Posts

উপন্যাস

মাদার মেরি কামস টু মি

October 13, 2025

saleh muhammed

173
View

বই : মাদার মেরি কামস টু মি

মূল : অরুন্ধতি রয়

অনুবাদ : সালেহ মুহাম্মদ

প্রথম অধ্যায়

গুন্ডা

তো তিনি সেপ্টেম্বার মাসটাকেই বেছে নিলেন। কি চমৎকার মাস এই সেপ্টেম্বার। তাঁরও মনে হলো এইতো মোক্ষম সময়। ক'দিন হয় বর্ষা গেল। সদ্যস্নাত কেরালা এক পান্না সুতিকার মতো ঝিকমিক করছিল সাগর আর পর্বতমালার মাঝে। অবতরনের জন্য প্রস্তুত হয় বিমান। নিচের জমিন যেন উথলে উঠে আমাদের আগলে ধরার জন্য। ভৌগোলিক বাস্তবতাও যে শরীর ও মর্মে এতটা বেদনা জাগাতে পারে তা আমার জানা ছিল না। চিরদিনের প্রিয় এই দৃশ্যাবলী আমি কোনো দিন তাঁকে ছাড়া জানি নাই। স্মৃতির সৃজনেও কল্পনা করি নাই। তাঁকে বাদ দিয়ে এই পর্বতমালা, বৃক্ষরাজি আর সবুজ নদীসব - ওদের কে আমি ভাবতেই পারি না। এই ক্ষীয়মান, সিমেন্টে বিলীন ধান ক্ষেতের ওপর গজিয়ে উঠতে থাকা বিয়ের শাড়ির বিদঘুটে, বা আরও খারাপ, গহনার বিজ্ঞাপন প্রচার করতে থাকা বিলবোর্ডগুলো তাঁকে ছাড়াও বিদ্যমান হয় তাহলে। এই সমস্ত কিছুর বুননে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। আমার মনোজগতের যেকোনো বিলবোর্ডকে হার মানায় তার দীর্ঘ কায়া। দুকূল ভাসিয়ে দিতে উন্মুখ নদীর চেয়েও বিপদজনক এক অস্তিত্ব। অতিবর্ষণে মতো জেদি ও নিরলস। সমুদ্রের মতো সদা উপস্থিত। এমন কি করে হয়? কীভাবে? কিছু না জানিয়েই তিনি এভাবে চলে গেলেন। বরাবরের মতোই সবাইকে চমকে দিয়ে।

গির্জা তাঁকে নিতে চাইলো না। তিনিও তো কোনোদিন চাননি ওই গির্জাকে। (এখানে বিশাল এক গেঞ্জামের ইতিহাস আছে, যা ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কহীন)। সুতরাং আমাদের মফস্বলে তার অবস্থান, এবং এই এলাকার ভাব বিবেচনা করে তাঁর জন্য মানানসই একটা শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করতে হলো। স্থানীয় পত্রিকাগুলো একদম প্রথম পাতায় তাঁর মৃত্যুর সংবাদটি ছাপালো। বেশিরভাগ জাতীয় পত্রিকাও প্রকাশ করল খবরটা। অন্তর্জালে প্রবল আলোড়ন উঠল। তাঁর বহু প্রজন্মের ছাত্রদের থেকে একের পর এক আসতে লাগল ভালোবাসার বার্তা। এই ছাত্ররা তাঁর হাতে গড়া স্কুলে পড়েছে। তাঁর সান্নিধ্যে পাল্টে গিয়েছিল তাদের জীবন। অন্যরা চিনতেন তাঁর কেরালার কিংবদন্তিতুল্য আইনি লড়াইটির জন্য। কেরালার খ্রিস্টান মহিলাদের সম্পত্তিতে সমান উত্তরাধিকারের জন্য ছিল তিনি লড়েছিলেন, এবং বিজয় নিয়ে ফিরেছিলেন। তার জন্য উপযুক্ত এক শেষকৃত্যের আয়োজনকে আরও জরুরি করে তুলল শোকবার্তার সেই মহাপ্লাবন। সঠিকভাবে তাকে তো বিদায় জানাতেই হয়। কিন্তু কী করলে সেটা সঠিক হবে? ভাগ্যের কথা হলো, যেদিন তিনি মারা গেলেন সেদিন ছিল স্কুল ছুটি। বাচ্চারা সব বাসায় চলে গিয়েছিল। গোটা ক্যাম্পাসটাই আমাদের। বাঁচা গেলো। কে জানে, হয়তো এটাও তাঁর কোনো এক পরিকল্পনা।

তার মৃত্যু এবং সেটি ঘটলে আমাদের কী হবে, বিশেষ করে আমার, সেই আলোচনা শুরু হয় যখন আমার বয়স তিন। তার বয়স তখন তিরিশ। অ্যাজমায় কাতর। কপর্দকশূন্য। (একমাত্র সম্পদ বলতে একটা ব্যাচেলরস ডিগ্রি)। সদ্যই পরিত্যাগ করেছেন স্বামীকে—যিনি ছিলেন আমার পিতা, বলতে কেমন অস্বস্তি হয় কেন জানি। যখন তিনি মারা যান তার বয়স হয়েছিল প্রায় ঊননব্বই। সুতরাং আমাদের হাতে ষাট বছর ছিল তার সমাগত মৃত্যু এবং তার উইল ও ইচ্ছাপত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য। উত্তরাধিকার, উইল—এই বিষয়গুলো নিয়ে তার একরকম বাতিকের মতো হয়ে গিয়েছিল। দুই সপ্তাহ পরপরই তিনি নতুন করে উইল লিখতেন। কতবার যে সবাই ভাবলো এবার বুঝি  মৃত্যু তাঁকে নিয়েই গেলো। সেই অসম্ভব সব পরিস্থিতি থেকে প্রতিবারই তিনি বেঁচে ফিরেছেন। সেগুলোর হিসাব করতে গেলে ক্ষনিকের জন্য স্তম্ভিত হবেন খোদ হুডিনীও। এসবের ফলে যেটা হলো যে, ওই মহা বিপর্যয় নিয়ে আমাদের একপ্রকার ঔদাসীন্য চলে আসলো। আমি বিশ্বাস করতে লাগলাম আমার জীবনাবসানের পরও তিনি বেঁচে থাকবেন। যখন তেমনটি ঘটলো না, আমি একদম ভেঙে পড়ি। আমার হৃদয় চুরমার হয়ে যায়। আমি হতভম্ব এবং বেশ খানিকটা লজ্জিতও হই আমার এই প্রবল প্রতিক্রিয়ায়। 

আমার ভাই সেই বেদনাকে আরো তীব্র করে তোলে। ‘তুমি এমন করছ কেন আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। তুমিই তো সেই মানুষ যার সাথে তিনি সবচেয়ে বেশি বাজে আচরণ করেছেন।’ তার কথা ঠিক হতেও পারে। যদিও আমার সবসময় মনে হয়েছে সবচেয়ে খারাপ আচরণ পাওয়া মানুষটা আমি না, আমার ভাই। ও কি ভাবছে আমি বুঝতে পারছিলাম, যে আমি বোধহয় ইচ্ছা করেই ভুলে যাচ্ছি শৈশবে আমাদের সাথে কী ঘটেছিল। এবং তেমনটি করে আমি নিজেকেই অপমান করছি। আমি কিন্তু আসলেই ওসব পিছে ফেলে এসেছি বহুদিন হয়। এই জগতের এমন সব দুর্দশা, এমন নিয়মতান্ত্রিক নির্যাতন আর বঞ্চনা, এমন ভয়াবহ বীভৎস অসভ্যতা, নারকীয়তার এমন সব প্রকারান্তর আমি দেখেছি এবং সেসব নিয়ে লিখেছি যে তার পরে নিজেকে পৃথিবীর অন্যতম ভাগ্যবানদের একজন না ভেবে আর পারি না। প্রকৃতই গুরুত্বপূর্ণ যা কিছু ঘটে, তার নিচে এক পাদটীকার মতো আমার এই জীবন। এখানে গভীর দুঃখের কোনো ব্যাপার কখনই নেই। বরঞ্চ সবটাই বেশ হাস্যকর। আবার হতে পারে আমি নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার জন্যই এই মিথ্যে বলে থাকি। এসব রূঢ় বাস্তবতার মাঝে অবস্থান নিয়েছি হয়তো ইচ্ছে করেই। যেন সেই কঠিন বাস্তবতার অতিশায্যে আমার হৃদয়ের সব যন্ত্রণা তুচ্ছ হয়ে যায়। হয়তো আমি যা লিখতে যাচ্ছি তা হবে আমার তরুণ সত্তার সঙ্গে আজকের  পরিণত সত্তার একপ্রকার বিশ্বাসঘাতকতা। তাই যদি হয় তবে এটি মোটেও কোনো লঘু পাপ নয়। কিন্তু সেটা বিচার করার অবস্থানে তো আমি নেই।

                                                 —-------------------------


 

আঠারো বছর বয়সে আমি গৃহত্যাগ করি। বা বলা যায় বাড়িতে- বা বাড়ির মতন যা একটা কিছু ছিল- সেখানে যাওয়া বন্ধ করে দেই। তখন আমি মাত্রই দিল্লির স্কুল অফ আর্কিটেকচারে তৃতীয় বর্ষ শুরু করেছি।


 

