Posts

উপন্যাস

শঙ্কর এর নতুন অভিযান: সূর্যশিলার সন্ধানে। পর্ব ১৩

September 24, 2025

প্রকৌশলী জেড আর চৌধুরী

120
View

কোনও উপায় নেই। একটা তাঁবু, দুটো রসদ ভরতি ব্যাগ আর ডঃ সেনগুপ্তের অতি যত্নের কিছু নমুনা সংগ্রহের বাক্স ফেলেই তাদের পালাতে হল। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তারা প্রায় অন্ধের মতো ছুটছে। গাছের ডালপালায় গা-হাত-মুখ ছিঁড়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেদিকে তাকানোর সময় নেই। তাদের কানের পেছনে তখন সেই একটানা, ভয়ঙ্কর খসখস শব্দটা তাড়া করে আসছে। সে শব্দ যেন স্বয়ং মৃত্যুর পায়ের আওয়াজ।

প্রায় আধ মাইল দৌড়ে একটা ছোট পাহাড়ি ঝর্ণার কাছে এসে তারা থামল। জল পেরিয়ে ওপারে গিয়ে তারা হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ল। মালবাহকেরাও একে একে সেখানে এসে জুটেছে। সবাই ভয়ে কাঁপছে।

শঙ্কর ফিরে তাকিয়ে দেখল, সেই কালো নদীটা ঝর্ণার ধারে এসে ইতস্তত করছে। তারা জল পেরোতে ভয় পাচ্ছে। আপাতত তারা নিরাপদ।

তাদের দলের মনোবল ভেঙে গেছে। আর তার চেয়েও বড় কথা, তাদের অতি প্রয়োজনীয় খাবার আর জিনিসপত্রের একটা বড় অংশ ওই সবুজ নরকের রাক্ষুসে বাহিনীর পেটে চলে গেছে। যাত্রা শুরুর মাত্র তিন দিনের মাথায় এই অত্যধিক ক্ষতি তাদের অভিযানকে এক বিরাট অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দিল।

অধ্যায় ৩: কুমিরের নদী

সিয়াফুর আক্রমণ থেকে প্রাণে বাঁচলেও, দলের প্রত্যেকের মনের উপর তার একটা গভীর ছাপ পড়ে গিয়েছিল। মালবাহকেরা সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকত, সামান্য খসখস শব্দ শুনলেই চমকে উঠত। ডঃ সেনগুপ্ত তাঁর হারানো নমুনাগুলোর জন্য অত্যন্ত বিষণ্ণ ছিলেন, আর শঙ্কর চিন্তায় পড়েছিল কমে যাওয়া রসদ নিয়ে। পথ এখন আরও অনেক কঠিন হতে চলেছে।

আরও দুই দিন হাঁটার পর তারা এক নতুন বাধার সামনে এসে পৌঁছাল। সামনে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল, খরস্রোতা নদী। জল খুব গভীর নয় হয়তো, কিন্তু স্রোতের টান সাংঘাতিক। নদীর ঘোলা জলের দিকে তাকালেই কেমন যেন ভয় করে। এ নদী সাঁতরে পার হওয়ার কথা চিন্তাও করা যায় না।

মাতুম্বো নদীর তীরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে কী যেন পর্যবেক্ষণ করল। তারপর বলল, নদীর নাম উবাঙ্গি। ওপারে যেতে হলে ভেলা বানাতে হবে।

যেমন কথা তেমন কাজ। মাতুম্বোর নির্দেশনায় সবাই মিলে কাজে লেগে গেল। জঙ্গল থেকে শক্তপোক্ত, হালকা কাঠ আর লিয়ানা বা বুনো লতা কেটে আনা হল। সেই কাঠ একসঙ্গে বেঁধে, লতা দিয়ে দুটো মজবুত ভেলা তৈরি করতে প্রায় সারাদিন লেগে গেল। একটা ভেলায় মালপত্র আর অর্ধেক লোক, অন্য ভেলায় বাকিরা— এইভাবেই নদী পার হওয়ার পরিকল্পনা করা হল।

