আর তাদের সবার প্রিয় বিষয় ছিল সেই 'অগ্নি-পর্বত' আর 'সূর্যশিলা'র কিংবদন্তী।
মাতুম্বো বলত, অনেক, অনেক কাল আগেকার কথা। তখন পৃথিবীতে মানুষ ছিল না, ছিল শুধু মহান আত্মারা। একদিন আকাশের বুক চিরে এক বিশাল আগুনের গোলা— তোমরা যাকে বল উল্কাপিণ্ড— এসে পড়েছিল এই জঙ্গলের ঠিক মাঝখানে। সেই গোলাটা এতই বড় আর গরম ছিল যে, তা মাটি ভেদ করে সোজা পাতালে চলে গিয়েছিল। আর তার ফলেই তৈরি হয়েছিল সেই 'অগ্নি-পর্বত'-এর জ্বালামুখ।
গল্প শুনতে শুনতে মালবাহকদের চোখগুলো বড় বড় হয়ে যেত। ডঃ সেনগুপ্তও তাঁর বৈজ্ঞানিক কৌতূহল নিয়ে মন দিয়ে শুনতেন, মাঝে মাঝে নোটবুকে কী যেন টুকে নিতেন।
মাতুম্বো বলে চলত, সেই আগুনের গোলার একেবারে কেন্দ্রে ছিল এক টুকরো পাথর, যা ছিল স্বয়ং সূর্যদেবের হৃৎপিণ্ড। পাতালে নেমেও সেই পাথরের তেজ কমেনি। রাতের অন্ধকারে সে জ্বলজ্বল করত, আর তার আলোয় পাতালে থাকা অশুভ আত্মারা কষ্ট পেত। তখন মহান আত্মারা সেই পাথরটাকে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের ঠিক মাঝখানে স্থাপন করলেন। তাঁরা বর দিলেন, এই পাথরের আলোয় জঙ্গলের সমস্ত প্রাণী রোগমুক্ত হবে, আর এর তেজে কোনও অশুভ শক্তি এই জঙ্গলের ক্ষতি করতে পারবে না।
সেই থেকেই ওই পাথরের নাম হল 'সূর্যশিলা', মাতুম্বো একদৃষ্টে আগুনের দিকে তাকিয়ে বলত। কিন্তু পাতালে থাকা অশুভ আত্মারা এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি। তারা পাহাড়টাকে অভিশাপ দিল। তারা বলল, যে কোনও লোভী মানুষ এই পাথরের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করবে, তাকেই তারা ভয়ঙ্কর মৃত্যু দেবে। সেই থেকে আমার পূর্বপুরুষেরা ওই পাহাড়কে পাহারা দিত। তারা নিশ্চিত করত, যেন কোনও অপবিত্র হৃদয়ের মানুষ ওই পবিত্র পাথরের কাছে পৌঁছাতে না পারে।
এই পর্যন্ত বলার পর মাতুম্বো হঠাৎ চুপ করে যেত। তার মুখটা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে উঠত। সে ফিসফিস করে বলত, এখনও, প্রতি অমাবস্যার রাতে, সেই অশুভ আত্মারা পাহাড়ের মাথায় উঠে আসে। তারা ভয়ঙ্কর জন্তু-জানোয়ারের রূপ ধরে পাহাড়টাকে পাহারা দেয়। তাদের চোখ আগুনের মতো জ্বলে, আর তাদের নিঃশ্বাসে বিষ থাকে।
মাতুম্বোর গল্প বলার ভঙ্গিটা ছিল এমনই জীবন্ত যে, মালবাহকদের মুখগুলো ভয়ে সাদা হয়ে যেত। তারা একে অপরের গা ঘেঁষে বসত, আর বারবার আঁধারের মধ্যে ভয়ার্ত চোখে তাকাত, যেন এখনই কোনও ভয়ঙ্কর জন্তু তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
