Posts

ভ্রমণ

স্মৃতিময় ভ্রমনঃ রূপসা ভৈরব ঢাংমারি কিংবা কীর্তিনাশার কোল ঘেঁষে

October 3, 2025

সাজিদ রহমান

189
View

হাসির দমক উঠলো ঠিকই, তবে এর জন্য ইউসুফ সরকারকে হাজির করতে হলো। 

এই ঘটনার অবতরণ হয় মিরপুর-১ এর একটা রেস্টুরেন্টে। আমরা সকালে বাগেরহাট থেকে রওনা হয়ে ঘুরতে ঘুরতে ঢাকা চলে এসেছি। সাফিয়া, সাফিন, ওদের মা ও আমি, সকলেই বেশ ক্ষুধার্ত। পাইক পাড়া থেকে একটা থ্রি হুইলারে চেপে মিরপুর এক নম্বরের একটা রেস্টুরেন্টে এসে বসেছি। ডিসেম্বর শেষ প্রায়। তারপরেও রেস্টুরেন্টের ভিতরে বেশ গরম। ওয়েটারকে কিছুক্ষণের জন্য ফ্যান ছেড়ে দিতে বললাম। কিন্তু সে কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বাইরে চালান করে দিয়েছে। ঐ ছেলে এদিক ওদিক যাচ্ছে, অর্ডার নিচ্ছে, কিন্তু ফ্যান ছাড়ছে না। ছেলেটাকে ইশারায় আবার ডাকলাম। কাছে আসলে বলি, কিরে ভাই, ফ্যান ছাড়তে কী ইউসুফ সরকারকে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে? এরপর আশেপাশের লোকজনও হাসতে শুরু করে। ফ্যান ছেড়ে দেয়। 

তিন দিন হয় আমরা ঘুরতে বের হয়েছি। ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখ, বুধবার সন্ধ্যায় পার্বতীপুর থেকে সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেন ধরি। আমাদের গন্তব্য খুলনা। এবারের এই ভ্রমণকে টুর অব মেমরি’ বলা যেতে পারে। সরকারের আদেশে ২০১৫ এর শুরুতে বাগেরহাটে জয়েন করি। এরপর পৌনে দুই বছর এই ট্রেনে বহুবার খুলনা-পার্বতীপুর যাওয়া আসা করেছি। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে পদোন্নতির পরে লালমনিরহাটে জয়েন করার জন্যে এই ট্রেনেই ফিরি। বাগেরহাটে থাকতে সাফিনের জন্ম হয়। ৩ ম্যাস বয়সী সাফিনকে নিয়ে উত্তরবঙ্গে ফিরে আসি। এরপর আর ওদেরকে নিয়ে ওইদিকটায় যাওয়া হয়নি। সব মিলিয়ে খুলনা বাগেরহাট সুন্দরবন ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাবে সকলে রাজি হয়ে যায়।

খুব ভোরে খুলনা স্টেশনে এসে নামি। খুলনা সওজ এর পরিদর্শন বাংলোতে আশ্রয় নেই। কিছু সময়ের জন্য। এরপর ছুটে যাই খুলনা ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনে। এই হাসপাতালে সাফিনের জন্ম। সাফিন প্রথমবারের মত এই হাসপাতাল দেখছে। অনেক দিন ধরে সাফিনের খুব শখ ট্রেনে করে ঘুরতে যাওয়ার। হয় হবে করে ট্রেনে ভ্রমণ আর হয়নি। সব মিলিয়ে এটা ছিল মোক্ষম সুযোগ, পূরা খাপের খাপ মমতাজের বাপ। যদিও ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডে থাকার সুবাদে আমরা বহুবার ট্রেনে উঠেছি। সাফিন ঐ সময় পুচকে ছিল,মনে থাকার কথা নয়। আমাদের ট্রেন ইউরোপিয়ান ট্রেনের চেয়ে বেশি নৃত্য করে। যারা নিয়মিত চড়েন, তাদের জন্য বেশ আনন্দের। আমি নিজেও ট্রেনের ভ্রমণ খুব পছন্দ করি। ট্রেন জার্নির বিকল্প কিছু নেই। ওদের অবশ্য বেশ অস্বস্তি লাগে। 