পরদিন সকালে, দিনের আলো ফুটতেই তারা ভেলা ভাসাল। প্রথম ভেলাটায় মালপত্রের সঙ্গে মাতুম্বো, ডঃ সেনগুপ্ত আর চারজন মালবাহক উঠল। শঙ্কর তার রাইফেল হাতে দ্বিতীয় ভেলাটায় বাকিদের সঙ্গে পাড়ি দিল। তাদের ভেলাটা প্রথম ভেলাটার থেকে কিছুটা পেছনে ছিল।

নদীর মাঝবরাবর আসতেই ঘটল সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা।

প্রথমে কিছুই বোঝা যায়নি। শুধু দেখা গেল, প্রথম ভেলাটার থেকে সামান্য দূরে জলের উপর দুটো শুকনো কাঠের টুকরোর মতো কী যেন একটা ভেসে চলেছে। কিন্তু মাতুম্বোর অভিজ্ঞ চোখ এক মুহূর্তেই বিপদটা চিনে ফেলল। সে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠল, "কুম্বওয়া! কুম্বওয়া!" (কুমির! কুমির!)

কিন্তু তার সাবধানবাণী শেষ হওয়ার আগেই সেই 'কাঠের টুকরো' দুটো জীবন্ত হয়ে উঠল। জলের নিচে থেকে উঠে এল এক বিশাল, প্রাগৈতিহাসিক দানব। কুমিরটা অন্তত পনেরো-ষোলো ফুট লম্বা হবে। তার পিঠের চামড়া যেন পাথরের বর্ম, আর চোয়ালের দু-পাশ দিয়ে বেরিয়ে আছে হলদে, ছুরি-ধারালো দাঁত।

কিছু বোঝার আগেই কুমিরটা তার লেজের এক প্রচণ্ড ঝাপটায় ভেলাটার এক কোণে আঘাত করল। আঘাতের চোটে ভেলাটা সাংঘাতিকভাবে দুলে উঠল, আর কোণে বসে থাকা 'বাকিলি' নামের এক যুবক মালবাহক টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে নদীর জলে পড়ে গেল।

সঙ্গে সঙ্গেই এক আর্তনাদ শোনা গেল। কুমিরটা বিশাল হাঁ করে বাকিলির একটা পা কামড়ে ধরে তাকে জলের নিচে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ঘোলা জল মুহূর্তে লাল হয়ে উঠল। ভেলার অন্যেরা ভয়ে, আতঙ্কে চিৎকার করতে লাগল। ডঃ সেনগুপ্ত পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর মুখ ভয়ে সাদা।

এই চরম মুহূর্তে শঙ্করের মস্তিষ্কের ভেতরটা যেন বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল। সে জানত, এক মুহূর্ত দেরি করলেই ছেলেটাকে আর বাঁচানো যাবে না। সে তার দ্বিতীয় ভেলা থেকে কাঁধের রাইফেলটা তুলে এক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।

কিন্তু গুলি করা অসম্ভব। বাকিলি আর কুমিরটা এমনভাবে জড়িয়ে জলের মধ্যে পাক খাচ্ছে যে, গুলি কুমিরের গায়ে না লেগে ছেলেটার গায়েও লাগতে পারে।

শঙ্কর তার জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটা নিল। সে জানে, কুমিরের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হল তার চোখ। সে অপেক্ষা করতে লাগল। এক মুহূর্তের জন্য, মাত্র এক মুহূর্তের জন্য কুমিরটা তার বিশাল মাথাটা জল থেকে ওপরে তুলল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে শঙ্করের হাতের 450 রাইফেলটা গর্জে উঠল।