তখনকার দিনে আমাদের হাইস্কুল শেষ হতো ষোল বছর বয়সে। ১৯৭৬ সালের গ্রীষ্মে আমি যখন নিজামউদ্দিন স্টেশনে পৌঁছালাম তখন আমার বয়সও ও-ই ছিল। স্টেশনে আমি এসেছিলাম একদম একা। কাজ চালানোর মতো হিন্দিটাও জানি না। যাবো স্কুল অফ আর্কিটেকচার এ প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে। কি যে ভয় পাচ্ছিলাম। ব্যাগের মধ্যে একটা ছুরি পর্যন্ত নিয়ে এসেছিলাম। কোলচিন থেকে ট্রেনে দিল্লি যেতে তিন দিন দুই রাত লাগতো তখন। সেই কোলচিন আমাদের মফস্বল, কটায়াম, থেকে তিন ঘণ্টার পথ গাড়িতে গেলে। কটায়াম থেকে আবার কয়েক কিলোমিটার দূরে ছিল আমাদের গ্রাম আয়ামিনেম, যেখানে কেটেছে আমার শৈশবের একদম প্রথম দিনগুলো। অন্যভাবে বললে, দিল্লি ছিলো আমার জন্য পুরোই এক ভিন্ন দেশ। সেখানকার ভাষা ভিন্ন, খাবার ভিন্ন, আবহাওয়া ভিন্ন, সবকিছুই ভিন্ন। এই শহরের পরিধি আমার মাথায় আঁটতো না। আমি এমন এক জায়গা থেকে এসেছিলাম যেখানে সবাই জানে কে কোথায় থাকে। তাই বোকার মত, এক অটোরিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি আমাকে আমার মা’র বড় বোন মিসেস জোসেফ-এর বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন কিনা। আমি ধরেই নিয়েছিলাম তিনি জানেন আমার বড় খালা কোথায় থাকেন। অটোরিকশাচালক বিড়িতে গভীর টান দিয়ে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তার চোখে ছিলো প্রবল উদাসীনতা এবং বিরক্তি। এর দুই বছর আমি নিজেই তখন বিড়ি টানছি। আমিও চোখে মুখে সেই বিরক্তি এবং উদাসীনতা ফুটিয়ে তুলতে শিখে গেছি। সময়ের পরিক্রমায় আমার ব্যাগের সেই ছুরিটার বিনিময়ে বেছে নিয়েছি হাশিশের চমৎকার সাপ্লাই এবং বড়-শহুরে অভিব্যক্তি। আমি পরিণত হয়েছি পূর্ণ এক ভিনদেশীতে।

মাকে ছেড়ে আসার কারণ তাকে ভালোবাসি না এমন নয়। বরং তাকে যেন চিরদিনই ভালোবাসতে পারি সেই জন্য়ই তাকে ছেড়ে আসা। তার সঙ্গে রয়ে গেলে সেটা অসম্ভব হতো। বাড়ি ছাড়ার পর, আমি বহু বছর তাকে দেখিনি, একটি কথাও বলিনি। তিনিও আমার খোঁজ করেননি কখনও। তিনি একবারের জন্যও জানতে চাননি কেন আমি চলে গেলাম। প্রয়োজনও ছিল না। আমরা দুজনেই জানতাম কারণটা। একটা মিথ্যের উপরে স্থির হয়েছিলাম আমরা। বেশ ভালো একটা মিথ্যে। আমার নির্মিত সেই মিথ্যেটি ছিল— ‘তিনি এতটাই ভালোবাসতেন যে আমাকে ছেড়ে দিতে তার কোনো সমস্যা হয়নি।’ এই কথাটাই লিখেছিলাম আমার প্রথম উপন্যাসের প্রারম্ভে, The God of Small Things, যে বইটাও তাকেই উৎসর্গ করা। তিনিই প্রায়ই এই কথাটা উদ্ধৃত করতেন। যেন সেটি কোনো ঈশ্বর বর্ণিত সত্য। আমার ভাই মজা করে বলতো যে ওই একটাই সত্য কাহিনি রয়েছে পুরো বইটার মধ্যে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি জানতে চাননি আমার গৃহত্যাগী ওই সাত বছরে কিভাবে বেঁচে ছিলাম। কখনও জিজ্ঞেস করেননি আমি কোথায় থেকেছি। কিভাবে আমার পড়ালেখা শেষ করে ডিগ্রি নিয়েছি। আমিও বলিনি তাকে কোনোদিন। সমস্যা তাতে কিছু হয়নি। আমি ভালোই সামলে নিয়েছিলাম।

একসময় মা’র কাছে আমি ফিরলাম। সেটা বেশ দুর্বল এক পুনর্মিলন। আস্থার যথেষ্ট অভাব ছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে আমি নিয়মিত তাকে দেখতে যেতাম। তার কাছে আমি ফিরেছিলাম একজন স্বাধীন সক্ষম প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে। তখন আমি একজন যোগ্য আর্কিটেক্ট, একজন নন্দননির্মান নকশাকার, একজন লেখক। তবে সবচেয়ে জরুরি যেটা, আমি তার কাছে যেতাম এমন একজন নারী হিসেবে যে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় অভিভূত হয়ে আরেকজন নারীকে দেখছেন। একই সাথে তাতে মিশে ছিল বেশ খানিকটা দুশ্চিন্তা এবং অস্বস্তি। কারণ অসাধারণ সব গুণাবলীর সঙ্গে একদম বিপরীতধর্মী অনেক বিষয়ও তার মধ্যে ছিল। আমাদের সেই ক্ষুদ্র দক্ষিণ ভারতীয় মফস্বলটি ছিল দম আটকে আসার মতো অতি রক্ষণশীল। তখনকার দিনে সেখানে মহিলাদের সতীত্বের অতিশয়ন—বা তার ভান করা—ব্যতীত কোনো কিছুই করতে দেওয়া হতো না। এর মধ্যে আমার মা চলাফেরা করতেন কোনো এক মহাগুন্ডার মতো সদম্ভে। আমি দেখতাম কিভাবে তিনি নিজের সমগ্র অস্তিত্বের লাগাম ছেড়ে দিচ্ছেন। তার প্রবল মেধা, তার পাগলামি, তার বৈপ্লবিক মমতা, তার যুদ্ধংদেহী সাহস, তার একরোখামি, তার মহানুভবতা, তার নির্মমতা, তার অত্যাচার, তার ব্যবসায়িক বুদ্ধি, এবং তার বন্য, খামখেয়ালি মেজাজ—সবকিছুই তিনি পূর্ণ বিকশিত হতে দিয়েছিলেন। আমাদের সেই ক্ষুদ্র, অন্তর্মুখী সিরিয়ান খ্রীষ্টান সমাজের কোনো তোয়াক্কা না করেই। যেই সমাজ শিক্ষা এবং তুলনামূলক বেশি টাকাপয়সার কারণে দেশের বাকি অংশের নিরন্তর সহিংসতা এবং ধ্বংসাত্মক দারিদ্র্য থেকে একরকম বিচ্ছিন্নই ছিল। আমি দেখতাম সেই ছোট্ট  পৃথিবীর মধ্যে কিভাবে তিনি তার সমগ্র অস্তিত্বের, তার প্রতিটি সত্তার জন্য জায়গা করে নিতেন। সেটা কোনো অলৌকিক ঘটনার চেয়ে কম কিছু ছিল না—দেখে যেমন ভয় লাগতো, তেমনি জাগতো প্রবল বিস্ময়। 

 খোদ মাতৃত্বের ধারণাটির প্রতিই তিনি যেন অসম্ভব রেগে ছিলেন। এবং সেই রাগের প্রাবল্য আমার হৃদয় চুরমার করে ফেলতো। তবে একসময় সেই অদ্ভুত ক্রোধ থেকে নিজেকে (কিছুটা হলেও) রক্ষা করতে শিখে যাই। আর তখন বিষয়টির প্রতি মন খারাপের বদলে একরকম মুগ্ধতা কাজ করতে শুরু করে। তার সেই রাগ এতই খোলামেলা, এমন নগ্নভাবে প্রকাশ পেতো যে মাঝে মাঝে হেসেই ফেলতাম। মানুষ যে শব্দ করে হেসে ওঠে সেরকম নয়। বরঞ্চ এরকম আপনি হাসবেন একা একা নির্জনে। যখন একটা ঘটনাকে আপনি তার পরিস্থিতি থেকে শল্য চিকিৎসকের মতো সন্তপর্ণে বিচ্ছিন্ন করবেন। তারপর নির্মোহ দৃষ্টিতে, পটভূমি বাদ দিয়ে সেটিকে চিন্তা করবেন। যেন তিনি অন্য কারো মা। এবং তার ক্রোধের লক্ষ্যবস্তু আমি নই, অন্য কেউ।

 শৈশবে মা’র প্রতি আমার ভালোবাসা ছিল অযৌক্তিক, অসহায়, ভীত, এবং নিখাঁদ, যেমনটা শিশুদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। বড় হওয়ার পর চেষ্টা করলাম তাকে আরেকটু শান্ত, যৌক্তিকভাবে এবং একটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ভালোবাসতে। এই ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়েই খুব বাজেভাবে ব্যর্থ হতাম। আমার লেখায় তার নানান সংস্করণ নির্মাণ করেছি। কিন্তু কখনও ঠিক তাকে নিয়েই লিখি নি। তবে আমার তৈরি সংস্করণগুলো তার বেশ পছন্দ ছিল। যেমন God of Small Things এর আম্মু চরিত্রটিকে ভাবতেন ওটা তিনি নিজেই। এই চরিত্র নিয়ে আলাপ উঠলে তিনি ‘আমি’ এবং ‘আমাকে’ এভাবেই বলতেন। তিনি ‘আম্মু’ হতে চেয়েছিলেন কারণ খুব ভালো করেই জানতেন যে তিনি সেরকম একজন নন। বইতে আম্মুর একটি করুণ প্রেমকাহিনী ছিল। তো এক দুষ্টু প্রকৃতির সাংবাদিক মাকে প্রশ্ন করলো, ওরকম ঘটনা তার নিজের জীবনে আছে কিনা। তিনি সাংবাদিক লোকটির চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলেন, “কেনো? আমাকে কি আপনার যথেষ্ট সেক্সি মনে হচ্ছে না?” তখন তার বয়স ষাট, নিজের নির্মাণে সম্যক এক দেবী। তার যা খুশি তিনি বলতে পারেন।

বইটা বের হওয়ার পর তিনি খুব চিন্তায় পড়ে যান। ভাবলেন কি কি গোপন কথা না জানি ফাঁস করে দেয়। নিরাপদে থাকার জন্য তিনি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। সেখানে তড়িঘড়ি করে বইটি পড়ে শেষ করলেন। খুব শান্তি পেলেন যে এটা বিস্ফোরক উন্মোচন জাতীয় কোনো লেখা না। তিনি বুঝতেই পারলেন না এই বই নিয়ে এতো হইচই হচ্ছে কেন। তারপর আরও একবার খুব মন দিয়ে সবটা পড়লেন। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলেন যখন ততদিনে তিন কি চারবার বইটা পড়া হয়ে গেছে। আমাকে ডাকলেন তার শয্যা পাশে। রৌদ্রোজ্জল এক মধ্যাহ্ন। জানালার পর্দা ভেদ করে তার ঘরে প্রবেশ করা আলোর রঙ গাঢ় লাল। তার দু'চোখ বন্ধ। বললেন তার মনে হয় এটা একটা চমৎকার বই। লেখা ভালো হয়েছে। এরপর বইটার বিশেষ একটা পদ্যাংশ নিয়ে জানতে চান। ওই অংশে আম্মুর সাত বছরের দুই জমজ, এস্থাপেন এবং রাহেল, তাদের বাবা-মায়ের একটা ঝগড়ার ঘটনা মনে করছে। তাদের মনে পড়ে কিভাবে ঝগড়ার সময় বাবা মা দৈত্যের মতো প্রকাণ্ড রূপ ধারণ করেছিল। তারা বাচ্চা দুটোকে একে অন্যের দিকে ছুড়ে ঠেলে দিচ্ছিল আর বলছিল, ‘এদেরকে তুমি নিয়ে যাও, আমি এগুলোকে চাই না।’

