সৃষ্টির বৈচিত্র্য হিসেবে মানবসমাজের ইতিহাসে বিশেষভাবে সক্ষম বা প্রতিবন্ধী শিশু জন্মানোর ঘটনা ঘটে। স্বাভাবিক ও সুস্থ মানুষের প্রাধান্য থাকা সমাজে প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মানো শিশু জীবনের শুরু থেকেই যে বৈষম্যের মুখোমুখি হয়, তা কোনো সভ্য সমাজে কাম্য না হলেও প্রতিবন্ধী শিশুর বিকাশের জন্য আন্তরিকতাপূর্ণ মানবিক সমাজ আমরা এখনো তৈরি করতে পারিনি। যে কারণে প্রতিবন্ধী শিশুর বাবা-মা বা নিকটাত্মীয় শিশুটির প্রতি যতটা মমতা প্রদর্শন করে, ঠিক একই কারণে পরিবারের বাইরের গণ্ডিতে শিশুটি ততটাই অসহায়ত্ব অনুভব করে। এ রকম বাস্তবতা অনেকটা ‘চলার পথে প্রতিবন্ধীকে নেই সাথে’ ট্রাফিক নির্দেশনারই প্রতিচ্ছবি, কারণ প্রতিবন্ধী মানুষকে নিয়ে কেউ পথ চলতে চায় না। সবাই শুধু নিজ গন্তব্যের দিকেই ধাবিত হতে ইচ্ছুক। ফলে যাপিত সামাজিক জীবনেও এমন মানসিকতা পোষণ করার ফলে আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধী শিশুর বিকাশের পথ স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠেনি।
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী বা বিশেষ শিশুদের অর্ধেকেরও বেশি স্কুলে যায় না উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউনাইটেড নেশনস ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন’স ইমারজেন্সি ফান্ড (ইউনিসেফ)। জাতীয় পর্যায়ের নতুন উপাত্ত অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি বলছে, প্রতিবন্ধী / বিশেষ শিশুদের বেশির ভাগই কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় নথিভুক্ত নয়।
ইউনিসেফের সহযোগিতায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ (এনএসপিডি) ২০২১-এ এমন তথ্য পাওয়া গেছে। জরিপ বলছে, প্রতিবন্ধী শিশুদের (৫-১৭ বছর বয়সী) মধ্যে মাত্র ৬৫ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং মাত্র ৩৫ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নথিভুক্ত আছে। সে হিসাবে মোট ৬০ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে রয়ে গেছে।
এমন দৃশ্য আমাদের জন্য অপ্রত্যাশিত, কারণ প্রতিবন্ধী শিশুরা এ সমাজেরই অংশ। আর দশটি স্বাভাবিক শিশুর মতোই প্রতিবন্ধী শিশুরও শিক্ষা লাভের অধিকার আছে। এজন্য সমাজের মূল ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমে ভর্তির সুযোগ দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু এটি যখন বিভিন্ন কারণে সম্ভবপর হচ্ছে না, তখন প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষায়িত স্কুলগুলোয় প্রতিবন্ধী শিশু ভর্তি কার্যক্রমের ওপর জোর দিতে হবে। কারণ প্রতিবন্ধী স্কুল থাকার পরও স্কুলগুলোয় শিক্ষার্থী ভর্তির হার আশানুরূপ নয়।
সরকার পরিচালিত স্কুলগুলোয় দক্ষ শিক্ষকের মাধ্যমে পাঠদান করা হলেও অভিভাবকরা তাদের বিশেষভাবে সক্ষম শিশুটিকে প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি করাতে ইচ্ছুক হন না। এক্ষেত্রে সরকারি স্কুলে পড়াশোনার মান কেমন সেটি নিয়ে যেমন তারা শঙ্কামুক্ত নন, তেমনিভাবে এমপিওভুক্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে বেসরকারি প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষকদের আন্দোলনের বিষয়টিও আমরা অতীতে দেখতে পেয়েছি। যার ফলে প্রতিবন্ধী স্কুলগুলো ভালোভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা সে বিষয়টি নিয়ে সন্দিহান হওয়াটাও স্বাভাবিক।
একটি স্বাভাবিক শিশুকে পড়ানোর চেয়ে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুকে পড়ানো অনেক বেশি কষ্টের। অনেক বেশি পরিশ্রমের। যে কারণে স্বাভাবিক স্কুলে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। এজন্য প্রতিবন্ধী স্কুলগুলো যেন সঠিকভাবে পরিচালিত হয় সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দেখভাল করতে হবে।
