Posts

উপন্যাস

শঙ্কর এর নতুন অভিযান: সূর্যশিলার সন্ধানে। পর্ব ১৫

September 29, 2025

প্রকৌশলী জেড আর চৌধুরী

55
View

অধ্যায় ৬: রূপালী পিঠের সাক্ষাৎ

গ্যাবুন ভাইপারের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার পর থেকে ডঃ সেনগুপ্ত অনেক বেশি সতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক কৌতূহল আগের মতোই ছিল, কিন্তু এখন তার সাথে মিশেছিল এক গভীর সাবধানতা।

এইভাবেই আরও কয়েকটা দিন কেটে গেল। তারা এখন এমন এক অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে বাঁশবন আর ফলের গাছ অনেক বেশি। মাতুম্বো বলেছিল, এই অঞ্চলটা 'এন'গো' বা গরিলারদের এলাকা।

সেদিন সন্ধ্যায় তারা একটা ছোট, পরিষ্কার ঝর্ণার ধারে ক্যাম্প ফেলেছিল। সারাদিনের হাঁটার পর সবাই ক্লান্ত। মালবাহকেরা আগুন জ্বালিয়ে রাতের খাবার তৈরি করতে ব্যস্ত। ডঃ সেনগুপ্ত তাঁর দিনের সংগ্রহ নিয়ে নোটবুকে ঝুঁকে পড়েছেন। শঙ্কর রাইফেলটা পরিষ্কার করে পাশে রেখে আগুনের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিল।

হঠাৎ করেই জঙ্গলের সেই একটানা গুঞ্জনটা থেমে গেল। এক অদ্ভুত, থমথমে নিস্তব্ধতা নেমে এল চারদিকে। মাতুম্বোর কান দুটো খাড়া হয়ে উঠল। সে ইশারায় সবাইকে চুপ করতে বলল।

তারপরেই তারা শব্দটা শুনতে পেল। খুব কাছেই, বাঁশবনের ভেতর থেকে মটমট করে ডাল ভাঙার শব্দ আসছে। এ কোনও ছোটখাটো জন্তুর শব্দ নয়। ভারী কোনও প্রাণী যে এদিক-ওদিক নড়াচড়া করছে, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

মালবাহকদের মুখগুলো ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। তারা নিঃশব্দে একে অপরের গা ঘেঁষে সরে এল। শঙ্কর দ্রুত তার রাইফেলটা হাতে তুলে নিল।

শব্দটা ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল। তারপর, আগুনের আলো আর জঙ্গলের অন্ধকারের সীমানায়, বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল এক বিশাল, ছায়ামূর্তি। তারপরে আরও একটা, আরও একটা...

একটা আস্ত গরিলার দল!

দলে বেশ কয়েকটি স্ত্রী গরিলা ছিল, তাদের কারো কারো পিঠে ছোট ছোট বাচ্চারা আঁকড়ে ধরে আছে। তারা মানুষ দেখে প্রথমে একটু থমকে গেল, তারপর নিচু গলায় এক ধরনের 'ঘুরঘুর' শব্দ করতে লাগল।

কিন্তু সবার চোখ আটকে গেল দলপতির দিকে। দলের সামনে, আগুনের আলোয় যে প্রাণীটি এসে দাঁড়িয়েছে, তার চেহারা দেখলে যে কোনও সাহসী মানুষেরও বুকের রক্ত হিম হয়ে যাবে। সে এক বিশালদেহী সিলভারব্যাক গরিলা। লম্বায় প্রায় সাড়ে ছয় ফুট উঁচু, চওড়া কাঁধ, পেশীবহুল হাত দুটো প্রায় মাটি ছুঁয়েছে। বয়সের ভারে তার পিঠের সমস্ত কেশর চাঁদের আলোর মতো ধবধবে সাদা হয়ে গেছে, যা অন্ধকারের মধ্যেও চিকচিক করছে।