‘এই ঘটনা তোমাকে কে বললো? তুমি তো অনেক ছোট তখন, মনে থাকার তো কথা না।’
‘এটা তো গল্প।’
‘না, এটা গল্প না।’
বলে তিনি দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এই স্মৃতির ভার কি বেদনা আমি আগে কোনোদিন জানি নি। আমি আসলেই বিশ্বাস করতাম যে এটা গল্প। ঐদিন জানলাম বেশির ভাগ মানুষই আসলে স্মৃতি এবং কল্পনার একটি মিশ্রণ, যা জীবন্ত, শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে। এখানে কোনটা স্মৃতি কোনটা কল্পনা সেটা মনে হয় না আমরা খুব ভালো আলাদা করতে পারি। সুতরাং, বইটি পড়ার সময় এটাকে উপন্যাসের মতোই ভাববেন। পাঠকের কাছে এর চেয়ে বড় কোনো দাবি নেই। কিন্তু আবার, বড় একটা দাবি থাকতেও পারে। কল্পকাহিনী এক অদ্ভুত, ধোঁয়াটে বিষয়। লেখকরা কখনো তার পূর্ণ মালিকানা রাখেন না। যদিও তারা ভাবেন তারা রাখেন। তো তাহলে এটা আসে কোথা থেকে? হ্যাঁ – আসে আমাদের অতীত, বর্তমান, আমরা যা পড়ি, কল্পনা করি তার থেকে। কিন্তু হয়তো আমাদের ভবিষ্যতের পূর্বাভাস থেকেও আসে? তা না হলে এটা কিভাবে সম্ভব যে আমি এখন, আমার দ্বিতীয় উপন্যাস The Ministry of Utmost Happiness-এর চরিত্রদের মতোই, একটি প্রায়-অতিথিশালার প্রাঙ্গনে একটি প্রায়-সমাধির পাহারাদার? কেমন অস্বাভাবিক ব্যাপার। এই চিন্তা আমাকে রাতে ঘুমাতে দেয় না। কিন্তু তারপর নিজেকে প্রশ্ন করি: সবকিছু আমাদের জানতে হবেই বা কেন?

                                                        —---------------

মা’কে বোঝার এক দীর্ঘ প্রচেষ্টা আমার ছিলো। আমি সমস্ত বিষয়গুলোকে তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম তার সাথে মানিয়ে নিতে। বুঝতে চেয়েছিলাম কী তাকে কষ্ট দেয়, যে কাজগুলো তিনি করেন সেগুলো কেন করেন। ভবিষ্যতে তিনি কী করবেন বা করবেন না সেটি অনুমান করতে চেয়েছিলাম। এই প্রচেষ্টাকালে আমি নিজে একটি গোলকধাঁধার রূপ নিলাম। যেন আমি মাটির নিচে অসংখ্য সর্পিল পথের এক জটিল সমন্বয়, যেগুলি পৃথিবীর অদ্ভুত সব জায়গায় গিয়ে উন্মোচিত হয়েছে। আশা ছিল এর মাধ্যমে আমি একটা সুবিধাজনক অবস্থান খুঁজে পাব, যেখানে আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলোকে বোঝা যাবে। এর ফলে আমি তাকে একটা নতুন লেন্সে দেখতে পেলাম। সেই লেন্স একান্তই আমার অভিজ্ঞতার রঙে রঙিন নয়। যে কারণে একজন নারী হিসেবে তার প্রকৃত মূল্যায়ন করা আমার পক্ষে সম্ভব হলো। এই প্রক্রিয়াটি আমাকে বানালো একজন লেখক। একজন ঔপন্যাসিক। কারণ ঔপন্যাসিকরা তো—গোলকধাঁধাই। আর এখন এই গোলকধাঁধাকে তার অনুপস্থিতিতে নিজের গোলকধাঁধা সত্তাটিকে বুঝতে হবে।

তার সান্নিধ্য পাওয়া অসংখ্য মানুষের জীবনে তিনি রেখে গেছেন ভালোবাসার উত্তরাধিকার। তেমনি আমাকে দিয়ে গেছেন কাঁটা। এগুলি যেন আমার রক্তস্রোতে ভাসতে থাকা ছোট ছোট সূচাগ্রো বড়শির মতো। হৃদয়-শরীরে রক্ত ধারার নিত্য প্রবাহে সেই বড়শিগুলো আজও বারবার আমার মাংসপেশীতে বিদ্ধ হয়। এই দুই বিভাজনের মাঝে একটি যোগসূত্র তৈরী করার জন্যই এই বই লেখা। এই লেখা আমি লিখতে যেমন পারি না, তেমনি না লিখেও পারি না।


 

হয়তোবা মা হারানো এক কন্যার শোকের চেয়ে আমি অধিক শোকার্ত একজন লেখক হিসেবে, যিনি তার লেখালেখির সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিষয়টিকে হারিয়ে ফেলেছেন। এই পৃষ্ঠাগুলিতে, আমার মা, আমার গুণ্ডা, বেঁচে থাকবেন। আমার জীবনে তিনি ছিলেন আশ্রয়, একইসাথে প্রলয়ঙ্করী ঝড়।

অধ্যায় ২: পলাতক

একজন শিক্ষক—এটাই তিনি হতে চেয়েছিলেন সবসময়, হওয়ার যোগ্যতাও তাঁর ছিল। বিয়ের পরবর্তী বছরগুলোতে, আমার বাবার সঙ্গে সংসারকালে, তাঁর যেকোনো প্রকার ক্যারিয়ার করার ইচ্ছেটি ক্ষীণ হতে হতে একসময় ঝরে পড়ে যায়। আমার বাবা ছিলেন আসামের এক দূর অজগাঁয়ের চা-বাগানের সহকারী ম্যানেজার। মায়ের ক্যারিয়ার করার স্বপ্ন পুনর্জীবন পেল (ঠিক করে বললে একটা দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে এলো) যখন তিনি আবিষ্কার করলেন যে নির্জন চা-বাগানে চাকরি করা আরও বহু যুবকের মতোই আমার বাবাও অ্যালকোহলে ভয়াবহ রকমের আসক্ত।

১৯৬২’র অক্টোবরে ভারত এবং চীনের মাঝে যুদ্ধ বেঁধে যায়। সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে তখন নারী ও শিশুদের সরিয়ে নেওয়া হয়। আমরা কলকাতায় চলে আসলাম। সেখানে আসার পর, আমার মা সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আর আসামে ফিরবেন না। কলকাতা থেকে পুরো দেশ পেরিয়ে আমরা চলে এলাম দক্ষিণ ভারতে। পৌঁছালাম তামিলনাড়ুর এক ছোট পাহাড়ি শহরে—উটাকামুন্ড—উটি-তে। আমার ভাই এল.কে.সি.—ললিত কুমার ক্রিস্টোফার রায়—এর বয়স তখন সাড়ে চার বছর। আর আমার তিন বছর হতে এক মাস বাকি। এরপর আমাদের বয়স বিশের কোঠায় না যাওয়া পর্যন্ত আমরা আর বাবাকে দেখিনি, তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগও হয়নি।

উটিতে একটা অবকাশ কুটিরের অর্ধেকটা নিয়ে আমরা থাকতাম। এই কুটিরের মালিক ছিলেন আমার নানা। তিনি দিল্লিতে ব্রিটিশ সরকারের একজন উচ্চপদস্থ চাকুরে ছিলেন। ‘রাজসিক পতঙ্গবিজ্ঞানী’ পদে পৌঁছে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। আমার নানির সঙ্গে তার মিল হয়নি। বহু বছর আগেই তিনি নানি এবং তার সন্তানদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। আমার জন্মের বছরেই তিনি মারা যান।

ওই বাড়িতে আমরা কিভাবে ঢুকে পড়েছিলাম আমার জানা নেই। মনে হয় কুটিরের বাকী অংশে যে ভাড়াটিয়া থাকতেন তার কাছে একটা চাবি ছিল। হতে পারে আমরা দরজা ভেঙেই ঢুকেছিলাম। মা’কে দেখে মনে হচ্ছিল এই বাড়ি তার অতি পরিচিত। শহরটাও যেন তার অনেক চেনা। হতে পারে তিনি শৈশবে এখানে এসেছিলেন, তার বাবা-মায়ের সঙ্গে। বাড়িটা কেমন যেন স্যাঁতস্যাঁতে আর অন্ধকার। ঠান্ডা সিমেন্টের মেঝে আর অ্যাসবেস্টসের ছাদ এখানে ওখানে ফেটে গেছে। অন্য ভাড়াটিয়ার অংশের থেকে একটা প্লাইউডের পার্টিশন দিয়ে আমাদের অর্ধাংশের ঘরগুলো আলাদা করা ছিল। ভাড়াটিয়া ছিলেন একজন বৃদ্ধা ইংরেজ মহিলা। নাম মিসেস প্যাটমোর। তিনি কেমন উঁচু করে ফুলিয়ে চুলটা বাঁধতেন। আমরা শুধু ভাবতাম ওই ফুলানো চুলের মধ্যে কী না জানি আছে। নিশ্চই বোলতার ঝাঁক আছে — আমি আর আমার ভাই ধারণা করতাম। বৃদ্ধা রাতের বেলা দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করতেন, গুঙিয়ে উঠতেন। তিনি আদৌ কোনো ভাড়া দিতেন কিনা আমি নিশ্চিত নই। তিনি হয়তো জানতেনই না কাকে ভাড়া দিতে হবে। আমরা যে কোনো ভাড়া দিতাম না — এটুকু নিশ্চিত বলতে পারি। আমরা ছিলাম অবৈধ দখলদার, অনুপ্রবেশকারী — ভাড়াটে নয়। পালাতক আসামির মতো বসবাস করতাম আমরা। চারপাশ ঘিরে থাকতো বড় বড় বাক্স ভর্তি মৃত রাজসিক পতঙ্গবিজ্ঞানীর সব বড়লোকি জামাকাপড় — সিল্কের টাই, ড্রেস শার্ট, থ্রি-পিস স্যুট। আমরা একটা বিস্কিটের টিন পেয়েছিলাম যেটা ছিল কাফলিংসে ভর্তি। (সন্দেহ নেই তিনি উপনিবেশিক সরকারের এক অতি উৎসাহী সহযোগী ছিলেন এবং নিজের পদবীর ‘রাজসিক’ অংশটিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতেন)। পরে আমার আর আমার ভাইয়ের যখন বোঝার মত বয়স হলো, তখন তার বিষয়ক সব পারিবারিক কিংবদন্তিসম গল্পগুলো আমাদের শোনানো হত। যে কেমন ছিল তার আত্মগরিমা (একটা হলিউড স্টুডিও থেকে তিনি নিজের পোর্ট্রেট তৈরি করে এনেছিলেন) এবং তার হিংস্রতা (তিনি প্রায়ই তার সন্তানদের বেত্রাঘাত করতেন, বাড়ি থেকে বের করে দিতেন, আর একবার তো পিতলের ফুলদানি দিয়ে মেরে আমার নানির মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন)। মা আমাদের বলেছিলেন যে শুধুমাত্র এই বাবার হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যই, তিনি জীবনে প্রথম যে পুরুষটি তাকে প্রস্তাব দিয়েছিল তাকেই বিয়ে করে ফেলেছিলেন।

