Posts

গল্প

আলিসা

November 24, 2025

MD Atikur Rahman

Original Author MD Atikur Rahman

Translated by MD Atikur Rahman

56
View

আলিসাকে দেখার জন্য বহুবার, বহুবছর ধরে অপেক্ষা। আলিসা আমার প্রেম, আলিসা আমার মোহাব্বত। এক বছরের ভালোবাসা রেখে আলিসা হঠাৎ করে যোগাযোগ বন্ধ করে চলে গেছে। কোথায় গেছে, সেটা অজানা; রেখে যায়নি কোনো ঠিকানা।

​আজ ১৩ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২ সাল। আজ পাঁচ বছর হলো আলিসা আমার জীবনে নেই।

​আজ সকালে পুরোনো চিঠির বাক্সটা ঘাঁটতে গিয়ে একটা খাম পেলাম। খামের ওপর আলিসার নাম লেখা, আর তারিখটা দেখে চমকে উঠলাম—১৩ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৭। আলিসা চলে যাওয়ার ঠিক আগের দিন। হাত কাঁপছিল। খাম খুলে পেলাম একটা চিঠি আর একটা ছোট্ট সোনার লকেট।

চিঠিতে লেখা, “যদি কখনও হারিয়ে যাই, এই লকেটটা দেখো। এর মধ্যেই আমার সব উত্তর লুকিয়ে আছে।”

লকেটটা হাতে নিয়ে দেখি, তাতে একটা অদ্ভুত প্রতীক খোদাই করা। প্রতীকটা যেন কোথায় দেখেছি বলে মনে হয়... কিন্তু কোথায়?

​পুরোনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছি, হঠাৎ ল্যান্ডলাইন টেলিফোনটা তীক্ষ্ণ স্বরে বেজে উঠল। দ্বিধা নিয়ে রিসিভার তুলতেই ওপার থেকে একটা ভারী, গমগমে কণ্ঠস্বর ভেসে এল, "লকেটটা কি খুঁজে পেয়েছো?"

আমার বুক কেঁপে উঠল। "কে বলছেন আপনি?"

"আমি বিভূতিভূষণ," কণ্ঠস্বরটা শান্ত কিন্তু তাতে এক হিমশীতল কর্তৃত্ব ছিল। "আলিসার সৎ দাদা। আর হ্যাঁ, আমি জানি তুমি এই মুহূর্তে লকেটটা দেখছো। ঐ প্রতীকের অর্থ খুঁজতে গিয়ে তুমি শুধু ভুল পথেই যাবে। আলিসাকে খুঁজতে হলে, তোমাকে আমার কাছে আসতে হবে। আজ রাত দশটায় 'শ্মশানকালীর ঘাটে'।"

ভয়ে, বিস্ময়ে এবং সন্দেহে আমার শরীর জমে গেল। বিভূতিভূষণ—আলিসা একবার যার কথা বলেছিল। বলেছিল যে তার দাদা তান্ত্রিক বিদ্যা নিয়ে থাকেন এবং তিনি বেশ অদ্ভুত প্রকৃতির। আমি জানতাম না যে তিনি এখনও বেঁচে আছেন, বা আলিসার লকেটের কথা কীভাবে জানেন!

"শ্মশানকালীর ঘাট? কেন?"

"আলিসাকে যারা নিয়ে গেছে, তারা সাধারণ মানুষ নয়। তারা এই লকেটের গোপন শক্তি চায়। তারা তোমার পিছু নিয়েছে। তুমি এখন একা, আর আমিই একমাত্র মানুষ যে তোমাকে সত্যিটা বলতে পারে। তুমি যদি সত্যিই আলিসাকে ভালোবাসো, তাহলে এসো। লকেটটা সঙ্গে নিয়ে আসবে। সময় কম।"

​বিভূতিভূষণ আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ধড়াম করে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। লকেটটা আমার হাতে তখন আগুনের মতো উত্তপ্ত মনে হচ্ছিল। পাঁচ বছরের রহস্যের জট কি তবে এই তান্ত্রিকের হাত ধরেই খুলবে? শ্মশানকালীর ঘাট—আমার সামনে তখন জীবনের এক নতুন, অন্ধকার অধ্যায় অপেক্ষা করছিল।

​রাত তখন দশটা ছুঁই ছুঁই। চারপাশ ঘন অন্ধকারে ঢাকা। শ্মশানকালীর ঘাটে পৌঁছে গা ছমছম করে উঠল। এখানে সর্বদা একটা চাপা থমথমে ভাব আর কর্পূরের তীব্র গন্ধ লেগে থাকে। লকেটটা পকেটে শক্ত করে ধরে আমি ঘাটের ধারে একটা পুরোনো বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাতাস যেন ভারী হয়ে আছে, মনে হচ্ছে চারপাশের গাছপালাও নিশ্বাস নিতে ভয় পাচ্ছে।