সে কোনওরকম ভয় বা আগ্রাসন দেখাল না। সে শুধু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, পাহাড়ের মতো অটল। তার ছোট, গভীর দুটো চোখ দিয়ে সে बारी बारी করে ক্যাম্পের প্রত্যেকটা মানুষকে জরিপ করতে লাগল। সেই চোখে ভয় নেই, রাগ নেই, আছে এক গভীর প্রশান্তি আর প্রশ্নহীন কর্তৃত্ব।

মালবাহকেরা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মন্ত্র পড়া শুরু করেছে। ডঃ সেনগুপ্ত তাঁর বৈজ্ঞানিক সত্তা ভুলে গিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন, তাঁর মুখটা বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে।

শঙ্করের রাইফেলটা তখনো কাঁধে তোলা, তার আঙুল ট্রিগারের ওপর। কিন্তু সে গুলি করার কথা চিন্তাও করতে পারল না। তার মনে হল, সে যেন কোনও জন্তুর সামনে দাঁড়িয়ে নেই। সে দাঁড়িয়ে আছে এই অরণ্য-রাজ্যের সত্যিকারের রাজার সামনে। এই গরিলাটির চাহনি, তার অটল ভঙ্গি— সবকিছু মিলিয়ে এমন এক রাজকীয় গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে, যার সামনে অস্ত্র তোলাটাকেও এক ধরনের অপমান বলে মনে হয়।

হঠাৎই সেই বিশাল সিলভারব্যাকটা সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর তার দুই হাতের চেটো দিয়ে নিজের বুকে আঘাত করতে শুরু করল। ড্যাম-ড্যাম-ড্যাম— সেই গম্ভীর, ভয়ানক শব্দে যেন মাটি পর্যন্ত কেঁপে উঠল। এ কোনও আক্রমণের হুঙ্কার নয়। এ হল নিজের শক্তি আর ক্ষমতার ঘোষণা। সে যেন বুঝিয়ে দিল, এই জঙ্গলের আসল প্রভু কে।

শব্দটা থামার পর সে আবার শান্তভাবে দাঁড়াল। সে হয়তো বুঝেছিল, এই ছোট মানব দলটি তার বা তার পরিবারের জন্য কোনও বিপদ নয়। সে নিচু গলায় একবার ডাকল। সেটা যেন তার দলের প্রতি একটা সংকেত।

সঙ্গে সঙ্গে অন্য গরিলাগুলো তার পেছন পেছন জঙ্গলের অন্য দিকে চলে যেতে শুরু করল। যাওয়ার আগে সিলভারব্যাকটা শেষবারের মতো একবার শঙ্করের দিকে তাকাল। সেই এক মুহূর্তের দৃষ্টি বিনিময়ে শঙ্কর যেন এক ব্যাখ্যাতীত বার্তা পেল— 'তোমরা আমার অতিথি। কোনও ক্ষতি কোরো না, আমিও করব না।'

তারপর সেই বিশাল প্রাণীটাও নিঃশব্দে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

সবাই যেন এতক্ষণ দম বন্ধ করে ছিল। এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মাতুম্বো ফিসফিস করে বলল, জঙ্গলের আত্মা আজ আমাদের ওপর প্রসন্ন।

শঙ্কর ধীরে ধীরে তার রাইফেলটা নামিয়ে রাখল। তার হাত দুটো সামান্য কাঁপছিল, তবে সেটা ভয়ে নয়, এক তীব্র, অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার উত্তেজনায়। সে আজ বুঝেছিল, এই জঙ্গলে টিকে থাকতে হলে শুধু বন্দুকের জোরই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন প্রকৃতির রাজাদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা। এই সাক্ষাৎ তাদের যাত্রাপথে এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি হয়ে রইল।
 

