Posts

নন ফিকশন

বিবিসি কেলেঙ্কারি ১ঃ বিবিসি যেভাবে ট্রাম্পের ভাষণ বিকৃত করেছে, অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট ফাঁস

November 30, 2025

মো; আহসান-উজ-জামান

Original Author দ্য টেলিগ্রাফ

Translated by Ahsan's Archive

10
View

ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ সম্প্রতি একজন গোপন তথ্য ফাঁসকারীর (হুইসেলব্লোয়ারের) মাধ্যমে বিবিসির একটি আভ্যন্তরীন মেমো হাতে পেয়েছে। এতে দেখা যায়, বিবিসি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষণের একটি ভিডিও ফুটেজ এমনভাবে সম্পাদনা করেছে যা দেখে মনে হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই ২০২১ এর ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিল এর দাঙ্গায় উৎসাহ দিচ্ছেন, অথচ বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

যে তথ্যচিত্রের ভিডিও ফুটেজ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে তা এক ঘণ্টার প্যানোরামা স্পেশাল—নামঃ Trump: A Second Chance? উক্ত তথ্যচিত্রটি সম্প্রচারিত হয় মার্কিন নির্বাচনের ঠিক এক সপ্তাহ আগে, যা দর্শকদেরকে বিভ্রান্ত করে “সম্পূর্ণ ভুল পথে পরিচালিত” করে, কারণ সেখানে প্রেসিডেন্টকে সমর্থকদের উদ্দেশে বলতে দেখানো হয়েছিল যে তিনি তাদের সঙ্গে ক্যাপিটলের দিকে হাঁটবেন প্রাণপনে লড়াই করতে (“fight like hell”)। কিন্তু বাস্তবে তিনি বলেছিলেন যে তিনি তাদের সঙ্গে হাঁটবেন “to peacefully and patriotically make your voices heard”—অর্থাৎ শান্তিপূর্ণভাবে এবং দেশপ্রেম এর সাথে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরতে।

১৯ পৃষ্ঠার একটি ডকুমেন্টে এই “বিকৃত” ফুটেজ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, যা তৈরি ক্রেছেন বিবিসির স্ট্যান্ডার্ডস কমিটির ই একজন সদস্য। ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর ডকুমেন্টটি সরকারি দপ্তরগুলোর মাঝে বেশ আলোড়ন তুলেছে।

ডকুমেন্ট এ বলা হয়েছে, প্রোগ্রামটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে এমন কিছু “‘বলতে’ দেখিয়েছে যা তিনি কখনোই বলেননি”—এবং তার ভাষণের শুরুতে বলা কিছু অংশকে প্রায় এক ঘণ্টা পরে বলা আরেক অংশের সঙ্গে জোড়া লাগিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে।

এতে আরো দাবি করা হয়েছে যে বিবিসিতে প্রকাশিত সংবাদের মান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্তরা বারবার এসব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ এবং সতর্ক করার পর ও সিনিয়র নির্বাহী কর্মকর্তারা এবং বিবিসির চেয়ারম্যান এসব উপেক্ষা করেছেন এমনকি খারিজও করে দিয়েছেন।

মি. ট্রাম্পের বক্তব্য বিকৃত করার পাশাপাশি ডকুমেন্টারিতে দেখানো হয়েছিল যে প্রেসিডেন্টের ভাষণের পরে ৬ জানুয়ারি ২০২১ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে ক্যাপিটল হিল এর দিকে আমেরিকার পতাকা নিয়ে মার্চ করছে একদল পুরুষ, যা এ রকম ধারণা দেয় যে ট্রাম্পের সমর্থকেরা তার ‘আহ্বান’ শুনে দাঙ্গার উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমে পড়েছে।” অথচ বাস্তবে ওই ফুটেজটি ধারণ করা হয়েছিল ট্রাম্প কথা বলা শুরু করার আগেই।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, সেই “দিনটির ঘটনাবলীর বিকৃত উপস্থাপন” এতটাই গুরুতর ছিল যে দর্শকেরা প্রশ্ন করতেই পারে:

 “বিবিসিকে কী আর বিশ্বাস করা উচিত? এর শেষ কোথায়?”

