কাল্পনিক কাহিনী নই, বাস্তব ঘটনার আক্ষরিক বিবরণ। চন্দ্রগঞ্জ থানা লক্ষীপুর। বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমী, সারদার এক বছরের কঠিন প্রশিক্ষন শেষে পিএসআই (প্রবেশনার সাব-ইন্সপেক্টর) হিসাবে লক্ষীপুর জেলায় যোগদান করে শামীম (ছদ্ধ নাম) সাহেব। লক্ষীপুর জেলার পুলিশের বিভিন্ন শাখায় মাঠ পর্যায়ের আরো একবছরের প্রশিক্ষণ শেষে চাকুরীতে স্থায়ী নিয়োগ পেয়ে চন্দ্রগঞ্জ থানায় যোগদান করে।
চোখ ভরা স্বপ্ন ও বুকভরা সাহস নিয়ে জনগনের সেবার মানসিকতায় উজ্জীবিত তরুণ অফিসার। কারো সাথে মেজাজ দেখিয়ে কথা বলে না। কাউকে জিম্মি করে মাল কামানোর তাড়নাও নাই। তার এই সততা ও সরলতার কারণে ওসির নিকট সে নির্বোধ ও অকর্মা অফিসার হিসাবে পরিগণিত হতে থাকে। ওসির ভাষায় আনফিট আফিসার। ওসি তাকে সবসমর ঝুকিপূর্ণ কাজগুলোর দায়িত্ব দেয় যেন সে বেকায়দায় পড়লে হেনস্তা করা যায়।
আদালত থেকে একটি মামলা ট্রিট ফর এফআইআর (প্রদত্ত ড্রাফ অভিযোগ কে এজাহার হিসাবে থানায় নিয়মিত মামলা রুজু) করার আদেশ প্রদান করা হয়। ওসি সাহেব এ মামলার তদন্তভার শামীম সাহেবের উপর অর্পণ করেন। রাজনৈতিক তদবিরের কারণে কোর্ট চাপে পড়ে এই মামলা নিয়েছে। এজাহার পড়লেই বুঝা যায়। কবুতর নিয়ে চাচার পরিবারের সাথে- ভাতিজার তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে চাচার বড়ছেলে ভিকটিমকে গাছের ডাল দিয়ে মাথায় বাড়ি দিলে, মাথা সামান্য ফেটে যায়। সচরাচর এরূপ ঘটনার কোন অভিযোগ আদলতে গেলে, আদালত তা স্থানীয় থানার ওসি বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন প্রদানের আদেশ প্রদান করে থাকেন। ভিকটিম ছেলেটি ক্ষমতাসীন দলের সক্রিয় কর্মী হওয়ার রাজনৈতিক নেতাদের শক্তিশালী তদবিরের কারণে আদালতকে মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্তের আদেশ প্রদান না করে সরাসরি নিয়মিত মামলা রুজুর আদেশ দিতে বাধ্য করা হয়। যাক সে কথা, আমাদের দেশের আমলারা চেয়ার ধরে রাখার জন্য বরাবরই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের লেজুড়বৃত্তি করে। সে হোক বিচারক বা প্রশাসনের কর্মচারী। কর্মচারী মানে ছোট পদাধিকারী কর্মী নই বরং জেলা পর্যায়ের এলিট শ্রেণীর কর্মী।
শামীম সাহেব মামলার এজাহার প্রাপ্তির পর এজাহার পর্যালোচনা করে এবং সরজমিনে মামলার ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও স্থানীয় সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহনের জন্য মামলায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। ভিকটিমের ক্ষতস্থান দেখেন এবং তাকে মালার ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সে মামলার ঘটনা নিজ মুখে বলেন। পরে বাদী- বিবাদের অনুপস্থিতিতে স্থানীয় সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে থানায় এসে ওসি ও পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত)কে ঘটনার বিষয়ে অবহিত করেন। তারা তদন্ত কার্যদ্রুত শেষ কর তারাতাড়ি আদালতে প্রতিবেদন প্রেরণ করতে বলেন। পরের দিন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংঘটনের স্থানীয় উপজেলা সভাপতি থানায় আসলেন। শামীম সাহেবের সাথে দেখা করলেন এবং দ্রুত আসামি গ্রেফতার করার অনুরোধ করলেন। শামীম সাহেব আসামি গ্রেফতারে তৎপর আছে মর্মে তাদের জানান। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন দলের মুল সংগঠনের জেলা সভাপতি শামীম সাহেবকে ঐ মামলার বিষয় নিয়ে ফোন করেছিল। শামীম সাহেবকে ভিকটিম তাদের দলের নেতা বলে পরিচয় করে তাদের দিকটা দেখার কথা বলেন। শামীম সাহেব তাকে তদন্তে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে পুলিশ প্রতিবেদন প্রদান করবে এবং ন্যয় প্রতিষ্ঠিত হবে মর্মে জানান।