শঙ্কর চুপচাপ সবটা শুনত। সে জানত, এই কিংবদন্তীর মধ্যে হয়তো অনেকখানিই কল্পনা মেশানো। কিন্তু সে এটাও বিশ্বাস করত যে, প্রত্যেকটা কিংবদন্তীর পেছনেই এক টুকরো সত্য লুকিয়ে থাকে। মাতুম্বোর গল্পগুলো তার মনের জেদকে আরও বাড়িয়ে দিত। এই রহস্যের শেষ তাকে দেখতেই হবে।
আর ডঃ সেনগুপ্ত? তিনি হয়তো মনে মনে ভাবতেন— উল্কাপিণ্ড, অর্থাৎ এর মধ্যে কোনও ভিনগ্রহের ধাতু থাকতেই পারে। আর অশুভ আত্মা বা বিষাক্ত নিঃশ্বাস? হয়তো আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে বেরোনো কোনও বিষাক্ত সালফার গ্যাসেরই পৌরাণিক রূপ এটা।
একই গল্প দুজনের মনে দুই ভিন্ন ধরনের কৌতূহল জাগিয়ে তুলত, আর সেই কৌতূহলের টানেই তারা সব ভয়, সব বিপদকে উপেক্ষা করে প্রতিদিন এগিয়ে চলত সেই অজানা অগ্নি-পর্বতের দিকে।
অধ্যায় ৫: রূপসী কিন্তু ভয়ঙ্করী
যাত্রা যত গভীরে ঢুকছিল, জঙ্গলের চরিত্রও তত বদলে যাচ্ছিল। গাছপালা আরও ঘন, আরও অচেনা হয়ে উঠছিল। ডঃ সেনগুপ্তের জন্য এটা যেন এক স্বর্গরাজ্য। তাঁর বিজ্ঞানী মনটা রোজ নতুন নতুন আবিষ্কারের আনন্দে নেচে উঠছিল। তিনি সারাদিন ধরে নানা অদ্ভুত ধরনের ফার্ন, ছত্রাক আর পোকামাকড় জোগাড় করতেন আর সন্ধ্যায় আগুনের আলোয় বসে সেগুলোর শ্রেণিবিভাগ করতেন। তাঁর ক্লান্তি বা ভয় বলে যেন কিছুই ছিল না।
একদিন দুপুরে, তারা একটা স্যাঁতস্যাঁতে, অন্ধকার মতো এলাকার মধ্যে দিয়ে পথ চলছিল। জায়গাটা এতটাই ঘন যে, দিনের বেলাতেও প্রায় সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। হঠাৎ ডঃ সেনগুপ্তের উল্লসিত চিৎকার শোনা গেলো।
ইউরেকা! পেয়েছি! পেয়েছি! অবিশ্বাস্য!
সবাই চমকে তাঁর দিকে তাকালো। ডঃ সেনগুপ্ত প্রায় একটা বাচ্চার মতো লাফাচ্ছিলেন আর একটা বিশাল গাছের গুঁড়ির দিকে আঙুল দেখাচ্ছিলেন। সেই গাছের ডাল থেকে ঝুলছে এক অপূর্ব, অদ্ভুত সুন্দর অর্কিড। ফুলটার রঙ ঘন বেগুনি, কিন্তু তার পাপড়ির মাঝখানে ঠিক যেন একটা বাঘের চোখের মতো হলদে-কালো ছোপ। এমন অদ্ভুত সুন্দর ফুল শঙ্কর জীবনে দেখেনি।
ডঃ সেনগুপ্তের চোখ দুটো তখন লোভে আর উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। তিনি বিড়বিড় করে বলছিলেন, "এ তো Phalaenopsis gigantea-র কোনো এক অজানা প্রজাতি! ভাবা যায়! বিজ্ঞানের জগতে সাড়া পড়ে যাবে!"
তিনি তাঁর কাঁধের ঝোলা থেকে নমুনা সংগ্রহের বাক্স আর একটা লম্বা চিমটে বের করে প্রায় দৌড়ে গাছের দিকে এগিয়ে গেলেন। শঙ্কর আর মাতুম্বো পেছন থেকে তাঁকে সাবধান করার সুযোগটুকুও পেলো না।
কিন্তু সেই রূপসী অর্কিড যে তার সৌন্দর্যের আড়ালে এক ভয়ংকর মৃত্যুকে লুকিয়ে রেখেছিল, তা কে জানতো!