যাহোক অবশেষে ট্রেনে চড়ার সেই শখ বেশ ভালভাবে মিটেছে।

২। 

পরের দিন বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে আমরা সুন্দরবনের গা ছুঁয়ে তৈরি “সুন্দরি” রিসোর্টে পৌঁছে যাই। তার আগে সকালে খুলনা শহরে ছোট্ট করে একটা চক্কর দেই। খুলনা শপিং কমপ্লেক্স, নিউ মার্কেট, এর আশেপাশের শপিং সেন্টারে ঘোরাঘুরি ও কেনাকাটার অনেক স্মৃতি আছে। প্রশস্ত রাস্তাঘাট, পরিচ্ছন্ন শহর, একই সাথে মানুষের ভিড় কম, এই তিনটি বিষয় খুলনাকে আলাদা করে রেখেছে। এ কারণে হয়ত অবেচতন মন এই শহরটাকে অনেক পছন্দ করে ফেলেছে। কিন্তু আমরা বহুদূরের মানুষ, সেই কারণে ভাল লাগলেও কাছে যাওয়ার সুযোগ কম। এক অর্থে খুলনা একটি ব্যতিক্রম শহর। দিনকে দিন এর জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। সারা দেশের চিত্র যেখানে ঠিক উল্টা। খুলনা একসময় ছিল শিল্প-কারখানার শহর। ছোটবেলায় পড়তাম খুলনা একটি শিল্প নগরী। অথচ সময়ের ফেরে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে খুলনার অর্থনীতি ছোট হয়ে এসেছে। কর্মের প্রয়োজনে মানুষ অন্যত্র পাড়ি দিয়েছে। ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থানের অভাব রাজধানী ঢাকায় জনসংখ্যার অসম্ভব চাপ তৈরি করছে। ঢাকার বাইরে সস্তায় শ্রমিক আছে, কিন্তু কারখানা নেই। ঢাকা বা এর আশপাশে কলকারখানা আছে, অথচ সেখানে জীবন যাত্রা ব্যয় বহুল। পলিসি মেকাররা শ্রমিকের এই সাপ্লাই ডিমান্ড চেইন কাজে লাগিয়ে ঢাকার উপর মানুষের চাপ অনেকাংশে কমাতে পারেন। খুলনা ময়লাপোতার মোড়ে ষাটগম্বুজ মসজিদের বনসাই আছে। সেটা পেরিয়ে রয়েলের মোড়ে নেমে ছবি তুলি। ভৈরব নদীর পাড়ে খুলনা শহর, সেই ভৈরবের উপরে অনিন্দ্য সুন্দর খাঁন জাহান আলী সেতু। ছবি তুলি সেই সেতুকে পিছনের ব্যাক গ্রাউন্ড বানিয়ে।

ব্রিজের ওপারে বাগেরহাট। সেখানে পা দিতেই মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। মায়ার টান অনুভব করি। এই সেই বাগেরহাট, একটা সময়ে যেখানে আমাদের দিন-মাস-বছর কেটেছে। কাটাখালি, চুলকাটি, দিগরাজ পেরিয়ে মোংলা ফেরি ঘাটের দিকে ছুটে চলি। যে পথ পেরিয়ে আসি, এক সময় সেই সকল রাস্তা, ফেরিঘাটের দায়িত্বে ছিলাম। এই সমস্ত পথের সাথে আমার অনেক জানাশোনা। মোংলা ফেরি ঘাটে আমাদের স্বাগত জানায় সোহরাব। বাগেরহাট সড়ক বিভাগের স্টাফ হলেও ঐ এলাকায় অনেকে তাঁকে চিনে। অনেক দিন পর সেই ফেরি, ফেরিঘাট, স্টাফদের দেখে পুলক বোধ করি। আমাদের হাতে খুব বেশি সময় থাকে না। রিসোর্টের ট্রলার রেডি ছিল, সেটাতে উঠে পড়ি। করমজল ছেড়ে ডানে ডাংমারি নদীর পাড়ে একটা কুমিরকে রোদ পোহাতে দেখি। দেখা মিলে বেশ কিছু বানরেরও। সুন্দরবনে প্রবেশের আগে ওরা কি আমাদের স্বাগত জানালো? বাস্তবে সেটা হলে মন্দ হতোনা। 

