Posts

গল্প

শূন্যতার মাঝে আলো

November 25, 2025

Tonmoy

59
View

পৃথা আজকাল খুব সকালেই দিন শুরু করে। পাঁচ বছরের মেয়েটিকে—ঈশানি—ঘুম থেকে তুলতে তুলতে তার মনে হয়, জীবন কখনো কোনো সতর্কতা ছাড়াই কত বড় পরিবর্তন এনে দেয়। তবুও সে হাসে, সাজে, নিজের ছোট্ট মেয়ের চুলে বেণি বেঁধে দিন শুরু করে দেয়। কারণ লড়াই যেন তার রক্তেই মিশে আছে।

পৃথা আধুনিক, শিক্ষিত, আত্মনির্ভর একজন নারী। তার জীবনে ঝড় এসেছে, আবার থেমেও গেছে। এখন সে একটি বেবি-ডে-কেয়ারে কাজ করে নিজের আর ঈশানির ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছে। জীবন কঠিন, তবু সে প্রতিটা দিন উপভোগ করে। কারণ সে জানে—অতীতের অন্ধকার আঁকড়ে থাকলে বর্তমানের আলো ফিকে হয়ে যায়।

কিন্তু তার জীবন প্রথম থেকেই এমন ছিল না।

প্রথম দেখা—বইমেলার ভিড়ে

হোম ইকোনমিক্স কলেজে পড়ার সময়ই পৃথার জীবনে এসেছিল জামিল। সেই বছরের ঢাকা বইমেলা ছিল যেন উৎসবের মতো। পৃথা বইয়ের ব্যাগ বগলে নিয়ে এক স্টল থেকে আরেক স্টলে ঘুরছিল। ঠিক তখনই এক অচেনা ছায়ার মতো সামনেই দাঁড়িয়ে যায় জামিল।

স্টলের ভেতরে বসে ছিল সে—হাসিখুশি কিন্তু একটু লাজুক চেহারা। আসলে সে ওই স্টলের লোকও ছিল না, বন্ধুর অনুরোধে বন্ধুর বাবার দোকানে বসেছিল মাত্র। পৃথার হাতে থাকা বইগুলোর দিকে তাকিয়ে বলেছিল—

—আপনি কি নতুন লেখকদের বই পড়েন?

পৃথা একটু চমকে—
—পড়ার চেষ্টা করি… তবে খুব একটা চিনি না।

জামিল কয়েকটা বই এগিয়ে দিয়ে হেসেছিল।
—এইগুলো নিন। ভালো না লাগলে কাল এসে ফিরিয়ে দেবেন। আপনাকে ঠকাবো না—প্রতিশ্রুতি দিলাম। আসলে বইগুলো জামিলের নিজের লিখা । সে টুকটাক লিখা লিখি করে, কিন্তু বাণিজ্যিক ভাবে বইগুলো বিক্রি করেনা। মাঝে মাঝে পরিচিত অপরিচিত বই প্রেমীদের ফিরত দেওয়ার শর্তে দিয়ে থাকেন।

পৃথা না চাইলেও তার কথার ভরসায় বইগুলো নিয়ে নেয়। কে জানত, সেদিনের সেই সিদ্ধান্ত তার সমগ্র জীবনকে অন্য পথে টেনে নিয়ে যাবে!

বই ফেরত দিতে যেতে যেতে, আরেকদিন নতুন বই নিতে নিতে, কথায় কথায় কী অদ্ভুত এক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে দু’জনের মাঝে। তারপর বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। আর প্রেম থেকে এমন এক টান—যেটাকে ধরে রাখতে পরিবারকে অতিক্রম করেছিল তারা।

পালিয়ে বিয়ে

পৃথার বাবা দেশের পরিচিত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। পরিবারের আদরের একমাত্র মেয়ে পৃথা—আর সেই পৃথা যখন প্রেমে পড়ে একজন সাধারণ ছেলের সঙ্গে, সেটা পরিবার মোটেই মেনে নিতে পারেনি। আসলে জামিলের বাবা মা কেও জীবিত ছিলোনা, সে অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছিল, লেখাপড়ায় ভালো হওয়ায়, তাকে উচ্চশিক্ষিত করতে আশ্রমের কর্তৃপক্ষ হেল্প করেছিল ।