আমরা আসার কিছুদিনের মধ্যেই মা একটি স্থানীয় স্কুলে শিক্ষিকার চাকরি পেয়ে যান। স্কুলটার নাম ছিল ব্রিক্স। উটিতে ওই সময় স্কুলের অভাব ছিল না। সেগুলোর কয়েকটা চালাতেন ব্রিটিশ মিশনারিরা। স্বাধীনতার পরও তারা ভারতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এমন একটি দলের সঙ্গে তিনি বন্ধু হয়ে যান। এই দলটি লাশিংটন নামের একটি সর্বশ্বেতাঙ্গ স্কুলে পড়াতো। স্কুলে শুধুমাত্র ভারতে অবস্থানরত ব্রিটিশ মিশনারিদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করত। মা তাদেরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করালেন যে চাকরি থেকে তার যখনই সময় মিলবে তিনি তাদের ক্লাসগুলোতে বসে পাঠদান শিখবেন। প্রাইমারি স্কুল ছাত্রদের জন্য লাশিংটনে নতুন উদ্ভাবনী সব পাঠদানের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হতো (যেমন পড়ানোর ও ধ্বনিতত্ত্ব শেখানোর জন্য ফ্ল্যাশকার্ড, গণিতের জন্য রঙিন কাঠের কুইসেনেয়ার রড)। মা বুভুক্ষের মত সেই জ্ঞান আহরণ করতেন। একই সময়ে ভারতীয় ও ভারতের প্রতি মিশনারিদের সদাশয়, শুভ-উদ্দেশ্যপূর্ণ কিন্তু বর্ণবাদী মনোভাব তাকে খানিকটা পীড়াও দিত। কাজে যাওয়ার সময় মা কয়েক ঘণ্টার জন্য আমাদেরকে এক গোমড়ামুখো মহিলার কাছে রেখে যেতেন। মাঝে মাঝে প্রতিবেশীদের কাছে থাকতাম আমরা।

আমাদের পালাতক জীবনের কয়েক মাসের মাথায় আমার নানি (পতঙ্গবিজ্ঞানীর বিধবা) এসে হাজির হলেন। সঙ্গে তার বড় ছেলে- জি. আইজ্যাক। তারা কেরালা থেকে এসেছেন আমাদের তিনজনকে উচ্ছেদ করতে। আমি আগে কখনো তাদের দেখিনি। তারা মা’কে বললেন ত্রাভাঙ্কোর খ্রিস্টান উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী মেয়েদের বাবার সম্পত্তিতে কোনো অধিকার নেই। আমাদের এই মুহূর্তে বাড়ি ছাড়তে হবে। তারা কোনো ভ্রুক্ষেপই করলেন না যে আমাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আমার নানি তেমন কোনো কথা বলছিলেন না। তারপরও তাকে কেমন ভয় লাগছিল। তার চোখের কর্নিয়ায় একটা সমস্যা ছিল। ওগুলো কেমন যেন ফোলা ফোলা, ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। এজন্য তিনি অসচ্ছ লেন্সের চশমা পরতেন। আমার মনে আছে আমার মা, আমার ভাই, আর আমি হাত ধরাধরি করে শহরে দৌড়ে বেড়াচ্ছিলাম একজন উকিলের খোঁজে। আমার স্মৃতিতে এই দৃশ্যটি রাতের। রাস্তা-ঘাটে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু বাস্তবে মনে হয় না এমন ছিল। কারণ একজন উকিল তো আমরা শেষমেশ খুঁজে পেয়েছিলাম বটে। তিনি আমাদের জানালেন যে ত্রাভাঙ্কোর ওই আইন শুধুমাত্র কেরালা রাজ্যে প্রযোজ্য, তামিলনাড়ুতে নয়। তাছাড়া অবৈধ বসবাসকারী বলেই যে তার কোনো আইনি অধিকার নেই এমনটিও না। তিনি বললেন কেউ আমাদের উচ্ছেদ করতে এলে আমরা পুলিশ ডাকে পারি। বিজয়োল্লাসে কাঁপতে কাঁপতে আমরা বাড়ি ফিরলাম। আমি আর আমার ভাই তখন এত ছোট যে বড়রা কী আলাপ করছে বুঝতে পারিনি। তবে কী রকম আবেগ অনুভূতির বিনিময় হচ্ছিল তা ভালোই টের পাচ্ছিলাম: ভয় দেখানো, আতঙ্ক, ক্রোধ, অস্থিরতা, আশ্বাস পাওয়া, স্বস্তি, আর তারপর বিজয়ানন্দ।

আমাদের মামা জি. আইজ্যাক ওই সময় একটা বিষয় বুঝতে পারেননি। বোনকে বাবার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে তিনি আসলে নিজের কবর খুঁড়েছিলেন। ত্রাভাঙ্কোর খ্রিস্টান উত্তরাধিকার আইনকে চ্যালেঞ্জ করে বাবার সম্পত্তিতে সমান অধিকার দাবি করার মতো শক্তি ও অবস্থানে আসতে আমার মাকে আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। তার আগ পর্যন্ত, তিনি প্রবল অপমানের সেই স্মৃতিকে পরম যত্নে আগলে রাখবেন। যেন সেটি কোনো অতি মূল্যবান পারিবারিক সম্পদ, একভাবে দেখলে, যা আসলেও তাই।

                                                            —----------

আইনি বিজয়ের পর কটেজের আরও কিছুটা অংশে আমরা রাজ্য বিস্তার করলাম। নিজেদের জন্য কিছুটা জায়গা নিলাম। আমার মা রাজসিক পতঙ্গবিদের স্যুট এবং কাফলিংকগুলো বাজারের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের ট্যাক্সিচালকদের মাঝে বিলিয়ে দিলেন। এর পরের কয়েকদিন উটিতে পৃথিবীর সবচেয়ে কেতাদুরস্ত ট্যাক্সি ড্রাইভারদের দেখা মিলেছিল।

অনিশ্চিত হলেও একটি কষ্টার্জিত বিজয় তখন আমাদের ছিল। তারপরও  উটির ঘটাপ্রবাহ ঠিক আমাদের অনুকূলে যাচ্ছিলো না। ওখানকার ঠান্ডা ভেজা আবহাওয়ায় আমার মায়ের অ্যাজমা আরও খারাপ হল। একটা উঁচু রট আয়রনের খাটে তিনি ধাতব-গোলাপি বর্ণের একটা মোটা কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতেন। দিনের পর দিন তিনি এভাবে শয্যাশায়ী থাকতেন এবং হাঁফ টেনে ভারী ভারী শ্বাস নিতেন। আমরা ভেবেছিলাম তিনি মনে হয় মারা যাবেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা যে তাকে দেখছি এটা তিনি পছন্দ করতেন না। ধমক দিয়ে বের করে দিতেন। তাই আমি আর আমার ভাই বাইরে চলে যেতাম অন্য কিছু দেখার জন্য। বাড়িটার ত্রিভুজাকার কম্পাউন্ডের এক কোণায় একটা নিচু, নড়বড়ে গেট ছিল। আমরা ওটায় উঠে দোল খেতাম আর নববিবাহিত দম্পতিদের দেখতাম। মধুচন্দ্রিমায় আসা নতুন দম্পতিগুলো আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে হাত ধরাধরি করে উটির বিখ্যাত বোটানিক্যাল গার্ডেনগুলোতে প্রেম করতে যেতো। মাঝে মাঝে তারা থেমে আমাদের সাথে কথা বলতো। আমাদের মিষ্টি আর বাদাম দিত তারা। এক লোক আমাদের একটা গুলতি দিয়েছিলো। কতদিন যে সেটা দিয়ে আমাদের নিশানা নিখুঁত করার চেষ্টা করেছি। নিতান্তই অপরিচিত লোকদের সাথে আমরা বন্ধুত্ব করে ফেলতাম। একবার সেই লোকদের একজন হাত ধরে টানতে টানতে আমাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলো। তিনি আমার মা’কে কঠিন সুরে বললেন যে তার মেয়ের চিকেনপক্স হয়েছে। জোর করে আমার পেটের ফোসকাটা মা’কে দেখালেন। ওটা তখন আমি যাকেই সম্ভব হচ্ছিলো তাকেই আগ্রহ নিয়ে দেখাচ্ছিলাম। আমার মা ভয়ঙ্কর রেগে গেলেন। লোকটি চলে যাওয়ার পর তিনি আমার গালে শক্ত একটা চড় দিলেন। বললেন কোন দিন যেন কোন অপরিচিত মানুষকে আমি আমার জামা তুলে পেট না দেখাই। বিশেষ করে পুরুষ মানুষদের।