৩। 

ঢাংমারি খালের উপর ম্যানগ্রোভ, ম্যানগ্রোভ হ্যাভেন, সুন্দরি, বনবিবি ফরেস্টসহ অনেক রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। আমরা বুকিং দিয়েছি সুন্দরি ইকো রিসোর্টে। আমাদের ট্রলার সুন্দরির পদতলে (উঠোনে) নোঙ্গর করে। কাঠের ফ্রেমের উপর নানা ডিজাইনে করা কটেজ। কটেজের সাথে লাগোয়া গোলপাতা গাছ। আর ঢাংমারির ওপারে সুন্দরবন শুরু। রিসোর্ট বেশ পছন্দ হয় সবার। 

দুপুরের খাবার পর্ব শেষ হয়। বিকেলে ছোট একটা নৌকা ভ্রমণ। সুন্দরবনের খালে কিছুদূর গিয়ে ফিরে আসা। সেই টুরে আমাদের সঙ্গী হয় ইংল্যান্ডের একটি কাপল। ওনারা ভালুকা হেলিবেরি স্কুলের টিচার। মেয়েটার নাম মিরিন্ডা। ছোটবেলায় শেক্সপিয়ারের নাটক টেম্পেস্ট পড়েছিলাম। ঐ গল্পের নায়িকার নাম মিরিন্ডা। সেই প্রসঙ্গ উঠতেই মিরিন্ডার জানায় ওর নাম টেম্পেস্টের নায়িকার নাম থেকেই ধার করা। ওদের সাথে বেশ আলাপ হয়। শেক্সপিয়ারের বার্থপ্লেস দেখার সুযোগ হয়েছিলো আমার। সেটা বলতেই মিরিন্ডা আমাকে জিজ্ঞেস করে, শেক্সপিয়ারের সবচেয়ে পঠিত নাটকের নাম জানি কিনা? আমাকে কনফিউজড দেখে সে বলে দেয়, জুলিয়াস সিজার। এটি দুনিয়ার প্রায় প্রতিটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সাফিয়ার সাথে মিরিন্ডার বেশ আলাপ হয়। সাফিয়ার ইংলিশ বাচনের ভূয়সী প্রশংসা করে। অল্প সময়ের জন্য হলেও নৌকা ভ্রমণ বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠে। 

সোহরাব আগেই বলেছিল, রিসোর্টের ইনচার্জের বাবা বাঘের মুখ থেকে ফিরে এসেছিলো। আমার বেশ আগ্রহ হয় নিজের মুখ থেকে সেই গল্প শোনার। অবশেষে ডিনারের আগে ইনচার্জ দেবাশিসের বাবার সাথে আলাপ হয়। 

২০১১ সালে সুন্দরবনে কাঠ কাটতে গিয়ে বাঘের মুখে পড়েছিলেন তিনি। গোপনে নিঃশব্দে জঙ্গলের ভিতর থেকে উড়ে এসে মুখ ও ঘাড়ে থাবা দিয়ে ধরে। মাথায় একটা মাফলার পেঁচানো থাকার কারণে ঘাড় মটকাতে সময় লেগে যায়। ঐ সময়ের মধ্যে উনার সঙ্গীরা বাঘকে একের পর এক আক্রমণ করলে সে পালিয়ে যায়। দেবাশিসের বাবার ঘাড় মুখ দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। সঙ্গীদের আপ্রাণ চেষ্টায় প্রাণে বেঁচে ফিরলেও মুখ বাঁকা রয়ে যায়, ভালভাবে খেয়াল করলে যে কেউ বুঝতে পারবে। এক সময় উনি বাঘের হামলার চিহ্ন দেখান। জোর করে আমার হাতটা সেখানে স্পর্শ করান। কেমন জানি শিউরে উঠি। আমরা যেখানে বসে এই গল্প শুনছি,সেটা ঢাংমারি খালের উপরেই। খালের ওপারেই সুন্দরবন। বাঘের মুখ থেকে ফিরে এসে আর কোনদিন সুন্দরবনে যান নি। তাঁর প্রতিবেশী এক নারীর মর্মান্তিক গল্প শোনান- যাকে বাঘ খেয়ে ফেলে গিয়েছিলো। গ্রামের লোকেরা সেই নারীর খোঁজ করতে গিয়ে এক বীভৎস লাশ দেখতে পায়। বাঘ ঘাড় মটকিয়ে পাছা, রানের মাংস ও দুই স্তন ছিন্ন ভিন্ন করে চলে গেছে। নিজের চোখে সেসব দেখে এবং বাঘের মুখ থেকে ফিরে এসে কেউ কি আবার সেখানে যেতে চাইবে? দেবাশিশের বাবাও চায়নি। 

