অবশেষে পুত্রের মান ভাঙ্গালেন দায়গ্রস্ত পিতা
==========================
সকালের তেজি রোদে শহূরে-কংক্রিটের পুচ্ছদেশ উত্তপ্ত হওয়া শুরু করেছে। অফিসে পৌঁছানোর যুদ্ধে আমাদেরও হেড টু বটম গরম হয়ে থাকে। আর সারাদিন চলে নানা মুখী যুদ্ধ।
তার আগে আয়েস করে ডিম-পরোটা খেতে খেতে ইউটিউব স্ক্রল করছিলাম।
সেখানে হাজির হয় সুলতান সুলেমান। ঠিক সুলতান সুলেমানও নয়। এলাকাতো বড়ভাই দীপক'দার একটা ইন্টারভিউ ভেসে আসে। তিনি সুলতান সুলেমানের বাংলা ডাবিং এর সাথে জড়িত ছিলেন। একটা সময় দীপ্ত টিভিতে 'সুলতান সুলেমান' ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। আমার অবশ্য দেখা হয়নি। ডাবিং এ দীপক'দার সংশ্লিষ্টতাও অনেক পরে জেনেছি।
২০২২ এ ৩ রাত ইস্তানবুল ও আশপাশ দেখার সুযোগ হয়েছিলো। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের শান-শওকত মুগ্ধ হয়েছি। আমার কাছে ইস্তানবুল বা তুরস্ককে দুনিয়ার অন্যতম সেরা ভিজিটিং প্লেস মনে হয়েছে।
ইন্টারভিউ থেকে আগ্রহ জন্মায়। সুলতান সুলেমানের নির্দেশে ছেলে মোস্তফাকে হত্যা করার দৃশ্যটা দেখলাম। সুলতান সুলেমান সিরিজ কেন এত জনপ্রিয় ছিল, ছোট একটা দৃশ্য দেখে বুঝতে পারি। মোস্তফাকে হত্যার মাধ্যমে ওসমানীয় বা অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। এটাও জানতে পারলাম। এই সিরিজ দীপ্ত টিভিকেও বাংলাদেশের জনগণের কাছে পরিচিত করে।
২।
অফিসে গিয়ে বাঁধে আরেক ঝামেলা। কত বিচিত্র রকমের মানুষ আছে, দিন যাচ্ছে আর দেখছি। অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ হচ্ছে। যদিও এই অভিজ্ঞতার পাঁচ পয়সাও দাম নেই।
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ওদের মা ক্ষেপে গেছে। সাফিনের ম্যাথ এক্সাম, পড়া শেষ করেনি। কয়দিন ধরে সাফিন অমনোযোগী। এবার ওকে ছাই দিয়ে ধরেছে।
আমি বরাবর সাফিনের পক্ষে থাকি। পড়া পারেনা? আচ্ছা পড়বে। থাক, অত শাসনের দরকার নেই। এভাবে পক্ষে থাকতে না পারলে নিরেপক্ষ জায়গায় চলে যাই। চোখের সামনে এসব অনাচার দেখতে ভালো লাগে না।
ওর মা ঝাড়ু দিয়ে ২/৩টা দেয়ার পরে দৌড়ে আমার কাছে চলে আসে। আমি যেন ত্রাণকর্তা হয়ে রক্ষা করি।
আমার যে কী হয়! ওর মায়ের হাত থেকে ঝাড়ু নিয়ে আমিও দুইটা দিয়ে দিই। আমার এই আচরণে সে হতভম্ব হয়। হতভম্ব হয় ওর মা, এমনকি সাফিয়াও। আমি বনে যাই বেকুব।
পরিস্থিতি থমথমে। সাফিনের কান্না থেমে আসলে নিস্তব্ধ নীরবতার ঢল নামে। ওরা ঘুমাতে যায়। আমি কতক্ষণ অং ভং করে বিছানায় যাই। সাফিন, ওর মা ঘুমিয়ে পড়েছে। কিংবা চুপচাপ শুয়ে আছে।
এতদিন গাঁয়ে হাত না তোলার রেকর্ড আজ ভেঙ্গে গেলো। নিজেকে চদু জনতার মত লাগে। রাতে ঘুম আসে না, আসলেও তৃপ্তি পাই না। অশান্তির রক্ত কণিকা সারা দেহের ধমনী, শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ে।

৩।
