ভূমিকা
মানুষের অস্তিত্ব মূলত দুটি বিপরীত শক্তির এক অবিরাম যুদ্ধক্ষেত্র। একটি শক্তি হলো 'মন', যা বিবেক, যুক্তি এবং সঠিক পথের প্রতীক। অন্যটি হলো 'নফস', যা মানুষের ভেতরের কুপ্রবৃত্তি, লোভ, আলস্য এবং ক্ষণস্থায়ী আরামের প্রতি আকর্ষণকে নির্দেশ করে। এই দুই শক্তির দ্বন্দ্ব মানুষের প্রতিটি সিদ্ধান্ত, কাজ এবং জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে। এই প্রতীকী গল্পটি সেই চিরন্তন সংগ্রামকে তুলে ধরে, যেখানে মন এবং নফস একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকে এবং ব্যক্তির জীবন কোন পথে পরিচালিত হবে, তা নির্ধারণ করে।
মন আর নফসের যুদ্ধ
একদা 'চেতনাপুর' নামক এক নগরে বাস করত দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী—'মন' আর 'নফস'। মন ছিল শান্ত, বিবেকী এক সাধু, যার কাজ ছিল সঠিক পথের দিশা দেখানো। আর নফস ছিল চঞ্চল, লোভী এক দৈত্য, যে কেবল আরাম, বিলাসিতা আর ক্ষণিকের আনন্দের পেছনে ছুটত।
তাদের যুদ্ধটা ছিল মূলত এক অদৃশ্য ময়দানে, যার নাম ছিল 'হৃদয়'।
একদিন সকালে, মন তার নিত্যদিনের প্রার্থনায় বসতে যাচ্ছিল। এমন সময় নফস এক সুস্বাদু খাবারের থালা হাতে হাজির। "আরে মন ভাই! এত সকালে ইবাদত? এসো, এই গরম লুচি আর হালুয়া খাও। জীবনটা তো একটাই, একটু আরাম করো!"
মন মিষ্টি হেসে বলল, "নফস, আমি জানি এর স্বাদ ক্ষণিকের। কিন্তু এর পরের আলস্য আর কাজের প্রতি অনীহা আমার লক্ষ্য অর্জনে বাধা দেবে।"
নফস দাঁত কিড়মিড় করে বলল, "তোমার লক্ষ্য? কী হবে সেই লক্ষ্যে পৌঁছে, যদি জীবনে কোনো আনন্দই না থাকে?"
তাদের এই বাগ্বিতণ্ডার মধ্যেই শহরে এক মহামারী দেখা দিল। বহু লোক অসুস্থ হয়ে পড়ল, তাদের সেবার জন্য লোক প্রয়োজন।
মন বলল, "এই তো সুযোগ, চলো আমরা মানুষের সেবা করি। এতে শান্তিও মিলবে, আর কর্তব্যের পালনও হবে।"
নফস চোখ বড় বড় করে বলল, "সেবা? এই নোংরা রোগীদের কাছে যাব? ধুর্! আমি বরং ঘরে বসে আরাম করি, নয়তো বন্ধুদের সাথে তাস খেলি।"
যুদ্ধ এবার চরম আকার ধারণ করল। মন সেবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু নফস সারাক্ষণ তার কানে ফিসফিস করত, "ফিরে এসো! তুমি ক্লান্ত হয়ে যাবে, তোমার নিজের কী হবে? সবাই তো নিজের আখের গোছাচ্ছে, তুমি কেন বোকার মতো খাটছ?"
মনের যাত্রাপথ কঠিন হয়ে উঠল। সেবার কাজ করতে গিয়ে তার শরীর ভেঙে পড়ল, কিন্তু মনের ভেতরের আলো আরও উজ্জ্বল হলো। সে জানত, নফসের প্রতিটি লোভনীয় প্রস্তাব এক একটি ফাঁদ, যা তাকে তার মূল উদ্দেশ্য থেকে সরিয়ে দেবে।
অবশেষে, বহু দিন পর মহামারী শেষ হলো। যারা সেবার কাজ করেছিল, সবাই তাদের সম্মান জানাল। মনের ভেতরে এক অপার্থিব শান্তি আর তৃপ্তি।
আর নফস? সে তখনো অন্ধকার কোণে বসে ফোঁস ফোঁস করছিল। কারণ সে দেখেছিল, ক্ষণিকের আরামের চেয়ে প্রকৃত শান্তি আর উদ্দেশ্যমূলক জীবন অনেক বেশি শক্তিশালী।
এইভাবে, 'হৃদয়' নামক ময়দানে মন জয়ী হলো। সে প্রমাণ করল, নফসের ধোঁকা থেকে বাঁচতে হলে প্রয়োজন দৃঢ় সংকল্প, ত্যাগ আর সঠিক কাজের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা।
মন আর নফসের যুদ্ধ" গল্পের মূল বক্তব্য হলো:
মানুষের জীবনে ভালো (বিবেক/মন) এবং মন্দ (কুপ্রবৃত্তি/নফস) শক্তির মধ্যে একটি চিরন্তন সংগ্রাম বিদ্যমান। এই গল্পে দেখানো হয়েছে যে, নফস সব সময় ক্ষণস্থায়ী আরাম, আনন্দ এবং স্বার্থপরতার দিকে টানে, আর মন মানুষকে দায়িত্ব, ত্যাগ এবং দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথ দেখায়।