অসুখ বা ঔষুধ কোনো একটার কারণে মা'র মেজাজ খুব বাজে হয়ে গেল। প্রায়ই তিনি আমাদের ধরে মারতেন। তিনি যখন ওরকম করতেন আমার ভাই বাড়ি থেকে পালিয়ে যেত। একমাত্র অন্ধকার নামার পরেই ফিরতো। সে ছিলো চুপচাপ স্বভাবের ছেলে। কোনদিন কাঁদতো না। মন খারাপ থাকলে খাবার টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে থাকত। ভান করত যে ঘুমিয়ে গেছে। মন ভালো থাকলে, যেটা বিরল, সে বক্সারের মতো বাতাসে ঘুষি ছুড়ে ছুড়ে আমার চারপাশে নেচে বেড়াত। বলত যে সে ক্যাসিয়াস ক্লে। সে কিভাবে ক্যাসিয়াস ক্লে কে চিনত আমি জানতাম না; আমি তো চিনতাম না। মনে হয় আমাদের বাবা বলেছিলেন তাকে।

আমার মনে হয় উটির ওই বছরগুলো আমার তুলনায় আমার ভাইয়ের জন্য বেশি কষ্টকর ছিল। কারণ স্মৃতিতে ততদিনে কিছু জিনিস জমা হয়েছে। তার স্মৃতি ছিল একটা অধিকতর ভালো জীবনের। তার স্মৃতিতে ছিল আমাদের বাবা এবং চা বাগানের যে প্রকাণ্ড বাড়িটায় আমরা থাকতাম। ভালোবাসা পাওয়ার স্মৃতি তার ছিল। সৌভাগ্য, আমার এসব কিছুই ছিল না।

আমার আগে আমার ভাই স্কুল শুরু করে। সে ভর্তি হয়েছিল লাশিংটনে। সেই যে শুধু শেতাঙ্গদের জন্য স্কুলটা। (সম্ভবত মিশনারিদের সঙ্গে খাতিরের কারণে আমার মা ওকে ভর্তি করতে পেরেছিলেন)। এই স্কুলে আমার ভাই পড়েছিল কয়েক মাস। এরপর সে যখন আমাদের মত স্থানীয় শিশুদের ‘ওইসব ভারতীয় শিশু’ বলে ডাকা শুরু করল তখন মা তাকে ছাড়িয়ে নিলেন। এবার তাকে ভর্তি করলেন ‘ব্রিক্স’-এ, যেখানে তিনি নিজে পড়াতেন। আমার বয়স পাঁচ হলে তিনি আমাকে একটি (ভারতীয় শিশুদের জন্য) নার্সারি স্কুলে ভর্তি করলেন। মিস মিটেন নামের এক ভয়ঙ্কর দর্শন অস্ট্রেলিয়ান মিশনারি মহিলা ওই স্কুলটা চালাতেন। তিনি নির্মম প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তার দুই হাত ভর্তি ছিল তিল। তার মুখের ওখানে কোন ঠোঁট ছিল না। শুধু একটা সরু ধারালো ছিদ্র। তিনি স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন যে আমাকে তিনি পছন্দ করেন না। ইতস্তত ঘাসওয়ালা একখণ্ড মাঠের ধারে একটি ছাউনি। ওটাই আমাদের ক্লাস রুম। পশ্চাতের হাড় বেরিয়ে আসা কয়েকটি রুগ্ন গরু সেই মাঠে চড়ে বেরাত।

মা’র অ্যাজমা বেশী খারাপ থাকলে সেদিন তিনি শাকসবজি ও অন্য দরকারি জিনিসপত্রের লিস্ট লিখে, একটি ঝুড়িতে রেখে, সেটা সহ আমাদের দুই ভাইবোনকে শহরে পাঠিয়ে দিতেন। উটি তখন একটি ছোট নিরাপদ শহর। রাস্তায় গাড়িঘোড়াও বেশি চলত না। পুলিশরা সবাই আমাদের চিনতেন। দোকানদাররা সবসময় খুব সদয় আচরণ করতেন। এমনকি আমাদের বাকিও দিতেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে চমৎকার মানুষটা ছিল ক্রূশাম্মা নামের একজন মহিলা। তিনি নিটিং শপে কাজ করতেন। আমাদের ভাইবোনের জন্য দুটি লম্বা গলার সোয়েটার বুনে দিয়েছিলেন। ভাইয়ের রঙ ছিল গাঢ় সবুজ। আর আমারটা খয়েরি।

একবার আমার মা টানা কয়েক সপ্তাহের জন্য সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হয়ে যান। তখন ক্রূশাম্মা আমাদের সঙ্গে থাকতে চলে এলেন। আমাদের ছন্নছাড়া জীবনধারার একটা ইতি ঘটল। ক্রূশাম্মা আমাদের শেখালেন ভালোবাসা কী। কারও  ওপর নির্ভর করতে কেমন লাগে। আমরা জানলাম ভালোবাসার আলিঙ্গন বোল একটা জিনিস আছে। তিনি আমাদের জন্য রান্না করতেন। এবং বাইরে উটির হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যে আমাদের গোসল করাতেন। তার আগে প্রথমে কাঠের চুলায় বিশাল একটি পাত্রে পানি ফুটাতেন। আজকের দিনেও আগুন গরম পানি ছাড়া আমরা স্নান করতে পারি না। গোসলের আগে তিনি চিরুনি দিয়ে আচড়ে আমাদের চুল থেকে উকুন তুলে আনতেন। দেখাতেন কিভাবে ওগুলোকে মারতে হয়। উকুন মারতে আমার খুব ভালো লাগতো। বুড়ো আঙ্গুলের নখে পিষে ফেলার সময় কেমন চমৎকার একটা শব্দ করতো তারা। বিদ্যুত গতিতে উল বুনতে পারা ছাড়াও ক্রূশাম্মার আরেকটি প্রতিভা ছিল। তিনি ছিলেন একজন মারাত্মক রাঁধুনি। তার বিশেষত্ব ছিল যে বাসায় কোন বাজার না থাকলেও তিনি কিছু একটা খাবার বানিয়ে ফেলতেন। শুধু লবণ দিয়ে সিদ্ধ করা ভাত, কাঁচা মরিচ ডলে খেতে অসাধারণ লাগতো যখন তিনি আমাদের পাতে তুলে দিতেন।

তামিল ভাষায় ক্রূশাম্মার নামের অর্থ দাঁড়ায় ‘ক্রূশের আম্মা ’ বা ‘ক্রূশের মা’। তার স্বামীর নাম ছিল ইয়েশুরাতনাম (‘যিশুর রত্ন’, ‘রত্নকূলের রত্ন’)। তিনি প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন। তার গলার থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছিল। একটি উলের মাফলার দিয়ে তিনি সেটি ঢেকে রাখতেন। আমাদের মতো, তার শরীর থেকেও সবসময় কাঠের ধোঁয়ার গন্ধ আসতো।

একসময় আমার মা এত অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে আর চাকরি করতে পারলেন না। যে বিপুল পরিমাণ স্টেরয়েড তিনি নিচ্ছিলেন সেটিও আর কাজে আসছিল না। আমরা কপর্দকশূন্য হয়ে পড়ি। আমি এবং আমার ভাই পুষ্টিহীনতায় ভুগতে লাগলাম। আমাদের ফুসফুসে যক্ষ্মা হয়ে গেল।

কয়েক মাসের মর্মান্তিক যুদ্ধের পর আমার মা ক্ষান্ত দিলেন। ঠিক করলেন অহংকার ভুলে তিনি কেরালায়, আয়ামিনেমে, আমার নানির গ্রামে ফিরে যাবেন। ততদিনে তার মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া কিছুটা শীতল হয়েছে। না হলেও কি, তার তো আর কোনো উপায় ছিল না।

ক্রূশাম্মাকে ছেড়ে যেতে আমার হৃদয় ভেঙে যাচ্ছিল। তবে কয়েক বছর পরই তার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে, যখন তিনি কেরালায় আমাদের সঙ্গে থাকতে চলে আসবেন।

                                          —------------------------------------------ 

বিশ্বনাগরিক (দেশহীন)

তামিলনাড়ুর সীমানা পেরিয়ে আমাদের ট্রেন কেরালায় ঢুকলো। প্রকৃতির বাদামি রং পাল্টে সবুজ হয়ে গেছে। সবকিছু, এমনকি বিদ্যুতের খুঁটিগুলোও, লতাগুল্মে চাপা পড়ে যাচ্ছে। সবকিছুতেই একটা সদ্যস্নাত চকচকে ভাব। ট্রেনের জানালার পাশে নারী-পুরুষের বহমান ধারা। তাদের প্রায় প্রত্যেকের পরনেই সাদা পোশাক, হাতে কালো ছাতা।

আনন্দে উদ্বেল হই

আবার মুষড়ে পড়ি 

অনাহূত ও স্পষ্টতই অবাঞ্ছিতভাবে আমরা আয়ামিনেমে এসে হাজির হয়েছিলাম। অদৃশ্য ভিক্ষার থালাটি নিয়ে যার দুয়ারে উপস্থিত হলাম, তিনি আমাদের নানির বড় বোন, মিস কুরিয়েন। ওই সময় তার বয়স মনে হয় ষাটের কোঠায়। পাতলা, ধূসর চুল স্কুল-বালকদের মতো ছোট পরিপাটি করে কান আর কপালের সঙ্গে মিলিয়ে ছাঁটা। একে তখন পেজবয় স্টাইল বলা হতো। তার শাড়িগুলোতে প্রচুর মাড় দেওয়া থাকত। দেখে মনে হত কাগজের মতো শক্ত ভাঁজহীন। সঙ্গে বড় ঢোলা ব্লাউজ। মিস কুরিয়েন তার সমসাময়িক বেশিরভাগ মহিলার থেকে এগিয়ে ছিলেন। বিয়ে করেননি। ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স। শ্রীলঙ্কায় (তৎকালীন সিলন) একটি কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন। তার নিজের বাড়ি ছিল। সঞ্চয় ছিল, পেনশন ছিল। সেই সঙ্গে ছিল সেই বিচক্ষণতা এবং একাগ্রতা যা একজন অবিবাহিত কর্মজীবী নারীর থাকতে হয়। যে নারী জানতেন, তার দেখাশোনার জন্য তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। মনে হয় না তিনি আগে বুঝতে পেরেছিলেন নিজের ছাড়াও আরও কতজনের দেখাশোনা যে তাকে শেষে গিয়ে করতে হবে।

