নুরু তার ভাগিনার বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পেরেছে যে তার ভাগিনা ইদানীং খুব উশৃংখল হয়ে উঠছে। মেয়ে সংক্রান্ত ইস্যুতে সে নাকি হতাশায় ভুগছে। যার তার সাথে গায়ে পড়ে মারামারি করছে। ভাগিনা এইচএসসি-তে পড়ে। অবশ্য নুরুকে তার বোন ও বোনজামাই আগেই তাকে তার ভাগিনা সম্পর্কে জানিয়েছিল। সে বাসাতেও খুব আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। তার ছোট বোনদেরকে যখন তখন মারতে শুরু করে। কারো কথা শুনতে চায়না। মাঝে মাঝে বলে, সে মরে যাবে, জীবনে বেচে থাকার উপর তার আগ্রহ উঠে গেছে।
নুরু তার ভাগিনা আর বোনজামাইকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসেছে। বোনজামাই অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ, এসব দেখার সময় নাই। অনেক করেই রাজি করাতে হয়েছে। একটা কোণে বসেছে, যেন ওদের আলোচনা কেউ শুনতে না পায়।
শুরুতেই বোনজামাই তার ছেলের বর্তমান করুন অবস্থা নিয়ে অনেক কথা বললেন। অনেক দু:খ এবং হতাশা প্রকাশ করলেন।
নুরু মনোযোগ দিয়ে শুনে বললো,"এতক্ষণ তো আপনার সমস্যার কথাই বললেন। আপনি কি বলতে পারবেন যে, আসলে ওর সমস্যাটা কোথায়? আপনার কি সময় আছে? আপনার কি মনে হয়? ওর সমস্যাটা কি? আপনি তো ওর বাবা?
এই বয়সে আপনার মানসিকতা কি ছিল? কখনো কি ওর পাশে বসে ওর অনুভূতিগুলো শুনতে চেয়েছেন?"
বোনজামাই এর কথা শুনে মনে হলো, এসব দেখা তার দায়িত্ব না। তার সাথে আর তর্কে গেলো না নুরু। আজকাল মা-বাবা জানেই না যে ছেলে একটা মেয়ের সাথে প্রেম করে এখন পাগল প্রায়। তাদের খোজ হয় যখন যে একদম ধংসের পথে চলে যায়। দেখা যায়, স্কুল পর্যন্ত মা-বাবা সন্তানকে কোলে করে আনা-নেওয়া করে। কিন্তু কলেজে উঠে যে ওরা এলোমেলো হয়ে যেতে পারে, সেই ব্যাপারে কারো খোজ নেই। তারা আশা করে হঠাৎ করে সন্তান অনেক দায়িত্বশীল আচরণ করবে, আর সন্তানের খোজ নেয়াটাকেও তারা তখন দায়িত্ব মনে করেনা।
ভাগিনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,"তোমার বর্তমান অবস্থা কি?"
ভাগিনা চুপ। আবার জিজ্ঞেস করলো,"মেয়েটা কে?আর বর্তমান অবস্থা কি?"
ভাগিনা সেদিকে না গিয়ে উত্তর দিল,"বাদ দাও। ওর নাম মুখেও আনতে চাইনা।"
এবার বোনজামাই এর দিকে তাকিয়ে বললো,"একটা মেয়ে ওকে ধোকা দিয়েছে। কিন্তু আপনার কাছে আমি জানতে চাই, আপনার কি কনে হয়? কেন সে একটা মেয়ের সাথে প্রেম করতে গেলো এই বয়সে?"
বোনজামাই এক্সপ্রেশন দেখে মনে হলো,"এসব ব্যাপার বোঝা তার সাধ্যের মধ্যে পড়েনা।"
একটু শান্ত হয়ে বললো,"এই বয়সে ছেলেমেয়েরা মানসিক এটাচমেন্ট, ইমোশনাল এটাচমেন্ট চায়। আপনাদের তো সময় নেই। পরিবারে যখন সে এটা পাবেনা, তখন সে বাইরে কারো কাছে খুজবে। হয়েছেও তাই। আর একটা মেয়েকে বিশ্বাস করে করেছে মহা ভুল।"
বোনজামাইকে দেখে মনে হলো কিছুই জানেনা।
নুরু আবার বলা শুরু করলো,"আপনার যে মানসিকতা। সে একটা ভুল থেকে এসেছে। তাকে বুঝার চেষ্টা তো করছেনই না উলটো তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন। এতে করে সে পরিবার থেকে আরো দূরে সরে যাবে। হয়ত নতুন কাউকে খুজবে মানসিক শান্তির জন্য, আরো ভুল করবে। আপনারা তো ভেতরে কি আছে তা দেখার সময় পাবেন না। সুযোগ পেলেই তাকে মানসিকভাবে আঘাত করবেন। সে আবার ভুল করবে। একটা সময় নানা প্রকার নেশায় ডুবে যাবে। আপনাদের সন্তান নিয়ে অভিযোগ আরো বাড়বে। কিন্তু ওকে বুঝার মতো মানসিকতাই আপনারা তৈরি করতে পারবেন না।"
হয়ত কথাগুলো বোনজামাই এর লেগেছে। হয়ত গায়েই লাগেনি। তবে এবার ভাগিনা কাদতে শুরু করেছে।
সে বলছে,"আমি এখন নিজেকেই ঘৃণা করি। আমি হয়ত আত্মহত্যা করে বসবো। আমি জানিনা কি করবো। জীবনের উপর মায়া উঠে গেছে।"
নুরু বোনজামাই এর দিকে তাকিয়ে বললো,"আপনি হয়ত বোঝার চেষ্টা করবেন না। বুঝতেও পারবেন না।"
এবার ভাগিনার দিকে তাকিয়ে বললো,"ওকে ভুলে যাও।"
ভাগিনা উত্তর দিল,"পারিনা।"
বোনজামাই এর দিকে তাকিয়ে বললো,"দেখেছেন?আপনাদের অবহেলায় ওর জীবনে চিরতরে একটা ক্ষত তৈরি হয়েছে। এটা কোনদিন যাবেনা।"
নুরু ভাগিনাকে বললো,"তোমার কাছে কি এটাকে ভালোবাসা মনে হয়?"