৪। 

পরদিন শুক্রবার সকালে সোহরাব নৌকা নিয়ে চলে আসে। আমরা নাস্তা সেরে সেই নৌকায় উঠি। সারা দিনে যতটুকু দেখা যায়, এই হল চুক্তি। সোহরাব মোংলা থেকে খাবার নিয়ে এসেছে, দুপুরে নৌকায় বসে খেতে বেশ লাগে। সন্ধ্যায় মংলা ফেরিঘাটে ফেরার আগে করমজল ও আন্ধারমানিক পয়েন্ট দেখে ফেলি। সুন্দরবন মানে সুন্দরী, গেওয়া, কেওড়া, গোলপাতা, গড়ান, পশুর সহ অনেক প্রজাতির গাছ। এদের মধ্যে কিছু গাছের আঠা অনেক বিষাক্ত, কারও স্পর্শে আসলে মানুষ মারাও যেতে পারে। সুন্দরবনের প্রধান নিরাপত্তা প্রহরী হল রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সুন্দরবনে বাঘ না থাকলে সুন্দরবন এতদিনে উজাড় হয়ে যেত। আর এই সুন্দরবন না থাকলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে যাবে। ১৯৭০ এর ভোলা ঘুর্নিঝড়, আইলা, সিডর, নার্গিসদের ভয়াবহ তাণ্ডব ঠেকিয়ে দিয়েছে দেশের দক্ষিণের এই বন-প্রাচীর, নির্ঘুম প্রহরীর মত।    

সন্ধ্যা বেলা সুন্দরবন থেকে ফেরার পথে নদীর উপর আলো আধারির খেলা 

আগের দিন বিকেলে একটা ভ্যান ভাড়া করে পাশের গ্রামে ঢু মারি। ঢাংমারি নদীর নামেই এলাকার নাম। খুলনার দাকোপ উপজেলার মধ্যে পড়েছে। এই এলাকায় সনাতন ধর্মের মানুষ সংখ্যাগরিস্ট। বেশ রিমোর্ট  হলেও পাকা রাস্তা আছে। ছোট একটা বাজার দেখে নামি। গরম গরম গুড়ের জিলাপি আর পুরি কিনি। সেই ফাকে দুয়েক জনকে জিজ্ঞেস করি। ওপার বাংলা থেকে অনেক রকম খবর প্রচারিত হচ্ছে। আদতে তাদেকে কী কোন অবিচার বা হিংস্রতার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে? আমার প্রশ্নের জবাবে জানান, ৫ই আগস্টের পর কয়েকদিন সকলের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করেছে। এখন সব ঠিকঠাক মত চলছে। তবে কিছুটা অস্বস্তি আছে বোঝা যায়। এই বিষয়ে আলাপ করে মনে হল, সবাই ভাবছে ওদের আশেপাশে ঠিকই আছে। কিন্তু টিভিতে যেহেতু বলছে, হয়ত অন্য কোথাও ওরকম ঘটনা ঘটছে। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, রংপুর, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, ঢাকা, খুলনা, প্রায় সকলের একই আশংকা। নেগেটিভ কিছু এমনিতেই দ্রুত ছড়ায়, পরিকল্পিতভাবে ভাবে এসব জিনিস ছড়ালে ভয়াবহ হবে, সেটাই স্বাভাবিক। সাংবাদিকতার ছাত্রদের কাছে নতুন একটি জানালা উন্মুক্ত করে দিয়েছে ওপারের ময়ূখ রঞ্জন গং।