কিভাবে ভিডিওটি এডিট করা হয়েছে তা দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
 

কী ছিল সেই তথ্যচিত্রেঃ

প্যানোরামার তথ্যচিত্রে মি. ট্রাম্পকে বলতে দেখা যায়: “We’re gonna walk down to the Capitol and I’ll be there with you and we fight. We fight like hell and if you don’t fight like hell you’re not gonna have a country any more.”

আবহ সঙ্গীত হিসেবে যোগ করা হয় কিছু ভীতিকর আবেশ তৈরি করা মিউজিক, সাথে দেখানো হয় ক্যাপিটলের দিকে মার্চ করা একদল মানুষের ফুটেজ, দেখে মনে হয় ট্রাম্পের আহবানে একদল মানুষ ভীতিকর মব তৈরি করে নাশকতার উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছে। কিন্তু দর্শকদের বুঝতেই দেয়া হয় নি যে ট্রাম্পের বক্তব্যগুলো ভিন্ন সময়ের এবং উস্কানি দেয়া মত কিছুই ছিল না।

বিবিসি যে অপকর্মটি করেছে তা হলো-  মি. ট্রাম্পের ভাষণের তিনটি আলাদা অংশকে একত্রে জুড়ে একটি একটানা বাক্যের মতো দেখিয়েছে।

অথচ বাস্তবে মি. ট্রাম্প যা বলেছিলেন তা হলো: “We’re gonna walk down, and I’ll be there with you, we’re gonna walk down, we’re gonna walk down any one you want but I think right here, we’re gonna walk down to the Capitol and we’re gonna cheer on our brave senators and congressmen and women and we’re probably not going to be cheering so much for some of them because you’ll never take back our country with weakness, you have to show strength and you have to be strong… I know that everyone here will soon be marching over to the Capitol building to peacefully and patriotically make your voices heard.”

প্রায় ৫৪ মিনিট পর, যখন মি. ট্রাম্প নির্বাচনকে “corrupt” বলে উল্লেখ করছিলেন, তিনি নির্বাচনের দিনের ভোটারদের প্রসঙ্গে বলেন: “Most people would stand there at 9 o’clock in the evening and say I wanna thank you very much, and they go off to some other life, but I said something’s wrong here, something’s really wrong, can’t have happened, and we fight.

“We fight like hell, and if you don’t fight like hell, you’re not gonna have a country anymore.”


 

ফাঁস হওয়া ডকুমেন্ট কী বলছে?

বিবিসির পক্ষপাত নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনটি লিখেছেন মাইকেল প্রেসকট, যিনি তিন বছর ধরে বিবিসির এডিটোরিয়াল গাইডলাইনস ও স্ট্যান্ডার্ডস কমিটির (EGSC) স্বাধীন বাহ্যিক উপদেষ্টা ছিলেন এবং জুন মাসে পদত্যাগ করেন।

প্রেসকট একজন প্রাক্তন সাংবাদিক, যিনি কর্পোরেট পরামর্শদাতার ভূমিকায়ও কাজ করেছেন, তাঁর ডসিয়ারের সঙ্গে পাঠানো চিঠিতে লিখেছেন - বিবিসি নির্বাহীদের কাছে “সমস্যা তুলে ধরলেও এসব নিয়ে বিবিসি নির্বিকার থাকায় হতাশা” থেকেই এমন পদক্ষেপ নিতে তিনি বাধ্য হয়েছেন।

ডসিয়ারটি তিনি বিবিসি বোর্ডে পাঠিয়েছেন কারণ EGSC-কে বারবার দেওয়া সতর্কবার্তা “উপেক্ষা করা হয়েছে বা খারিজ করা হয়েছে।”