অধ্যায় ৭: অদৃশ্য শত্রু

সিলভারব্যাক গরিলার দলের সহিত সেই অদ্ভুত সাক্ষাতের পর বেশ কয়েকটা দিন নির্বিঘ্নেই কেটে গেল। তারা এখন আরও ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করেছে, যেখানে জলাভূমি আর ছোট ছোট নদীর সংখ্যা অনেক বেশি। এই স্যাঁতস্যাঁতে, গুমোট আবহাওয়ায় পথ চলাটা ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল। কিন্তু দলের সবাই আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক, তাই বড় কোনও বিপদ ঘটেনি।

তবে জঙ্গলের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শত্রু সবসময় বাইরে থেকে আক্রমণ করে না। কখনও কখনও সে আসে নিঃশব্দে, অদৃশ্য ঘাতকের মতো।

একদিন সকালে, ক্যাম্প তোলার সময় দেখা গেল, দুজন মালবাহক— 'ওটা' আর 'কেয়ো'— তাদের স্লিপিং ব্যাগ থেকে উঠছে না। তাদের গায়ে হাত দিয়ে দেখা গেল, গা যেন পুড়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড জ্বর, তার সাথে ভয়ানক কাঁপুনি। থেকে থেকে তারা প্রলাপ বকছে, চোখ দুটো লাল জবাফুলের মতো হয়ে গেছে।

শঙ্কর প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো সাধারণ ম্যালেরিয়া। সে তাদের কুইনাইন ট্যাবলেট খাইয়ে দিল। কিন্তু বেলা বাড়ার সাথে সাথে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল। জ্বর তো কমলই না, উল্টে তাদের সারা গায়ে লাল লাল র‍্যাশ বেরোতে শুরু করল এবং নাক দিয়ে অল্প অল্প রক্ত পড়তে লাগল।

ডঃ সেনগুপ্ত অত্যন্ত চিন্তিত মুখে তাদের পরীক্ষা করলেন। তিনি অনেকক্ষণ ধরে তাদের চোখ, জিভ, নাড়ি দেখলেন। তারপর শঙ্করের দিকে ফিরে গম্ভীর গলায় বললেন, এটা সাধারণ জ্বর নয়, শঙ্কর। এটা হেমোরেজিক ফিভার বা রক্তক্ষরা জ্বর। সম্ভবত কোনও বিষাক্ত পোকার কামড় থেকে বা দূষিত জল থেকে এটা হয়েছে।

তিনি আরও যোগ করলেন, এই রোগের কোনও নির্দিষ্ট ঔষধ আমার কাছে নেই। যদি দুই-একদিনের মধ্যে জ্বর না নামে, তাহলে এদের বাঁচানো খুব মুশকিল হয়ে পড়বে।

কথাগুলো শুনে দলের সবার মুখ শুকিয়ে গেল। বন্দুকের সামনে বা বন্য জন্তুর মুখে দাঁড়িয়ে লড়াই করা যায়। কিন্তু এই অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়াই করার কোনও উপায় তাদের জানা নেই। মালবাহকদের মধ্যে এক চাপা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। তারা ফিসফিস করতে লাগল যে, অশুভ আত্মারা এই দুজনের ওপর ভর করেছে, কারণ তারা হয়তো জঙ্গলের কোনও নিয়ম ভেঙেছে।

মাতুম্বো কোথা থেকে এক ধরনের বুনো লতাপাতা পিষে সেই অসুস্থ দুজনের কপালে আর বুকে লাগিয়ে দিল। সে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগল। কিন্তু তাতে অবস্থার কোনও উন্নতি হল না।

যাত্রার কথা তো ভাবাই যায় না। সেই জলাভূমির ধারেই তাদের তাঁবু ফেলে থাকতে হল। শঙ্কর আর ডঃ সেনগুপ্ত পালা করে রাত জেগে অসুস্থদের সেবা করতে লাগলেন। তাদের কপালে অনবরত জলপট্টি দেওয়া হতে লাগল। গরম স্যুপ করে চামচে করে খাওয়ানোর চেষ্টা করা হতে লাগল, যদিও তার বেশিরভাগটাই তারা ফেলে দিচ্ছিল।

চলবে......
 

Comments

    Please login to post comment. Login