৫। 

অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই। আমরা যখন সুন্দরবন, খুলনা, বাগেরহাটে ঘুরে দেখছি, ঐ সময় বাংলাদেশের একটা দল এন্টার্টিকা থেকে শুরু করে জর্জিয়া, গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ, আমাজন ইত্যাদি সহ দুনিয়ার সবচেয়ে দুর্গম পথে বেরিয়ে পড়েছে। সেই টুরে আছে তারেক অণু, যে আদতে আমাদের বন্ধুর বন্ধু। অনেক আগে তাঁর হাত থেকে তাঁর লেখা ভ্রমণ সমৃদ্ধ বই ‘পৃথিবীর পথে পথে’ পেয়েছিলাম। তবে সত্যি হল, তারেক অণুরা ব্যতিক্রম, ওদের দিয়ে বাকিদের তুলনায় আনা যাবে না। এখনও ভ্রমণ আমাদের কাছে বিলাসিতার নামান্তর, অর্থহীনও বটে। যদিও ধীরে ধীরে সেই মনোভাব থেকে মানুষ বের হয়ে আসছে, কিন্তু পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব এবং অত্যধিক খরচের আশংকায় ঘরকুনো মানুষ কুয়ার ব্যাঙ হয়েই দিনাতিপাত করছে। তবে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়, চাকরির সুবাদে ২০১৫ সালের মধ্যে ৬৪ জেলায় অন্তত পা দিয়েছি। প্রতিবছর পরিবারকে ২/৩ টা নতুন জেলা দেখানোর চেষ্টা করি। যেকোন কিছু বুঝতে হলে আগে দেখা দরকার। দেশকে বুঝতে হলে, ভালবাসতে হলে সারা দেশটা দেখা খুব প্রয়োজন।  

লেখক ও পরিবার ষাটগম্বুজ মসজিদের সামনে 

৬। 

আমাদের এবারের এই ভ্রমণ সূচির অন্যতম গুরুত্বপুর্ন নাম বাগেরহাট, শরীয়তপুর ও পদ্মাসেতু। বাগেরহাটের দিনগুলোর কথা বিশেষ করে বলতে হয়। সাফিয়া খুব ছোট, বিকেলে টেনিস খেলতে বের হলেই কান্না কাটি করে বসে। সাফিন মাত্রই দুনিয়ার আলো দেখেছে। এরপর অনেকটা লম্বা সময়ের পর এই সফর। একটা সন্ধ্যা আমরা বাগেরহাটে থাকি। এই অল্প  সময়ে সাফিয়া ঘুরে ঘুরে ওর স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়। বাগেরহাটে সাফিনের জন্ম। ওকে সে কথা মনে করিয়ে দিই। শুনে এদিক ওদিক তাকায়, কিছু খুঁজে হয়ত। পরদিন সকালে ফেরার সময় আমরা ষাটগম্বুজ মসজিদে ঢুকি। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এই মসজিদ যত দেখি, ভালো লাগা ফিকে হয় না। 

 শরীয়তপুরে প্রায় ৮ মাস চাকরি করেছি। অল্প দিন হলেও এই জেলা বেশ মায়া তৈরি করেছে। শরীয়তপুর শহর গড়ে উঠেছে কীর্তিনাশা নদীর কোল ঘেঁষে। সেই নদীর উপর একটা সেতু নির্মিত হবে। উপযুক্ত স্থান নির্ধারনের জন্য সরেজমিন পরিদর্শন করছি। এলাকার এক মুরুব্বি এগিয়ে আসেন। ব্রিজ নির্মান হবে শুনে খুব খুশি। কথায় কথায় জানতে পারি, ব্রিজ হলে শহরে মাইর দিয়ে দ্রুত বাড়িতে ফিরতে পারবেন। ব্রিজ না থাকায় এতদিন শুধু মাইর খেয়েই যাচ্ছেন। সেই কথা মনে পড়লে এখনও হাসি পায়। প্রত্যেক এলাকার আলাদা সৌন্দর্য আছে। সেটা অনুভব করতে পারলে ঠকার কোন সুযোগ নেই। এখানে থাকতে কোভিড-১৯ এর শুরুতে করোনায় আক্রান্ত হই। কোভিডের মৌসুম ছিল বলে ওদের আসা হয়নি তখন। পথে মাদারীপুর পড়ে। সে শহরে একটা চক্কর দিয়ে আসি। মাদারীপুরের শকুনি দিঘি বা মাদারীপুর লেইক এই শহরটাকে একটা অনন্য রূপ দিয়েছে। আমাদের নিজ জেলার কেন্দ্রে আছে গোরে শহীদ ময়দান নামের এক বিশাল মাঠ। মাদারীপুরের কেন্দ্রে অবস্থিত এই দীঘিও শহরটাকে একটা ভিন্ন রূপ দিয়েছে। 