আমার মা তার খালাকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন যে একটা চাকরি পেলেই আমরা এখান থেকে চলে যাব। মিস কুরিয়েন নিজেকে একজন আদর্শ খ্রিস্টান মনে করতেন। এই নিয়ে তার খানিক গর্বও ছিল। তিনি আমাদের থাকতে দিতে রাজি হন। তবে আমরা এবং আমাদের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি যে খুবই অখুশি, সেটা ভালোই বুঝিয়ে দিলেন। আমাদের ভাইবোনকে তিনি পাত্তাই দিতেন না। কিন্তু অন্য আত্মীয়দের বাচ্চারা বেড়াতে এলে তার কত আদর। তিনি তাদের উপহার দিতেন। পিয়ানো বাজিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় গান শোনাতেন। তিনি স্পষ্ট বোঝাতেন যে আমাদের অপছন্দ করেন (যে কারণে আমরাও তাকে পছন্দ করতাম না)। তবুও একটা কথা বলতেই হয় — ভয়ঙ্কর প্রয়োজনের সময় তিনিই ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি আমাদের সাহায্য করেছিলেন, আশ্রয় দিয়েছিলেন।

আমার নানিও তার সঙ্গে থাকতেন। তার শঙ্কু কর্নিয়া আগের চেয়েও খারাপ হয়েছিল। বলতে গেলে তিনি অন্ধই ওই সময়। তখনও কালো চশমা পরতেন। এমনকি রাতের বেলাতেও। তার মাথার ওপরে একটা লম্বা গভীর দাগ ছিল। ওটা তার সেই পিতলের ফুলদানি-আঘাতের বিখ্যাত ক্ষত। মাঝে মাঝে তিনি সেই দাগটায় আমাকে আঙুল বোলাতে দিতেন। আবার কখনো ঘুমোতে যাওয়ার আগে তার পাতলা চুলগুলোতে আমি বেনি করে দিতাম।

প্রতি সন্ধ্যায় তিনি বারান্দায় বসে বেহালা বাজাতেন।

তিনি ছিলেন একজন গুণী বেহালা-বাদক। রাজসিক পতঙ্গবিদ স্বামী ভিয়েনায় চাকরি করার সময় তিনি সংগীত শিক্ষকের কাছে তালিমও  নিয়েছিলেন। সেই শিক্ষক পতঙ্গবিদকে বললেন যে আপনার স্ত্রীর যেমন প্রতিভা, তিনি একদিন কনসার্টে বেহালা বাজাবেন। শুনে তার স্বামী তৎক্ষণাৎ স্ত্রীর সংগীত শেখা বন্ধ করিয়ে দেন। এবং ঈর্ষায় ও ক্রোধে অস্থির হয়ে নানির জীবনের প্রথম বেহালাটি আছড়ে ভেঙে ফেলেন।

তখন অনেক ছোট ছিলাম, তাই বলতে পারব না ঠিক কতটা ভালো বেহালা তিনি বাজাতেন। কিন্তু যখন আয়ামিনেমে সন্ধ্যা নামতো, চারদিক ঝিঁঝিঁর ডাকে মুখরিত, তখন তার বেহালার সুর সেই সন্ধ্যা এবং অতি অন্ধকার রাতগুলোকে আরও বেশি বেদনাবিধুর করে তুলত।

মূল বাড়ির সঙ্গে যুক্ত একটি উপগৃহে বাস করতেন আমার মামা জি. আইজ্যাক। প্রথমদিকে তার ভয়ে অস্থির ছিলাম। আমার মনে তিনি ছিলেন সেই বিশালদেহী রাগী লোকটা, যিনি আমাদেরকে উটির বাসা থেকে উৎখাত করতে এসেছিলেন। কিন্তু আয়ামিনেমে তার অন্য রূপ দেখলাম। তাকে ভয়ের চেয়ে মজার মানুষই বেশি মনে হতে লাগলো। তিনি আমাকে আর আমার ভাইকে নদীতে নিয়ে যেতেন। তার পেটের চারপাশে পানিতে ঘুরে ঘুরে আমি সাঁতার কাটতে শিখি। এসব কারণে তার প্রতি একসময় ভালোবাসা জন্মায়।

জি. আইজ্যাক ছিলেন ভারতের প্রথম রোডস স্কলারদের একজন। তার বিষয় ছিল গ্রিক এবং রোমান পুরাকাহিনি। ধরুন, খাবার টেবিলে তিনি হঠাৎই বলে উঠবেন, ‘এই যে সুরা ও আনন্দের জন্য একজন দেবতা আছে, ব্যাপারটা চমৎকার না?’ সবাই শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতো। তিনি তখন ডায়োনিসাসের গল্প শুরু করে দিতেন, বা ওইদিন যে দেবতা নিয়ে মেতেছিলেন।

মাদ্রাজের একটি কলেজে তিনি কয়েক বছর পড়িয়েছিলেন। সেই চাকরি ছেড়ে দিলেন কারণ নিজের শিকড়ের কাছে ফিরে যেতে চান। শিক্ষক জীবন ছেড়ে আচার, জ্যাম, রান্নার মসলার কারখানা শুরু করলেন তার মায়ের সঙ্গে। ওটার নাম ছিল মালাবার কোস্ট প্রোডাক্টস। কোট্টায়ামে পতঙ্গবিদের একটি পৈতৃক ভিটা ছিল। বাসে করে যেতে বেশি সময় লাগতো না। সেখান থেকেই কার্যক্রম চলতো। (পরবর্তীতে আমার মা যখন ত্রাভানকোর খ্রিস্টান উত্তরাধিকার আইনকে চ্যালেঞ্জ করবেন তখন ঐ বাড়িটাই বিবাদের মূলবিষয়ে পরিণত হবে) উত্তরাধিকার, ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি এসব নিয়ে তার প্রবল আগ্রহ সত্ত্বেও, জি. আইজ্যাক ছিলেন একজন মার্ক্সবাদী। তিনি বলতেন শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি মসলার কারখানা দিয়েছেন যেন ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের প্রসার ঘটে, এবং স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। তার এসব ফালতু কাজকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে, তার সুইডিশ স্ত্রী সিসিলিয়া, যার সঙ্গে অক্সফোর্ডে পড়ার সময় তার পরিচয়, তাকে ছেড়ে তাদের তিন পুত্রকে নিয়ে সুইডেনে ফিরে যান।

                                                        —----------    

এমনই অদ্ভুত বিচিত্র সব উপায়ে, জীবনে পরাজিত একদল অসাধারণ, উদ্ভট, বিশ্বনাগরিকের সম্মিলন ঘটেছিল আয়ামিনেমের সেই ক্ষুদ্র গ্রামে।

ওখানকার উষ্ণ, ভেজা আবহাওয়ায় আমার মা কিছুটা স্বস্তি পেলেন। তাঁর হাঁপানি যে সেরে গেল, এমন না। ওটার তীব্রতা আর দৈনন্দিন যন্ত্রণা ছিলই। তারপরও যেন আগের চেয়ে ভালো। তিনি তখনও জীবন নিয়ে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। মাঝের সময়টা আমার ভাই আর আমাকে বাড়িতেই পড়াতে লাগলেন। সবার থেকে আমরা স্নেহের বদলে উপেক্ষাই বেশি পেতাম। তবে মাঝে মাঝে জি আইজাকের মেজাজ ভালো থাকলে সেদিন অন্যরকম হতো।

আয়ামিনেমের জীবন ছিল খাদের কিনারার জীবন। কখন না জানি পড়ে যাই। এমনকি বাড়িতে রান্নার যে লোকটা ছিল, কচু মারিয়া, সেও কথা শোনাতে ছাড়ত না। বলত যে এখানে এভাবে বসবাসের কোন অধিকার আমাদের নেই। পিতৃপরিচয়হীন ছেলে-মেয়ে ভদ্রলোকদের সঙ্গে এক ছাদের নিচে থাকা কেমন লজ্জার ব্যাপার — এই নিয়ে সে প্রায়ই গজগজ করত। কয়েকদিন পরপরই বিশ্বনাগরিকদের মাঝে ঝগড়া বেঁধে যেত। তারা যখন ঝগড়া করত, সমগ্র বাড়িটা থরথর করে কাঁপত। বাসন-কোসন ছুঁড়ে মারা হতো, দরজা ভাঙা হতো। জি আইজাক আর আমার মায়ের মধ্যকার সম্পর্কটা বোঝা বেশ কঠিন ছিল। কোনদিন তারা ছিলেন পরম বন্ধু, আরেকদিন হঠাৎ করেই দেখা যেত তারা একে অপরের জানের শত্রু। আশ্চর্যজনক নয় যে, এসব বিবাদের বেশিরভাগই ছিল টাকা-পয়সা নিয়ে — কীভাবে আমার মা গৃহস্থালির কোন খরচ দিচ্ছেন না, বাকিদের ওপর দিয়েই চালিয়ে দিচ্ছেন। জি আইজাক চেষ্টা করতেন আমার ভাই আর আমাকে এই ঝগড়াগুলোর অংশ না বানাতে।

চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হলেই আমি পালিয়ে যেতাম। নদীর ঘাট ছিল আমার আশ্রয়। আমার জীবনে যা কিছু ঠিক ছিল না, সেগুলো যেন ঘাটে এলে ঠিক হয়ে যেত। সেখানে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতাম। নদীর মাছ, পোকামাকড়, পাখি আর গাছপালার সঙ্গে নাম ধরে ডাকার মত অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হয়ে গেল। আমি গ্রামের অন্য বাচ্চাদের (এবং কয়েকজন বড়দের) ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেলাম। দ্রুতই মালয়ালম শিখে ফেললাম। সবার সঙ্গে আলাপ চালাতে তেমন কোনো সমস্যাই হত না।

ওদের জগৎ ছিল আমার থেকে খুবই ভিন্ন। তারা বেশিরভাগই কাছের ধানক্ষেত আর রাবার বাগানে কাজ করতেন। অথবা জমিদারদের প্রকাণ্ড প্রাঙ্গণওয়ালা বাড়ির দেখাশোনা করতেন। সেখানে তারা নারকেল তুলতেন, ঘরের কাজে সাহায্য করতেন। তাদের ঘরগুলো ছিল কাদামাটির দেয়াল আর খড়ের ছাউনি দেওয়া। জাতধর্মের বিবেচনায় এদের অনেকে ছিলেন ‘অস্পৃশ্য’। এই ভয়ংকর বিষয়টা আমি তখন তেমন বুঝতাম না। কারণ আয়ামিনেমের বাড়িতে সবাই ঝগড়াঝাটিতেই এত ব্যস্ত থাকত যে আমাকে জাতধর্মের শিক্ষা দেওয়ার সময় তাদের হত না।

