বাংলাদেশের উত্তরের পাহাড়ি গ্রাম রংছড়ি।
এ গ্রামে একটা গোপন বিশ্বাস আছে—
“যেখানে আলো নিভে যায়, সেখানে পরীরা জন্মায়।”
কেউ কখনো দেখেনি, শুধু কথায় কথায় শোনা যায় রাতে পাহাড়ের গায়ে ক্ষণিকের সাদা আলো জ্বলে ওঠে।
লোকজন ভাবে এটা পোকা বা বাতাসের খেলা।
কিন্তু ১৬ বছরের নাহিয়ান জানে—
এ আলো পোকা নয়, বাতাস নয়।
ওর দাদি মরার আগে বলেছিল—
“একদিন তুই সত্যিকারের পরী দেখবি। কিন্তু সাবধানে… আলোকাহারা পরী মানুষের হাসি খেয়ে বাঁচে।”
নাহিয়ান তখন হাসছিল।
এখন আর হাসে না।
অদ্ভুত রাতের শুরু
এক রাতে লোডশেডিং। গ্রাম একদম কালো।
ও পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখে—
পাথরের গায়ে আঙুল-সাইজের সাদা আলো স্লো স্লো নড়ে।
ভয় হলেও কৌতূহল জেতে।
ফোনের টর্চ নিয়ে বাইরে যায়।
যত এগোয়, আলোটা তত দৌড়াতে থাকে—
যেন তাকে ডাকছে।
হঠাৎ আলোটা থেমে যায়।
আর অন্ধকারের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এক অদ্ভুত ছোট্ট জীব।
না, রাজকন্যার মতো সুন্দর না।
না, গল্পের বইয়ের চমকানো ডানা নেই।
বরং—
• চোখ দুটো আলোয় তৈরি
• শরীর আধা স্বচ্ছ
• পিছনে পাতা-আকৃতির ডানা, কিন্তু সেটা আলো নয়—ছায়া দিয়ে তৈরি
• আর মুখে একটুও হাসি নেই
নাহিয়ান কাঁপা গলায় বলে,
“তুই… কে?”
শব্দহীন এক কণ্ঠ তার মাথায় ভেসে ওঠে—
“আমি আলোখেকো।”
আলোখেকো পরীর জন্ম
পরীটা বলে—
মানুষের দুঃখ, অবহেলা আর একাকীত্ব যখন জমতে জমতে ভারী হয়ে যায়,
সেই অন্ধকার থেকেই জন্ম হয় আলোখেকোদের।
তারা আলো খায় না,
তারা খায়—
মানুষের মনে লুকানো আনন্দ।
যত হাসি খায়, শরীরের আলো তত বাড়ে।
আর মানুষ তত নিস্তেজ হয়ে যায়।
নাহিয়ান হকচকিয়ে বলে,
“তবে তুই আমাকে কেন ডাকলি?”
পরীটা বলে,
“কারণ তোর আলো খুব শক্ত।
অনেক দিন ধরে তুই সেটা লুকিয়ে রেখেছিস।
আমি সেই আলো খেতে চাই।”
নাহিয়ান ভয় পায় কিন্তু পালাতে পারে না।
পরীর অদ্ভুত ক্ষমতা
পরীটা হাত বাড়িয়ে দেয়।
এক ধরণের ঠাণ্ডা অনুভূতি নাহিয়ানের বুকের ভেতর ঢুকে যায়।
এবং সে অনুভব করে তার একটা সুখের স্মৃতি মুছে যাচ্ছে।
তার মাথায় কণ্ঠটা আবার আসে—
“তোর হাসিটা খুব উজ্জ্বল ছিল। আমি সেটা নিলাম।”
নাহিয়ান হাঁটুতে পড়ে যায়।
সে ভাবে পরীটা তাকে মেরে ফেলবে।
কিন্তু পরীটা থেমে যায়।
ওর আলোর চোখ দুটো কাঁপে।
পরীটা বলে—
“আজ প্রথমবার… আমি কোনো মানুষের ভেতরে ভয় নয়,
ভালবাসার আলো দেখলাম।”
নাহিয়ান অবাক।
সে বলে, “কি দেখলি?”
পরীটা বলে—
“তুই নিজের আনন্দ নিজের জন্য রাখিস না…
তুই অন্যের জন্য হাসিস।
এটা খেলে আমি মরে যাব।
এ আলো আমাকে পোড়ায়।”
পরীর সিদ্ধান্ত
আলোখেকোরা মানুষের আনন্দ খেলে শক্তিশালী হয়।
কিন্তু নিঃস্বার্থ আনন্দ—
এটা তাদের ভেতর আগুন ধরিয়ে দেয়।
পরীটা দুলে ওঠে, যেন টিকে থাকতে পারছে না।
সে বলে—
“আমি বাঁচতে চাই না।
কারণ আমি অন্ধকার থেকে জন্মেছি।
তোর আলো আমার শত্রু।”
তার ছায়া-ডানাগুলো ফাটতে শুরু করে।
নাহিয়ান কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“থাম! তুই মরিস না!”
পরীটা শান্তভাবে হেসে বলে—
“আমি মরলে নতুন আলো জন্মাবে—
তোর ভেতরে।
তুই সেটা দুনিয়াকে দিস।”
তারপর পরীটা ধীরে ধীরে ভেসে উঠে
একা একা উজ্জ্বল হতে থাকে।
আর এক ঝলক আলো হয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
শেষ সত্য
সেদিনের পর নাহিয়ান আর পরী দেখেনি।
কিন্তু রাতে পাহাড়ে একটুকরো নতুন আলো জন্ম নেয়—
আগেরগুলোর চেয়ে আলাদা,
সফট, উষ্ণ, আর মানুষের হাসির মতো।
নাহিয়ান বুঝে—
আলোখেকোরা সবাই অন্ধকার না।
কেউ কেউ আবার আলো ফিরিয়ে দেয়।
মানুষ শুধু পরীদের ভয় পায়—
কারণ তারা জানে না
পরীরাও ভয় পায় মানুষের ভেতরের আলোকে।