ফটোগ্রাফি টেকনিক।

ফটোগ্রাফি তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ফটোগ্রাফি টেকনিক। একটা চিত্রকে কাঙ্ক্ষিত রূপ দেওয়ার জন্য যে কলা-কৌশল প্রয়োগ করা হয় তাই ফটোগ্রাফি টেকনিকস।
শিল্প, সাহিত্য ও জীবনের সবখানে কলা-কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা বাস্তবতা তৈরি করার চেষ্টা করি। ফটোগ্রাফি তেও ক্যামেরা যা সচরাচর দেখে তাকে কৌশল দিয়ে পরিবর্তন করে আমরা নিজের পছন্দ মতো এক্সপোজার তৈরি করে থাকি। অথবা আমরা যে দৃশ্য দেখি তাকে টেকনিক দিয়ে ক্যামেরাকে নির্দেশনা দিয়ে উক্ত কাঙ্ক্ষিত এক্সপোজার আনার চেষ্টা করি।
ফটোগ্রাফি টেকনিক নিয়ে আলাপে প্রথমে ক্যামেরা নিয়ে আলাপ করতে হয়। ক্যামেরা হলো কৃত্রিম চোখ। মানুষের চোখ যেভাবে কাজ করে ক্যামেরা সেভাবেই কাজ করার চেষ্টা করে। চোখও ছবি ক্যাপচার করে জমা হয় intangible মেমরিতে। ক্যামেরাও ছবি ক্যাপচার করে, তবে এক্ষেত্রে তার ফিজিক্যাল একটা মেমরি কার্ড আছে। এবং এই ফিজিক্যাল মেমরির ছবি আমরা অসংখ্যবার প্রিন্ট করতে পারি।
মানুষের চোখ সাধারণত ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্সে দেখে, তবে যখন সে কোনো কিছু ফোকাস করে তখন সে গভীরতা ও স্ক্রিন সাইজ ঠিক করে নেয়। চোখ ও মস্তিষ্ক এত দ্রুত সবকিছু করে যে আমরা ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারি না।
ফটোগ্রাফির মূল বিষয় আলো। এর যত টেকনিক তা সবই আলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। ফটোগ্রাফিতে আমরা দুই ধরনের আলো দেখি—ন্যাচারাল লাইট ও আর্টিফিশিয়াল লাইট। ইনডোর ফটোগ্রাফিতে আর্টিফিশিয়াল লাইট ব্যবহার হয়।
ফটোগ্রাফার সাধারণত আলোর দিক নির্ণয় করে ইমেজ ক্যাপচার করে থাকে। সূর্যোদয় থেকে বেশ কিছু সময় এবং সূর্যাস্তের আগে কয়েক ঘণ্টা আলো সবচেয়ে আকর্ষণীয় থাকে। বিখ্যাত আলোকচিত্রগুলো এই দুই সময়ের আলোতেই তৈরি। তবে তার মানে এই নয় অন্য সকল সময় ছবি হবে না। সন্ধ্যার পরের ছবির হিসেব করলে দেখা যায় ২৪ ঘণ্টাই ফটোগ্রাফি করা যায়। তবে গোল্ডেন লাইটে আকর্ষণীয় একটি ছবি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
যখন আমরা নান্দনিক একটি আলোকে চিনতে পারব তখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ভালো কম্পোজিশন। যদি ফটোগ্রাফার ছবিকে নান্দনিকভাবে কম্পোজ না করতে পারে তাহলে যত নাটকীয় আলোই থাকুক না কেন তা কোনো কাজে আসবে না।
আরও পড়ুন--ফটোগ্রাফি কম্পোজিশন ও তার দর্শন।
আবার ভালো কম্পোজিশন করার জন্য পর্যাপ্ত টেকনিক জ্ঞান আবশ্যক। ক্যামেরার টেকনিক নিয়ে আলাপে আমরা তিনটি বিষয়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেব—অ্যাপারচার, শাটার ও আইএসও। তিনটিই আলো নিয়ন্ত্রণ করে।
