের ওপর মানিব্যাগ থেকে একটা কার্ড রেখে বলল, স্যার আমার কার্ড রইল দরকার হলেই ফোন করবেন।

গেটের বাইরে পর্যন্ত রুদ্রকে এগিয়ে দিয়ে এলেন হাসান সাহেব। মোটর সাইকেলের লাইট টা হারিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত সে দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। হাসান সাহেবের বুকের ভেতর থেকে নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

ধীরে ধীরে দরজাটা লাগিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় গা এলিয়ে দেন তিনি। টেবিলের ওপর রাখা রুদ্রের ভিজিটিং কার্ডটা তুলে নেবার সময় লক্ষ্য করলেন টেবিলের কোনায় একটা প্যাকেট করা নতুন ছাতা।

- ইশ্ ছেলেটা এই বৃষ্টিতে ছাতাটা ফেলে গেছে। দ্রুত কার্ড থেকে নম্বর টা খুজে নিয়ে কল করেন তিনি। দুবার রিং হতেই রুদ্র ফোন রিসিভ করে।

- হ্যালো!

- রুদ্র আমি হাসান স্যার বলছি।

- জি স্যার!

- তোমার ছাতাটা তো ফেলে গেছ বাবা!

- না স্যার ওটা আপনার। দূর থেকে দেখছিলাম আপনার ছাতাটা ভেঙে গেছে। আপনাকে ডাক দেবার আগেই মোড়ের ছাতার দোকান থেকে ছাতাটা কিনেছি। কেনার সময় আপনাকে চোখে চোখে রেখেছিলাম স্যার। এই না আবার আপনি কোন গাড়িতে উঠে পড়েন। তাহলে তো আর আপনার সাথে যেতে পারতাম না।

বলেই ছেলেটা আবার হাসছে।

হাসান সাহেব বলার জন্য কিছু খুজঁছিলেন । রুদ্র আবার মৌনতা ভাঙলো। সামনের বুধবার সুইডেন চলে যাচ্ছি স্যার। দোয়া করবেন।

- আচ্ছা বাবা ভালো থেকো। না চাইলেও শিক্ষকদের দোয়া সবসময় তোমাদের সাথে থাকবে।

ফোনটা রেখে ছাতাটার দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। আসার সময় দেখা খবরের কাগজের হেডলাইন টা তার স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে আসে। বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি। শহরের আবর্জনা গুলো ধুয়ে যাচ্ছে। এভাবে মনের আবর্জনাগুলো যদি ধুয়ে ফেলা যেত!

হাসান সাহেব দুহাত তুলে তার ছাত্রদের জন্য দোয়া করেন।

Comments

    Please login to post comment. Login