গ্রামের এক তরুণ আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হয়ে যায়। সে আয়ামিনেমেই থাকত, তবে কাজ করত কটায়ামের মালাবার কোস্ট প্রোডাক্টসে। আমরা একসঙ্গে অনেক সময় কাটাতাম। সে বাঁশের ছিলকা দিয়ে আমার জন্য একটা বড়শি বানিয়ে দিয়েছিল। দেখিয়েছিল, মাছের টোপ হিসেবে সবচেয়ে ভালো কেঁচো কোথায় পাওয়া যায়। আমি তার থেকে মাছ ধরা শিখেছি। সে আমাকে শিখিয়েছে, মাছ ধরার সময় একদম স্থির নিঃশব্দে বসে থাকতে হয়। যে ছোট মাছটা আমি ধরতাম, সেটা সে ভেজে দিত। আমরা দুজন মিলে এমনভাবে খেতাম যেন কোনো মহাভোজ চলছে।

'দ্য গড অব স্মল থিংস'-এ একটা চরিত্র আছে — ভেলুতা, আম্মুর প্রেমিক। আয়ামিনেমের সেই তরুণ ছিল চরিত্রটির অনুপ্রেরণা। আহা, যদি আমার বয়স তখন ছয় না হয়ে ষোলো হত, তাহলে কে জানে, ভাগ্য সহায় হলে, এই তরুণটিকে হয়তো আমিই পেতাম। সে ছিল আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে অমায়িক, সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ।

আয়ামিনেমে বসবাসের কয়েক মাস যায়। আমি সেখানকার প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে যাই। একজন পূর্ণ বন্য শিশু। পায়ে কড়া পড়ে গেছে। নদীমুখি গ্রামের প্রতিটি গোপন রাস্তা আমার নখদর্পণে। আমি বনেই বেশিরভাগ সময় থাকতাম, কালেভদ্রে বাড়িতে যেতাম, যতটুকু না গেলে নয়।

আমার না-মানুষ বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম ছিল ডোরাকাটা বাদামী একটা কাঠবিড়ালি। সে আমার কাঁধে থাকত, আর কানে ফিসফিস করে কথা বলত। আমরা অনেক গোপন কথা বলতাম একে অপরকে। সে আমার পোষা প্রাণী ছিল না। তার ছিল একান্তই তার নিজের জীবন, কিন্তু সেই জীবনের কিছুটা সে আমার সঙ্গে ভাগ করে নেবে ঠিক করেছিল। বনে তার অনেক কাজ। তাই প্রায়ই সে উধাও হয়ে যেত। খাবার সময় হলেই আবার উদয় হত। আমার প্লেটে উঠে বসে থাকত,  কুটকুট করে আমার খাবার থেকে খেত। তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল আনারস। সে ছিল সর্বক্ষণ সজাগ। যেকোনো বিপদের সম্ভাবনায় সদা সচকিত। অনেক কিছু শিখিয়েছিল সে আমাকে।

আয়ামিনেমের খাদের কিনারার জীবনে থাকা কারো জন্য কাঠবিড়ালির মতো টিকে থাকার শিক্ষা যথেষ্ট কাজে আসতে পারে।

‘আমি তোমাকে দ্বিগুণ ভালোবাসি’

প্রতিদিনকার ঝগড়া আর অপমানের ভার মা আমাদের ভাই বোনের মাধ্যমে লাঘব করতেন। আমরা ছাড়া তাঁর আর কেউ ছিল না। তাঁর তো আগে থেকেই বদ মেজাজ। এবার সেটা আরও খেয়ালি, নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠল। কীসে তিনি রেগে যাবেন বা খুশি হবেন অনুমান করা অসম্ভব হয়ে পড়ল আমার জন্য। এ যেন মাইন সংকুল এক মাঠ। তার মধ্যে দিয়ে আমি পথ চলছি মানচিত্রহীন। প্রায়শই আমার পা আর আঙুল, এমনকি কখনও  মাথাটাও বিস্ফোরণে উড়ে চলে যেত। কিছুক্ষণ শূন্যে ভেসে বেড়ানোর পর আবার কী জাদুতে জানি সেগুলো নিজেরা নিজেরাই জোড়া লেগে যেত।

আমার ওপর রেগে গেলে, তিনি ভেঙিয়ে আমার কথাগুলো আমাকে শোনাতেন। তিনি খুব ভালোই ভেঙাতে পারতেন। তাঁর মুখে নিজের কথাগুলো ওভাবে শুনতে কী যে খারাপ লাগত। যতবার তিনি ওই কাজটি করেছেন, প্রত্যেকবারের সব খুঁটিনাটি আমার হুবহু মনে আছে। এমনকি তিনি যখন ভেঙাচ্ছিলেন, তখন আমি কী পোশাক পরেছিলাম, সেটাও ভুলি নি। বিষয়টা এমন, যেন তিনি আমাকে—মানে আমার আকৃতিটিকে—ধারালো কাঁচি দিয়ে একটা ছবির বই থেকে কেটে বের করে তারপর দু’হাতে ছিঁড়ে ফেললেন।

এই ঘটনাটি প্রথমবার ঘটে যখন আমরা মাদ্রাজ থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। সেবার দুই সপ্তাহ মাদ্রাজে ছিলাম আমরা। মার বড়বোন মিসেস জোসেফ আর তার স্বামী ছুটিতে গিয়েছিলেন দুই সপ্তাহের জন্য। এই সময়টায় তাঁদের তিন সন্তানকে দেখাশোনার জন্য মা’কে বলেছিলেন। (এই সেই মিসেস জোসেফ, বহু বছর পর যার বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য দিল্লির এক অটোরিকশাচালককে বলব আমি)। মা রাজিও হয়েছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, এটা করলে আয়ামিনেমে তাঁর বসবাসের ঋণ কিছুটা শোধ হবে।

আয়ামিনেমের ঝগড়াটে বিশ্বনাগরিকদের থেকে চেয়ে অন্যরকম ছিল মিসেস জোসেফের জীবন। তার একজন গোছানো পরিপাটি স্বামী ছিল — যিনি ছিলেন ভারতীয় এয়ারলাইন্সের পাইলট। তাঁর ছিল গোছানো সন্তান এবং চাকরচাকরসহ একটি গোছানো বাড়ি। মিসেস জোসেফ এই বিষয়টা খুব ভালোই বুঝতেন। তাঁর ভাইবোনরা যা পারেনি তিনি পেরেছেন। তিনি দেখতেও সুদর্শনা। কিন্নর, আত্মতুষ্ট কণ্ঠে তিনি কথা বলতেন, যা তার মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা শাড়ি এবং পরিপাটি চুলের সঙ্গে মানিয়ে যেত। মুখে একটা মাপা, সবজান্তা ধরণের হাসি লেগে থাকত। যে মানুষের সাথেই  কথা বলতেন শুনলে মনে হত তাকে যেন গোপন কিছু জানাচ্ছেন। শারীরিক বা মানসিক কোন দিক থেকেই আমার মা'র সঙ্গে তার কোনো মিল ছিল না।

মিসেস জোসেফ ছুটি থেকে ফেরার পর কী একটা নিয়ে জানি দুই বোনের মধ্যে ভয়াবহ ঝগড়া হলো। পরদিন বিমানে করে আমরা কেরালা ফিরে গেলাম। আমার খালার পাইলট স্বামীর ফ্রি টিকিটের একটা কোটা ছিল।

আমরা আগে কোনদিন প্লেনে চড়িনি। আসন গ্রহণ করার পর আমার মনে হলো, সহযাত্রীর সাথে বড়দের মত যুক্তিপূর্ণ কিছু কথাবার্তা বলা দরকার। বিমানে তো তেমনটাই করে সবাই। তাই আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মিসেস জোসেফ যদি তার আসল বোন হন, তবে তিনি ওরকম পাতলা ছিপছিপে গড়নের হলেন কী করে? মানে, তিনি মার মতো মোটা কেন হলেন না? কথাটা শুনে মা খুব রেগে গেলেন। তিনি আমার কথাগুলো ভেঙ্গিয়ে অনুকরণ করলেন। আমার মনে হল, চামড়ার নিচে আমার সমস্ত শরীরটা কুঁকড়ে যাচ্ছে। আমি যেন সিঙ্কে পানির মতো ঘুরতে ঘুরতে নাই হয়ে গেলাম। তারপর তিনি বললেন, “যখন আমার মতো বয়সে যাবে, তখন তুমি আমার তিনগুণ মোটা হবে।” আমি বুঝতে পারছিলাম আমি ভয়ানক কিছু একটা তাঁকে বলেছি। কিন্তু সেটা যে ঠিক কী, তা ধরতে পারছিলাম না। (‘মোটা’ আর ‘চিকন’ যে মানুষের মূল্যমানের নির্ধারক হতে পারে, সেটা বোঝার মতো বয়স তখন হয়নি)। বহু বছর পরেও এই ঘটনাটা আমার মনে সিনেমার মতো চলতে থাকে। এবং এখন, যখন নিজের আবেগগুলো বাদ দিয়ে নিরপেক্ষভাবে সেটা চিন্তা করি, তখন উপলব্ধি করি যে আমার সেই কথাগুলো তাঁকে কী প্রচণ্ড কষ্ট দিয়েছিল।