অবশেষে এক ঝড়ো সন্ধ্যায় তারা সব ছেড়ে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলে। তখন মনে হয়েছিল—সুখের সূর্যটা তাদের দিগন্তজোড়া আলো ছড়াবে।

জামিল এক প্রাইভেট কোম্পানিতে অ্যাকাউন্টসের চাকরি পায়। টাকার অঙ্ক খুব বড় ছিল না, কিন্তু তাদের সংসারের হাসিটাই ছিল সবচেয়ে বড় সম্পদ।

নতুন জীবনের স্বপ্ন

বিয়ের দু’বছর পর পৃথা টের পায়—তার ভেতরে নতুন প্রাণের অস্তিত্ব। সে ঠিক করে জামিলকে চমকে দেবে। তাই অনেকদিন ধরেই খবরটা গোপন রাখে।

একদিন সে ঘর সাজায়—বেলুন, রঙিন ফিতা, আর একটা ক্ষুদে গোলাপি ফ্রক শোকেসে সাজিয়ে রাখে। ভেবেছিল, অফিস থেকে ফিরেই জামিল বিস্ময়ে চমকে উঠবে। তাকে জড়িয়ে ধরে বলবে—

“পৃথা… তুমি আমাকে সত্যিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুখ দিতে চলেছ?”

কিন্তু সেদিন… জামিল বাড়িতে ফিরল না।

অপেক্ষার অনন্ত ভাঁজ

প্রথমে পৃথা ভাবল—কাজের চাপ। কয়েকবার ফোন করেও তার ফোনে কল গেলোনা। পরেরদিনও না ফিরলে সে অফিসে খোঁজ নেয়, বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ করে, পরে পুলিশে খবর দেয়, ।

কিন্তু কোনো হদিস পাওয়া যায় না।
জামিল যেন আকাশে মিলিয়ে গেল।

সেই দিন থেকে পাঁচ বছর কেটে গেছে।

পৃথা জানে না—জামিল কোথায়।
সে কি বেঁচে আছে?
না কি অন্য কোনো অচেনা পরিণতি তাকে গ্রাস করেছে?

কখনো মনে হয়—হয়তো কোথাও নতুন জীবনে ব্যস্ত।
আবার কখনো মনে হয়—কোনো অন্ধকার রাতে হয়তো তাকে কিছু একটা গ্রাস করে নিয়েছে।

তবু এই দীর্ঘ শূন্যতার মাঝেও পৃথা থেমে যায়নি। ঈশানিকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে, নিজের শক্তি আর সাহসেই আজ সে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁদার সময় তার নেই—শিশুদের হাসির শব্দেই তার দিন কেটে যায়, মেয়ের চোখেই সে ভবিষ্যতের আলো দেখতে পায়।

অদৃশ্য অনুপস্থিতি

রাতে ঈশানি ঘুমিয়ে পড়লে, পৃথা কখনো কখনো শোকেসের ওপরে রাখা সেই ছোট গোলাপি ফ্রকটা হাতে নেয়। যে ফ্রকটা দেখে জামিলের বিস্ময়ে চোখ ভেজা হাসি দেখার স্বপ্ন দেখেছিল সে।

জামিল তা কোনোদিনই দেখেনি…
দেখার সুযোগ পায়ওনি।

তবু পৃথা ফ্রকটা ফেলে দেয় না।
কেন জানে না—কিন্তু তার মনে হয়, কখনো কখনো জীবন এক অদ্ভুত পূর্ণতার পথে হাঁটিয়ে দেয় মানুষকে। যদিও সেই পূর্ণতা কেমন হবে, তা কেউই বলতে পারে না।

কিন্তু পৃথা আজ আর আগের মতো ভেঙে পড়া মানুষ নয়।

সে জানে—যাদের জীবনে কেউ নেই, তারা নিজেরাই নিজেদের আলো জ্বালাতে শেখে।

আর তার আলো?

ঈশানি—
যে মায়ের হাত ধরে নতুন করে পৃথিবী দেখতে শেখে, আর প্রতিদিন তাকে মনে করিয়ে দেয়—

অনুপস্থিত কোনো মানুষকে নিয়ে জীবন থেমে থাকে না।
জীবন সবসময়ই নতুন পথে হাঁটার আরেকটা সুযোগ দেয়।

Comments

    Please login to post comment. Login