প্রতিবন্ধী শিশুরা যেসব বিদ্যালয়ে পড়ে, সেখানে তাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। তাদের উপযোগী বিদ্যালয়ের ঘর, দরজা, সিঁড়ি, টয়লেট, বেঞ্চ, টেবিল তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতিবন্ধী স্কুলের সুযোগ-সুবিধার কেউ যেন অপব্যবহার না করতে পারে সেটিও পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে ৬৪ জেলায় একটি করে সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুল, সাতটি শ্রবণপ্রতিবন্ধী স্কুল, পাঁচটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুল, ৫৬টি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুল রয়েছে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুলের মধ্যে সুইড বাংলাদেশ পরিচালিত ৪৮টি, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন পরিচালিত সাতটি ইনক্লুসিভ স্কুল এবং প্রয়াস পরিচালিত একটি অটিস্টিক স্কুল রয়েছে। এছাড়া রাজধানীর মিরপুরে ‘জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্র’ রয়েছে।
এসব স্কুলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ পাচ্ছে কিনা সেটি যাচাই করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে যারা অন্য কোনো চাকরিতে না গিয়ে প্রতিবন্ধী শিশুদের পড়ানোর গুরুদায়িত্ব পালন করছেন তাদের কথাও বিবেচনা করতে হবে। নিকট অতীতের মতো প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষকরা যদি রাজপথে নেমে আন্দোলন করেন, তাহলে তা এ স্কুলগুলোর দুরবস্থাকেই তুলে ধরবে।
তাই প্রতিবন্ধী স্কুলগুলোর প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ দৃষ্টি প্রয়োজন। স্কুলগুলোয় অভিভাবকরা যেন প্রতিবন্ধী শিশুদের পাঠাতে উৎসাহী হন সেটি নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবন্ধী শিশুরা সমাজের জন্য বোঝা নয়, তাদের সঠিকভাবে শিক্ষিত করা গেলে তারা সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে, এ দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে অভিভাবকদের প্রথমে সচেতন হতে হবে।
ইউনিসেফের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিশুরা বাংলাদেশে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার ৯৭ শতাংশ হলেও মাত্র ১১ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু যেকোনো ধরনের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়।
জন্মনিবন্ধন না করার মধ্য দিয়ে প্রতিবন্ধী অনেক শিশুর জীবনের প্রথম থেকেই বঞ্চনার শুরু হয়। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির কারণে তারা সামাজিক সেবা ও আইনগত নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হয়।
প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য গৃহীত উদ্যোগগুলো বিশেষায়িত ও আলাদা। এ ধরনের উদ্যোগগুলো মূলধারার কর্মসূচি ও সেবার আওতার বাইরে থেকে যায়। এক্ষেত্রে ধীরগতির উন্নয়ন সত্ত্বেও পরিমার্জন এবং সামাজিক সচেতনতার কারণে পরিবর্তনগুলো লক্ষ করা যায়। বর্তমানে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকারের বাড়তি সুযোগ এবং দক্ষতার বিকাশ ও চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের যথাযথ বিকাশে এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। বিবিএস প্রথমবারের মতো প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে জরিপ করেছে। জরিপে প্রতিবন্ধী শিশুরা বেড়ে ওঠার সময় কত ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় তা তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের মধ্যে কতজন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত নতুন এ তথ্য তা তুলে ধরেছে। রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিতের জন্য পরিকল্পনা ও উদ্যোগ প্রণয়নে সরকারকে সহায়তা করবে।
বস্তুত প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুদের সর্বোচ্চ বিকাশের জন্য শৈশবে দ্রুত শনাক্ত করা ও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া গুরুত্বপূর্ণ। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি করাও দরকার, যেখানে পরিবার ও সেবা প্রদানকারীরা এ শিশুদের জীবনের সবখানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণে সহায়তা করবে। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রতিবন্ধী শিশুদের বৃহৎ আকারে অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। বিশেষভাবে সক্ষম শিশুরা উপযুক্ত শিক্ষা পেলে সমাজে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। তাই প্রতিবন্ধী শিশুদের কথা ভেবে বিশেষায়িত স্কুলগুলোর কার্যক্রম বৃদ্ধির পাশাপাশি স্কুলগুলোয় উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা হোক।