সাধারণত অ্যাপারচার নাম্বার পরিবর্তন করে বিষয়ের গভীরতা আমরা ঠিক করি। ২.৮ অ্যাপারচারে ফোকাসকৃত অংশ ছাড়া আশেপাশে অস্পষ্ট হয়ে যায়। আবার অ্যাপারচার ১৮-তে আমরা সম্পূর্ণ অংশ পরিষ্কার পাব। এই যে স্পেসকে বিভিন্নভাবে দেখা ও দেখানো, গভীরতা নির্ধারণ করার মধ্যে দিয়েই এই কাজটা করে অ্যাপারচার।
একটা ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফিতে আমরা হাই অ্যাপারচার ব্যবহার করব, কারণ আমরা সম্পূর্ণ ছবির চিত্র চাই। আবার একটি পোর্ট্রেট ক্যাপচার করতে গিয়ে আমরা লো অ্যাপারচার দিয়ে শুধু ফোকাসকৃত অংশের চিত্র চাইতে পারি। আবার শুধু মুখের ছবি যদি নেই সেক্ষেত্রে হাই অ্যাপারচার ব্যবহার করতে পারি, কারণ আমরা সম্পূর্ণ মুখের ডিটেইল চাই। অ্যাপারচার একটি ইমেজের কোথায় এবং কতটুকু গভীরতা থাকবে তা নির্ধারণ করে।
শাটার স্পিড আলো নিয়ন্ত্রণ করলেও সে গতি নিয়ন্ত্রণ করে। স্লো শাটার স্পিড দিয়ে ফটোগ্রাফার লো লাইটে ভিন্ন রকম ছবি তৈরি করতে পারে। আবার আর্টিফিশিয়াল লাইটে হাই স্পিড শাটারে প্রচণ্ড গতির বস্তুকে ফ্রিজ করে দিতে পারে। একটি মুভিং ইমেজ যে ভিডিও আকারে চলে তাকে ফ্রিজ করে দিয়ে একটি স্থির চিত্র বের করে আনার কাজটা শাটার স্পিড করে থাকে।
আর আইএসও একটি ইমেজের এক্সপোজার নির্ধারণ করে। ২০০ আইএসও-তে আপনি যে আলো পাবেন ৪০০-তে তার দ্বিগুণ পাবেন। ফটোগ্রাফার লো লাইটে আইএসও হাই করে ছবি ক্যাপচার করে। আবার যখন সে পর্যাপ্ত আলো পায় তখন জেনারেলের চেয়ে কমিয়ে ছবি ক্যাপচার করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ১০০ আইএসও-তে ছবি ক্যাপচার করা, যেটায় কালার কনট্রাস্ট ও টোন ৪০০ আইএসও-এর চেয়ে ভালো হওয়ার কথা।
একজন ফটোগ্রাফার যদি অ্যাপারচার, শাটার স্পিড ও আইএসও এই তিন বিষয়কে আয়ত্তে না আনতে পারেন তার ছবি মিস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এই তিন বিষয় দিয়ে একটি ছবির এক্সপোজার নিয়ন্ত্রিত হয়। মানে একটি ছবির এক্সপোজার কেমন হবে বা কী হবে। ফটোগ্রাফি টেকনিক পুরোটাই বলা যায় এক্সপোজার দেওয়ার কলা-কৌশল।
এবং এক্সপোজার দিতে পারার সাথে সাথে আমাদের ফোকাল লেন্থ নিয়ে আলাপ করতে হয়। ফোকাল লেন্থ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনি যদি ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফি ১০০ মিমি-তে ক্যাপচার করেন তাহলে ইমেজের জুম করা অংশ পাবেন। ছবিটা সংকুচিত হবে এবং জুম করার কারণে ডিটেইলও হারাবেন। কিন্তু আপনি যদি ১৬ মিমি-তে একই ল্যান্ডস্কেপ ক্যাপচার করেন তাহলে ছবিটা বিস্তারিত পাবেন। আর অ্যাপারচার যদি ২২ বা তারও বেশি দেন তাহলে আপনি ডিটেইলও পাবেন। আবার আপনি যদি একটি মুখচ্ছবি ক্যাপচার করেন ১৬ মিমি দিয়ে তাহলে ছবিটি হয়তো অস্বাভাবিক দেখাবে, কারণ ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স খুব কাছের বস্তুকে বড় দেখায়। সেক্ষেত্রে আপনার ৮৫ মিমি ভালো অপশন। ভালো প্র্যাকটিস হলো নির্দিষ্ট একটি ফোকাল লেন্থকে অনুশীলনে রাখা এবং দক্ষতা অর্জন করা, এবং এই জ্ঞান রাখা যে কখন কোন ফোকাল লেন্থ ব্যবহার করতে হবে।
ফটোগ্রাফার যখন সঠিক এক্সপোজার দেওয়া ও ফোকাল লেন্থের ব্যবহার শিখে যায় তখন তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ফটোগ্রাফি কম্পোজিশন। ভিউয়ারকে ছবি দেখানোর তরিকা প্রয়োগ করে ফটোগ্রাফার ঠিক করে দেন ভিউয়ার কিভাবে তার ছবি পাঠ করবে। সেক্ষেত্রে তিনি বেশ কিছু ফটোগ্রাফি টেকনিক ব্যবহার করে থাকেন।
আমরা রুলস অফ থার্ডের কথা জানি, বা গোল্ডেন আওয়ার ফটোগ্রাফি মানে উৎকৃষ্ট সময়ের আলোতে ছবি ক্যাপচার করা। কিংবা ফটোগ্রাফার ছবিতে লাইন ব্যবহার করে ভিউয়ারের দৃষ্টিকে প্রভাবিত করতে পারে। সেক্ষেত্রে সাধারণ একজন ভিউয়ারের চোখ লাইনকে ফলো করে বা করতে বাধ্য হয় তার স্বভাব অনুসারে। অথবা রঙিন আলোকচিত্রের ক্ষেত্রে রঙের প্যাটার্ন ঠিক রাখা—এমন অসংখ্য কৌশল ব্যবহার করা যেতে পারে ফটোগ্রাফি কম্পোজিশনে।
আলোকচিত্রই একটি স্পেসের জ্যামিতি কে পাঠ করে বিয়োগ করে একটি কম্পোজিশন করে। ফটোগ্রাফি টেকনিক দিয়ে ভিজ্যুয়ালের সাহিত্যকে অনুসরণ করা হয়।
আমরা যদি ফটোগ্রাফির ক্যাটাগরি ও সাব-ক্যাটাগরি নিয়ে আলাপ করি, তাহলে প্রত্যেকটি ক্যাটাগরির জন্য আলাদা আলাদা টেকনিক আমরা দেখতে পাই। স্ট্রিট ফটোগ্রাফি এক ধরনের টেকনিক এবং ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফির জন্য আরেক ধরনের। দিনে ছবি ক্যাপচার করার জন্য এক রকম, আবার রাতে লং এক্সপোজারে ছবির জন্য আরেক ধরনের। ফটো জার্নালিজমে এক ধরনের টেকনিক, আবার ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফির জন্য আরেক ধরনের।
যেহেতু একেক ক্যাটাগরির ছবি একেক ধরনের, সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ফটোগ্রাফি টেকনিক আমরা টেক্সটবুক থেকে শিখতে পারি। তবে ফটোগ্রাফি টেকনিক আয়ত্ত করার মূল উপায় অনুশীলন। এবং সবাই সব ধরনের ফটোগ্রাফি করবে না। অতএব সকল টেকনিক তার জানারও প্রয়োজন নেই।ফটোগ্রাফার যে ক্যাটাগরির ছবিতে আরাম ও আনন্দ বোধ করবে, সেই ক্যাটাগরির টেকনিক সে রপ্ত করতে থাকবে।
সাইদ সুমন
৩০,০৯,২০২৫