আব্বা ছিল ভীষণ রাগী মানুষ। আর উনার সেই রাগী রূপ দেখেছে মূলত বড় তিন ভাই। শুধু পরিবারের সদস্যরা নয়, পাড়া, গ্রাম ছাড়িয়ে আশেপাশের গ্রামের মানুষও ওয়াকিবহাল ছিলেন। একবার আব্বা মেজ শহীদুল ভাইকে একবার গাছে টাঙ্গিয়ে পিটিয়েছিল।
খুব ছোটবেলায় মা মারা যায় আমাদের। অর্থাৎ বাপের হাতে মাইর খাওয়ার বয়সে পৌছার আগেই এতিম খেতাবে ভূষিত হই। বলতে গেলে এই খেতাব বাপের হাতের পিটুনি থেকে রক্ষা করেছে। মা মারা যাওয়ার পর আমরা গ্রাম থেকে উপজেলা শহরে চলে আসি।
কিছু স্মৃতি আজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। ভুলে যাওয়ার কোন উপায় নেই। এর মধ্যে বাপের পিটুনিও আছে। যতদূর মনে পড়ে, বাপের হাতে দুই দফায় খুব মাইর খাই।
প্রথমবার গ্রামে থাকতে। আসলে আমার নিজের দোষে ঝড়টা আমার উপর দিয়ে যায়। ছোটবেলায় আমার খুব জেদ ছিল। জেদ যে এখন নেই, তাও বলা যাবে না। তবে সেটাকে সহজে গর্ত থেকে বের হতে দেয়া হয় না, এই আর কী।
প্রথম পিটুনি খাওয়ার গল্প বলি। আব্বা কোথাও যাচ্ছেন। আমি খুব জিদ করছি। আবার সাথে আমিও যাবো। আমাকে বুঝালেন, সাথে নেয়া সম্ভব না। দূরে কোথাও যাবেন। কিন্তু আমি কথা শুনছি না। যাবোই যাবো। পাঞ্জাবি বা শার্ট কিছু একটা টেনে ধরে রেখেছি। আব্বা সামনে আগাচ্ছেন, আমি ছেঁচড়ে চলে যাচ্ছি।
এই যখন অবস্থা, বাপের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। এরপর ডিফেন্সের খেলোয়াড় যেভাবে ফুটবলে কিক মারে, ঠিক ওইভাবে কিক মারে। একটা মেরে ছেড়ে দেয় না, একটার পর একটা চলতে থাকে। সাথে সাথে আমি কক করে উঠি। জান ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে শুরু করি। সাথে মাটিতে গড়াগড়ি চলে। আব্বা চলে যাচ্ছে দেখে কান্নার রোল বাড়িয়ে দেই। গড়াগড়ির হারও বাড়তে থাকে। ধুলা ময়লা গাঁয়ে মাখামাখি হয়ে আমাকে সাক্ষাৎ হ্যালোউইনের ভূতের চেয়েও বেশি ভুতুড়ে লাগে।
এক সময় কান্না থেমে যায়। কিন্তু অনেকক্ষণ হেঁচকি চলে। হিক্কি হিক হোক হিক্কি হিক হক ......
