Posts

গল্প

বুঝতে আমার পঞ্চান্ন বছর লাগলো

November 23, 2025

Md. Lalon Shaikh

42
View

বুঝতে আমার পঞ্চান্ন বছর লাগলো

রাজিব ছিলেন গ্রামের গর্ব।তাঁর বাবা ছিলেন স্কুল মাস্টার, মাগৃহিণী।ছোট বেলা থেকেই রাজিব দেখতেন, বাবা কখনো একটা পয়সাও অন্যায়ভাবে নেননি।কিন্তু সেই বাবাই একদিন বলেছিলেন, “বাবা, এই দেশে সৎ থাকলে পেট ভরেনা, মূল্যায়ন পাওয়া যায় না।”

রাজিব  ভুলে যাননি বাবার সেই কথা। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় তিনি ঠিক করলেন, তিনি যেভাবেই হোক টাকা কামাবেন।সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে পাস করলেন।পিডব্লিউডি-তে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেলেন।প্রথম পোস্টিং হল দূরের এক জেলায়।

প্রথম প্রথম মনে হতো, দূর্নীতি না করলে কাজই এগোবেনা। ঠিকাদাররা বলত, “স্যার, একটু ‘সেটিং’ না করলে মালপত্র আসবে কী করে?” রাজিব হাসতেন। তারপর একদিন প্রথম খামটা হাতে নিলেন। পঞ্চাশ হাজার টাকা। হাত কাঁপেনি। বুকটা কেমন যেন শিরশির করেছিল, কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল বাবার কথা— “পেট ভরে না।”

টাকা এল। বাড়ি হল। গাড়ি কিনলেন। ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে দিলেন। বউয়ের গয়নার বাক্স ভরে গেল। গ্রামে এলে লোকে সালাম দিতো, প্রশংসা করতো। রাজিব এখন ‘ রাজিব সাহেব’।

কিন্তু তার রাতের ঘুম কমে গিয়েছিল। প্রতি রাতে স্বপ্ন দেখতেন, যে ব্রিজটা তিনি বানিয়েছেন নিম্নমানের মাল দিয়ে, সেটা ভেঙে পড়ছে। শতশত মানুষ মরছে। চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে যেত।বউ জিজ্ঞেস করত, “কীহয়েছে?” তিনি বলতেন, “কিছুনা, বুকে ব্যথা।”

তারপর এল সেই বর্ষা। নদীর ওপর নতুন ব্রিজের উদ্বোধন হল। রিবন কাটলেন মন্ত্রী। ফ্ল্যাশ বাল্ব জ্বলল। রাজিব হাসছিলেন ক্যামেরার সামনে। ঠিক তখনই প্রচণ্ড বৃষ্টি নামল। নদী ফুলে উঠল।আর ঠিক সেই রাতেই ব্রিজ ভেঙেপ ড়ল।

রাত দুটোর সময় ফোন এল। “স্যার… ব্রিজ… ব্রিজ ভেঙে গেছে… স্কুলের বাস… বাচ্চারা…” রাজিবের হাত থেকে ফোন পড়ে গেল।

পরদিন সংবাদপত্রের হেডলাইন: “২৩ জন স্কুলছাত্রীর মৃত্যু: দুর্নীতির কালো ছায়া” তার নীচে তাঁর ছবি। আর নীচে লেখা— “প্রকৌশলী রাজিব সাহেব গ্রেপ্তার।”

জেলের অন্ধকার ঘরে বসে রাজিব প্রথম যেদিন কাঁদলেন, সেদিন তাঁর বয়স পঞ্চান্ন। সন্তানেরা আর মুখ দেখাতে আসেনি। বউ এসেছিল একবার। চোখে শুধু ঘৃণা। বলেছিল, “তোমার টাকায় যে গয়না পরি, আজ সব বেচে দিয়েছি। আমার মেয়ে যে বাসে ছিল… সে বেঁচে ফিরেছে, কিন্তু তার বন্ধুরা মরেছে। তুমি ওদের বাবা-মাকে কী চোখে দেখবে বলো?”

রাজিব কিছু বলতে পারেননি। শুধু মাথা নিচু করে বলেছিলেন, “আমি ভেবে ছিলাম টাকা থাকলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু টাকা দিয়ে যে মনের শান্তি কেনা যায়না, সেটা বুঝতে আমার পঞ্চান্ন বছর লেগে গেল।”

জানালার বাইরে শীতের রোদ পড়ছিল। রাজিব, যিনি একদিন গ্রামের গর্ব ছিলেন, আজ শুধু একটা নম্বর— কয়েদি নং ৪৫৬৭। তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই ছোট্ট মেয়েটির মুখ, যে বাসের জানালা দিয়ে হাত নেড়েছিল— “আঙ্কল, নতুন ব্রিজটা খুব সুন্দর হয়েছে!”

তারপর আর কখনো হাসেননি রাজিব। শুধু রাতে রাতে একটা কথা আউড়ে কাঁদতেন— “টাকা থাকলে সব পাওয়া যায়, কিন্তু যা হারিয়েছি, তা আর কোনো দিন ফিরে পাবনা।”

শিক্ষা: “এক মুহূর্তের সুখের জন্য যে দুর্নীতি করা হয়, তার শাস্তি গোটা জীবন ধরে ভোগ করতে হয়— আর কখনো কখনো তা প্রাণের বিনিময়েও শোধ হয় না।”

(কাল্পনীক গল্পটি শুধুই মানুষকে সংশোধ ও সাবধান করার জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে)।

Comments