শরীয়তপুর থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। এবং পথে পদ্মা নদীর উপর নির্মিত পদ্মা সেতু দেখি। এই সেতুর গুরুত্ব তিনি বুঝবেন না, যিনি সেতু হওয়ার আগে এই পথ পাড়ি দেননি। যিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাটে আটকে থাকেন নি, যিনি দ্রুত পার হতে চেয়ে স্পিড বোটে জীবন বাজি রেখে পার হননি। জাজিরা প্রান্তে ব্রিজের গোঁড়ায় আমার এক সহকর্মী আসে দেখা করতে। তাঁর সহায়তা নিয়ে বেশ কিছু ছবি তুলি। এবং প্রথমবারের মত সেতুর উপর দিয়ে পার হয়ে যাই, সত্যি একটা অন্য রকম অনুভূতি কাজ করে। পদ্মা সেতু পার হয়ে আমরা ঢাকা ঢুকি। পাইকপাড়ায় রেস্ট হাউজে মালামাল রেখে মিরপুর-১ এ রাতের খাবার খেতে যাই।

সেখানেই ফ্যানের সুইচ দেয়া নিয়ে ইউসুফ সরকারকে হাজি করতে হয়। 

৭। 

    

পরের দিন আমাদের গন্তব্য সোনারগাঁয়ে। ঈশা খাঁর জমিদার বাড়ি, লোকশিল্প জাদুঘর দেখে পানাম সিটিতেও ঢু মারি। সেখান থেকে ফেরার সময় মনে পড়ছিল র‍্যালফ হাডসনের সেই বিখ্যাত কবিতার-যেখানে তিনি লিখেছেন ‘Time, you old gypsy/ why hasten away?/Last week in Babylon/Last night in Rome/ Morning, and in the crush Under Paul’s dome’ সোনারগাঁ-এক সময়ের বাংলার রাজধানী ছিল। সময়ের আবর্তনে এখন একটি উপজেলা মাত্র। প্রাচীন নগর সভ্যতার নিদর্শন পানাম সিটিতে এখন কেউ বসবাস করে না। সময় এক পাগলা ঘোড়া, এক জায়গায় স্থির থাকে না কখনই। সোনারগাঁও থেকে আমরা চলে আসি ঢাকায়। তার আগে বাংলার তাজমহলে ঢুকি। অনেক টুরিস্ট সেখানে। কর্তৃপক্ষ এটা তৈরিতে অনেক অর্থ ঢেলেছে নিশ্চয়। পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য তাজমহলের রেপ্লিকা তৈরি করার সময় নির্দিস্ট নিয়ম, মাপ মেনে করা উচিৎ ছিল। বাস্তবে এনারা কোন কিছুর ধার ধারেন নি। পাশে যে পিরামিড আছে-সেটার বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। 

অনেক মানুষ বলে গাঁটের পয়সা খরচ কষ্ট কেনার নামই ভ্রমণ। অনেকে মজা করে ওদেরকে কুয়ার ব্যাঙ বলে থাকে। তবে আমার মনে হয়, জীবনকে জানতে হলে পথে নামার বিকল্প নেই। দূরে কোথাও গান বাজছে। জেমসের ভরাট গলায় শোনা যাচ্ছে, “পথের বাপই বাপরে মনা/পথের মা’ই মা/এই পথের বুকেই খুঁজে পাবি/আপন ঠিকানা......”। 

Comments

    Please login to post comment. Login