ভাগিনা মাথা নেড়ে সায় জানালো।
নুরু বললো,"এটা ভুল। এটাকে বলে মোহগ্রস্ত হওয়া। ইংরেজিতে বলে infatuation বা enchantment। এটা অবশ্যই প্রেম ভালোবাসা নয়।"
ভাগিনা আগ্রহভরে তাকালো। নুরু আবার বলা শুরু করলো," মন দিয়ে শুনো। Love at first sight বলতে কিছুই হয়না। এসব সিনেমাটিক কথাবার্তা, বাস্তবতার সাথে মিল নেই। তোমরা যেটাকে crush খাওয়া বলো, সেটাই হলো মোহগ্রস্ত হওয়া। মোহ কেটে গেলে মোহগ্রস্ত অবস্থায় কৃত ভুলের জন্য মানুষ নিজেকেও ঘৃণা করতে শুরু করে। এমনটাই হয়েছে তোমার বেলায়।"
ভাগিনা বললো,"ওকে আমি ঘৃণা করি। আবার ওকে ছাড়া থাকতেও পারছিনা।"
নুরু বললো,"সত্যিকারের ভালোবাসা হতে পারে যেমন তোমার জন্য তোমার মা-বাবার। অথবা তোমার মা-বাবার মাঝে যে সম্পর্ক সে রকম এটা হঠাৎ করে হয়ে যায়না। দুজন মানুষের মাঝে বিন্দু বিন্দু করে গড়ে উঠে। এটা এত সহজে ভেঙেও যায়না। অথচ কয়েকদিনেই তোমার মোহ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।"
ভাগিনা বললো,"এখন আমি কি করবো?"
নুরু বললো,"অনেক পথ খোলা আছে। তুমি পড়াশোনা ছেড়ে ভালো একটা সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করো। আর সংসার চালানোর জন্য চাকরি বা ব্যবসায় করো। অবশ্য এই পড়াশোনায় ঝাড়ুদারের চাকরিও পাবেনা।"
ভাগিনা বললো,"আমি পড়াশোনা করতে চাই। কিন্তু পারছিনা। ওই মেয়েকে দেখলেই আমার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।"
নুরু বোনজামাই এর দিকে তাকিয়ে বললো,"আগামীকালের মধ্যে ওর কলেজ মাইগ্রেশন করেন। অন্য কোন ভালো একটা কলেযে চলে গেলে আবার নতুন করে শুরু করতে পারবে।"
ভাগিনাও বললো,"এটাই ভালো হবে।"
নুরু ভাগিনাকে বললো,"মনে করো, একটা মেয়ের সাথে প্রেম করছো কিন্তু বিয়ে করতে পারোনি। যে কোন কারণেই বিয়ে হলোনা বা প্রেম ভেঙে গেল। এখন যে মেয়েকে বিয়ে করবে যদি শুনতে পাও সেও কারো সাথে সম্পর্ক করে এসেছে, তবে কষ্ট পাবেনা?"
ভাগিনা বললো,"কষ্ট তো পাবোই।"
নুরু বললো,"তাহলে আল্লাহর কাছে তওবা করো। ক্ষমা চাও। আর এই পথ থেকে ফিরে আসো। ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ অবশ্যই তোমার জন্য ভালো কিছু রেখেছেন।"
ভাগিনা প্রশ্ন করলো,"আমি কি ভালো মেয়ে পাবো?এখন আর কোন ভালো মেয়ে আছে বলে তো মনে হয়না।"
নুরু উত্তর দিলো,"এটা তোমার ভুল ধারণা। অনেক ভালো এবং সুন্দরী মেয়ে আছে। তুমি নিজে ভালো থাকলেই তো পাবে। দেখো, তোমার নিজের বোনেরাই তো কত ভালো। এমন অনেক মেয়ে আছে। তোমার খুজতে হবেনা ইনশাআল্লাহ।"
একটু থেমে আবার বলা শুরু করলো,"তুমি পড়াশোনাটা ভালো করে শেষ করে একটা কর্মসংস্থান করো। তারপর আমি নিযে ভালো মেয়ে খুজে তোমাকে বিয়ে দিবো ইনশাআল্লাহ। তোমার বাবাও আটকাতে পারবেনা।"
ভাগিনা একটু টয়লেটে গেলে বোনজামাই নুরুকে বললো,"ও এত কথা বলতে পারে? এতদিন তো চুপ মেরে থাকতো।"
নুরু বললো,"অবশ্যই বলতে পারে। আপনি তো এতদিন ওর মনের কথা শুনতে চাননি। মাঝে মাঝে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে খোজ খবর নিতে পারেন যদি দায়িত্ব মনে করেন।"
31
View