মা তখন এজমার জন্য স্টেরয়েড নিচ্ছিলেন। ওষুধের কারণে হঠাৎ করেই তার ওজন খুব বেড়ে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন কর্টিসোন নেওয়া রোগীদের চাঁদের মতো ভোঁতা গোলাকার চেহারা হয়ে যায়। তারও তেমনই হয়েছিল। আগের সেই আকর্ষণীয় মুখশ্রী হারিয়ে গিয়েছিল ফোলা ফোলা গাল আর মেদবহুল থুতনির আড়ালে। সবেমাত্র তার সুচিক্কন বোনের নিখুঁত সংসার দেখে এসে নিশ্চয়ই হতাশায় অস্থির বোধ করছিলেন। সামনে তিনি বিশাল সফল ক্যারিয়ার করবেন। কিন্তু সেসব দিনের তখন কোন চিহ্ন নেই। (সময়ের পরিক্রমায় তিনি তার শরীরকে চমৎকারভাবে গ্রহণ করবেন। এমনকি তার ছাত্রদেরও তিনি একই জিনিস শিখাবেন। তার বয়স যখন পঞ্চাশ, তখন একবার স্কুলের ফ্যাশন শো'তে তিনি বেদিং স্যুটের মডেল হয়েছিলেন। সব বাচ্চাদেরকে দেখিয়েছিলেন কিভাবে কোমর দুলিয়ে স্টাইল করে হাঁটতে হয়।) এর মধ্যে তার ছিপছিপে গড়নের বোন নিয়ে করা প্রশ্নটি নিশ্চয়ই খোলা ঘায়ে সিরকার মতো জ্বালা ধরিয়েছিল। এক অবোধ শিশুর অবোধ কথাবার্তা। তাই, তিনি রেগে গেলেন এবং আমার ছয় বছরের বয়সের কথা বলার ঢং ভেঙ্গিয়ে দেখালেন। আর আমি গুটিয়ে যাই নিজের মাঝে। আমার মনে আছে বিমানের বাতাস —কোন বাতাসই ছিল না ভিতরে। আমার মনে আছে আমার জামার রঙ। আসমানি নীল রঙের জামায় বৃত্তের নকশা করা। আমার দীঘল চুলের হরিণী চোখের নিখুঁত খালাতো বোনের পরিত্যক্ত এক নিখুঁত জামা। আমি খেয়াল করলাম যে এই জামার সঙ্গে আমার হাঁটু নিচটা মিলছে না। নানান পুরোন কাটা ছেঁড়ায় আমার হাঁটুর নিচগুলো ভর্তি। ওটা যেন মীনাচিল নদীর তীরে আয়েমেনেমে আমার বন্য, অনিখুঁত, পিতৃহীন, পাইলটহীন জীবনের একটা সংক্ষিপ্ত খতিয়ান। আমার নিখুঁত খালাতো বোনের সঙ্গে আমি একটা কাল্পনিক প্রতিযোগিতা করলাম এবং বিশাল ব্যবধানে জিতলাম। এটা ঠিক যে তার ছিল পাইলট বাবা। দীর্ঘ চমৎকার চুল। কিন্তু আমার ছিল একটি সবুজ নদী। (তাতে মাছ ছিল, সকালে সেখানে ছায়া পড়ত আকাশ ও বৃক্ষমালার এবং রাতে ভগ্ন হলুদ চাঁদের)। আর ছিল একটি কাঠবিড়ালী। আমি আমার পায়ের দিকে লক্ষ্য করলাম। দেখলাম, এই পায়ে ওই স্যান্ডালগুলো মানাচ্ছে না।

কি বিশ্রী একটা প্লেন। বিশ্রী সব মানুষে ভর্তি। আর বিশ্রী একটা আকাশে সেটা উড়ে চলছে। আমার মনে হল এই প্লেনটা ক্র্যাশ করুক। আমরা সবাই যেন মরে যাই। সবচেয়ে অসহ্য লাগছিল আহ্লাদি বাপ মা ওয়ালা  ন্যাকাবোকা বাচ্চাগুলোকে। গণহারে সবার শাস্তির পক্ষে ছিলাম আমি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আমার মা বললেন, ‘আমি তোমার মা আর আমিই তোমার বাবা। আমি তোমাকে দুই গুণ ভালোবাসি।’

আর তখন প্লেনটাও সুন্দর ঠিকঠাক হয়ে গেলো। ঠিক হয়ে গেলো আকাশটাও। কিন্তু আমার পায়ের স্যান্ডালগুলো তখনও মানাচ্ছিলো না। তাছাড়া কিছু সমস্যার সমাধান তো হয় নি।

যেমন, আমি যদি মার তিনগুন হই, তাহলে আমার বসার জন্য তিনটা সিট লাগবে। মানে তিনটা ফ্রি টিকিট।

দুই গুণ। তিন গুণ। যেনো অংকের ক্লাস চলছে। একটা সমস্যা সমাধান করতে দিয়েছে।

দ্বিগুন ভালোবাসাকে আমার তিনগুণ দিয়ে ভাগ করে ফ্রি টিকিট দিয়ে গুণ করে যদি অবোধ কথাবার্তা দিয়ে ভাগ করি তাহলে কি পাওয়া যায়? পাওয়া যায়, একটা লোমশ মথ। শংকিত হৃদয়ের ওপর বসে যেটা শীতে শিরশির করে কাপঁছে। ঐ মথ হয়ে গেলো আমার সর্বক্ষণিক সঙ্গী।

কম বয়সেই শিখে গেলাম যে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাটাই আপনার জন্য হতে পারে সবচেয়ে বিপদজ্জনক। এমনকি পরিস্থিতি যখন তেমন নয়, তখনও আমি নিজে থেকেই ওরকম বানিয়ে নেই।

বহু বছর পরের কথা। আমার বয়স তখন তিরিশের কোঠায়। পূর্ণবয়স্ক এক নারী। বই প্রকাশ হওয়া ঔপন্যাসিক। তো, সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে এমন এক বন্ধুর কাছে বেড়াতে গিয়েছি। নবদম্পতি খুবই সুখী। সারাদিন একে অপরকে পাখির মতো ডাকাডাকি করে। শিশুভাষ্যে ন্যাকা ন্যাকা কথা বলে। দিনের পর দিন চলতেই থাকে এমন। তিন নম্বর দিন আমি উন্মাদের মতো তাদের বাড়ি থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসি। একটু হলেই রাস্তায় গাড়ির নিচে পড়ছিলাম। এমন প্রবল প্রতিক্রিয়া কি কারণে হলো জানি না। এই এখন এটা লিখতে গিয়ে মাত্র বুঝতে পারলাম। ওরা কিছুই খারাপ করেনি আমার সাথে— সমস্যা আসলে আমারই। আমার সেই শীতকাতর পুরনো মথ বন্ধুটি কিছু না জানিয়ে হঠাৎ দেখা করতে চলে এসেছিল।

(তারপরও, যেসব বয়স্করা শিশুভাষায় কথা বলেন, তাদের একটা সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ থাকলে আমার মত মানুষের সুবিধা হত। )

যে স্কুল গুটিয়ে ভাজ করে রাখা যেত

মাদ্রাজে মিসেস জোসেফের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া শেষ হল মন খারাপ দিয়ে। আমরা আয়ামিনেমে ফিরে এলাম। খাদের কিনারের সেই অনিশ্চিত জীবন আবার শুরু হলো।

কিন্তু তারপর, আসল মুক্তির সুযোগ।

সুযোগটি একজন কঠিন প্রকৃতির মধ্যবয়সী ব্রিটিশ মহিলার রূপে দেখা দিল। তিনি ভদ্রলোকদের মতো জুতো আর ফুল আঁকা জামা পরতেন। তিনি ছিলেন মিসেস ম্যাথিউস। উটিতে যে মিশনারিদের সঙ্গে মা খাতির জমিয়েছিলেন, তাদের একজন। আয়ামিনেমে আসার পরও এই বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। দু’জনে মিলে তাঁরা একটা পরিকল্পনা করেছিলেন।

একসাথে তারা কোট্টায়ামে একটা স্কুল চালু করলেন। তখন ১৯৬৭ সাল। আমি সাত, আর আমার ভাইয়ের বয়স সাড়ে আট।

তারা দুটো ছোট হলরুম ভাড়া করলেন। রুমদুটোর মালিক কোট্টায়াম রোটারি ক্লাব। সদস্যরা শুধু সন্ধ্যাবেলায় রুমগুলো ব্যবহার করতেন। সাতজন ছাত্র নিয়ে স্কুলটা চালু হলো। এর মধ্যে দু’জন আমি আর আমার ভাই। শুনতে সবটা সহজ মনে হয়। কিন্তু একা আমার মা কখনই এই স্কুলটা করতে পারতেন না। এখানে মিসেস ম্যাথিউসের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। একজন শ্বেতাঙ্গ, খাঁটি খ্রিষ্টান মিশনারিকে দেখে বাবা-মায়েরা সাহস পেয়েছিলেন — বিশেষ করে প্রথম দিকের ছাত্রদের ক্ষেত্রে তো এটা সত্য বটেই। মিসেস ম্যাথিউস না থাকলে মনে হয় না শহরের কেউ বাচ্চাদের এই স্কুলে পাঠাতে ভরসা পেতেন। একজন খ্যাপাটে স্বভাবের স্থানীয় মহিলা, যে বাইরের এক লোককে বিয়ে করে আবার তালাক দিয়ে চলে এসেছে, তার কাছে ছেলে-মেয়েদের পড়তে পাঠাবে কে!

এখন চিন্তা করলে মনে হয়, রোটারি ক্লাবের ঘর ভাড়া দেওয়ার জন্য জি. আইজ্যাকই কলাকাঠি নেড়েছিলেন সম্ভবত। কারণ তিনিও তো ক্লাবের সদস্য ছিলেন। তাঁদের ভাই-বোন সম্পর্কের এটা খুবই স্বাভাবিক দিক। যতটুকু ক্ষতি করবেন, সেই পরিমাণ উপকারও করে দেবেন।

প্রতিদিন সকালে মিসেস ম্যাথিউস, আমার মা, আমার ভাই আর আমি বাসে শহরে আসতাম সময়মত স্কুল শুরু করার জন্য। কিছু দিন আমি আর আমার ভাই জি. আইজ্যাকের সঙ্গে আসতাম। সূর্যের দিকে হেলে যাওয়া ধানক্ষেত আর রাবারবনের বুক চিরে হেঁটে চলতাম আমরা। বর্ষার দিনে পথঘাট সব ডুবে যেত। আমরা তখন ছোট ছোট নৌকা বেয়ে পার হতাম। হঠাৎ হঠাৎ গ্রামের কোন বাড়িতে এসে থামতাম। এইসব বাড়িতে আচার কারখানার কোন না কোন তরুণী কর্মচারী থাকত। তাদের সাথে হয় জি. আইজ্যাকের প্রেম চলছিল, নয়তো বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছিল। আমরা দু' ভাইবোন একরকম অভিভাবক হিসেবে যেতাম। আমাদের উপস্থিতি তরুণীদের পরিবারকে আশ্বস্ত করত জি. আইজ্যাক কোন বদ উদ্দেশ্যে আসেননি।















 


 



 














 

Comments

    Please login to post comment. Login