Posts

উপন্যাস

শঙ্কর এর নতুন অভিযান: সূর্যশিলার সন্ধানে। পর্ব ১২

September 24, 2025

প্রকৌশলী জেড আর চৌধুরী

49
View

তৃতীয় পরিচ্ছেদ: কঙ্গোর বিপদসংকুল অরণ্যে
 

অধ্যায় ১: সবুজ নরক

জঙ্গলের মধ্যে প্রথম পা রাখা আর এক সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে প্রবেশ করা— দুটো যেন একই সঙ্গে ঘটল। এক মুহূর্ত আগেও মাথার উপর ছিল খোলা আকাশ, পায়ের তলায় শক্ত মাটি, বাতাসে ছিল মুক্তির গন্ধ। আর এক মুহূর্ত পরেই সভ্য জগতের সমস্ত চিহ্ন যেন এক ঝটকায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

তাদের মাথার উপর এখন আর আকাশ নেই। বিশাল বিশাল, শতবর্ষী সব গাছের ডালপালা আর লতাপাতা একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে এক দুর্ভেদ্য ছাউনি তৈরি করেছে যে, দিনের বেলাতেও সূর্যের আলো তার সামান্যতম অংশ নিয়েও নিচে প্রবেশ করতে পারছে না। চারিদিকে এক চিরস্থায়ী গোধূলির রাজত্ব। গাছগুলোর গুঁড়ি এত মোটা যে, তিন-চারজন লোক মিলেও হয়তো বেড় দিতে পারবে না। তারা যেন এই আদিম জগতের নীরব প্রহরী।

বাতাসে ভাসছে এক অদ্ভুত ভারী গন্ধ— স্যাঁতস্যাঁতে মাটি, পচা পাতা, অজানা বুনো ফুলের উগ্র সুবাস আর লক্ষ লক্ষ বছর ধরে জমে থাকা পচনের এক তীব্র গন্ধ। বাতাস প্রায় স্থির, গুমোট গরমে শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে, কিন্তু সেই ঘাম শুকোবার উপায় নেই। জামাকাপড় আঠার মতো গায়ে সেঁটে যাচ্ছে।

কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হল এই জঙ্গলের শব্দ। বাইরে থেকে যেটাকে নিস্তব্ধতা বলে মনে হচ্ছিল, ভেতরে ঢোকার পর বোঝা গেল, তা আসলে লক্ষ কোটি প্রাণের একটানা গুঞ্জন। হাজার হাজার রকমের পোকার একটানা ঝিঁ ঝিঁ ডাক, অদৃশ্য কোনও সরীসৃপের খসখস শব্দ, দূরে কোনও অজানা জন্তুর অস্পষ্ট ডাক— সবকিছু মিলেমিশে এক একটানা, সম্মোহনী ঐকতান তৈরি করেছে। এই শব্দের মধ্যে কোনও বিরতি নেই, কোনও থামা নেই। মনে হয়, এ যেন এই অরণ্যের হৃৎস্পন্দন, যা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে একইভাবে বেজে চলেছে।

ডঃ সেনগুপ্তের মতো মানুষও প্রথমে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে রইলেন। তাঁর চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে সেই সব গাছপালা, যা তিনি এতদিন কেবল বইয়ের পাতায় ছবিতেই দেখেছেন। তিনি উত্তেজনার সঙ্গে বলতে লাগলেন, আশ্চর্য! মিঃ রায়, ওই দেখুন, Cycad... আর ওই যে ঝুলছে, ওগুলোই হল আসল Lianas... ভাবা যায়!