​কিছুক্ষণের মধ্যেই বটগাছের শিকড়ের আড়াল থেকে এক ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল। দীর্ঘদেহী মানুষটি—বিভূতিভূষণ। পরনে কালো আলখাল্লা, কপালে সিঁদুরের মোটা ফোঁটা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। তাঁর চোখ দুটি যেন অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছিল। তাঁকে দেখে তান্ত্রিকের চেয়ে কোনো প্রাচীন রহস্যময় পুরোহিতের মতো লাগছিল।

​"এসেছো তাহলে," বিভূতিভূষণের কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল। "আলিসার জন্য তোমার ভালোবাসা এখনও মরেনি, এটাই তার প্রমাণ।"

আমার ভেতরে জমে থাকা পাঁচ বছরের কষ্ট আর উদ্বেগ এক ধাক্কায় বেরিয়ে এল, "আলিসা কোথায়? আপনি কী জানেন? কেন সে হঠাৎ চলে গেল?"

​বিভূতিভূষণ আমাকে থামিয়ে দিয়ে তার হাতের একটি জীর্ণ পুঁথি দেখালেন। "উত্তেজিত হয়ো না। আলিসা সাধারণ মেয়ে নয়। তার রক্তে সেই হারিয়ে যাওয়া রাজকুমারীর উত্তরাধিকার আছে, যার কথা লোকে কেবল কিংবদন্তীতে শোনে।"

বিস্ময়ে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। "রাজকুমারী? মানে কী?"

"পাঁচ বছর আগে এক ভয়ংকর গুপ্ত সংস্থা জানতে পারে যে আলিসার কাছে সেই রাজকুমারীর কণ্ঠহারের একটি অংশ আছে—যেটা তোমার কাছে থাকা এই লকেট। তারা সেই কণ্ঠহার সম্পূর্ণ করে একটি প্রাচীন শক্তির দ্বার খুলতে চায়। আলিসা সেটা জানতে পেরেছিল। তোমাকে বিপদমুক্ত রাখতে এবং কণ্ঠহারের পূর্ণ শক্তি তাদের হাতে যাওয়া থেকে বাঁচাতে, সে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।"

আমি লকেটটা পকেট থেকে বের করে তাঁর দিকে ধরলাম। "তাহলে এই প্রতীকের অর্থ কী?"

​বিভূতিভূষণ লকেটটা স্পর্শ করলেন না। "এই প্রতীক কোনো মানচিত্র নয়। এটি হলো 'চাবি'। এই চাবি একমাত্র আলিসার রক্তধারার কেউ তার গোপন মন্ত্র দিয়ে ব্যবহার করলে তবেই লকেটের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আসল গুপ্ত সংকেত প্রকাশ পাবে।"

​তিনি মুহূর্তের জন্য থামলেন। শ্মশানের এক কোণে তখন শেয়ালের ডাক শোনা গেল।

"আমি তান্ত্রিক। আমি জানি তারা কোথায় লুকিয়েছে। আমি তোমাকে পথ দেখাতে পারি, কিন্তু মনে রাখবে, এই পথ অন্ধকার আর বিপদসঙ্কুল। আলিসা যেখানে আছে, তার চারপাশে সেই গুপ্ত সংস্থার মানুষ আর তাদের অশুভ শক্তি পাহারা দিচ্ছে। তোমাকে আগামী সাত দিনের মধ্যে তাকে খুঁজে বের করতে হবে, নয়তো তারা আলিসাকে ব্যবহার করে সেই গোপন শক্তির দ্বার খুলে দেবে।"

​বিভূতিভূষণ বটগাছের শিকড়ের কাছে থাকা একটা ছোট মাটির পাত্র থেকে কিছু ভস্ম তুলে নিলেন। "এই ভস্ম নিয়ে নাও। যখন তুমি সঠিক পথের কাছাকাছি পৌঁছবে, এই ভস্ম আলো ছড়াবে। এটিই তোমার একমাত্র রক্ষাকবচ।"

তিনি আমাকে পূর্ব দিকের একটি প্রাচীন মন্দিরের নাম বললেন, যেটি নাকি আলিসার শেষ অবস্থান। "যাও, আর কোনো প্রশ্ন নয়। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। তুমি যদি ব্যর্থ হও, তাহলে শুধু আলিসাই নয়, এই পৃথিবীর বড় ক্ষতি হবে।"

​বিভূতিভূষণ নিঃশব্দে অন্ধকারের গভীরে মিলিয়ে গেলেন। হাতে লকেট আর তান্ত্রিক ভস্ম। এই মুহূর্তে আমার কাছে আলিসাকে খুঁজে বের করার জন্য দুটো জিনিস আছে: এক, অগাধ ভালোবাসা; দুই, এক তান্ত্রিকের দেওয়া বিপদসঙ্কুল সংকেত।

Comments

    Please login to post comment. Login