প্রেসকট চিঠিতে লেখেন: “আমি (পরামর্শদাতা পদ) থেকে গভীর উদ্বেগ নিয়ে বিদায় নিয়েছি। বিবিসি সম্পর্কে আমার মত হলো, নির্বাহীরা বারবার চিহ্নিত সমস্যাগুলোর সমাধানে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং অনেক ক্ষেত্রে তো অস্বীকারই করে বসেছে যে কোথাও কোনো সমস্যা আছে।”

তথ্যচিত্রটি যখন সম্প্রচারিত হয় তখন বিবিসির সম্পাদকীয় গাইডলাইনস এবং স্ট্যান্ডার্ডস কমিটিতে থাকা দুই স্বাধীন সম্পাদকীয় উপদেষ্টার একজন হিসেবে প্রেস্কট প্রোগ্রামটি দেখেন এবং এর “স্পষ্ট ট্রাম্প-বিরোধী মনোভাব” লক্ষ্য করে বেশ বিস্মিত হন, যেখানে ১০ জন ট্রাম্প-বিরোধীর মতামত দেখানো হয়েছিল, আর সমর্থকের সংখ্যা ছিল মাত্র একজন।

তিনি বলেন, তিনি জানতে পেরে “আশ্চর্য” হন  যে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করবে এমন কোনো প্রোগ্রাম ই ছিল না বিবিসির।

প্রেস্কট EGSC-এর সঙ্গে তাঁর উদ্বেগ শেয়ার করেন এবং কমিটির পক্ষ থেকে সিনিয়র সম্পাদকীয় উপদেষ্টা ডেভিড গ্রসম্যানকে প্রোগ্রামটি পুনর্মূল্যায়ন করতে বলা হয়।

গ্রসম্যান “২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ট্রাম্প তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ প্যানোরামা যেভাবে সম্পাদনা করেছে, তা নিয়ে উদ্বেগজনক বিষয়গুলো তুলে ধরেন।”

প্রেস্কট লেখেন: “ট্রাম্প প্রতিবাদকারীদের ক্যাপিটল হিলে ঝাঁপিয়ে পড়তে উসকানি দিয়েছিলেন—এই অভিযোগটি পরীক্ষা করে দেখা যায় যে প্যানোরামা তাঁর ভাষণের আলাদা অংশ থেকে নেওয়া দুটি ক্লিপ জোড়া লাগিয়েছে। এতে এমন ধারণা তৈরি হয় যে ট্রাম্প এমন কিছু বলেছেন যা তিনি বলেননি এবং এর ফলে দর্শকরা প্রকৃতপক্ষে ভুল পথে পরিচালিত হন।”

দর্শকদের বোঝানোর মতো কোনো স্ক্রিন-ওয়াইপ বা ক্যাপশন ছিল না যা দেখাতো ফুটেজটি সম্পাদনা করা হয়েছে বা একসাথে কথাগুলো বলা হয় নি কিংবা খন্ড খন্ড বক্তব্য্যকে জোড়া দেয়া হয়েছে।

প্রেস্কট তাঁর রিপোর্টে বলেন: “প্যানোরামা যেভাবে ক্লিপটি সম্পাদনা করে প্রচার করেছে তা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর। [মি. ট্রাম্প] স্পষ্টভাবে সমর্থকদের ক্যাপিটল হিলে গিয়ে লড়াই করতে বলেননি—এবং এ কারণেই দাঙ্গায় উসকানির জন্য ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কোনো ফেডারেল অভিযোগ আনা হয়নি।”

ফুটেজে আরও শোনা যায় একজন পুলিশ ডিসপ্যাচার বলছেন, “three hundred Proud Boys” যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের প্রধান ভবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