তাঁর বৈজ্ঞানিক কৌতূহল তখন জেগে উঠেছে। কিন্তু এই গুমোট গরম আর স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে হাঁটার অনভ্যাস তাঁর শরীরকে কাবু করে দিচ্ছিল। তিনি হাঁপাতে লাগলেন।

শঙ্করের অনুভূতি ছিল মিশ্র। সে এর আগেও আফ্রিকার নানা প্রান্তে ঘুরেছে, কিন্তু কঙ্গোর এই বর্ষারণ্যের রূপ সম্পূর্ণ আলাদা। রোডেসিয়ার খোলা প্রান্তর বা কালাহারির মরুভূমির বিপদের সঙ্গে এর কোনও তুলনা চলে না। এ জঙ্গল যেন এক জীবন্ত সত্তা। এর প্রতিটি গাছ, প্রতিটি লতা, প্রতিটি পোকামাকড় যেন এই সবুজ সাম্রাজ্যের সৈন্য। শঙ্করের মনে এক ধরনের গভীর শ্রদ্ধা ও ভয় মেশানো অনুভূতি হচ্ছিল।

মাতুম্বো ও তার মালবাহকেরা অবশ্য এই পরিবেশে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। তারা নিঃশব্দে, সাপের মতো মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলেছে। মাতুম্বো মাঝে মাঝে হাত দিয়ে পথ পরিষ্কার করছে, আর তার চোখ দুটো সাপের মতো এদিক-ওদিক ঘুরছে, যেন সে মাটির নিচের স্পন্দনও শুনতে পায়।

হাঁটা অত্যন্ত কঠিন। মাটি কোথাও শক্ত, আবার কোথাও নরম তুলতুলে কাদায় ভরা। শুকনো পাতার পুরু আস্তরণের নিচে যে কী লুকিয়ে আছে, তা বলা মুশকিল— সাপের গর্ত, নাকি কোনও চোরাবালি! প্রত্যেককে পা ফেলার আগে লাঠি দিয়ে মাটি পরীক্ষা করে নিতে হচ্ছিল। তার উপর ছিল জোঁকের উপদ্রব। কথা নেই বার্তা নেই, কোথা থেকে যেন পায়ের পাতায়, ঘাড়ে, হাতে জোঁকগুলি এসে রক্ত চুষতে শুরু করে দিয়েছে।

প্রথম দিনটা শেষ হল। তারা যখন তাঁবু খাটানোর জন্য একটা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার জায়গা খুঁজে বের করল, তখন গোধূলি আর রাতের মধ্যে কোনও তফাৎ করা যাচ্ছে না। সভ্য জগৎ, সূর্য, আকাশ— সবকিছুই যেন অন্য কোনও জন্মের স্মৃতি বলে মনে হতে লাগল। তারা বুঝতে পারল, তারা কোনও সাধারণ জঙ্গলে প্রবেশ করেনি। তারা প্রবেশ করেছে এক আদিম পৃথিবীতে, এক জীবন্ত গোলকধাঁধায়— এক সবুজ নরকে।
 

অধ্যায় ২: সিয়াফু!

জঙ্গলের সেই দমবন্ধ করা পরিবেশে দুটো দিন কেটে গেছে। তৃতীয় দিন সকালে ঘুম ভাঙার পর দলের সবার মধ্যেই একটা থিতিয়ে আসা ভাব। শরীরটা এই অদ্ভুত পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে শুরু করেছে। বিপদ যে পদে পদে, তা তারা জানে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত বড় কোনও জন্তু-জানোয়ারের সামনে পড়তে হয়নি।

সকালের সামান্য খাবারদাবার সেরে তারা আবার পথ চলতে শুরু করল। মাতুম্বো সেদিন যেন একটু বেশিই চুপচাপ। তার চোখ দুটো constantly এদিক-ওদিক ঘুরছে, কান দুটোও যেন খাড়া হয়ে আছে। শঙ্কর জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, মাতুম্বো? সব ঠিক আছে তো?