ভাবছিলাম সকাল হতে হতে আগের রাতের ঘটনা ভুলে যাবে। কিন্তু না, অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়না। স্কুলে নিয়ে গেলাম। স্কুলের পথে মনে হল, সাফিন যেন অপরিচিত বালক, আলাপ তখনও শুরু হয়নি।
স্কুল থেকে ফেরার পর ফোন দিলাম। অন্য সময়ে অন্য কেউ ফোন ধরার সুযোগ পায় না। কিন্তু আজ কেউ ফোন ধরছে না। ওর মাকে জিজ্ঞেস করায় বলল, সাফিন আমার সাথে কথা বলবে না।
ওর মা প্রায়শই বকা দেয়, লাগলে মাইর দেয়। এরপরেও কিছুক্ষণ পর, মায়ের কাছে গিয়ে এই আব্দার, সেই আব্দার। অথচ আমার সাথে সে কথা বলবে না। আমি মহা ভাবনায় পড়ে গেলাম। মায়ের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব। মায়ে মারলে দোষ নাই, বাপে মারলে মাফ নাই অবস্থা।
আজ অফিস থেকে ফিরতেও দেরি হল। সাগরে সামুদ্রিক ঘুর্নিঝড় 'মোন্থা' আঘাত হেনেছে। সন্ধ্যায় ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরছে। নতুন করে প্লান করলাম। সাফিনকে বাইরে নিয়ে কিছু খাওয়াইতে হবে।
৪।
অবাক কাণ্ড। সে আমার সাথে যাবে না। অথচ এরকম মুহুর্তের জন্য সারা বছর মুখিয়ে থাকে। অনেক বুঝিয়েও লাভ হল না। এরপর ওস্তাদ ধরলাম। ওর মাকে বললাম, ওকে রাজি করাও।
এরপরেও সে গররাজি। যাবে না। ওর মাকে আবারও বললাম, ভালো করে বোঝাও। তুমি পারবে। এরপর কাজ হল। আস্তে আস্তে বের হল।
কয়দিন থেকে টেস্টি ট্রিটের খাবার খুব পছন্দ করছে। নুরজাহান রোডের আউটলেটে ঢুকলাম। খাবে না। বাইরের খাবার খেলে সমস্যা হতে পারে। একদিনই কেমন বড় হয়ে গেলো। যে কথা আমি বলি, সেই কথা আমাকে বলছে। টিট ফর ট্যাট। তাজমহল রোডের মিনিসোতে ঢু মারি। সেখানেও কিছু পছন্দ হল না। কেমন গাঁ ছাড়া ভাব।
এই পর্যায়ে কথা বার্তা একটু স্বাভাবিক ঠেকছে। ওর তাগিদে টোকিও স্কয়ারের দিকে ছুটলাম। ঘুরে ঘারে একটা লেগো সেট মনে ধরেছে।
আজ কোন কিছুতে না নেই। যা লাগে বের করতে হবে। নিয়াত ভালো ছিল, আল্লাহ সহায় হয়েছেন। দাম খুব বেশি না। কিনলাম। দোকানদারকে অনুরোধ করে ছবিও তুললাম। অবশেষে স্বাভাবিকতা ফিরেছে।
৫।
নব্বইয়ে বেড়ে ওঠা আমাদের এই প্রজন্মের অনেক আনন্দময় স্মৃতি আছে। মর্তের এই দুনিয়াকে সম্পুর্ন এনালগ থেকে হাইলি ডিজিটাল হতে দেখেছি আমরা।
একটা বড় চ্যালেঞ্জও আছে। আমরা বেড়ে ওঠার কালে পিতা-মাতার কড়া শাসনে পূরা স্পিকটি-নট হয়ে ছিলাম। ভুল করলে উঠতে বসতে শপাং শপাং মাইর হজম করতে হয়েছে। এরপর দীর্ঘ সময় পালিয়ে বাঁচতে হয়েছে। সন্ধ্যা রাতে বাড়িতে ফিরেও হাঁটু কাঁপা থামেনি। আরেক দফা হয় নাকি, সেই ভয়ে।
এখন পিতা হয়ে আমাদেরই কাবু হয়ে থাকতে হয়। ওদের উপর বেশি রাগ করার সুযোগ নেই। কোনভাবে রাগ হয়ে গেলে প্রচুর উৎকোচ দিয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হয়। আমরা সারা জীবন ভীত হয়ে থাকা সেই বালক রয়ে গেলাম।
সেই ঘটনার একটা ছোট ডেমো হয়ে গেলো। পরিবর্তন হবেই। Change is the only Constant. সে অবশ্য মন্দ নয়, যদি খাপ খাওয়ায়ে নেয়া যায়।
মোহাম্মদপুর, ঢাকা
২৯ অক্টোবর ২০২৫