গুলির শব্দটা জঙ্গলের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে দিল। কুমিরের মাথাটা একপাশে ঝটকা দিয়ে কাত হয়ে গেল, তার চোখটা দিয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। সে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বাকিলির পা-টা ছেড়ে দিয়ে জলের মধ্যে পাক খেতে খেতে স্রোতের টানে ভেসে গেল।

ততক্ষণে অন্য মালবাহকেরা কোনওমতে বাকিলিকে টেনে ভেলায় তুলেছে। কিন্তু তার অবস্থা ভয়ঙ্কর। কুমিরের কামড়ে তার পায়ের মাংস ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, হাড় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সে যন্ত্রণায় জ্ঞান হারিয়েছে।

তাড়াতাড়ি করে দুটো ভেলাই নদীর ওপারে নিয়ে আসা হল। ডঃ সেনগুপ্ত তাঁর ডাক্তারি জ্ঞান দিয়ে ছেলেটার ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। কিন্তু তিনি শঙ্করের কানে কানে বললেন, অবস্থা ভালো নয়, শঙ্কর। গ্যাংগ্রিন হয়ে যাওয়ার ভয় আছে। এই জঙ্গলের মধ্যে একে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব।

দলের সবাই চুপ করে বাকিলির পাশে বসে আছে। তাদের চোখেমুখে ভয় আর হতাশার ছাপ। তারা নদীটা পার হতে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু তার জন্য যে মূল্য দিতে হল, তা অনেক। একজন সঙ্গীর এই ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখে সবার মনোবল যেন একেবারে ভেঙে গেল। শঙ্কর বুঝতে পারল, শুধু বন্য জন্তু বা পোকামাকড় নয়, এই জঙ্গলের প্রতিটা নদী, প্রতিটা জলাশয়ও তাদের জন্য এক একটা মৃত্যুফাঁদ পেতে রেখেছে।

অধ্যায় ৪: মাতুম্বোর উপকথা

কুমিরের আক্রমণের পর দলের মধ্যে যে ভয় আর হতাশার মেঘ জমেছিল, তা কাটতে বেশ কয়েকদিন সময় লেগে গেল। আহত বাকিলির অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। ডঃ সেনগুপ্তের অক্লান্ত সেবা আর শঙ্করের শিকার করে আনা গরম স্যুপ খেয়ে সে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিল বটে, কিন্তু হাঁটার ক্ষমতা সে পুরোপুরি হারিয়েছিল। বাকি মালবাহকেরা পালা করে তাকে একটা কাপড়ের ডুলিতে করে বয়ে নিয়ে চলছিল। এতে যাত্রার গতি অনেক কমে গিয়েছিল, কিন্তু সঙ্গীকে ফেলে যাওয়ার কথা কেউ চিন্তাও করতে পারেনি।

এইরকম একটা থমথমে, বিষণ্ণ পরিবেশে একমাত্র যে জিনিসটা তাদের মনকে কিছুটা চাঙ্গা করে রাখত, তা হল রাতের আগুন। সারাদিনের ভয়ঙ্কর পরিশ্রম আর ভয়ের পর, সন্ধ্যায় যখন তারা ক্যাম্প ফেলত আর দাউদাউ করে আগুন জ্বালানো হত, তখন সেই আগুনের উষ্ণ আলোয় সবার মনেই একটু ভরসা ফিরে আসত।

আর সেই আগুনের পাশেই বসত মাতুম্বোর গল্পের আসর।

বৃদ্ধ মাতুম্বো ছিল এক অসাধারণ গল্পকার। সারাদিন সে গম্ভীর আর চুপচাপ থাকত, কিন্তু রাতের আগুনে তার মুখটা আলোকিত হয়ে উঠলেই সে যেন এক অন্য মানুষ হয়ে যেত। তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করত, আর তার সেই গভীর, শান্ত গলা থেকে বেরিয়ে আসত তার পূর্বপুরুষদের মুখে শোনা সব অদ্ভুত অদ্ভুত উপকথা।

চলবে.....
 


 

Comments

    Please login to post comment. Login