মাতুম্বো কেবল মাথা নেড়েছিল, কিন্তু কোনও উত্তর দেয়নি।

দুপুর নাগাদ তারা একটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গায় এসে পৌঁছাল, যেখানে কয়েকটা বড় বড় গাছ থাকায় ছাউনিটা একটু পাতলা। ঠিক হল, এখানেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার রওনা দেওয়া হবে। মালবাহকেরা মালপত্র নামিয়ে সবে বসেছে, এমন সময় শঙ্কর একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করল।

জঙ্গলের সেই একটানা গুঞ্জনটা যেন হঠাৎ করে কমে গেছে। পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে না, বানর বা অন্য কোনও জন্তুর সাড়াশব্দও নেই। পুরো জঙ্গলটা জুড়ে যেন একটা থমথমে, অপ্রাকৃত নিস্তব্ধতা।

ঠিক তখনই মাতুম্বো প্রায় লাফিয়ে উঠল। সে বাতাসে কীসের যেন গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করল, তারপর মাটিতে কান পাতল। এক মুহূর্ত পরেই তার মুখটা ভয়ে আতঙ্কে সাদা হয়ে গেল। সে বিদ্যুৎবেগে উঠে দাঁড়িয়ে তার ভাঙা ভাঙা সোয়াহিলি আর ইংরেজির মিশ্রণে চিৎকার করে উঠল, "সিয়াফু! সিয়াফু! পালাও, সাহেব! শিগগির পালাও!"

'সিয়াফু' নামটা শোনানোর সঙ্গে সঙ্গেই মালবাহকদের মধ্যে যেন নরক ভেঙে পড়ল। তারা তাদের মালপত্র ফেলেই যে যেদিকে পারল, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড় শুরু করল।

শঙ্কর বা ডঃ সেনগুপ্ত প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলেন না। ডঃ সেনগুপ্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, কীসের এত ভয় পেল এরা? সিয়াফুটা আবার কী?

কিন্তু তাঁর প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই তারা নিজেরাই উত্তরটা পেয়ে গেল।

তাদের থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে, একটা শুকনো পাতার স্তূপের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে একটা জীবন্ত, কালো নদী। প্রথমে দেখে মনে হয়, যেন কেউ এক ড্রাম আলকাতরা ঢেলে দিয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই ভুলটা ভাঙল। ওটা আলকাতরা নয়, ওটা পিঁপড়ে! লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি কুচকুচে কালো, রাক্ষুসে পিঁপড়ে।

তাদের বয়ে চলার একটা একটানা খসখস শব্দ হচ্ছে, যেন শুকনো পাতার ওপর দিয়ে কেউ ঝাঁটা টানছে। সেই জীবন্ত কালো স্রোত কোনও বাধা মানছে না। তাদের পথের ওপর পড়ে থাকা একটা মরা গিরগিটি এক নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল, শুধু সাদা হাড় ক'টা পড়ে রইল। একটা বড় গুবরে পোকা পালানোর চেষ্টা করতেই হাজার হাজার পিঁপড়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিল।

মাতুম্বো এসে প্রায় টানতে টানতে শঙ্কর আর ডঃ সেনগুপ্তকে ওঠাল। দাঁড়িয়ে দেখছ কী, সাহেব? এরা মানুষও আস্ত রাখে না! দৌড়াও!

এবার তাদের হুঁশ ফিরল। এ তো সাধারণ পিঁপড়ে নয়, এ হল আফ্রিকার কিংবদন্তির ড্রাইভার অ্যান্ট বা সৈন্য পিঁপড়ে। এরা যখন শিকারে বেরোয়, তখন এদের সামনে যা কিছু পড়ে— পোকামাকড়, সাপ, পাখি, এমনকি ঘুমন্ত হরিণ বা মানুষ— সবকিছুকে শেষ করে দিয়ে যায়।

তারাও দৌড় শুরু করল। কিন্তু মালপত্র? তাঁবু, খাবার, দামী যন্ত্রপাতি— সবকিছু যে সেখানে পড়ে আছে! শঙ্কর একবার চেষ্টা করেছিল দুটো ব্যাগ তুলে নেওয়ার, কিন্তু দেখল, সেই কালো স্রোত সাংঘাতিক গতিতে তাদের ক্যাম্পের দিকেই এগিয়ে আসছে। আর কয়েক মুহূর্ত দেরি করলেই তাদের ঘিরে ফেলবে।

ফেলে দাও, সাহেব! প্রাণের চেয়ে জিনিসের দাম বেশি নয়! মাতুম্বো চিৎকার করে বলল।

চলবে.....
 


 

Comments

    Please login to post comment. Login