২।
দ্বিতীয় দফায় যখন মাইর খাই, তখন আমরা শহরে চলে এসেছি। যদিও সেটি ১ম দফার মাইরের কয়েক বছর পরে, তবু সঠিক কারণ মনে নেই।
যতদূর মনে পড়ে, কিছু একটা কিনে চাইছিলাম। আব্বা বলেছে, হাতের অবস্থা ভালো নাই, পরে কিনে দিবেন। কিন্তু ঐযে, জিদ, আমার আজকেই লাগবে। আব্বা বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন। ঘ্যানর ঘ্যানর করতে করতে জ্ঞানাঙ্কুর স্কুল মোড় পর্যন্ত চলে আসি। স্কুল পার হয়ে পুবালি ব্যাংকের অফিস। সেটার বিপরীতে একটা হোটেল (রেস্টুরেন্ট)। আব্বার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে দেই আমি। এরপর গাঁয়ের সব জোর লাগিয়ে বড়-সড় হাত দিয়ে ঠাস করে চড় মেরে দেয়। এরপর আরও চড় খাওয়ার আগে ভো-দৌড় দিয়ে পালিয়ে যাই।
আমি তখন অনেক ছোট। গ্রাম থেকে চলে আসার পর সেদিন আবার চোখে সর্ষে ফুল দেখতে পাই। চড়ের ঠেলায় মাথা টলে যায়, চোখে কিছুই দেখতে পাই না।
এরপর মাথা খুলে যায় আমার। কোন কিছু চাইতে হলে, নিজের আব্দার পাড়ার আগে পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝেই চলতাম। হয়ত আব্বা একটু বেশি ভালবাসতেন। সব মিলিয়ে এরপর আর কোনদিন বাপের হাতে ধোলাইয়ের স্বীকার হইনি।
৩।
আমরা মূলত নব্বইয়ের সন্তান। আমাদের সময়ে মারামারি হত খেলা নিয়ে, এলাকার আধিপত্য নিয়ে। আর বিশেষ ছিল মেয়ে নিয়ে। আমার পাড়ার মেয়ে,প্রেম হলে আমাদের সাথে হবে। তুই এতদূর থেকে এসে কিভাবে প্রেম করিস? তোর তো সাহস কম না। এরপর পাড়ার ছেলেরা মিলে ইচ্ছেমত মাইর। এরপর ওরা বাগে পেলে ইচ্ছেমত মাইর। মেয়েরাও ছিল সেই রকম। মারামারি করে যে টিকে থাকবে, তার সাথে প্রেম চলবে। জো জিতা ওহি সিকান্দার।
বাপের পরে জীবনে একবার বেকায়দা মত মাইর খেয়েছিলাম। কী একটা বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কির পর ঝগড়া লেগে যায়। পাশের বাড়ির রতনের সাথে। ঐদিন ওর ছিল রাজ কপাল। ওর হাতে ছিল একটা লাঠি। এরপর মারামারি শুরু হলে রতন তার হাতের লাঠির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে। ইচ্ছেমত মাইর খাই। রতনের হাতে মাইর খেয়ে দুঃখ পাইছি, তার চেয়েও বেশি কষ্ট লাগছে আমার বড় অহিদ ভাইয়ের কাণ্ড দেখে। সে সেখানে উপস্থিত ছিল, কিন্তু আমাকে রক্ষা করতে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। হয়ত এমনও হতে পারে, কী করবে বোঝার আগে আমার মাইর খাওয়া শেষ।
আরেকটা ঘটনা বলে শেষ করি। ফুটবল খেলতে গিয়ে মারামারি লেগেছে গুলমণ্ডির সাথে। ওর মাথার সাইজ বেশ ছোট ছিল। সেজন্য ওকে আমরা গুলমণ্ডি ডাকতাম। আসল নাম ভুলে গেছি। মাইর খেয়ে কোন ফাঁকে ওর খালাকে ডেকে নিয়ে এসেছে।
ওরা বিহারি ছিল। রেলে চাকরির সুবাদে আমাদের এলাকায় অনেক বিহারি ছিল। ওর খালা এসে চিল্লাতে শুরু করে, 'এ রাণ্ডী কা বেটা, উসকো কিউ মারা রে। কিউ মারা বোল'। বলেই ক্ষান্ত হয় না, দুজনে মিলে আমাকে মারতে চেষ্টা করে। আমিও কম যাই না। সুযোগ মত লাফ দিয়ে গুলমণ্ডির খালার গালে ঘুষি মেরে চম্পট। আর পায় কে!
৪।
সকলেরই বেড়ে ওঠার বহু সুখ-স্মৃতি আছে। সে সময় দুঃখের কারণ হলেও সুখ-স্মৃতি হিসেবে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকে। আপনিও খুলে দিতে পারেন, আপনার সুখ-স্মৃতির দুয়ার।