ডঃ সেনগুপ্ত যেইমাত্র ফুলটার নিচে পৌঁছেছেন, অমনি গাছের গুঁড়ির একটা কোটর থেকে হিস্স করে একটা শব্দ উঠলো। ডঃ সেনগুপ্ত কিছু বোঝার আগেই, সবুজ পাতার রঙের সাথে মিশে থাকা এক ভয়ংকর দেখতে সাপ বিদ্যুৎগতিতে তাঁর দিকে ফণা তুলে এগিয়ে এলো। সাপটার মাথাটা চ্যাপ্টা, তিনকোনা, আর সারা গায়ে পান্না সবুজ রঙের ওপর কালো কালো ছোপ।
গ্যাবুন ভাইপার! আফ্রিকার অন্যতম বিষাক্ত এবং দ্রুতগামী সাপ।
ডঃ সেনগুপ্ত ভয়ে একেবারে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে গেছেন। তাঁর মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। সাপটা তাঁর হাত থেকে মাত্র এক ফুটের মধ্যে! আর এক মুহূর্ত, তারপরই সাপটা ছোবল মারবে এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব শেষ হয়ে যাবে।
ঠিক সেই চরম মুহূর্তে, যখন মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত, শঙ্করের রাইফেলটা গর্জন করে উঠলো। শঙ্কর এক মুহূর্তও দ্বিধা করেনি। সাপটাকে লক্ষ্য করার মতো সময় ছিল না। সে গুলি করেছিল ডঃ সেনগুপ্তের ঠিক পাশেই, গাছের গুঁড়িটাকে লক্ষ্য করে।
গুলিতে গাছের ছাল উড়ে গেলো এবং সেই প্রচণ্ড শব্দে সাপটা ভড়কে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো। আর সেই এক মুহূর্তই যথেষ্ট ছিল। শঙ্কর প্রায় লাফ দিয়ে ডঃ সেনগুপ্তের কাছে পৌঁছালো এবং তাঁর জামার কলার ধরে এক হ্যাঁচকা টানে পেছনে সরিয়ে আনলো। ঠিক সেই সময়েই সাপটা দ্বিতীয়বার ছোবল মারলো, কিন্তু লক্ষ্য সরে যাওয়ায় তার বিষদাঁত শুধু শূন্য বাতাসেই বিঁধলো।
সাপটা আর সেখানে দাঁড়ালো না। মুহূর্তের মধ্যে সে জঙ্গলের ঘন অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
ডঃ সেনগুপ্ত মাটিতে বসে থরথর করে কাঁপছিলেন। তাঁর ফ্যাকাশে মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছিল না। মৃত্যু যে কত কাছ দিয়ে চলে গেলো, তা ভেবে তিনি যেন এখনো বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
শঙ্কর তাঁর কাঁধে হাত রেখে তাঁকে আশ্বস্ত করলো। মাতুম্বো এক দৌড়ে কোথা থেকে এক ধরনের গাছের পাতা এনে ডঃ সেনগুপ্তকে চিবোতে দিলো, বললো এটা নাকি ভয় কাটানোর ওষুধ।
অনেকক্ষণ পর ডঃ সেনগুপ্ত স্বাভাবিক হলেন। তিনি লজ্জিত মুখে শঙ্করের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি... আমি মাফ চাই, শঙ্কর। আমার বিজ্ঞানী মনের কৌতূহল আজ প্রায় আমার প্রাণটাই নিয়ে নিয়েছিল। তোমার জন্য আমি বেঁচে গেলাম।
শঙ্কর হালকা হাসলো। এ জঙ্গলে কৌতূহল ভালো, ডক্টর সেনগুপ্ত। কিন্তু অতি কৌতূহল ভালো নয়।
সেদিন সন্ধ্যায় আগুনের পাশে বসে সবাই চুপচাপ ছিল। সবার মনেই একই কথা ঘুরছিল। এই আফ্রিকা এক অদ্ভুত দেশ। সে তার সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে মানুষকে মুগ্ধ করে, আকর্ষণ করে, আবার সেই সৌন্দর্যের আড়ালেই লুকিয়ে রাখে এক নিশ্চিত, ভয়ংকর মৃত্যু। এখানে প্রত্যেক পদে সৌন্দর্য আর বিপদ হাত ধরাধরি করে চলে। এক মুহূর্তের অসতর্কতা মানেই চিরকালের জন্য এই সবুজ নরকে হারিয়ে যাওয়া।
চলবে.....