বিবিসি নিউজনাইটে ট্রাম্প-সমর্থক “প্রাউড বয়েজ”-এর আচরণ বিশ্লেষণকারী একটি প্রতিবেদনেও বলা হয়েছিল যে ওই লোকেরা “ট্রাম্প বক্তৃতা শুরু করার আগেই ক্যাপিটলের দিকে রওনা দেয়।”

প্যানোরামার ফুটেজের সমসাময়িক ভিডিওতে সময় দেখানো ছিল সেদিন সকাল ১০:৫৮—এক ঘণ্টা আগে ট্রাম্প কথা বলা শুরু করেন।

ডকুমেন্টারিটি বিবিসির অভ্যন্তরে তৈরি ও পরিচালিত হয়েছিল ম্যাথিউ হিলের দ্বারা, যিনি বিবিসির একজন ডকুমেন্টারি নির্মাতা; এবং এটি সম্পাদনা করেছিলেন ক্যারেন ওয়াইটম্যান, যিনি ২০০২ সাল থেকে প্যানোরামার সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন। প্রোগ্রামটি সম্প্রচারের পর বিবিসির নীতিমালা অনুযায়ী এক বছর আইপ্লেয়ারে ছিল, তারপর তা সরিয়ে নেওয়া হয়।

বিবিসি ম্যানেজারদের প্যানোরামা প্রোগ্রামের সমস্যাগুলোর কথা প্রথম জানান প্রেস্কট। তিনি চিঠিতে লেখেন: “যদি বিবিসির সাংবাদিকদের এমনভাবে ভিডিও সম্পাদনা করার অনুমতি দেওয়া হয় যাতে মানুষকে এমন কিছু ‘বলতে’ দেখা যায় যা তারা কখনোই বলেননি, তাহলে কর্পোরেশনের গাইডলাইনগুলোর মূল্য কী, বিবিসিকে কেন বিশ্বাস করা হবে, এবং এর শেষ কোথায়?”

প্রতিক্রিয়াঃ

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন একে “সম্পূর্ণ লজ্জাজনক” বলেছেন।

তিনি X-এ পোস্ট করেন:


“এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক। বিবিসি ট্রাম্পের ফুটেজ বিকৃত করেছে যেন মনে হয় তিনি দাঙ্গায় উসকানি দিয়েছেন—যখন তিনি আসলে এমন কিছু বলেননি। আমরা দেখছি ব্রিটেনের জাতীয় সম্প্রচারকারী একটি ফ্ল্যাগশিপ প্রোগ্রাম ব্যবহার করে ব্রিটেনের নিকটতম মিত্র সম্পর্কে প্রকাশ্য মিথ্যা প্রচার করছে। বিবিসিতে কেউ কি দায়িত্ব নেবে—এবং পদত্যাগ করবে?”


 

প্রেসিডেন্টের জ্যেষ্ঠ পুত্র, ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র, বিবিসিকে অসৎ বলে উল্লেখ করেন এবং “ফেক নিউজ” প্রকাশের দায়ে অভিযুক্ত করেন।


তিনি টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনটি এক্স (X)-এ পোস্ট করে লিখেছেন:

“যুক্তরাজ্যের FAKE NEWS ছড়ানো সাংবাদিকরা আমেরিকারগুলোর মতোই অসৎ ও বাজে!!!!”

টেলিগ্রাফ শিগগিরই মেমোটির বাকি অংশও প্রকাশ করবে, যেখানে বিবিসির আরবি ভাষার সার্ভিসের বিরুদ্ধে গাজা যুদ্ধের পক্ষপাতমূলক কাভারেজের অভিযোগ করা হয়েছে, ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ক খবরে পক্ষপাতিত্বের এবং কর্পোরেশনটির রিপোর্টিং-এ “সেন্সরশিপ” এর কথাও বলা হয়েছে।

কিভাবে ভিডিওটি এডিট করা হয়েছে দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন


 

Comments

    Please login to post comment. Login