মামলা হওয়ার পর আসামিরা অজ্ঞাত স্থানে আত্নগোপন করায় তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয় নাই। ১৫/১৬ দিনের মধ্যে মামলার প্রধান আসামিকে শামীম সাহেব গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করেন। আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণের আদেশ প্রদান করেন।
শামীম সাহেব ভিকটিমের এমসি (আঘাতের প্রকৃতি সম্পর্কে প্রতিবেদন) এর জন্য সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে আবেদন প্রেরণ করেছিলেন। ১মাস পরে ডাক্তার সাহেব ডাকযোগে এমসি প্রদান করেন। এমসিতে ডাক্তার "ভোতা অস্ত্র দ্বারা সাধারণ আঘাত" বলে মতামত প্রদান করেন।
শামীম সাহেব এমসি প্রতিবেদন সহকারে আদালতে প্ররণ করেন এবং দ্রুত মামলার প্রতিবেদন প্রেরণ করা হবে বলে আদালতকে অবগত করেন। এমসি পাওয়ার পর আদালত পরবর্তী শুনানিতে আসামি কে জামিন প্রদান সহ অপরাপর আসামিদের জামিন মঞ্জুর করেন।
মামলার এজাহারে মূল অভিযোগ ছিল কবুতর চুরি ও ভিকটিমের মাথায় আঘাত করা। তদন্তে প্রাপ্ত সাক্ষ্য মতে কবুতর চুরির বিষয়টি সত্য নই আর ডাক্তারি সনদ অনুযায়ী ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৩২৩ ধারার অপরাধের স্বপক্ষে তথ্য - প্রমান পাওয়া যায়। যা অধর্তব্য অপরাধ। যার জন্য অভিযোগ পত্র দেওয়ার বিধান নাই। চুড়ান্ত রিপোর্টের মাধ্যমে আদালতকে অবহিত করতে হয়।
পরের দিন সকালে ওসি সাহেব শামীম সাহেবকে তলব করেন এবং পূর্বে উল্লেখিত মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাই। শামীম সাহেব বলেন, উক্ত মামলার প্রধান অভিযোগ চুরি ও আঘাত করার অপরাধ। চুরির বিষয়ে সাক্ষ্য - প্রমানে সত্যতা পাওয়া যায়নি। আর আঘাত করার যে অপরাধ তা ডাক্তারি সনদ অনুযায়ী ৩২৩ ধারা অপরাধ প্রমানিত হয়। যা অধর্তব্য অপরাধ। সে হিসাবে অভিযোগ পত্র দেওয়ার বিধান নাই। চুড়ান্ত রিপোর্টের মাধ্যমে আদালতকে অবহিত করতে হবে। ওসি সাহেব বলেন, ওটা অভিযোগ পত্র দিতে হবে। শামীম সাহেব বলল কি ভাবে স্যার? ওসি সাহেব বললেন, চুরির অপরাধ প্রমানিত হয়েছে মর্মে রিপোর্ট পেশ কর। স্যার, আমি মিথ্যা প্রতিবেদন দিতে পারব না। ওসি সাহেব বললেন, ক্ষমতাসীন দলের জেলা সভাপতি তাকে ফোন করে যে কোন ভাবে অভিযোগ পত্র দাখিল করতে চাপ দিচ্ছে। তাই অভিযোগ পত্র দিতে হবে। শামীম সাহেব ওসিকে সাফ জানিয়ে দিলেন, সে কোন পরিস্থিতিতেই মিথ্যা প্রতিবেদন দাখিল করবেন না।
পরে ঐ দিন ওসি সাহেব মামলার তদন্তকারী অফিসার পরিবর্তন করলেন। দুই দিন পরে শামীম সাহেব জানতে পারলেন তার বান্দরবান জেলায় বদলি হয়েছে। স্টেন্ড রিলিজ। তাকে চলে যেতে হবে পরের দিন। শামীম সাহেব বান্দরবান চলে গেলেন। পরে জানতে পরলেন, পরবর্তী তদন্তকারী অফিসার ঐ মামলায় অভিযোগ পত্র দাখিল করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ভাবেই চলছে স্বদেশ। শামীম সাহেবদের পাহাড়ে বদলি হয়। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপে মামলার রিপোর্ট পক্ষপাতদুষ্ট হয়। মানবতা ভূ-লুন্ঠিত হয়। ন্যয় বিচার রূদ্ধশ্বাসে নিভৃতে কেঁদে মরে।
21
View